॥দুই॥
আজ থেকে বছর পনেরো আগে, পনেরো বছর বয়সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিতে পা রেখেছিল মশি মোহাম্মদ। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল ফেল করার ভয়ে। ফেল অবশ্য করেনি, তবে সে খবর পাওয়ার পরও বাড়ি ফিরে আসা হয়নি আর। পরের সাত বছর কেটেছিল কাপ্তাই আর রাঙামাটিতে। নৌকোয় চাকরি, পাহাড়ে গাছকাটা, পাথর ভাঙা, জুমচাষ—এসব কাজ করেছে। এরপর একসময় বাড়ি ফিরে গেছে। সেটা পরের গল্প। এখন মশি চালচুলোহীন এসএসসি পাস বেকার যুবক। এক বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে দু’বেলা খাবার জোটে। দুই/একটা টিউশনি করে কোনোভাবে পকেট খরচ চালায়। স্কুলে পড়ার সময় লেখালেখি শুরু করেছিল। কবিতা-টবিতা লিখে ক্লাসমেট আর শিক্ষকদের দুই/একজনের বাহবা-টাহবাও পেয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকার সময় ওসব আর মনে ছিল না। কিন্তু ওখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর আবার পেয়ে বসেছে লেখালেখির নেশা। কবিতা লিখে লিখে খাতার পর খাতা ভরিয়ে ফেলেছে। ঢাকা চট্টগ্রামের দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাপ্তাহিক সাহিত্যপাতায় লেখা পাঠাতে শুরু করেছে। প্রথম প্রথম নিজের লেখা নিয়ে খুব উঁচু একটা ধারণা ছিল। ভেবেছিল পত্রিকার সম্পাদকরা খুব গুরুত্বসহকারে ওর লেখা ছাপাবে। আর পাঠকরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে। হুড় হুড় করে নাম ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। একজন আরেকজনকে বলবে, মশি মোহাম্মদের কবিতা পড়েছেন?
সঙ্গে-সঙ্গে অন্যজন বলবে, মশি মোহাম্মদের কবিতা! উহ্! অদ্ভুত। আজই তো ছাপা হলো একটা ইত্তেফাকে। পড়েননি?’
প্রথমজন বলবে, হুঁ, পড়েছি। অপূর্ব! গত সপ্তাহে সংবাদে ছাপা হয়েছিল। ওটা পড়েছেন?
তবে এসব কল্পনার রঙ শুকোতে দু’দিনও লাগেনি। ইত্তেফাক, সংবাদসহ নানা পত্রিকায় কবিতার পর কবিতা পাঠিয়েও যখন দেখল একটাও ছাপা হয়নি, তখন ওই চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়েছে। বুঝে গেছে, বড়-বড় পত্রিকা ওর মতো নতুন লেখকের লেখা খুলেও দেখবে না। এরপর স্থানীয় পত্রিকাগুলোর দিকে নজর দিয়েছে। অনেক লেখা পাঠানোর পর মাঝে মাঝে দু’একটা কবিতা-ছড়া ছাপা হতে শুরু করেছে। মশি মোহাম্মদ এখন চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট কবি-লেখক। অন্তত ওর সেরকমই ধারণা। ওর কিছু লেখার দারুণ প্রশংসা করেছে বন্ধুবান্ধবরা। লেখাগুলো নাকি ভালোই হয়েছে।
কিন্তু কবিতা লিখে তো টাকা পাওয়া যায় না। চট্টগ্রামে একটা পত্রিকা অবশ্য টাকা দেয়। একটা ছড়া ছাপা হলে পঞ্চাশ টাকা। প্রথম লেখার বিল পেয়ে তো রীতিমতো আকাশে ওড়ার অবস্থা হয়েছিল ওর। কবিতাটার নাম ছিল ‘স্বদেশ আমার’। এমনিতে লেখাটা ওর নিজেরই ভাল লেগেছিল। দেশপ্রেম নিয়ে লেখা বটে, তবে তাতে কেবল দেশের রূপ-সৌন্দর্য বর্ণনার ব্যাপার ছিল না। বরং ভেতরের কষ্টটাই ফুটে বেরিয়েছিল। লেখাটাতে একবার বলা হয়েছে, ‘স্বদেশ আমার গর্ব আমার/বিশ্বে তোমার নেই সমতুল’, আবার বলা হয়েছে, ‘স্বদেশ আমার দুঃখ আমার/বুকভাঙা এক কষ্ট আকুল’। ভেতর থেকে যেন আবেগ ফুটে ফুটে বের হয়েছে। মনে আছে, যেদিন লেখাটা শেষ করেছে, সেদিন সারাক্ষণ তার মন খারাপ ছিল। আসলে লেখাটা বেরিয়ে এসেছিল বেকারত্বের যন্ত্রণা আর পকেট খরচ না থাকার কষ্ট থেকে।
পকেট খরচও বা এমন আর কী? সারা দিনে কাপ চার পাঁচেক চা আর সিগারেট। তেমন দামি সিগারেটও নয়। গোল্ডলিফ বেনসন তো নয়ই। ১০ শলাঅলা এক প্যাকেট সিগারেটের দাম সাড়ে চার টাকা, বড়জোর পাঁচ টাকা। চার-পাঁচ কাপ চায়ের দাম ১০-১২ টাকা। মোটামুটি ২০ থেকে ২৫ টাকা হলেই পকেট খরচাটা মিটে যায়। কিন্তু বেকার মানুষের জন্য এই টাকাও বা আসে কোত্থেকে? চা-সিগারেটের দোকানে বাকি পড়ে যায়। মাস শেষে দোকানদার টাকা চেয়ে বসে। কিন্তু দেয়া হয়ে ওঠে না। এরপর দোকানদারের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়। যে পথে বাকির দোকান, সে পথ দিয়ে না হেঁটে ঘুরতি পথে চলাচল করতে হয়। বাকি টাকা সময় মতো না পেয়ে একজন লেখকের সাথে যদি দোকানদার শক্ত গলায় কথা বলে, তাহলে তার চেয়ে অপমানের বিষয় আর কী হতে পারে?
