॥পর্ব-১৬॥
আমি চুপ করে থাকলাম আশিকের কথা শুনে। সত্যিই তো, বাঁদরমুখোদের দখলে চলে যাচ্ছে মানুষগুলো। আশিক হয়তো একজনকে দেখেছে। আরেক আশিক হয়তো আরেকজনকে দেখেছে। আসলে এভাবে অনেক আশিক অনেক মানুষকে দেখেছে বাঁদরমুখোদের দখলে যেতে। এইসব স্বতন্ত্র আশিকের দেখা মানুষগুলোকে একত্রিত করলে হয়তো দেখা যাবে অধিকাংশ মানুষই চলে গেছে বাঁদরমুখোদের দখলে। তারা হয়ে গেছে বাঁদরমুখোদের দাস। তারা হয়ে গেছে বাঁদরমুখোদের খেলার হাতিয়ার। তারা হয়ে গেছে বাঁদরমুখোদের বিনোদনের উপাদান।
আশিক বলল, এভাবে চুপ করে আছিস কেন?
আমি কোনো কথা বলি না।
আশিক আবারো বলে, এভাবে চুপ করে আছিস কেন?
আমি কোনো কথা বলি না।
আশিক আবারো বলে, এভাবে চুপ করে আছিস কেন?
আমি তাও কোনো কথা বলি না। তখন আশিকও চুপ হয়ে যায়।
অনেকক্ষণ পর বলি, আশিক তোকে একটা কথা বলব?
আশিক বলে, বল।
তুই যে লোকটাকে বাঁদরমুখোদের দখলে দেখেছিলি, সে কে জানিস?
কে সে?
আমি।
আশিক এ কথা শুনে উঠে দাঁড়ালো। সে যে সচল হয়ে উঠেছে তা তার মাথায় খেললোই না। উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল। কী বলিস তুই! তুই এ কী কথা শোনালি আমাকে! তাহলে তুই মুক্তি পেলি কিভাবে! তুই এখানে এলি কিভাবে! আমি বলি, আমিও জানি না এতগুলো প্রশ্নের উত্তর। আমিও কিচ্ছু জানি না।
আশিক আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। দেখলাম, আশিক ধীরে ধীরে আমার বুকের ভেতরে মিলিয়ে গেল। আমি আমার বুকের ভেতরে আশিককে খুঁজতে লাগলাম। আমি আমার আশে পাশে আশিককে খুঁজতে লাগলাম। আমি এই জোসনা বিধৌত চরাচরে আশিককে খুঁজতে লাগলাম।
না, আশিক কোথাও নেই।
তাহলে আশিক কে ছিল? আশিক এভাবে আমার বুকের ভেতরে এসে মিলিয়ে গেল কিভাবে? তাহলে আশিক কি আমিই? আমিই আশিক? তাহলে কি আশিক আমার আরেক রূপ? তাহলে আশিক কি আমারই আরেক সত্তা!
