পর্ব: দুই
রোড অ্যাকসিডেন্টে আবিদের প্রাণ যখন যায় যায় তখন নিজের রক্ত দিয়ে ঋণি হয়েছিলাম তার কাছে। সুস্থ হয়ে আবিদ বলেছিল, সে কোনো ট্রাকের নিচে পড়েনি। একটা জাহাজ আসছিল তার দিকে। জাহাজে ছিল এক তরুণী। আবিদ খুব ভালো করে লক্ষ করেছিল, ওই তরুণী ছাড়া আর কোনো যাত্রী নেই। তরুণীযাত্রী খুব করুণভাবে তাকিয়েছিল তার দিকে। আর আহ্বান করছিল আবিদকে। কী যে ছিল সেই আহ্বানে আবিদ স্পষ্ট করে বলতে পারে না। আবিদ এগিয়ে গিয়েছিল জাহাজ ও তরুণীর দিকে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
পেছনে ফিরে দেখি জাহাজটি পেন্ডুলাম হয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই একটা বিশাল পেন্ডুলাম হয়ে দূলতে থাকে। পেন্ডুলামটি ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র হতে থাকে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাই। পেন্ডুলাম পেছাতে থাকে।
আশিক বলত, পেন্ডুলাম হচ্ছে সরল দোলক, কিন্তু এর দোলনটি সরল নয়। এখানেই রহস্য। আশিক আমার আরেক বিপন্ন বন্ধু। পেন্ডুলামের দোলন রহস্যই যেন তার একমাত্র পাঠ্যবিষয়। সারা দিনে রাতে কত ঘণ্টা পেন্ডুলামের দোলন নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করে তা সে নিজেও বলতে পারবে না। সে বলত এই পেন্ডুলাম যেদিন থেমে যাবে সেই রাতে আকাশে উঠবে এক অদ্ভুত চাঁদ, যাকে বেষ্টন করে রাখবে চারটি তারকা। আমরা আমাদের নিয়োগপত্রগুলো ওই তারকাবেষ্টিত চাঁদের আলোয় বারবার পড়ব। কোনো এক সময় আমাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ওই চারটি তারকার কোনো একটি তারকা খসে পড়বে বৃন্তচ্যুত আমের মতো। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের জীবনের ময়নাতদন্তের ফলাফল আসন্ন। আমরা আবার মানবিক সত্তা ও অনুভুতি ফিরে পাব। আমরা ফিরে পাব আমাদের হারানো আধুলি। আমরা ফিরে পাব আমাদের মুদ্রাদোষ। আমরা অতি সহজেই ঘুরে আসতে পারব আমাদের হৃত শৈশব, আধুলি হারানো বিকেল। আমরা ফিরে পাব বাবার আঙুল ধরে পরম নির্ভরতায় গঞ্জের হাট থেকে কিনে আনা পরাবাস্তব লজেন্স। তারপর শৈশবে এসে ধু-ধু দুপুরের চুরি করা ঘুম দিয়ে কিনে আনব হলুদ বিকেল। এসব কথা কয়জন জানে! তারা কোনো কিছু জানার আগেই বৃদ্ধ হয়ে যায়। আমরা আরো ফিরে আনব হিন্দি গানের কলি। নতুন নতুন গালি আর অকারণ কোনো সুন্দরী বালিকা দেখে অহেতুক কষ্টের পাণ্ডুলিপি। আমাদের সহপাঠিনীদের চাহনি অনুবাদ করব আমরা। কিন্তু আমাদের ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখব লাল শাড়ি পরে কোনো নিকট অথবা দূরগ্রামের বধু হয়ে যাচ্ছে তারা। তারপর কোনো প্রাকসন্ধ্যায় আমরা খুঁজে বেড়াব কোনো বালিকার চোখের ভেতরে আমাদের সমূহ সর্বনাশ। কিন্তু কোনো সর্বনাশ সেখানে পাব না। বহুদিন পর কোনো এক লাবণ্য কিংবা কোনো এক চৈতি কিংবা কোনো এক শ্রাবণী কিংবা কোনো এক ঝরাবকুল কিংবা কোনো এক বৈকালিনী কোনো এক গিরিবালা কিংবা কোনো এক রজনী কিংবা…. কিংবা সেই এক প্রিয়কষ্ঠের চোখের ভেতরে দেখতে পাব আমাদের জীবনের ঝরে যাওয়া দুপুরবৃষ্টি। এরপর…এরপরও আমরা আরো অনেক কিছু করার চেষ্টা করব। আবছা আবছা আলোর মতোই সেগুলো ধরা-অধরার মাঝামাঝি কোনো এক অজ্ঞাত বস্তু হয়ে থাকবে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠব এর পরের অংশটুকু উদ্ধারের জন্য। কিন্তু পারব কী? হয়তো পারব! হয়তো পারবো না! কারণ কোনো এক লাবণ্য কিংবা কোনো এক রজনীর কোনো চোখ অবশিষ্ট নেই যে! তারা হয়ে গেছে অন্যকিছু…
