চতুর্থ কিস্তি (শেষ পর্ব)
শুকুর শাহ, লালন শাহের আস্তানা বা আখড়ার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।
তাঁর বংশ লতিকা নিম্নরুপ-
নযীবুল্লাহ মোল্লা,
শুকুর শাহ বা শাকুর শাহ,
আয়েজ উদ্দীন শাহ (পালিত পুত্র),
আহম্মদ শাহ, আতর শাহ,
**আমজাদ হোসেন শাহ (মৃত), আমির হোসেন শাহ শাহ (মৃত), আলতাফ হোসেন শাহ।
আলমডাঙ্গা বাজারের নিকট এই আখড়া থাকার কারণে এ অঞ্চলে লালনের শুধু আসা যাওয়াই ছিলনা অনেক বাহাসে তিনি হাজিরও থেকেছেন। লালনের এই আখড়ার প্রমাণ মেলে -১৮৭৬ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানার বড়দাহ গ্রাম হতে মুন্সী মোহাম্মদ হাহেক ওরফে ছাদেক আলী হানিফির আরবিতে রচিত ‘জালালাতো ফোকরা’ (আরবি ফকিরের ভণ্ডামি) গ্রন্থে। ‘বড়দাহ গ্রামে আছে ছাদেক আলি নামি। তাহার বাড়িতে করিতাম মওয়াল্লামি। আমি আর তিনি তথা ছিলাম বসিয়া তিনটা ফকির সেথা পৌঁছিল আসিয়া। শুকুর শাহ নাম তাঁর এক জোনার ছিল…কহিল তাহারা তিন জোনাতে মিলিয়া আলমডাঙ্গিতে মোদের সাধু সিবা হবে। বহুত ফকির সেথা আসিয়া জমিবে। আসিবে লালন সাহা মোরসেদ আমার।
…দাওয়াতের দিনে সবে এক সাতে হৈয়া। আলমডাঙ্গিতে মোরা পৌঁছিনু জাইয়া। বারোসও চৌরাসি সালের ফাল্গুনে আঠাসে তারিখ ছিল সনিবার দিনে।’
এ গ্রন্থ থেকে জানা যায় ১২৮৪ সালের ২৮ ফাল্গুন শনিবার ঝিনাইদহ জেলার অন্তর্গত শৈলকুপা থানার আলমডাঙ্গা নামক স্থানে লালন ও তাঁর শিষ্য অনুসারীদের সঙ্গে এ অঞ্চলে উগ্রপন্থী মুনসী তোফাজ্জেল হোসেন ও তার দুই সাগরেদ ‘জালালাতো ফোকরা’ গ্রন্থের লেখক নছিররদ্দিন ও মহম্মদ হাদেকসহ অন্যদের সঙ্গে বাহাস হয়েছিল। সে দিন ছিল লালনপন্থীদের বিশেষ অনুষ্ঠানের দিন ‘সাধুসেবা’। বাহাসের সময় লালনের প্রতিপক্ষ হিসেবে এ অঞ্চলের তথাকথিত আলেম, মোল্লা, মৌলভি ও সমাজ নেতাদের প্রায় ২০ জন উপস্থিত ছিলেন।
এই আলমডাঙ্গার নিকটবর্তী চড়িয়া নামক স্থানে লালনের আখড়া ছিল। এ অঞ্চলে লালনের আখড়াকে কেন্দ্র করে লালনের প্রচুর প্রভাব ছিল এবং ফকিরবিদ্বেষীরা ধর্মের কথা বলে লালনের সঙ্গে বিভিন্ন বাহাসে অংশ নিয়েছে। বর্তমান শুকুর সাঁইয়ের সেই বংশধরেরাও জীবিত রয়েছে এবং আখড়া স্থানে তাদের বসতি গড়ে উঠেছে। এরূপ লালনের অন্য একটি আখড়া কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে ছত্রপাড়াতে ছিল বলে এসএস লুৎফর রহমান ‘লালন শাহ: জীবনও গান’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এ আখড়াটা তিনি অর্পণ করেন কানাই ও বলাই নামে দুজন শিষ্যকে। শোনা যায় লালনের গান প্রচারে এদুই শিষ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি ছেঁউড়িয়াতে আখড়া স্থপন করেন এবং এখানে তার জীবনের অবসান ঘটে। এ আখড়া যেন সাধুর হাট বাজার । লালনের যে গুলো আখড়া ছিল সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় আখড়া ছেউড়িয়াতে। এখানেই লালন তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন। শৈলকুপার আলমডঙ্গার নিকট লালনের যে আখড়া ছিল সেখানেও তিনি তার আধ্যাত্ম বোধের সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছেন শিষ্যদের। সঙ্গীতই যেন লালন সাঁইজির জীবনের প্রাণ। তিনি যেন এ সঙ্গীতের মাধ্যমে শূন্য এ জগতে পূর্ণতার অন্বেষণ করে গেছেন সারাজীবন ধরে যা আজ তার অচিন পাখিরূপী রহস্যময় জীবনের সন্ধান করি। রহস্য যেন লারনের সঙ্গীতের একঅনুষঙ্গ । রহস্যের মধ্যেই যেন সাঁইজি বিরাজ করে মীনরূপে। তিনি আত্মতত্ত্বে কঠিন সত্য আর রিপুর সঙ্গে যুদ্ধের শিক্ষা দেন নিজের শিষ্যদের নিজ আশ্রমে বসে। এসব জ্ঞান দিব্য জ্ঞান দিয়ে লাভ করা যায় না। এ বড় কঠিন জিনিস তাকে সর্বস্ব দিয়ে অর্জন করতে হয়। সাধনা করতে হয় দীর্ঘ সময় ক্ষ্যাপনের মাধ্যমে। তা না হলে জ্ঞান সাধন হয় না। লালনের অন্ধত্ব নিজেকে না দেখতে পারার অন্ধত্ব। তাই তো সিরাজ সাঁই বলেন- ‘সে তার নিজ মন গুণেই জন্ম অন্ধ থেকে গেল।’ এ অন্ধত্ব নিজেকে না দেখতে পারার অন্ধত্ব ছাড়া বৈকি আর কিছু নয়। আব্দুল ওয়াহাব রচিত ‘লালন-হাসন – জীবন কর্ম সমাজ’ গ্রন্থে আব্দুল ওয়ালীর তথ্য সূত্র সম্পর্কে তিনি বলতে গিয়ে বলেন- প্রবন্ধকার গবেষণার দৃষ্টি নিয়ে লালনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যাদি পরিবেশনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। অথচ ডা. খোন্দকার রিয়াজুল হক লিখেছেন- ওয়ালী সাহেবের রচিত প্রবন্ধ সত্য তথ্য ভিত্তিক এই জন্য যে ঐ প্রবন্ধে তৎকালীন বাংলাদেশের ফকিরদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা আছে। এতটুকু আলোকপাত করার পর তিনি ওয়ালী সাহেবের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলেন-‘লালনের জন্মস্থানের ব্যাপারে তার এই অনির্দিষ্ট বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য করে বিবেচনা করা সমীচীন নয় বলেই আমার মনে হয়।’ কিন্তু আমার প্রশ্ন-আব্দুল ওয়াহাব সাহেব কেন সমীচীন নয় বলে তিনি মনে করেন তার কি একটা সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বা যুক্তি উপস্থাপন করার দরকার ছিল না? কেনই বা তিনি ওয়ালী সাহেবের এ প্রবন্ধকে খারিজ করে দিবেন। শুধু এতটুকুই বলেছেন- তিনি গবেষকের দৃষ্টি নিয়ে এ প্রবন্ধটি রচনা করেননি। তাহলে বলতে হয় আব্দুল ওয়াহাব যে ‘হিতকরী’ পত্রিকাকে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়াস পান, সেটি বুঝি একজন গবেষকের দৃষ্টিতে রচনা করা হয়েছে। আর যদি গবেষকের দৃষ্টিতে আলোকপাত করা হয়, তাহলে কেন যে মানুষ নিজে লালনের সঙ্গে আলাপ করেছেন বা যাকে চোখে দেখেছেন সেখানে কেন বারবার সংশয়াপন্ন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। পাঠকের সুবিধার জন্য ‘হিতকরী’র ‘মহাত্মা লালন ফকির’র কিছু অংশ তুলে দিলাম- ‘লালন ফকিরের নাম এ অঞ্চলের কাহারও শুনিতে বাকি নাই। শুধু এ অঞ্চলে কেন, পূর্ব্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রংপুর দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেক দূর পর্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকীরের শিষ্য শুনিতে পাই। ইহার শিষ্য দশ হাজারের উপর। ইহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি।’ অনেকে আবার লালনের বিবাহ সম্পর্ক নিয়েও অনেক আলোচনা সমালোচনা করেছেন। কেউ বলেছেন লালন বিয়ে করেন নি কিন্তু তার সাধন সঙ্গীনি ছিল। এ মতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এস.এস লুৎফর রহমান তার ‘লালন শাহ : জীবন ও গান’ গ্রন্থে বলেন-”লালন শাহ তার দীর্ঘ জীবনকালে একাধিক সাধন সঙ্গীনি গ্রহণ করেছেন। তারা হলেন একজন ‘বিশাখা’ অপর জন ‘লালমোতি’। এরা কেউ লালনের বিবাহিত স্ত্রী নয়। অতএব লালন বিবাহিত ছিলেন এটার ধারণা ভুল।” কিন্তু লালন গবেষক আনোয়ারুল করীম ভিন্ন মত গ্রহণ করে বলেন- লালন বিবাহিত ছিলেন এবং তার স্ত্রীর নাম ছিল ‘বিশাখা’। আবু ইসহাক হোসেন তার ‘বাউল ও লালন’ প্রবন্ধে বলেছেন- লালন একজন সংসারী এবং তাকে সরাসরি বাউল বলতে পারি কিনা সে বিষয়েও তর্ক থাকতে পারে। তবে সে একজন ভাবসাধক। সারা জীবন সাধনা করে গেছেন। তিনি একজন সম্ভ্রান্ত মাপের মানুষ ছিলেন। সংসারী লোক কবি তাঁর স্ত্রী এবং পালক কন্যা ‘পেরিন্নেসা’র প্রতি ছিল গভীর দায়িত্বশীল এবং মৃত্যুর সময় নগদ ২০০০/- টাকা রেখে গেছেন যার বর্তমান মূল্য লাখের কোটায়। আবার রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের সাক্ষাৎকার নিয়েও রয়েছে নানা রং, ঢঙ্গের কিংবদন্তী যা সত্যিই আমাদের অবাক করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ সর্ব প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৭ সালে এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ১৮৯১ সালে। ততদিনে লালন পরলোকগমন করেছেন। শচীন্দ্রনাথ অধিকারী তার ‘সহজ মানুষ রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং লালনের সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছেন। এ সাক্ষাৎকার বা প্রথম দর্শনকে আমার কাছে মনে হয়েছে শচীন্দ্রনাথ বাবু লালন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে একটা নাটক বা সিনেমা দৃশ্যের সৃষ্টি করেছেন। যা যে কোনো পাঠককেই হাসাবে। কাহিনি বিস্তার লাভ করেছে লালন সাঁইয়ের লাঠিকে কেন্দ্র করে। কেউ এই লাঠিকে চিনতে পারছে না অবশেষে ছেঁউরে গ্রামের প্রজারা নিশ্চিত করে যে এতো সাঁইজির লাঠি। তখন সবাই উৎকন্ঠিত। সাঁইজি কে এই সাঁইজি? তখন প্রজারা বলে লালন সাঁইজি? কি মজার নাটক কি সুন্দর করে শচীন্দ্রনাথ অধিকারী দৃশ্যটা সাজিয়ে তুলেছেন। যা যে কাউকে মোহিত করে তুলবে। তারপর থেকেই রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের সর্ম্পক গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের গবেষণা পর্যালোচনা যা কিছুই বলি না কেন আমরা উচ্চকণ্ঠে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের কোন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। যদি হয়েও থাকে তাহলে হয়েছে জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। যার ফলে তিনি লালনের ছবিটা অংকন করতে সক্ষম হয়েছেন। লালন সাঁইজির সঠিক তথ্য না জানার কারণে যার যেমন ইচ্ছা তেমন করেই নতুন নতুন তথ্য হাজির করেছেন এবং অমক তমকের সাথে প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ দাবি করে গ্রন্থের চেষ্টা সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন। কিন্তু হায়! লালন তুমি রাখবে যদি একটা বাকা সর্পাকৃতি লাঠিই রেখে গেলে জমিদার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য, যা দেখে জমিদারের প্রাসাদের ছেলে-মেয়েরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল এবং তাদের চেচামেচিতে ঘুম ভেঙে ছিল রবীন্দ্রনাথের। কি বুদ্ধি তোমার লালন সাঁইজি। নিম্নে লালন এবং রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারের বিবরণ তুলে দিচ্ছি- ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন তরুণ কবি ও জমিদার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে জমিদারি পরিদর্শনে এসেছেন। প্রজারা জমিদার সকাশে অহরহ আসা-যাওয়া করে। তাদের নানা কাজ নানা আবদার আবার জমিদার বাবুও বেশ ছিল ভোলা। তিনিও প্রজাদের অভাব অভিযোগ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন তার প্রতিকার করেছেন বা করার আশ্বাস দিচ্ছেন। এমনি এক জমিদার দর্শন প্রার্থীদলে একদিন এলেন এক পলিতকেশ নারদ সদৃশ বৃদ্ধ। বয়স তাঁর শত বৎসর পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘকেশ, দীর্ঘশ্মশ্রূ, উন্নত প্রশস্ত ললাট। লোকটি যেন সকল দিক দিয়েই স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি সকলকে ফেলেই যেন বারবার তার দিকে ধাবিত হচ্ছিল। সে ছিল পুণ্যাহের দিন তাই নানা কাজে ব্যস্ত থাকার দারুন তিনি তাঁর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে পারেননি। আবার দিনশেষে লোকটি যে কখন কোনদিক দিয়ে চলে গেল, তার কোনো উদ্দেশ্যই পাওয়া গেল না। কিন্তু