আমি কিচ্ছু জানি না। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
তবে আশিক আমার ভেতরে মিলিয়ে যাওয়ার পরপরই দেখতে পাই জোসনা কেটে যেতে শুরু করেছে। ঝাপসা আলো আঁধারি কেটে যেতে শুরু করেছে। বিদায় নিতে শুরু করেছে লক্ষ কোটি সাপের হিসহিসানি। বিদায় নিতে শুরু করেছে নোনা রক্তের ঢেউ। বিদায় নিতে শুরু করেছে ঢেউয়ের শেষ চিহ্নটুকু। ক্রমশ এই চরাচর প্রকাশ্য হতে শুরু করেছে। ক্রমশ এই চরাচরে চরাচরের চিহ্নগুলো অবলুপ্ত হতে শুরু করেছে। ক্রমশ শোনা যেতে থাকলো রিকসার টুংটাং। ক্রমশ সে শব্দ বাড়তে থাকলো। ক্রমশ বাড়তে থাকলো হাজারো মানুষের কোলাহল। ক্রমশ বাড়তে থাকলো গাড়ি ঘোড়ার শব্দ। ক্রমশ বাড়তে থাকলো মাইকের ধ্বনি। শিশিরভেজা দুর্বা ঘাসগুলো হয়ে গেলো কংক্রিটের রাস্তা। আশেপাশের গাছপালাগুলো উধাও হয়ে গেল। সেখানে দেখা গেলো থরে থরে সাজানো বিল্ডিং।
এ তো চিরচেনা নাগরিক শহর। জনবহুল শহরের সবগুলো বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভালোয়-মন্দোয় কেটে যাওয়া প্রহর। সে প্রহরের কোনো এক মুহূর্তে হেঁটে যাওয়া এক দুপুর। মাইকে উচ্চকণ্ঠে কেউ বক্তৃতা দিচ্ছেন। তার বক্তৃতার শব্দে বেড়ে যাচ্ছে শব্দ-দূষণ। তার বক্তৃতার শব্দে বেড়ে যাচ্ছে শহরের কাঁপুনি। তার বক্তব্যে বেড়ে যাচ্ছে রক্তের প্রবাহ। তার বক্তব্যে বেড়ে যাচ্ছে রক্তের নাচ। তার বক্তব্যে বেড়ে যাচ্ছে রক্তের উন্মাদনা। চিরচেনা নাগরিক হৈ চৈ এবং মাইকের চিৎকারের ভেতরেও কোথায় যেন এক ছন্দ নেচে যায়। হঠাৎ ওই ছন্দ ভেদ করে আরও অতি উচ্চকণ্ঠের আওয়াজ শোনা যায়। দেখা যায় একটি সতেরো আঠারো বছরের কিশোর, একটি হালকা পাতলা শরীরের কিশোর, একটি পুষ্টিহীন নড়বড়ে কিশোর, সদ্য গোঁফের দাগ ওঠা কিশোর রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। তার পেছনে দশ বারোজনের উচ্চকণ্ঠের কতিপয় কিশোর-যুবক। তাদের হাতে উদ্ধত ছুরি, কারও হাতে উদ্ধত চাপাতি, কারো হাতে উদ্ধত কোনো আঘাত-সক্ষম অস্ত্র। তারা এতজন মিলে একজনের পেছনে হুঙ্কার দিয়ে ধাওয়া করছে। একাকী কিশোর রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে কিছুদূর গিয়ে পড়ে গেল। দ্রুত উঠে আবার দৌড় শুরু করল। ধাওয়া খাওয়া কিশোর দৌড়াতে দৌড়াতে একটি পুরাতন বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। লোকজন বলাবলি করতে লাগল এই বিল্ডিংয়ে ছেলেটা দরজির কাজ করে।
কিশোর দৌড়ে দোতলায় উঠে দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল আবার। তখন পেছন থেকে কেউ তাকে চাপাতির বড় একটা কোপ বসিয়ে দিলো। ছেলেটি রক্তমাখা পিঠ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে আবার দৌড়ানো শুরু করল। সে দেখল নিরাপত্তার জন্য এখানে এসেও সে মুক্তি পেল না। তাহলে আগের পথেই যাওয়া যাক। সে আগের পথেই দৌড়ানো শুরু করল। কিন্তু