হাবিব কারণে অথবা অকারণে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বলে, বন্ধু, বল না আমরা কি সত্যিই…। হাবিবের কথা শেষ হতে না হতেই আশিক নির্বিকার উঠে বথরুমে ঢোকে। অনেকক্ষণ পর বের হয়ে এসে বলে, হেন্ডেল মারলাম। তোরাও মারতে পারিস। আর যাদের নায়িকা আছে…
হাবিবের চিৎকার আশিককে থামিয়ে দেয়, চোপ শা-লা চোপ।
তবুও স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। আশিকের কথাগুলোকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আগামীকাল মৌখিক পরীক্ষাটা দিতে যাব।
হাবিব মল্লিকা শেরওয়াত নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। আমার ইদানিং কোনোটা দিয়েই হয় না। না বিপাশা বসু, না মল্লিকা শেরওয়াত, না সানি লিওন। কাগুজে সঙ্গম দৃশ্যও এক সময় আমাকে জাগিয়ে তুলত। এখন কোনো কাগুজে নারী কিংবা সঙ্গম দৃশ্যও আমাকে জাগিয়ে তুলতে পারে না। তৃপ্তি আসে না। এখন আমার চাই জীবন্ত রক্তমাংস।
বিসিআইসি ভবনের তেরো তলায় উঠে দেখি রিসিপশনে চারজন ছেলে ও একজন মেয়ে অপেক্ষারত। আমার মতো তারাও প্রার্থী। ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। আর মেয়েটি গোমড়া মুখে প্রথম আলো পড়ছে। পাশে গিয়ে বসি। দেখি খেলার পাতায় মেয়েটির চোখ। অর্ধবুক খোলা একটা নারীর সঙ্গে ম্যারাডোনা নাচছে। তার ওপরে ডানপাশে সানিয়া মির্জার প্রোফাইল। হঠাৎ আমার মনে হলো গতকাল বিপাশা বসু বা মল্লিকা শেরওয়াত যেটা পারেনি সানিয়া মির্জা সেটা পারবে।
মেয়েটি প্রথম আলো আমার হাতে দিয়ে বলে, সানিয়া মির্জা আপনার ফেবারিট?
আমি পেপারটি ভাঁজ করে টেবিলে রেখে দিই। জানালা দিয়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বর দেখবার চেষ্টা করি।
কী নাম আপনার? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
কষ্ট।
পেন্ডুলামটি হালকাভাবে দুলছে এখন। তার মানে কি থেমে যাওয়ার ইঙ্গিত! আমার ভাবতে ভালো লাগে পেন্ডুলামটি থেমে গিয়ে আশিকের কথাগুলোকে সত্যি করে তুলবে। আমার চোখ সতর্কভাবে পেন্ডুলামটির ওপর নজর রাখে।
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কারো উত্তপ্ত নিঃশ্বাস। পেন্ডুলামটি থেকে চোখ ও চেতনা ফিরে আসে। পেছনে ফিরে তাকাই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাপটে ধরে এক উদ্ভিন্ন নারী শরীর। কামতপ্ত উন্মাদিনী আমাকে বুকের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে চায়। আমার ঠোঁট কখন যে তার ঠোঁট দখলে নিয়েছে জানি না। আমারও সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। চাঁদ, পেন্ডুলাম, কুয়াশা, নারী— সবকিছুকে স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। সহসা মনে হয় আমি কোনো সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে। একাকী। সূর্য ডোবা দেখছি। পরম নিবিড়তায় প্রত্যক্ষ করছি সূর্যের আপেক্ষিক প্রস্থান।
সাগরপাড় আমাকে শীতল করে দেয়। মনেই হয় না কিছুক্ষণ আগেই আমার দেহে জেগে উঠেছিল আগ্নেয়গিরি। আমার সামনে বসে আছে রিসিপশনে দেখা সেই মেয়ে অথবা সানিয়া মির্জা। চোখে চোখে গভীর মাদকতা। আমাদের চোখে স্থির দৃষ্টি। কেঁপে ওঠে সহসা। সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। হেঁটে দূরে চলে যায়। আবার ফিরে আসে। আমার ডান হাতটা খপ করে ধরে তার কোমরের খাঁজে রাখে।
আমি ধমক দিয়ে হাত সরিয়ে নিই। বলি, কে তুমি?
