পর্ব-৭
নেশাটা মাত্র চড়তে শুরু করেছে, ঠিক তখনই পেছনের ছোট্ট বারান্দার গ্রিলে আঘাতের ধাতব শব্দ পেল রেজা। কপাল কুঁচকে উঠল অজান্তেই। সন্ধ্যার অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার তিক্ততা কাটাতে সবে সে বাংলা মদের বোতল নিয়ে ঘরে ঢুকেছে, খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজে দু পেগ গিলে মাত্র ধাতস্থ হতে শুরু করেছে, হঠাৎ এই শব্দ মগ্নতায় চিড় ধরাল তার, নেশাটা ছুটিয়ে দিল নিমেষেই। এসময় একবার নেশা ছুটে যাওয়া মানে বাকিরাত নির্ঘুম কাটানো, যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ভোরের জন্য প্রহর গোণা। গ্রিলে শব্দ করা অজানা মানুষটাকে শাপ-শাপান্ত আর তার চৌদ্দোগোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে সশব্দে বারান্দার দরজা খুলল রেজা। বকের মতো গলা বাড়িয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চাপা, গনগনে গলায় বলল, শব্দ করে কেডা রে? কোন খানকির বাচ্চা?
একটা ছায়ামূর্তি নড়ে উঠল অন্ধকারে। হিসহিসে, তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, খানকির বাচ্চা না, আমি খানকি!
ভূত দেখার মতো চমকায় রেজা। বাকি নেশাটাও টুটে যায় মুহূর্তে। এত রাতে আলেয়া কী করছে এখানে! আজ তো আসার কথা নয় তার! আলেয়া সচরাচর রাতেই আসে, কিন্তু এখন তার নাইট ডিউটি নয়, আজ সে এখানে কেন! তবে কি সন্ধ্যার ব্যাপারটা কোনোভাবে জেনে গেছে ডাইনিটা? মনে মনে প্রমাদ গুনল রেজা। নিচু, ক্রুদ্ধগলায় বলল, ক্যান আইছ এত রাইতে? আইজ তো আওয়ার কথা না তোমার?
ক্যান? হুট কইরা আইসা তোমার বাড়া ভাতে ছাই দিছি নাকি? ছুকরি নিয়া ফূর্তি করবা রাইতে?
গা জ্বলে গেল রেজার। সেই সাথে বুকের ভেতর থেকে অস্বস্তির কাঁটাটাও নেমে গেল এক লহমায়, টের পেল সে। সন্ধ্যার ব্যাপারটা তাহলে আলেয়া জানে না বোঝা যাচ্ছে। জানলে এতক্ষণে নর্মদা উগড়ে দিত মুখে। আস্তে পেছনের দরজাটা খুলে দিল সে। স্বর নরম করে বলল, আসো ভিত্রে।
রেজার কণ্ঠের পরিবর্তন খেয়াল করল আলেয়া। মুহূর্তে বদলে গেল সে-ও। খানিক আগের রুদ্ররূপ উধাও হল নিমেষেই। শান্ত, আহ্লাদিসুরে বলল, খ্যাপ মাইরা কখন আইছ? খাইছ রাইতে?
সন্ধ্যার দিকে আইছি। খাইছি হালকা। বাহির থিকা খায়া আসছি। -আলেয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ভেতরে ঢুকে আবার আধখাওয়া গ্লাস নিয়ে মেঝেতে পেতে রাখা মাদুরটায় বসল রেজা। চুমুক দিল আস্তে। সেদিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে ঠোঁট বাঁকাল আলেয়া। শাসনের সুরে মৃদু ধমক তুলে বলল, এই সাঁঝকালেই শুরু কইরা দিছ আইজ? কী অইছে শুনি?
আলেয়াকে এক নজর দেখল রেজা। সদ্য স্নান সেরে এসেছে, কোঁকড়া চুল ছড়ানো পিঠময়। ভেজা চুলে ভিজে উঠেছে পিঠের অনেকটা। পরনের সবুজ-কালো মিশেলের তাঁতের শাড়িটায় অদ্ভুত লাগছে তাকে। বয়স কমে গেছে বছর দশেক। এই মুহূর্তের আলেয়াকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে হাসপাতালে ফ্লোর পরিষ্কার করে দিন যায় তার। পরিচ্ছন্ন, পরিস্রুত আলেয়া এখন স্রেফ আলেয়াই রেজার চোখে। তার পান খাওয়া ঠোঁটে প্রশ্রয়, কাজল পরা চোখে রহস্য। কালিদা বুঝি এজন্যই বলে, নারীর কোনো জাত নাই রে পাগলা! নারী হল মায়া, তারে ভক্তি করবি সব্বদা, বুঝলি?