পা দুটো যে কেন এত ভারী হয়ে গেল! পা দুটো যে কেন এত ভারী হয়ে যায়! তবু যে দৌড়াতে হয়। পিঠ বেয়ে রক্তের স্রোত জীর্ণ পুরনো শার্টটাকেও ভারী করে তুলছে। সে আর পারছে না যে! তবু সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নেমে পড়ল সে। তারপর আরও কিছুদূর দৌড়ালো। তার পেছনে পেছনে যথারীতি ওরা। তার দৌড়ের গতি কমে আসতে লাগলো। খুব শ্লথ গতিতে দৌড়াচ্ছে এখন সে। এর ভেতরে তার পিঠে আরও একটি চাপাতির কোপ পড়ল। এই কোপ খেয়ে সে পড়ে যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকালো। আকুল ভরা চোখ নিয়ে বলল, আমার নাম বিশ্বজিৎ। আমি হিন্দু। আমার বাপ মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে হারিয়ে যায়। এখনো ফেরেনি।
একথা বলতে না বলতেই তার মুখ বরাবর একটি ছোরার ধারালো অগ্রভাগ আঘাত করে ফেলল। সে খুব বিস্মিত হয়ে তাদের দিকে তাকাতে তাকাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তারপর তার ওপর বাধাহীন অস্ত্রের ব্যবহার হতে থাকলো। রক্তের ছাপে নির্মিত হয়ে গেল এক রক্তচিত্র। এই দৃশ্যের আগে পরে অনেক লোকজনকে দেখা গেল। কেউ সরে গেল। কেউ এগিয়ে গেল। কেউ ছবি তুলল। কেউ অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই ক্যামেরা দিয়ে ক্লোজ শট নিতে থাকলো। দেখা গেলো কারো ব্যক্তিগত ফোন। কারো হাতে বড় ক্যামেরা। ক্যামেরায় লাগানো বিখ্যাত সব টিভি চ্যানেলের লোগো।
আমিও এইসব দেখতে থাকলাম। দেখলাম অস্ত্রধারীরা চলে গেল। দেখলাম কিশোরের চোখ ভাবলেশহীন হয়ে যাচ্ছে। দেখলাম কিশোরের চোখ ফ্যাকাশে হযে যাচ্ছে। দেখলাম কিশোরের চোখ পাণ্ডুর হয়ে যাচ্ছে। দেখলাম কিশোরের চোখ পলকহীন হয়ে যাচ্ছে।
আমি তার কাছে গেলাম। তার চোখের দিকে চোখ রাখার চেষ্টা করলাম। মনে হলো তার চোখের ভেতরে কার যেন এক ছবি ভেসে উঠছে। বিবর্ণ আঁচল দিয়ে কিশোরের কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে এক মহিলা বলছেন, এত ঘেমে গেছিস? খাবি কখন? পান্তাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তো বাপ।
আমি দেখলাম। তার চোখে রক্ত নেই। দুই ফোঁটা অশ্রু চোখের কোণা দিয়ে নামতে নামতে শুকিয়ে গেল। আমি তার চোখের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলাম। দেখতে চাইলাম তার চোখের ভেতরে আর কী কী হচ্ছে। দেখতে চাইলাম এই ভরদুপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে জীবন বাঁচাতে দৌড়াতে দৌড়াতে সে কী ভাবছিল। আমার ভাবতে ইচ্ছে করল তার চোখের দিকে তাকালে তা বুঝা যাবে। বুঝা যাবে কোন আশ্রয়ের কাছে, কোন প্রশ্রয়য়ের কাছে সে যেতে অমন উদ্যত হয়েছিল। যখন পড়ে গেল সে, যখন আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হলো, যখন যে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গেল তখন ঠিক কার মুখটি মনে পড়ল তার!