সে খু-উ-ব মিষ্টি করে হাসে। রিনিঝিনি শব্দ তুলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বলে, হেমন্তের অরণ্যে দাঁড়ানো আমি পোস্টম্যান। আমি তোমার জন্য সুখবর নিয়ে এসেছি। তার ধূসর মিষ্টি কণ্ঠস্বর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তবুও অজানা ঘাসের মধ্যে ফুটে থাকা রংধনুময় ফুলের মতো জড়িয়ে যাই।
কী সুখবর নিয়ে এসেছো তুমি!
তোমাকে সুখী করবার সুখবর নিয়ে এসেছি আমি। আমি বিপন্ন মানুষের বন্ধু।
কিন্তু আমি তো বিপন্ন নই!
মনের ভেতরে তুষার ঝড় বইতে থাকে। সম্ভবত আমি তার দিকে কাতর চোখে তাকাই। সে হয়তো এর কোনো অর্থ বা ব্যাখ্যা দাঁড় করায় যেটা উদ্ধার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
একগুচ্ছ চুল গালের কাছে নিয়ে এসে তর্জনিতে পেচাতে পেচাতে বলে, কিন্তু শর্ত আছে।
তার কথা শেষ হয় কি হয় না আমি আমার অজান্তেই একটা কথা বলে ফেলি, কী শর্ত?
হঠাৎ… রিসিপশনের সেই মেয়ে কিংবা সানিয়া মির্জা কিংবা বিপাশা বসু কিংবা মল্লিকা শেরওয়াত…কিংবা সানিয়া মির্জা কিংবা সানি লিয়ন
সে আমার শরীর ঘেঁসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, আমাকে সুখী করতে হবে।
কীভাবে?
আমি তোমার অস্তিত্ব ধারণ করতে চাই।
না, এটা অসম্ভব। আমার অস্তিত্ব অবিভাজ্য।
তুমি মিথ্যা বলছো। অভিভাজ্যতা বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই। এই খাঁজ কাটা কোমর ও নগ্ন বুক কি হেমন্ত হয়ে আসতে পারে না তোমার জীবনে! তুমি কোন হেমন্তের আশায় এখানে আত্মহত্যা করতে এসেছো!
