॥পর্ব-৪॥
বাস যখন মানিকছড়ি পৌঁছালো, তখন প্রায় সন্ধে। সূর্য চলে গেছে পাহাড়ের আড়ালে। পুবেও পাহাড় শ্রেণী। দু’দিকের পাহাড়ের মাঝখানে বিস্তীর্ণ জায়গাটায় ছোট ছোট আরও পাহাড় আর সমতল জায়গার সন্নিবেশ। মাঝখান দিয়ে পুব থেকে পশ্চিম দিকে নেমে গেছে ছোট একটা পাহাড়ী নদী। এখন শীতের সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা স্রোত নেই। ফলে নদীর কোথাও শুকনো, কোথাও হাঁটু পানি। কোথাও কোথাও বড় জোর বুক সমান হতে পারে। নদীর নাম, গোলাম মোর্শেদের মুখে শোনা গেল, মনশ্রী।
আচমকা বুকের ভেতরটা কেমন যেন হয়ে গেল মশির। মনশ্রী। কে দিল নদীটাকে এমন সুন্দর নাম! মনশ্রী, মনশ্রী…বিড় বিড় করে আওড়ালো মশি নামটা।
মানিকছড়ি বাজারটা মনশ্রীর পূর্ব তীরে। বাস থেকে নেমে একটা পাকা পুল পেরিয়ে বাজার। বাজারটা বেশ বড়সড়ো। প্রচুর দোকান পাট। দু’তিনটা চায়ের দোকান দেখা গেল বেশ জমজমাট। খদ্দের টদ্দেরও নেহাত কম না। ক্যাশের টেবিলে রাখা টেপরেকর্ডারে হিন্দি-বাংলা গান বাজছে। একটা দোকানে ঢুকল গোলাম মোর্শেদ। একটা টেবিল দখল করে বসে বললো, কী খাবেন বলুন। খিদে পেয়েছে কিন্তু। এখন আর ভাত খাওয়ার সময় নেই। কিছুক্ষণ পর তো সন্ধে হয়ে যাবে। ভাত খাব রাতের বেলায়। কী বলেন?
মাথা নেড়ে সায় দিল মশি। খিদে পেয়েছে বটে। দোকানে পরোটা ভাজা হচ্ছে। উৎসুক চোখে ওদিকে তাকাল সে- পরোটা হলে মন্দ হয় না।
বেয়ারা ডেকে পরোটার অর্ডার দিল গোলাম মোর্শেদ। সঙ্গে গরুর মাংস। ভালো লাগল মশির। লোকটা বেশ ভদ্রতা করছে ওর সঙ্গে। খরচ টরচও করছে বেশ।
মশি এবার একটা ইচ্ছের কথা জানিয়েছে গোলাম মোর্শেদকে। ওর ভালো এক জোড়া জুতো কেনার খুব শখ। কিন্তু বেশি দামের কারণে কেনা হচ্ছে না। এবার গোলাম মোর্শেদ যখন তার বাসায় গিয়ে মানিকছড়ি আসার প্রস্তাব দিল, তখন সে তাকে বলেছিল ইচ্ছের কথাটা। সে একজন পত্রিকার লেখক, এক জোড়া ভালো জুতো না থাকলে মানায় না। লেখার সুবাদে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। প্রায় ছেঁড়া এক জোড়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে লেখক বা সাংবাদিক পরিচয়ে কারো কাছে গেলে ঠিক মতো পাত্তা নাও পাওয়া যেতে পারে। এক জোড়া ফিতেঅলা সু পায়ে দিয়ে কারও সামনে গেলে প্রথমে যেটা ওই লোকের চোখে পড়বে, সেটা হলো ঝকঝকে পালিশ করা জুতোজোড়াই।
ব্রিজ পেরিয়ে মানিকছড়ি বাজারে পা দিতেই একটা জুতোর দোকান চোখে পড়েছে। ভেতরে তাকে সাজানো কয়েক জোড়া সু দেখেছে।
