॥পর্ব-১৭॥
আমি এখনো দৌড়াচ্ছি। হঠাৎ আবিষ্কার করি আমার পেছনের তীব্র ফ্লাশ-লাইট নেই। যে ফ্লাশ লাইট আমার সম্মুখ-পথকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিল। আমি এখনো দৌড়াচ্ছি। কিন্তু এখন আগের মতো হুঙ্কার নেই। আমি এখনো দৌড়াচ্ছি আমার পেছনে হাজারো পায়ের শব্দ নেই। আমি তবুও দৌড়াচ্ছি। আমি এখনো দৌড়াচ্ছি। আমার চারপাশে এখন তীব্র নাগরিক শব্দ নেই। আমি তবু দৌড়াচ্ছি।
আমি দৌড়ের গতি কমিয়ে দিলাম। মনে হয় আর পারছিলাম না। আমার ভেতরে ক্লান্তি এসে যাচ্ছিল। আমি গতি কমাতে কমাতে দৌড় বন্ধই করে দিলাম। দ্রুত শ্বাস পড়ছে। ক্লান্ত লাগছে খুব। ঘামে গা ভিজে যাচ্ছে আমার। খুব গরম লাগছে। যেন কেউ শরীরে আগুন লেগে দিয়েছে। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। তবু চারিদিকে তাকাচ্ছি আমি। অস্ত্রধারী প্রাণীগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। একটা দমকা বাতাস এসে গায়ে ধাক্কা দিলো। এতো আরামদায়ক! বাতাসের এক হলকা আমার ক্লান্তি খানিকটা কমিয়ে দিলো। আমি বসে পড়লাম। দেখলাম যেখানে বসে পড়েছি সেটা দুর্বা ঘাসের বন। বসার পর বুঝলাম দুর্বা ঘাসের এক ধরনের সুবাস আছে। সুবাস আমার মনটাকে সুখকর করে তুলছে। আমি এখন খানিকটা ধাতস্থ হয়েছি। বাতাস আমাকে এত সুখ দিচ্ছে যে আবেশে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
ক্লান্ত ছিলাম। অবসন্ন ছিলাম। সন্ত্রস্ত ছিলাম। এই হালকা আরামদায়ক বাতাস, সুনসান নীরবতা, নিরাপত্তার বোধ, এই এলিয়ে দেওয়া শরীর, দুর্বা ঘাসের সুবাস আমাকে মুহূর্তেই অচেতন করে ফেলল। আমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন জাগা পেলাম তখন আমার ভেতরে একটুও ক্লান্তিবোধ নেই। যখন জাগা পেলাম তখন আমার ভেতর থেকে উধাও হয়ে গেছে সব অবসন্নতা। যখন জাগা পেলাম তখন আমার মনের ভেতর থেকে কেটে গেছে সব সন্ত্রস্ত ভাব। আমার ভেতরে বাসা বেঁধেছে তীব্র এক নিরাপত্তাবোধ। আমার প্রতীতি জন্মেছে যে এখানে এই দুর্বা ঘাসের চাদরে শুয়ে থাকলে, বসে থাকলে কেউ আমাকে আঘাত করতে উদ্যত হবে না। আমার মনে কেন জানি এই প্রতীতি জন্মেছে যে এই দুর্বা ঘাসের চাদর দেখে যেকোনো হন্তারকের হাত থেকে ছুরি পড়ে যাবে। আমার কেন জানি এই প্রতীতি জন্মেছে যে এই দুর্বা ঘাসের সুবাস নাকে একবার লাগলে যে কোনো হন্তারকের হুঙ্কার পরিণত হবে প্রেমের সঙ্গীতে। আমার কেন জানি এই প্রতীতি জন্মেছে যে এই দুর্বা ঘাসের সবুজের দিকে তাকালে সবাই এক সাথে গেয়ে উঠবে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
আমি দুর্বা ঘাসের বিছানা থেকে উঠে বসলাম। এই প্রথম শান্ত চোখে চারিদিকে তাকালাম। এক স্নিগ্ধ দুপুর। শীতল নয়। ঠা ঠা করা দুপুর নয়। স্নিগ্ধ রোদ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। যে দিকে চোখ যায় সোনালি ধানের ক্ষেত। ধান পাকলে যে এ রকম সোনালি রঙের হয় আগে দেখিনি। ধান পাকলে প্রকৃতি যে এরকম আগুন-সুন্দরী হয়ে ওঠে আগে দেখিনি। দেখিনি মানে লক্ষ করিনি। তীব্র সোনালি রঙ চারিদিকে আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। সোনালি রঙের ভালোবাসা দোল খাচ্ছে যেন এখানে। সোনালি রঙ ছাড়া আর কিছুই নেই এখানে। সোনালি সাগর যেন। সাগরপাড়ে দাঁড়ালে যেমন ওপারে কিছুই দেখা যায় না তেমনি এখানেও ওপার বলতে কিছুই নেই। সোনালি ধানক্ষেত। এতবড় ধান ক্ষেতে ধানগুলো পেকে সোনালি হয়ে আছে কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এ এক রহস্য মনে হলো আমার কাছে। মনের ভেতরে প্রশ্নের উদয় হলো। কেউ নেই কেন এখানে? এই সোনালি স্বরূপ দেখার কেউ নেই কেন! এই সোনালি স্বরূপ ঘরে তুলবার কেউ নেই কেন এখানে! না-কি এগুলো নিছক প্রাকৃতিক। এগুলোর কেউ থাকে না! তা-ই বা হবে কেন? যে কোনো উৎপাদনের পেছনে কেউ না কেউ তো থাকেই!
ধানগুলো এখুনি কাটা দরকার। মাড়াই করা দরকার। নইলে ঝরে যাবে।
আবার ঠাণ্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে গেল আমাকে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবং লক্ষ করলাম আমার কোনো ছায়া পড়েনি। তার মানে মধ্য দুুপুর! মধ্য দুপুরে ছায়া পড়ে না। সূর্য আক্ষরিক অর্থেই তখন মাথার উপরে থাকে। আমরা প্রচলিত অর্থে যে মধ্য দুপুরের কথা বলি তা প্রকৃত মধ্য দুপুর নয়। প্রকৃত মধ্য দুপুরে কোনো ছায়া পড়ে না। আমি খুবই আনন্দিত বোধ করলাম প্রকৃতির এই প্রাপ্তিতে। মধ্য দুপুর আসলে কখন আসে কখন যায় কেউ পরখ করে না। এই নাক্ষত্রিক ঘটনা সহজে ঘটেও না। আজকে হঠাৎ তার দেখা পাওয়া গেল। এই প্রথম আমি দেখলাম আমার কোনো ছায়া নেই। আমার কোনো ভয়ও লাগছে না আর। এই বিজন প্রান্তরের সোনালি ধানের ধানক্ষেত, এই বিজন প্রান্তরের ছায়াহীন মধ্যদুপুর, এই বিজন প্রান্তরের হলকা বাতাস আমাকে কেন জানি নির্ভার করে তুলেছে।
আমি হাঁটতে লাগলাম ধীরে ধীরে। এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সাগরের ঢেউয়ের যেমন শেষ নেই, এখানে সোনালি ধানের ঢেউয়েরও শেষ নেই। সাগরের প্রতিটি ঢেউকে যেমন নতুন মনে হয়, সাগরের প্রতিটি ঢেউকে যেমন মনোহর লাগে তেমনি এখানকার প্রতিটি সোনালি ধানের ঢেউকে নতুন মনে হচ্ছে। প্রতিটি ঢেউকে মনোহর লাগছে। এক একটা ঢেউ বয়ে যাচ্ছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অমনি আবার বাতাস রচনা করে দিচ্ছে আরেকটা ঢেউ। এই ঢেউখেলা চলছেই। আমি বিমুগ্ধ হয়ে এই ঢেউ ঢেউ খেলা দেখছি। আর হাঁটছি। আমি যতই হাঁটছি এই সোনালি ধানের ধানক্ষেত শেষ হচ্ছে না।
একসময় শেষ হলো। দেখলাম একটা ছোট্ট নদী বয়ে চলেছে। এই ছোট্ট নদীর ছোট ছোট ঢেউ কেমন একটা সুর তুলে তুলে ছুটে ছুটে যাচ্ছে। আমি খরস্রোতা নদী দেখেছি। এ নদীকে দেখে মনে হলো সুরস্রোতা। আমি সুরস্রোতা নদীটি দেখছি মুগ্ধ হয়ে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। এত বড় আকাশ আমি জীবনেও দেখিনি। আকাশ এত নীল হয়! আকাশ এত বড় হয়! আকাশ এত বিস্তৃত হয়! আকাশ এত উঁচুতে হয়! আকাশ এ রকম ছাতার মতো হয়! আকাশে এত মেঘ থাকে! মেঘের এত রং থাকে! আমি মুগ্ধ হয়ে নদী দেখি। আমি মুগ্ধ হয়ে আকাশ দেখি!