তুমি ভুল বুঝছো। আমি কোনো হেমন্ত রচনা করতে আসিনি এখানে। আমি হেমন্তকে দাফন করতে এসেছি।
ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে কোথাও। পরপর কয়েকবার। আমার চোখে তার খাঁজকাটা কোমর, অর্ধনগ্ন বুক ও বুকের উচ্চতা থেকে সরিয়ে চলে যায় সেই পেন্ডুলামটির দিকে। কী আশ্চর্য! পেন্ডুলাম থেমে গেছে! আমি যেন যমুনা নদীর ভেতর জেগে ওঠা চরে ফুটে থাকা কাশফুলের মধ্যে হাঁটছি। অদূরে কোথাও কাঠ চেরাই হচ্ছে। কাঠ চেরাইয়ের শব্দ ও কাশফুল আমাকে উত্তেজিত করে তোলে। আমি রিসিপশনের সেই মেয়ে কিংবা সানিয়া মির্জার সঙ্গে জড়িয়ে যাই। আমি তার বুকে বুকে জড়িয়ে যাই। তার ঘাড়ে আমার ঠোঁট শিল্প রচনা করতে থাকে। তার গালে এবং ঠোঁটে তেললঙ জলরঙে আঁকতে থাকি আদিম স্কেচ। আমি ধীরে ধীরে ভু-স্বর্গের দিকে নামতে থাকি। এই চরাচরে উন্মাদ হয়ে ওঠে একজোড়া মানব মানবী। শরীরে আমার ইলেকট্রনের দারুণ প্রবাহ। আমার চোখে ভেসে ওঠে উনিশশত বাহান্ন সালের স্কেল, উনসত্তর সালের কম্পাস। আমার নাকে আম্রমুকুলের ঘ্রাণ। সামান্য বিন্দু-বিচ্ছেদও আমাকে অক্ষরবৃত্ত করে তোলে। আমি ছন্দবদ্ধ হই। আমি শব্দ রচনা করি। আমি ছন্দ রচনা করি। অক্ষর, মাত্রা, ধ্বনি সব, সবগুলোকে সাজাতে থাকি। আমার মাত্রা ভয়ানক সুসজ্জিত হতে থাকে। আমার পর্বসমূহ সুবিন্যস্ত আমার অতিপর্ব কোনো পঙ্ক্তিকে অশিল্পশোভন করে তোলে না। আমরা সমর্পিত হয়ে যাই।
আগে কতভাবে সূর্য রচনা করতে চেয়েছি! কেয়া এসেছে। ক্যামেলিয়া এসেছে। লাক্স এসেছে। অ্যারোমেটিক এসেছে। অথচ সূচনাই হয়নি সূর্যের আবহ। জেগে ওঠেনি সুপ্তবৃত্ত। আমার চোখে টেস্টটিউব, মাইক্রোস্কোপ, পঞ্চইন্দ্রিয়, জলাশয়, বায়বীয় কাঠির ছন্দনৃত্য। আমাদের শরীরে প্রচণ্ড লবণাক্ততা। আমাদের শরীরে প্রচণ্ড সিক্ততা। আমাদের শরীরে ঘাম। সৌরঘামে আমরা চান্দ্রিক হয়ে যাই। গ্রহের মতো পবিত্রতা জমাট বাঁধতে থাকে। পবিত্রতা ঘনীভূত হতে থাকে। পবিত্রতা উন্মাদ হয়ে ওঠে। পবিত্রতা এক সময় কাশফুল হয়ে যায়। পবিত্রতা এক সময় শিউলি ফুলের মতো ঝরে পড়ে। পবিত্রতা এক সময় সাদা পায়রা হয়ে উড়ে যায়।
আমার সামনে বিশাল পেন্ডুলাম। থেমে যাওয়া পেন্ডুলাম। আমার সংলগ্ন কিংবা সামনে কোনো সানিয়া মির্জা নেই। কোনো সানিয়া মির্জা এখানে আসেনি। আসেনি কোনো রিসিপশনের সুন্দরী নারী। শুধু নেমে এসেছিল পেন্ডুলাম।
আমার বোধহয় ফেরা উচিত। কেননা পেন্ডুলাম থেমে গেছে। যদি না থামতো তাহলে না হয় এই হেমন্তকে, হেমন্তের এই চরাচরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া যেত। আমার বোধ হয় পেন্ডুলাম নিয়েই ফেরা উচিত। আর কারো জন্য না হোক। আশিকের জন্য।
আমি পেন্ডুলাম ধরতে যাই! পেন্ডুলাম দূরে সরে যায়! পেছনে পড়ে থাকে আমার সঙ্গীহীন শুক্রাণু। আমি আবার ছুটে যাই পেন্ডুলাম ধরতে। পেন্ডুলাম আকাশে উড়ে যায়। পেন্ডুলামটি ধীরে ধীরে চাঁদ হয়ে যায়। আকাশে দেখা যায় দুটি চাঁদ! পাশাপাশি! এটা কি বিভ্রম!! আশিকের কথা তাহলে পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়! জগতের অন্যান্য সত্যের মতোই আংশিক সত্য! কিন্তু…!
ওইতো ঝরে পড়লো একটি তারকা! তারকা নিচে নামতে থাকে! নিচে…! আরো নিচে…! অতঃপর ভুমিতে পতিত হয় ঠিক সেই জায়গায় যেখানে একাকী ভূমির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল আমার শুক্রাণু।
একটু পরেই আমি নবজাতকের কান্না শুনতে পাই।