॥পর্ব-দশ॥
ওসি মাথা নাড়লো। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। তারপর জিজ্ঞেস করলো, আপনার নাম?
ইয়াসমিন।
শুধু ইয়াসমিন? আগে-পিছে কিছু নেই?
আছে। বেগম।
আগে বেগম বলেননি কেন?
বুঝতে পারিনি আপনি ফরমালি জানতে চাইছেন। তাহলে ইয়াসমিন বেগমই বলতাম—মেয়েটির মুখে মুখে মৃদু হাসি।
ওসির মুখ গম্ভীর—ঠিক আছে, মেয়েটিকে নিয়ে যান। কিন্তু পরে কোনো সমস্যা হলে আপনি দায়ী হবেন।
আমি দায়ী হবো?
হ্যাঁ।
কেন?
কারণ মেয়েটি এখন আপনার হেফাজতে থাকবে।
না। আমার হেফাজতে নয়। ও থাকবে ওর মা-বাবা ভাইয়ের হেফাজতে। কিংবা চাইলে ও ওর নিজের হেফাজতে থাকবে। ও এখন প্রাপ্তবয়স্কা। কিন্তু তা যদি না চান, তাহলে আপনাদের হেফাজতে রাখুন। তবে আমার মনে হয় না সেটা করবেন।
মেয়েটার বাবাকে ডাকেন।
মেয়েটার বাবা আসতে বললো, বুড়া মিয়া, মেয়েকে নিয়ে যাবেন?
বুড়া মিয়ার বয়স ৬০-৬৫। তোবড়ানো গাল। কপালে নদীর ঢেউয়ের মতো বলীরেখা। মাথার চুল পেকে সাদা। শ্যামলা গায়ের রঙ এখন কয়লা কালো। দেখলে মনে হয়, নিরীহ আর শান্ত। হয়তো তাই। কিন্তু ওসির কথায় জ্বলে উঠলো তেলেবেগুনে—নিমু না? আমার মেয়ে আমি ফেলাই দিমু? অই হারামজাদা মেজিস্টর আমার মেয়ের গায়ে হাত দিতে চাইছে। আমনে দারোগা। বিচার করেন।
তুবড়ি ছুটছে বুড়োর মুখে। সব কথা স্পষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু বুড়োর মুখের বিরাম নেই। ওদিক থেকে বুড়িরও মুখ খুলে গেছে। স্বামীর কথার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলছে সেও। তবে ওর কথা বোঝা যাচ্ছে না।
গোলাম মোর্শেদ হা করে আছে। মশির অবস্থাও সেরকম।
পরিস্থিতি সামলালো ওসি। হাতের কাছে টেবিলের ওপর রাখা বেতটা তুলে এক বাড়ি লাগালো টেবিলে—থামেন।
থেমে গেলো বুড়ো। দারোগার বেত। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। সম্ভবত জানে, পুলিশকে বিশ্বাস নেই।
ইয়াসমিন বলে, চাচা, আমনে থামেন। আমনে চাচির কাছে যান। আমি ব্যবস্থা করতাছি।
আধঘণ্টা পরে মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল রানী নিহার দেবী স্কুলের শিক্ষিকা ইয়াসমিন বেগম। মশি গোলাম মোর্শেদের দিকে চাইলো। গোলাম মোর্শেদ গম্ভীর। বোঝা যাচ্ছে কাজটা পছন্দ হয়নি ওর। মশি অবাক হলো একটু। ব্যাপারটা তো ভালোয় ভালোয় চুকে গেলো। গোলাম মোর্শেদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, লোকটা হতাশ। হতাশ হওয়ার কী আছে?
একটু পরে বেরিয়ে গেল ওরা থানা থেকে। গোলাম মোর্শেদ গম্ভীর। ভাব দেখে কিছু বলছে না মশিও। একটু পরে গোলাম মোর্শেদ বললো, চলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাই। তার বক্তব্য শুনতে হবে।
কেন? কেস তো ডিসমিসড। ওরা তো বলেছে মামলা করবে না। তাই না?