গরম গরম ভাজা পরোটা আর মাংস এসে পড়ল টেবিলে। নিজের প্লেট টেনে নিল গোলাম মোর্শেদ। পরোটা ছিঁড়ে মুখে ঢুকিয়ে চামচ দিয়ে এক টুকরো মাংস গালে ঢোকালো। অস্পষ্ট স্বরে বললোো, নিন, খান।
নিজের প্লেট টেনে নিল মশি। খেতে খেতে বললোো কথাটা, জুতোর দোকান আছে দেখলাম।
হুম। খেতে খেতে মাথা নাড়ল গোলাম মোর্শেদ। মানিকছড়ি বাজারে সব আছে। জুতোর দোকান থেকে সিঁদলের ঝুপড়ি পর্যন্ত। আর্মি ক্যাম্প হওয়ার পর থেকেই এই রমরমা অবস্থা। ওদিকে আবার হাই স্কুল। রানী নীহারময়ী হাই স্কুল এখন গভর্নমেন্ট হাই স্কুল। দূর-দুরান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রী আসে আসে এখানে পড়তে। এদিকে থানা, উপজেলা অফিস, পোস্ট অফিস… কাল সবকিছু দেখাব ঘুরে ঘুরে। আর্মি আসার পর থেকে এই অবস্থা। আগে তো খান কয়েক টিমটিমে দোকান ছাড়া বাজারে কিছুই ছিল না। তারপরেও এই খাউপ্যা শালারা…কথাটা শেষ করল না। বিরক্তির ভঙ্গি করে বড় এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে এক টুকরো মাংস মুড়ে নিয়ে গালে ঢোকালো।
‘খাউপ্যা’ বলতে পাহাড়িদের বুঝিয়েছে গোলাম মোর্শেদ। শব্দটা অবশ্য চাটগাঁইয়া লোকেরা ব্যবহার করে চাকমাদের বেলায়। কেন চাকমাদের ‘খাউপ্যা’ নামকরণ করা হলো, সেটা অবশ্য মশি জানে না। তবে সহজ সরল পাহাড়িদের রাঙামাটি বা কাপ্তাইয়ের মতো শহরে এসে সংকোচ ভরে চলাফেরা করতে দেখেই সম্ভবত এ রকম বিশেষণ। গোলাম মোর্শেদের বাড়ি ফরিদপুর। স্থানীয়দের বলতে শুনে সেও শিখেছে শব্দটা। চাটগাঁর লোকেরা নামকরণে ওস্তাদ। ওদের কাছে নোয়াখালীর লোক হলে ‘পানি আগ্রা’, ময়মনসিংয়ের লোক ‘খাইছুইন পার্টি’ আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না, এমন সব লোকই হলো একচেটিয়া ‘বইঙ্গা’। তবে মশি জানে, এসব নামকরণ স্রেফ মজা করার জন্যেই। যেমন পশ্চিম বঙ্গের লোক পদ্মার এপারের লোকদের বলে ‘বাঙাল’ আর পূর্ববঙ্গের মানুষ তাদের ‘ঘটি’ ডেকে তার শোধ তোলে।
গোলাম মোর্শেদ বললোো, সব কিছু খুঁটিয়ে দেখেন। এবারের সংখ্যায় বেশির ভাগ লেখা যাবে মিলিটারি আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা কতটা উন্নত হয়েছে, তার ওপর। পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব উন্নয়ন শান্তি বাহিনীর পছন্দ হচ্ছে না। তাদের উদ্দেশ্য হলো, সাধারণ পাহাড়িদের অন্ধকারে রেখে নিজেদের উন্নতি করা। তারা পাহাড়িদের ভয়-ডর দেখিয়ে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করছে। তাদের ভাবতে বাধ্য করছে, মিলিটারিরা এক ভয়ঙ্কর জাত। পাহাড়িদের ভয় দেখিয়ে ভারতে শরণার্থী বানাতে পারলে বিদেশিদের বোঝানো যায়, বাংলাদেশ সরকারের অত্যাচারে এরা ঘর-বাড়ি ফেলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে তাদের জন্যে নানা সাহায্য-সহযোগিতা আসছে আর শান্তিবাহিনী তা মেরে খাচ্ছে।