মশি মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত চিন্তা করে। সে ভাবে, লেখকদের জন্যে সব কিছু ফ্রি হওয়া উচিত। একজন লেখক জাতির গৌরব। সে লিখবে নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়। তাকে যদি পকেট খরচার টাকা যোগানোর চিন্তায় ক্লিষ্ট থাকতে হয়, তাহলে সেটা জাতিরই ক্ষতি। লেখক চায়ের দোকানে যাবে, দোকানদার মিষ্টি হেসে তাকে আপ্যায়িত করে বসাবে। বয়কে ডেকে চা-নাশতা এনে দিতে বলবে। সিগারেটের দোকানদার দোকানের সামনে যাওয়া মাত্র এক প্যাকেট সিগারেট বাড়িয়ে দেবে। এ রকম প্রয়োজনীয় সব কিছুই লেখককে জুগিয়ে দেবে সমাজের মানুষ। এমন কী লেখক যদি দূরে কোথাও গিয়ে এককাপ চা আর একটা সিগারেট খেতে চায়, দোকানদারকে নিজের পরিচয় দেওয়ামাত্র দোকানদার তা সসম্মানে বাড়িয়ে দেবে।
কিন্তু এখানে একটা সমস্যাও আছে। মশি মনে মনে হাসে। এরকম নিয়ম চালু হলে সমাজে কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যা রাতারাতি বেড়ে যাবে।
তাহলে সে ক্ষেত্রে দায়িত্বটা দেশের সরকারের। সরকার দেশের প্রকৃত কবি-সাহিত্যিকদের বেছে নেবে এবং সামাজিকভাবে এটা নিয়ম করে দেবে, এদের বেলায় অন্তত পকেট খরচ ফ্রি। বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চলে এরা বিনা ভাড়ায় ভ্রমণ করতে পারবে এবং পকেট খরচার ব্যাপারে সহযোগিতা পাবে।কিন্তু কথা হলো প্রকৃত কবি-সাহিত্যিক বাছাই করার কাজটা সরকার কিসের ভিত্তিতে করবে?
বিনে পয়সায় স্বপ্ন দেখার কাজটা এর পরও এগোতে পারে। কিন্তু মশি ক্ষান্ত দেয়। পৃথিবীতে কোনো দেশেই এরকম নিয়ম কখনো ছিল না, কখনো হবেও না।
টিউশনি করে মশি। সকাল-সন্ধে ছেলে পড়িয়ে এক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার প্রয়োজনটা মেটে। বিকেলে দু’তিনটে টিউশনি থেকে শ’ ছয় সাতেক টাকা আসে। তাতে চা-সিগারেট, কবিতা লেখার জন্যে খাতা-কলম, পত্রিকা অফিসে লেখা পাঠানোর জন্যে ডাকটিকিট, পত্রিকা এসব কেনার কাজ চলে। পোষায় না অবশ্য।
তবে দশ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকার সময় সে লেখালেখির কথা ভুলেছিল। বাঙালি আর পাহাড়িদের সঙ্গে অদ্ভূত এক ঘোরের মধ্যে যেন কেটেছিল সে সময়টা। আর এ পর্যন্ত জীবনের অবিস্মরণীয় সময় কেটেছিল বিলাইছড়ির ধানগোদা পাড়ায়। মশি কখনো ভুলবে না ধানগোদা পাড়ার এক বাঙালি সেটলারের মেয়ে পল্লবী শতরূপা ইয়াসমিনের কথা।
চলবে…