ওরা বললে তো হবে না, ভাই। ঘটনা একটা ঘটেছে। নইলে মেয়েটিকে থানায় নিয়ে আসা হলো কেন? পুলিশ যা-ই বলুক। তাতে পাবলিক ভুলতে পারে, সাংবাদিক ভোলে না। সাংবাদিকের কাজ হলো, সত্যটা টেনে বের করে আনা।
মশি কিছু বললো না। হাঁটতে লাগল গোলাম মোর্শেদের পিছে পিছে।
মানিকছড়ি পাহাড়ি জায়গা। বাজারটা মোটামুটি সমতলে। থানা, উপজেলা অফিসসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসগুলো ছোট ছোট পাহাড়-টিলার ওপরে। মিনিট তিনেক হাঁটার পর একটা টিলা বেয়ে উঠতে লাগলো গোলাম মোর্শেদ। টিলার ওপর একটা অফিসের মতো। গোলাম মোর্শেদ বলল, এটা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসা। আজ কোর্ট নেই। বাসায় পাওয়া যাবে।
তিনটা ঘর নিয়ে ছোট একতলা বাসা।
দরজা বন্ধ। বাইরে থেকে নক করতেই খুলে গেলো। ৫০-এরও বেশি বয়সের এক লোক গলা বাড়ালেন, কে?
আমরা—গোলাম মোর্শেদ জবাব দিল। সে বলে, আমরা পত্রিকার লোক। আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।
আমার সঙ্গে কী কথা?
আপনার বিরুদ্ধে থানায় একটা অভিযোগ গেছে। আমরা তা নিয়ে কথা বলতে এসেছি। আমাকে দেখিয়ে বললো, ইনি অমুক পত্রিকার সাংবাদিক। ওসি সাহেব মেয়েটাকে থানায় আটকে রেখেছিলেন। উনি গিয়ে সে মেয়ের ইন্টারভিউ নিয়েছেন। মেয়েটা আপনার নামে অভিযোগ দিয়েছে। এখন সাংবাদিক সাহেব আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। উনি পত্রিকায় রিপোর্ট করবেন। সে জন্যে দুই পক্ষের কথাই শোনা দরকার।
কোন পত্রিকার সাংবাদিক বললেন?
গোলাম মোর্শেদ তার অমুক পত্রিকার নাম বলল। একটু ভাব নেয়া চেহারা করল মশি। গোলাম মোর্শেদ যে পত্রিকার নাম বলেছে, সেটা চট্টগ্রামের একটি চালু পত্রিকা। পত্রিকার নাম শুনে একটু ভাবান্তর দেখা গেল ম্যাজিস্ট্রেটের মুখে। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ঢোকার পথ করে দিয়ে বললেন, আসুন।
আগে গোলাম মোর্শেদ ঢুকল। পেছনে আমি। ছোট্ট দুই রূমের ঘরটা। বড় রূমটা ম্যাজিস্ট্রেটের শোবার ঘর। ডাইনিং রূম এবং রিডিং রূমও বলা যায়। ছোট্ট একটা ডাইনিং টেবিল মাঝখানে। দেয়ালের সাথে সাঁটানো ছোট একটা বইয়ের তাক। নানারকম আইনি বই দিয়ে ঠাসা। একটা খাট। খাটে সাদা চাদর বিছানো, দুটি বালিশ একটা আরেকটার ওপরে রাখা। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব একাই থাকেন। পরিবার নিশ্চয় বাড়িতে।
মশিদের বসার জন্যে খাটের একটা পাশ নিজের হাতে চাপড় মেরে ধুলোবালি পরিষ্কার করলেন ম্যাজিস্ট্র্রেট।
বসুন। বলুন, আপনারা কী জানতে চান।
গোলাম মোর্শেদ তাকাল মশির দিকে। মশি বুঝল, গোলাম মোর্শেদ তাকেই প্রশ্ন করতে বলছে। এটাই স্বাভাবিক। দৈনিক অমুক পত্রিকার সাংবাদিক এসেছে ব্যাপারটা জানতে, সুতরাং প্রশ্ন যা করার সাংবাদিকই করবে।
একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল মশি। তারপর বলল, ইয়ে আপনার বিরুদ্ধে একটা খারাপ ধরনের অভিযোগ এসেছে….
কীরকম খারাপ।
ইয়ে মানে…আবার গলা খাঁকার দিল মশি। আপনার কাজের মেয়ে বলেছে, আপনি তাকে রেপ করতে চেয়েছেন। ও থানায় গিয়ে বলেছে।
কী বললেন? রীতিমতো গর্জে উঠতে চাইলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তবে শীর্ণ শরীরে মানাল না সেটা। অবশ্য থামলেন না। বলে চললেন, জানেন, আমি কে? আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেট। আপনারা কার বিরুদ্ধে কী বলছেন?