তার দীর্ঘ, গৌরবর্ণ, স্বাস্থ্যবান নধর শরীর এই মুহূর্তে প্রায় দ হয়ে কাৎ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়, অসহায়, করুণ, আর অপার্থিব লাগছে তাকে। অপলক তাকিয়ে থাকে আলেয়া। ডাকতে ভুলে যায়।
চোখ সরিয়ে নিল রেজা। হাত নেড়ে মাছি তাড়াল। আলেয়াকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে তুবড়ি ছোটাল। অন্যদিকে চোখ রেখে বলল, অত টিকটিক কইরো না তো! আইজ তো ডিউটি নাই তোমার, তাইলে আইলা কেমনে? মাইয়া কিছু জিগায় নাই?
রোশনি বাইত নাই আইজ, তার কাইলকা পরীক্ষা আছে কইছে, হোস্টেলে থাইকা বান্ধবীগো লগে পড়ব রাইতে, তাই সাঁঝকালেই গেছেগা।
ও। -অস্ফুট শব্দ করল রেজা। অন্যমনস্ক।
কী? আইছি যে, খুশি অও নাই?
হ। বিরাট খুশি অইছি। অক্ষনে যাও, খানিক চানাচুর মাখায়া আনো ঝাল পিঁয়াজ দিয়া। ঝাল বেশি দিবা। যাও।
খুশি মনে রান্নাঘরের দিকে গেল আলেয়া। সেদিকে তাকিয়ে আনমনে খালি গ্লাসে আবার তরল ঢালল রেজা, জল মেশাল অভ্যস্ত, পাকা হাতে। সন্ধ্যার ব্যাপারটা মনে পড়ে কপাল কুঁচকে উঠল, মেজাজ খিঁচড়ে গেল আবার হুট করে। অমন হওয়ার কথা নয়। তবু হল। কিন্তু কেন? ভাবনাটা তোলপাড় করে দিল তাকে। আবার গোড়া থেকে ব্যাপারটা ভাবতে বসল সে। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ভাবল, তবু থই পেল না ভেবে। কেয়াকে অত কাছে পেয়েও কেন সাড়া দিতে পারল না সে, কেন অমন গুটিয়ে গেল তার শরীর, সেটা ভেবে নিজেই অবাক মানল। কেয়া ইচ্ছুক ছিল, ভীষণই। তবু রেজা কেন তাল হারিয়ে ফেলল হঠাৎ? কেয়ার সাথে মেলার সময় কেন ছন্দ হারাল তার শরীর? কেয়ার সে সময়ের মুখটা মনে পড়ল। লাল, রাগে গনগনে মুখ। আগুনের আঁচ আসছিল শরীর থেকে তার, যেন পুড়িয়ে দিতে চাইছিল গৌরবর্ণ, দীর্ঘকায় রেজার পতঙ্গ শরীর। রেজাও প্রস্তুত ছিল পুড়তে, আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত ছিল সে-ও। হঠাৎ যে কী হল তার! গুটিয়ে গেল তার উদ্যত শরীর, উগড়ে দিল আঠালো সাদা কেয়ার শরীর বরাবর। কেয়ার সেই অবাক, অপ্রস্তুত, হতাশ দৃষ্টি, চোখে-মুখে ঘৃণা আর বিতৃষ্ণার সেই তীব্র আগুন! তার তাপে এখনও যেন পুড়ে যায় রেজার শরীর। কী লজ্জা! কী অসহ্য লজ্জা! ছি! কেয়া কী ভাবল তাকে! অপদার্থ! অক্ষম! কাপুরুষ! ছি!
উত্তেজনায়, অপমানে গ্লাসের তরল দ্রুত গিলতে থাকে রেজা। কেয়ার শেষ বাক্যটা মনে পড়তেই কান, মুখ গরম হয়ে ওঠে তার। নিজেকে ঠিক করতে করতে কেয়া তীব্র ঘৃণা আর বিরক্তিতে রেজার দিকে তাকিয়ে বলছিল, হাভাতে কোথাকার! পেটই নাই যার, তার আবার খিদে কী রে? থাপড়ায়া দাঁত ফেলায়া দেব আবার যদি সামনে এসে হা করে থাকিস!