নদীর ওপারে মানুষ কাজ করছে। একটা সেচ যন্ত্র দিয়ে পানি তুলছে। নদীটির পাড় বেশ উঁচু। ওপারে কোনো ক্ষেত নেই। মনে হলো নতুন ক্ষেত রচনার কাজে ব্যস্ত এই মানুষগুলো। আমার ইচ্ছে করল নদীর পানি একটু ছুয়ে দেখতে। কিন্তু পাড় এত উঁচুতে! নামতে উদ্যত হলাম। ভয়ও করলো যদি আর উঠতে না পারি? তখন? তবু একটু নামছি মাত্র। অমনি বাঘের মতো এক হুঙ্কার কানে ভেসে এলো। চমকে আশি পাশে তাকাই। দেখি নদীর ঢালু পাড়ের শেষ মাথায় যেখানে থেকে পানি ছোঁয়া যাবে সেখানে এক বিশাল আকৃতির বাঘ। আমার দিকে গোল গোল চোখ তুলে হুঙ্কার দিচ্ছে। আমার আত্মারাম কেঁপে উঠল আরেকবার। আমি পড়ি মড়ি করে কিনারায় উঠলাম। তার দিকে তাকালাম। দেখি উনিও আমার দিকে তেড়ে আসছেন হুঙ্কারসহ। আমি আবারো দৌড়ানো শুরু করলাম। এই সোনালি ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে যেতে আমার একটু ইচ্ছে করছিলো না। আমি জানি এমন পাকাধানে টোকা লাগলেই ঝরে যাবে। আমি যতদূর সম্ভব ওদের স্পর্শ বাঁচিয়ে দৌড় দিচ্ছি। কিন্তু বাঘটি ক্রমশ কাছাকাছি চলে আসছে আমার। অগত্যা আমি সোনালি ধানের ক্ষেতের ভেতর দিয়েই দৌড় দেওয়া শুরু করলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য ক্ষেতের একটি ধানও ঝরে পড়ছে না। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার আমি যেদিকে দৌড় দিচ্ছি সে দিকে যেন পথ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আমার দৌড়ানোয় কোনো বাধা থাকছে না। আমি আবারো দৌড়াচ্ছি। আমি আবারও দৌড়াচ্ছি।
আমার দৌড়ানো কি শেষ হবে না? দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় আমি একটা ভবনের দেখা পেলাম। প্রাচীন সে ভবন। আমার বিশ্বাস হলো এ ভবনে প্রবেশ করলে অন্তত এই বাঘের হাত থেকে রক্ষা পাব।
কোনো বাধা ছাড়াই আমি সে ভবনে ঢুকে পড়লাম। মূল ফটকে কাউকেই দেখা গেল না। এবং ফটকে কোনো দরজা নেই। আটকানোর কোনো পাল্লা নেই। আমি মূল ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। তখন একবার পেছনে ফিরে দেখি বাঘটিও মূল ফটকে ঢুকে পড়েছে। আমি কোনো সময়ক্ষেপণ না করে ভবনের অন্দরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করে প্রথম যে দরজাটি পেলাম সেটা আটকাতে চাইলাম। দরজা বন্ধ করে দেখি তা আটকানোর জন্য কোনো খিল নেই। আমি আবারো দৌড় শুরু করলাম। দুই পাশে হাজারো কুঠুরি। একবার ভাবলাম কোনো এক কুঠুরিতে ঢুকে পড়ি। কিন্তু কুঠুরিগুলোর কোনো দরজা নেই। সে ক্ষেত্রে বাঘের নজরে পড়লে নিজেকে রক্ষা করার কোনো সুযোগই থাকবে না। আমি শিগগিরই আরও একটি দরজা পেলাম। সেটার দরজা লাগিয়ে দেখি এটারো কোনো খিল নেই। অগত্যা