ম্যাজিস্টেটের কথা শেষ হওয়ার সময় দিল মশি। তারপর হাসল। বলল, আপনি আমার কথা খেয়াল করেননি, স্যার। আমি আপনার বিরুদ্ধে কিছু বলছি না। থানায় আটক একটা মেয়ের অভিযোগ সম্পর্কে আপনার মত জানতে চাইছি। কারণ মেয়েটা আপনার বাসায় কাজ করে এবং সে বলেছে আপনি তাকে রেপ করেছেন কিংবা করার চেষ্টা করেছেন।
আর একজন সাংবাদিক হিসেবে এরকম ঘটনাকে নিউজ হিসেবে দেখা আমার কর্তব্য।
কাজের মেয়ে বানিয়ে বানিয়ে কী বলল আর আপনারা তা বিশ্বাস করলেন? আশ্চর্য! আরে ও একটা কাজের মাতারি। ওদের কথায় বিশ্বাস করতে আছে?
মাতারি শব্দটা খারাপ, স্যার। ওটা আপনার মতো বয়সী এবং প্রাজ্ঞ একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার মুখে শোভা পায় না।
কিন্তু ওর সব কথা তো মিথ্যে। সব বানিয়ে বলেছে।
কেন? বানিয়ে বলবে কেন? একজন মেয়ে তার শ্লীলতাহানির মতো মর্যাদার কথা কেন বানিয়ে বলতে যাবে? আর যার বিরুদ্ধে সে অভিযোগ করেছে, তিনি একজন বিচারক। একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়ের এতটা সাহস….আপনার কী মনে হয়, হবে?
চুপ করে গেলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তারপর কিছু একটা বলতে গিয়ে ফের থেমে গেলেন। হাত ইশারায় মশিদের বসতে বলে উঠে রান্না ঘরে ঢুকলেন। একটু পরে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা প্লেটে একছড়া পাকা কলা। মশিদের সামনে এনে রাখলেন। একটু হেসে বললেন, ভাই কলা খান। আসছেন অসময়ে…কী দিয়ে আপনাদের সম্মান করি বলেন?
আমরা তো কলা খেতে আসিনি, বলল গোলাম মোর্শেদ। আপনি আপনার কথা বলেন।
চম্পা কলা। মধুর মতো মিষ্টি। হাসলেন ম্যাজিস্ট্রেট। নিজে একটা ছিলে নিয়ে অর্ধেকটাই গালে চালান করে দিলেন। চিবোতে চিবোতে বললেন, আসল কথা হলো এসবই ষড়যন্ত্র। এখানে কিছু লোক আমাকে সহ্য করতে পারে না। তারা চায় না, আমি এখানে থাকি। তাই এসব আজে বাজে কথা ছড়াচ্ছে। মেয়েটাকে আমি নিজের মেয়ের মতো দেখতাম।
কেন চায় না? প্রশ্ন করল মশি।
সেটা আমি কী করে জানব? আমাকে উপজেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেটা হয়তো কারো পক্ষে যায়, কারো বিপক্ষে যায়। মানিকছড়ি নতুন উপজেলা। এখানে অনেক কিছু রদবদল হচ্ছে। এ রদবদলকে সবাই সমান ভাবে নিতে পারলে এর প্রতিক্রিয়া তো নানাভাবেই আসতে পারে।
তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, এটা আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ? গোলাম মোর্শেদ জানতে চাইল। আপনি মেয়েটাকে ধর্ষণ করেননি?
ধর্ষণ তো পরের কথা। ধর্ষণের চেষ্টাও করিনি। তাছাড়া….আমার এ বয়সে…আমি একজন শিক্ষিত, দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা…কীভাবে বিশ্বাস হয় আপনাদের?
চুপ করে রইল মশি। পরবর্তী প্রশ্ন কী করা যায়, ভাবছে। আর গোলাম মোর্শেদের মুখ কালো হয়ে গেছে। দেখেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, আপনি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না। এটা পত্রিকায় নিউজ হবে। আপনার নামে বদনাম হবে। আপনি কি বুঝতে পারছেন?
বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করতে বলেন আমাকে?
হুম। সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। নড়ে চড়ে বসল গোলাম মোর্শেদ। নিউজটা যাতে পত্রিকায় না যায়, সে ব্যাপারে কী করা যায় ভাবুন। জানেন তো, আপনি মানী লোক। ইজ্জতের দাম কোটি টাকা….
গোলাম মোর্শেদ কী বলতে চাইছে, বুঝতে পারছে মশি। টাকা চাইছে লোকটা। ম্যাজিস্ট্রেটকে ব্ল্যাকমেইল।
সাংবাদিক সাহেব সবার স্টেটমেন্ট নিয়েছেন। উনি কাল চলে যাবেন। আপনার কিছু বলার থাকলে আমরা রাতে আবার আসব। মশির দিকে চাইল। চলেন ভাই। উঠি। স্লামালেকুম, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। আমরা যাই। আপনি চিন্তা-ভাবনা করুন।
চলবে…