মজায় ব্যাপার হল দরবার শেষ হওয়ার পর জমিদার বাবু বিশ্রাম নিচ্ছেন, একটু তন্দ্রার ভাবও এসে গেছে হঠাৎ বাচ্চা ছেলেমেয়েদের হৈ চৈ শব্দে তন্দ্রাভাব কেটে গেল। ব্যাপার কী? জমিদার বাবু কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। ব্যাপার এমন কিছু নয় দরবার গৃহের কোনে একটি সাপমুখো অদ্ভূত গোছের লাঠি পড়ে ছিল, ছেলে মেয়েরা তা নিয়ে হৈ চৈ শুরু করেছে। কোথায় পেলে এ লাঠি? জমিদার বাবু প্রশ্ন করলেন পাহারাওয়ালারা কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না। অবশেষে ছেঁউড়ে গ্রামের প্রজারা লাঠিটি কে শনাক্ত করলেন এ যে সাঁইজির লাঠি। কোন সাঁইজি? প্রশ্ন হলো ‘কেন, আমাদের সাঁইজি! লালন সাঁইজি! লালন সাঁইজি!’ জবাব হলো। সাঁইজির নাম ইতোপূর্বেই জমিদার বাবুর জানা ছিল। এবার হুকুম হল- সাঁইজিকে কুঠি বাড়িতে অবিলম্বেই হাজির করা চাই!
সাঁইজি এলেন। সঙ্গে এলো তাঁর একতারা। ঝংকৃত হলো খঞ্জনি। অসম বয়সী হলেও বাংলার দুই ঋষি কবির মিলন হলো। গানে গানে মুখরিত হলো শিলাইদহের আকাশ বাতাস। শচীন্দ্রবাবু এখানেই আবার বলেছেন- ‘কবির এক প্রশ্নের জবাবে লালন তাঁই সবচেয়ে আলোচিত জাত সংক্রান্ত এ গানটি পরিবেশন করেন-
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন বলে জেতের কিরূপ দেখলাম না নজরে॥
লালন সাঁইজি সর্বদা মানব মুক্তির বাণী প্রচার করে গেছেন যে গানে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কোনো স্থান নেই। তিনি মানবতাবাদের প্রবক্তা হিসেবে আজ চারিদিকে সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন। যে মধ্যযুগের মানুষ নানা কুপমণ্ডুকতাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকার প্রেরণা পান, সেখান থেকে এসব ছুতমার্গের উর্ধ্বে উঠে আসেন বাংলার মহান ভাব সাধক লালন সাঁইজি। কিংবদন্তীতুল্য এই গান পাগল মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র সঞ্জীবনী ছিল সঙ্গীত। এ সঙ্গীত ব্যতিত তিনি অন্য কিছু বুঝতেন না। তিনি তাঁর সঙ্গীতে মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা আর জীবন দর্শনের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। আজ তাঁর লালিত সমাজ মনষ্কামনা আর জীবনযাপনের মূখ্য যে সঙ্গীত সেই সঙ্গীতই যেন তাঁর জীবন দর্শনের সারৎসার বলে চারিদিকে পরিগণিত হয়েছে। লালন তাঁর সঙ্গীতে বাহ্যিক বিষয়কে স্থাপন করেন নি। তবে অন্তরনিহিত গুঢ়ার্থ তাঁর সঙ্গীতের এক গুপ্ত বিষয় যা তাঁকে এক বিশ্বজগতের নব্য ধারার চিন্তক হিসেবে আবিষ্কার করার প্রয়াস পায়। আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণে আবিষ্কার করতে পারি অন্য লালনকে যে আমাদের অন্তর জগতে জাগিয়ে তোলে জিজ্ঞাসার অদ্ভূত ব্যঞ্জনাময় সুরের ঝংকার। সর্বোপরি লালনের মানব ভূবন যে মানবময় তা স্বীকারে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারে না। কারণ এ মানুষই তাঁর সাধনার বিষয়। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় একজন পূর্ণমানবের সন্ধান করেছেন যে তাঁকে মনের মানুষ এবং সাধক মানুষের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে দেয়। লালনকে আজ হিন্দু কি মুসলমান বা কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের মানুষ হিসেবে বিভাজিত না করে সর্ব মানবের পথ প্রদর্শক একজন মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে মেনে নিয়ে সংগ্রামী হয়ে উঠি। ধর্মান্ধ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং স্বার্থ অন্বেষণ ছুঁড়ে ফেলে চলে আসি মানবতার জয়গানে। যেখানে মুক্তি মেলে মানুষ আর মনবতা বোধের, জয় হোক শোষণ মুক্ত গণতন্ত্রের।
শেষ