আমি আবারো দৌড় শুরু করলাম। এত বড় ভবন পার হচ্ছি কোনো জনমনুষ্যি নেই। দুই পাশে হাজারো কুঠুরি। আমি তার মাঝখান দিয়ে দৌড়াচ্ছি। একের পর এক দরোজা পাচ্ছি। সেগুলো বন্ধ করতে গিয়ে দেখছি কোনো খিল নেই। একটি দরজায় খিল পাব এ ভরসায় দরজা লাগাচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না। এভাবে অনেক দরোজা পার হলাম। প্রত্যেকটি দরোজা লাগানোর চেষ্টা করলাম। কোনো খিল পেলাম না। একসময় ভবন-যাত্রা শেষ হলো। আমি একটা জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়লাম। জঙ্গলটি অত গহীন ছিল না। আমার আরো ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু পেলাম না। কারণ বাঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে না। মনে হয় বাঘ রণে ভঙ্গ দিয়ে চলে গেছে। আমি যখন একটা দরজা লাগিয়ে দিয়ে দৌড় দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম কিছুদূর যাবার পরই শুনতে পারছিলাম ওই দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে বাঘের আগমনের হুঙ্কার। এখন হুঙ্কার পাচ্ছি না। কিন্তু চকিতে আমার মনে পড়লো বাঘ হয়তো একটু পিছিয়ে পড়েছে সে-জন্য এখন হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে না। যদি এখুনি এখানে এসে পড়ে! আমি আবারও জঙ্গলের মধ্যেই দৌড়ানো শুরু করলাম। দেখা গেল জঙ্গল ক্রমশ লঘু হতে থাকলো। কিছুদূর গিয়ে জঙ্গলকে জঙ্গল মনে হলো না। মনে হলো বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়।
আমি আবারো অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। পা চলছে না। কিন্তু এখানে বিশ্রাম নেবার কোনো পরিবেশ নেই। তাই আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম। বাঘের আতঙ্ক মনের ভেতর থেকে চলে গেছে। এখন মনে হচ্ছে আমি আর কত দৌড়াব! আর দৌড়াতে পারব না। যদি বাঘ আসে আসুক। তার কাছে আমি মানবিক আবেদন করব।
অজান্তেই হেসে ফেললাম আমি। বাঘের কাছে মানবিক আবেদন! হা হা হা। পশুর কাছে থাকে শুধুই পাশবিকতা। তার কাছে মানবিকতা আমি আশা করি কীভাবে! মানুষের কাছেই তো মানবতা পেলাম না। আর পশুর কাছে কি না আমি মানবিকতা আশা করি! হা হা হা।
আমি আবারও হাঁটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে বাঁশ ঝাড়ের জঙ্গল কমে আসতে লাগলো। একসময় একটা মেঠো রাস্তা পাওয়া গেল। দুই পাশে জমি। দূরে অনেক বাঁশঝাড় গাছপালা মনে হলো। মনে হলো এই দুই গ্রামকে সংযুক্ত করেছে এই রাস্তাটি। রাস্তার মাঝামাঝি একটা বিশাল লম্বা গাছ দেখা যাচ্ছে। এত দূর থেকে ঠাহর করা যাচ্ছে না ওটা কিসের গাছ।
চলবে…
মিথ্যামানব: পর্ব-১৬॥ এমরান কবির