শান্তিবাহিনী মশিরও পছন্দের নয়। সে যখন হিলট্রাক্টসে ছিল, তখন দেখেছে তাদের উৎপাত। কাঠের নৌকো, বাঁশের চালি, পাথরের সরঙ্গা আর জেলে নৌকো থেকে চাঁদাবাজি করতে। চাঁদা না পেয়ে নিরীহ নেয়ে-মাঝিদের মারধর করতে দেখেছে। ওর নিজের কপালেও বন্দুকের বাড়ির দাগ রয়েছে। নিজেদের শান্তিবাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে এসেছিল লোকগুলো। এসেই কী হম্বি তম্বি- ট্যাঙা দে, সোল দে, নইলে খাক্কে ক্যাবং মোগোদা বাআঁল..হুঁ।
মানে কী না, টাকা দাও, নইলে চাউল দাও। নইলে এখনই কেটে ফেলব, শালার বাঙালি।
কিন্তু ‘ট্যাঙা-সোল’ কোত্থেকে দেবে। থাকলেই তো। মশিরা সেগুনগাছ ভর্তি খেপ নিয়ে আসছে মারিস্যা থেকে। বিশ-পঁচিশ দিনের খেপে নৌকোয় খোরাকি ফুরিয়েছে। নগদ টাকাও নেই যে, কিনে খাবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব, রাতে নৌকো বেয়ে হলেও কাপ্তাই চলে আসার চেষ্টা করছিল ওরা। সে রাতটা সুবলং ছেড়ে এসে বড়ুয়া পাড়ায় কাটিয়ে তার পরের দিন কাপ্তাই পৌঁছার আশা করছিল। কিন্তু এর মধ্যে শান্তি বাহিনীর হামলা। নৌকোয় খোরাকি থাকলে রাতটা সুবলংয়েই কাটাত তারা। ঝুঁকি নিয়ে বড়ুয়া পাড়ায় আসত না।
তিনজন এসেছিল তারা। আচমকা। বয়স ২০ থেকে ৩০ হতে পারে। ওদের হাঁকডাকে ঘুম ভেঙে যায় মশিদের। ছইয়ের এক দিক বন্ধ গাছ বোঝাই করায়। পেছন দিক দিয়েই ভেতরে চলাচলের রাস্তা। সেটাই আটকে ফেলে ওরা। একজন ছোট নৌকো সামলাচ্ছিল, আরেক জন দু’হাতে সই করে রেখেছে একটা বন্দুক। বাকি জন নৌকোয় ঢুকে দা খানা তুলে নেয়। তার পর শুরু ঘ্যান ঘ্যান..ট্যাঙা দে, সোল দে।
কিন্তু মশি টাকা দেবে কোত্থেকে? বার কয়েক বুঝিয়ে বললোো, দেখ, আমরা খেপ থেকে আসছি। তোরাও জানিস, এসময় টাকা থাকে না। সব টাকা খরচ হয়ে গেছে।
ধ্যাৎ, শালা বাঙাল! বেজ মাদে- বলেই পিঠের ওপর দাও দিয়ে এক বাড়ি লাগালো ভেতরের লোকটা। পরমুহূর্তে সামনের বন্দুকঅলা বন্দুকের কুঁদো দিয়ে কপালে লাগাল এক ঘা। দে ট্যাঙা… দে!
পিঠে আর কপালে ঘা খেয়ে থর থর করে কেঁপে উঠল মশির শরীর। ব্যথা, ভয় আর অপমান তিনটাই বোধ করেছ। দুই নাইয়া চুপচাপ। বিপদ আপদ যা যাচ্ছে, মাঝির ওপর দিয়ে যাচ্ছে। অনর্থক কথা বলে নিজেরাও বিপদে পড়তে চাইছে না তারা। দা আর বন্দুকের মুখে কে কথা বলবে?
কী করবে বুঝতে পারছে না মশি। টাকা বা চাউল থাকলে অনেক আগেই দিয়ে ফেলত। প্রতিবাদ না করে এবার আধ্যাত্মিকতার লাইন ধরল। মরিয়া হয়ে বললো, দেখ, তোদেরও একটা ধম্ম আছে, আমারও একখান ধম্ম আছে। ধম্মের নাম নিয়ে কইতাছি, আমার কাছে চাউল-টাকা কোনোটাই নাই। জীবনের চেয়ে কি চাউল-টাকাই বড় হলো? তোরাই চিন্দা গর না। ধর্মের কথা তোলাতে হোক, আর ব্যাপারটা ততক্ষণে বুঝে ফেলাতে হোক, এরপর আর বাড়াবাড়ি করল না লোকগুলো। কেবল দাওটা নিয়ে নেমে গেল নৌকো থেকে। তখন বোঝেনি, কিন্তু এখন মশি জানে, ওই লোকগুলো শান্তিবাহিনী ছিল না আর বন্দুকটাও আসল বন্দুক ছিল না। শান্তিবাহিনী নৌকো-সাম্পান থেকে চাঁদা নেয়, রাতের বেলা চাউল ছিনিয়ে নিতে আসে না। আসলে সে সময় হিলট্রাক্টসে সাধারণ পাহাড়িরা ভীষণ অভাবে ছিল। এখনো আছে কি না, কে জানে? শরণার্থী আসা শুরু হতেই বড় বাজার বা শহরের আশপাশ ছেড়ে তারা আস্তে আস্তে গভীর পাহাড়ের দিকে চলে যেতে শুরু করেছে। অভাব আর আতঙ্কে কেউ কেউ চলে গেছে সীমান্তের ওপারে। ত্রিপুরা আর মিজোরামের পাহাড়ে।
তবু শান্তি বাহিনীর সঙ্গে নৈতিকভাবে একমত হতে পারেনি মশি। ১৯০০ সালে ব্রিটিশপ্রণীত সিএইচটি আইনের বিরোধিতা করে সে। আর শান্তিবাহিনী চায় তার প্রয়োগ। এর মানে হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো বাঙালি থাকতে পারবে না। সব ছেড়ে ছুড়ে সমতলে চলে আসতে হবে তাদের।
নাস্তা সেরে চা খেল ওরা। তারপর সিগারেট ধরাল। গোলাম মোর্শেদ ধোয়ার রিং বানাতে বানাতে বললো, রাতে থাকবেন বোর্ডিংয়ে। মনশ্রী বোর্ডিং। ভাত টাত খেয়ে লেখা শুরু করবেন। আমি কিছু কাগজ দেব। আগে ওগুলো পড়বেন।
কীসের কাগজ? সিগারেটে লম্বা টান দিল মশি।
মিলিটারি পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার পর কী কী উন্নয়নমূলক কাজ করেছে, তার কিছু খসড়া ডকুমেন্ট। এরা যেভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তার বিপরীতে উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রচার নাহলে সামরিক বাহিনীর ইমেজ নিয়ে টানাটানি পড়বে। বিদেশ দূরে থাক, নিজের দেশের আঁতেলদের মুখেও তো পার্বত্য চট্টগামে সেনা উপস্থিতির যৌক্তিকতা নিয়ে খই ফোটে। বামধারার বুদ্ধিজীবীরা ঢাকায় থেকে সব জেনে বসে আছে। লোগাং হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে তারা গলাবাজি করে। কিন্তু ভূষণছড়ায় এতগুলো সেটলার যে শান্তিবাহিনীর হাতে মারা গেল, তা নিয়ে এদের কারো মুখে টুঁ শব্দও নেই। বুঝলেন, এই বামপন্থীরা কেবল বাম দিকটাই চেনে, সোজা পথে হাঁটার অভ্যাস আর করতে পারল না।’ গলা ছেড়ে হেসে উঠল গোলাম মোর্শেদ। নিজের রসিকতায় নিজেই হেভি মজা পেয়েছে।
উপমাটা হাসির, তবে নেহাত অযৌক্তিকও ভাবতে পারল না মশি। তার নিজেরও তাই মনে হয়। বাংলাদেশের বামপন্থীরা সারাজীবন কেবল শ্রেণিশত্র“ শ্রেণিশত্র“ করে গেল, কিন্তু জিনিসটা আসলে কী, তা পাবলিককে আজো বোঝাতে পারল না।
চলবে…