কেয়ার চলে যাওয়া দেখছিল তখন রেজা, চুপচাপ, একটাও শব্দ না করে। নিজের এই অচেনা আচরণে নিজেই সে থ হয়ে ছিল বিস্ময়ে। ঘটনার আকস্মিকতা তাকে বোবা বানিয়ে দিয়েছিল প্রায়। কেয়াকে থামানো, তাকে বুঝিয়ে শান্ত করা কিংবা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার বিষয়গুলো তখন মাথায়ই আসেনি তার। আর সে নিজেই ব্যাপারটায় এতটা অনভ্যস্থ ছিল, এতটা চমকে গেছিল যে কীভাবে পরিস্থিতিটাকে সামাল দিতে হবে সেটাই বুঝতে পারছিল না আদতে, আর তার মধ্যেই পাখি ফুরুত। কেয়াবিবি ততক্ষণে রেগেমেগে হাঁটা দিয়েছে নিজের পথে। যখন সম্বিত ফিরল তার, ততক্ষণে কেয়াবিবি হোস্টেলে ঢুকে গেছে সম্ভবত, না ঢুকলেও করার কিছুই ছিল না তখন, কারণ তখনকার মতো ফুরিয়ে গেছিল সে।
মুরাদ স্যার এফসিপিএস করতে সপরিবারে দেশের বাইরে বছর দুয়েক। বাসার চাবিটা রেজার কাছে দিয়ে গেছেন স্যার। মাঝে মাঝে লোক দিয়ে সাফসুতরো করায় রেজা, ঝাড়পোঁছ করিয়ে বাসযোগ্য রাখে। ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও বাসাটা সে ব্যবহার করে হঠাৎ হঠাৎ, যেমন আজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এমন বেইজ্জতি হতে হবে ভাবেনি। নিজের মনে আঁতিপাঁতি করে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা খোঁজে রেজা, তন্ন তন্ন করে খোঁজে কারণ। ভেবে পায় না কিছুই। সকালে দেখা ঐ সদ্য বিধবা বউটা কিংবা এ্যাম্বুলেসের ঐ দারুণ সুদর্শন মৃত লোকটা কি কোনো প্রতিক্রিয়া ফেলেছিল তার ভাবনায়, মনে, তারই অজান্তে? প্রশ্নটা নিজেকে করে নিজেই নাকোচ করে দেয় রেজা। অসম্ভব। চাকরিটা সে করছে প্রায় দশ বছর হতে চলল, প্রায় প্রতিদিনই লাশ নিয়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটতে হয় তাকে, বিশেষ কোনো লাশ বা বিশেষ কোনো ব্যক্তির স্মৃতি তার ভাবনায় প্রভাব ফেলবে, তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করবে অত সহজ নয় ব্যাপারটা। তাহলে তার এই অকাল উদ্গীরণ এর কারণ কী? কী রহস্য তার এই হঠাৎ নেতিয়ে পড়ায়? ভেবে পায় না রেজা। ক্লান্তি জমে শরীরে। হাই ওঠে তার।
আলেয়া যত্ন নিয়ে ঝাল-পেঁয়াজ কাটে। রান্নাঘরের তাক থেকে চানাচুর, সরিষা তেলের বয়াম নামায়। সামান্য বিটলবন ছড়িয়ে একবাটি চানাচুর মাখায়। মদের সাথে চানাচুর খুব পছন্দ রেজার। কাঁচামরিচ বেশি দিতে হয় তার চানাচুরে। একটু মুখে দিয়ে দেখে আলেয়া। বেশ হয়েছে খেতে। অমৃত প্রায়। বাটি হাতে রুমে ঢুকে অবাক হয় আলেয়া। নীরব, সুনসান। গ্লাসে আধখাওয়া তরল, বোতল তখনও প্রায় অর্ধেকটা ভরা, রেজা মাদুরের ওপর শোয়া। কাছে গিয়ে দেখে আলেয়া। ভারী, ঘন শ্বাস পড়ছে, ঘুমিয়ে গেছে রেজা। তার দীর্ঘ, গৌরবর্ণ, স্বাস্থ্যবান নধর শরীর এই মুহূর্তে প্রায় দ হয়ে কাৎ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়, অসহায়, করুণ, আর অপার্থিব লাগছে তাকে। অপলক তাকিয়ে থাকে আলেয়া। ডাকতে ভুলে যায়।
চলবে…
বেনু মসলাঘর-৬॥ শিল্পী নাজনীন