আমার কাছে মুহূর্তটি অত্যন্ত নীরব হয়ে গিয়েছিল। আমি প্রায় তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ তীব্র হুঙ্কারে টুটে গেল সে নীরবতা। দেখি আমাকে ঘিরে রয়েছে ওরা। ওরাই। ওরা কতিপয় মানুষের চেহারার প্রাণী। তাদের কারো হাতে উদ্যত চাপাতি, কারো হাতে উদ্যত ছোরা, কারো হাতে অন্য কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র। অস্ত্রগুলো ভেজা। হালকা কালচে রঙের তরল বেয়ে বেয়ে পড়ছে সেগুলো থেকে। আমি এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে মুহূর্তের মধ্যেই দৌড় শুরু করলাম। কোন দিকে যাচ্ছি জানি না। শুধু জানি এই অস্ত্রোন্মুখ প্রাণীদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে।
আমি দৌড় শুরু করেছি। আমার পেছনে অস্ত্রধারীদের উদ্যত অস্ত্র। আমার পেছনে অস্ত্রধারীদের ক্ষুধার্ত অস্ত্র। আমার পেছনে অস্ত্রধারীদের রক্ত-পিপাসু অস্ত্র। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার পেছনে কতিপয় জানোয়ারের হুঙ্কার। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার পেছনে শত শত জিজ্ঞাসু চোখ। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার পেছনে শত শত পেশাদার ক্যামেরা। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে নিউজ-ভ্যালু। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার পেছনে পেছনে আসছে পেশাদারিত্ব। আমি দৌড়াচ্ছি আমার পেছনে পেছনে মৃত্যুর থাবা। সবাই সব কিছুই দেখছে। কিন্তু কারো চোখে যেন পড়ছে না আমার পেছনে ধেয়ে আসা মৃত্যুদূত। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই হতে যাচ্ছি একটু আগের স্থির হয়ে যাওয়া চোখের সহযাত্রী। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই হতে যাচ্ছি ওই কিশোরের সহযাত্রী। সে-দিকে কারও যেন ভ্রূক্ষেপ নেই। সবাই দৃশ্য ধারণে ব্যস্ত। কেউ দৃশ্য বদলানোর জন্য সামান্য উদ্যাগী নয়।
আমি দৌড়াচ্ছি। আমার পেছনে হাজারো আলোর তীব্র ফ্লাশ। ওই তীব্র আলো আমার সামনের পথকে বিভ্রান্ত করে তুলছে। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার পেছনে তখনো তীব্র হুঙ্কার। আমি দৌড়াচ্ছি আমার পেছনে তখনো মৃত্যুদূত। আমি দৌড়াচ্ছি। আমি দৌড়াচ্ছি। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার কিছু মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে আমাকে বাঁচতে হবে। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার কিছু মনে পড়ছে না। আমি দৌড়াচ্ছি। এখন বাবার মুখটি মনে পড়ছে। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার কিছু মনে পড়ছে না। আমি দৌড়াচ্ছি। এখন মায়ের মুখটি মনে পড়ছে। আমি দৌড়াচ্ছি আমার কিছু মনে পড়ছে না।। আমি দৌড়াচ্ছি। এবার বাবার মুখটি মনে পড়ছে না। আমি দৌড়াচ্ছি আমি আমার বাবার মুখটি মনে করবার চেষ্টা করছি। আমি দৌড়াচ্ছি কিন্তু আমার বাবার মুখটি মনে করতে পারছি না। আমি দৌড়াচ্ছি। এবার মায়ের মুখটি মনে করার চেষ্টা করলাম। আমি দৌড়াচ্ছি আমি আমার মায়ের মুখটি মনে করতে পারছি না। আমি দৌড়াচ্ছি। এবার আমি আমার শৈশব মনে করার চেষ্টা করছি। আমি দৌড়াচ্ছি। আমি দৌড়াচ্ছি। আমি দৌড়াচ্ছি। আমি এবার কিছুই মনে করতে পারছি না।
আমি এখনো দৌড়াচ্ছি। হঠাৎ আবিষ্কার করি আমার পেছনের তীব্র ফ্লাশ-লাইট নেই। যে ফ্লাশ লাইট আমার সম্মুখ-পথকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিল। আমি এখনো দৌড়াচ্ছি। কিন্তু এখন আগের মতো হুঙ্কার নেই। আমি এখনো দৌড়াচ্ছি আমার পেছনে হাজারো পায়ের শব্দ নেই। আমি তবু দৌড়াচ্ছি। আমি এখনো দৌড়াচ্ছি। আমার চারপাশে এখন তীব্র নাগরিক শব্দ নেই। আমি তবু দৌড়াচ্ছি।
চলবে…
মিথ্যামানব: পর্ব-১৫॥ এমরান কবির