পর্ব-৫
ক্লাসের ব্যস্ততায় সারাদিন দম ফেলার ফুরসত মেলে না আজকাল। আটটা থেকে ক্লাস, মাঝে একঘণ্টার বিরতিতে স্নান-খাওয়া সেরে প্রাকটিক্যাল ক্লাসে ছোটা। দিনগুলো রীতিমতো দৌড়ায় এখন। ছুটির দিনগুলোতে রাজ্যের কাজ জমে যায়। কোনটা রেখে কোনটা সারবে ভাবতে ভাবতেই কণার হাঁফ ধরে যায় প্রায়। বাড়িতে কুটোটি নাড়তে হয়নি কোনোদিন। কিন্তু হোস্টেলে এসে সেসব বড়লোকি চাল ভুলতে হয়েছে বাধ্য হয়েই। পান থেকে চুন খসলেই আছে হাউজ টিউটর সোহিনী ম্যাডামের বকুনি আর সিনিয়র আপুদের চোখ রাঙানি। মাঝে মাঝে শাস্তিও পেতে হয়। মনে আছে, ভর্তির প্রথম দিকে, সিনিয়র এক আপুর সঙ্গে চোপা করেছিল বলে ভরদুপুরে এক বালতি কাপড় দিয়ে সেই আপু তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল কলতলায়। চোখের জলে নাকের জলে এক করে, সাবানের ক্ষারে অনভ্যস্ত নরম হাতের চামড়া অনেকটা ক্ষইয়ে দিয়ে সেই আপুর কাপড়গুলো কণা সেদিন ধুয়েছিল দুপুরের কাঠফাটা রোদে বসে। কাজ শেষে দেখেছিল হাতের আঙুলের ডগায় দগদগে ঘা, চামড়া উঠে রক্ত বের হচ্ছে ফোঁটায় ফোঁটায়।
আরেকদিন অন্য এক আপু তাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিল নিজের ঘর পরিষ্কারের কাজ, প্রায় বিনা অপরাধেই। এখন অবশ্য সিনিয়রদের শাস্তির ভয় কমেছে খানিকটা, তাদের পরেও দুটো ব্যাচ এসে গেছে কলেজে। সে হিসেবে তারাও এখন বেশ চোটপাট করতে পারে জুনিয়রদের ওপর। তবে ব্যাপারটা বরাবরই অপছন্দ কণার। স্রেফ এক-দুবছর আগে ভর্তি হয়েছে বলেই কারও ওপর অমানবিক হতে বাধে তার, বন্ধুদেরও নিরুৎসাহিত করে সে এ কাজে। কিন্তু কেয়াটা বড্ড ছটফটে। সবকিছুতে অত্যুৎসাহী সে। জুনিয়রদের পারলে সে চরকি ঘোরায়।
আজ শুক্রবার। ছুটির এ দিনটাতে কাজ জমে যায় প্রচুর। আজও জমেছে। কিন্তু আজ আলসেমিতে পেয়েছে তাকে, সেই সকাল থেকেই। এসাইনমেন্টের কাজ ঝুলে আছে, কাপড় জমেছে অনেক, সেগুলোও ধুতে হবে, সেই সাথে আছে ঘর পরিষ্কারের কাজও। পালা করে ঘর পরিষ্কার করে তারা, গত সপ্তায় তাসনূভা করেছে, তার আগের সপ্তায় কেয়া, আজ তার দিন। কিন্তু বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না কণার।
দোস্ত, আজ ঘরটা তুই পরিষ্কার করবি, প্লিজ? আমি এরপর যেদিন তোর পালা থাকবে সেদিন করব তাহলে? -কেয়াকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলে কণা। তাসনূভা রুমে নেই, সেই সকালে বেরিয়েছে সে, ফিরতে বিকেল হবে বলেছে।
নখে নেইলপলিশ লাগাতে লাগাতে ঠোঁট উল্টায় কেয়া। কণাকে একফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলে, আরে দূর! আমি কেমনে পরিষ্কার করব আজ, বল? আমাকে তো বের হতে হবে একটু পর! আজ বোধনের সাথে আমার ডেটিং, মনে নাই তোর!
ওহ তাই তো! সরি দোস্ত, ভুলে গেছিলাম। আসলে শরীর খারাপ লাগছে একটু। কাজ করতে ইচ্ছে করছে না আজ।
ও এই কেস? এটা তো ওয়ান টুর ব্যাপার! দাঁড়া, এখনই তোর মুশকিল আসান করে দিচ্ছি!
কিভাবে? তুইতো যাচ্ছিস ডেটিং এ! -অবাক হয়ে প্রশ্নটা করল কণা।
কেয়া ততক্ষণে উঠে গিয়ে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে গলা তুলে ডাকতে শুরু করেছে, ২০৪ রুনু, শম্পা!
কয়েকবার ডাকতেই রুনু আর শম্পার মুখ ২০৪ নম্বর রুমের দরজায় উঁকি দিলো। প্রায় সমস্বরে দুজনে বললো, জি কেয়া আপু!
একবার রুমে আয়তো! কুইক! -হুকুমের সুরে কথাটা বলে রুমে এসে বিছানায় বসে আবার নখে নেইল পালিশ লাগাতে বসল কেয়া। হাত-পায়ের নখে নেইল পলিশ দেওয়াটাকে সে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। সেদিকে তাকিয়ে কণা বললো, কী করতে চাইছিস বল তো? ওরা এসে কী করবে?
কী আবার করবে! একজন ঘর পরিষ্কার করবে, অন্যজন কাপড় কাচবে!
কী বাজে বকছিস! ওরা কেন এসব করবে?
আমরা করেছি এতদিন, তাই এখন ওরা করবে! যেন কেউ করে না এসব! কেন, আমরা আমাদের সিনিয়রদের কাপড় ধুইনি? বাসন মেজে দেইনি? ঘর পরিষ্কার করিনি? এখন ওরা করবে! আমরা শোধ নেবো সুদে-আসলে!
কী বলছিস পাগলের মতো!
চুপ থাক! কথা বলবি না। যা করছি দেখে যা চুপচাপ। -ধমক দিয়ে কণাকে থামিয়ে দেয় কেয়া। কণা প্রত্যুত্তর দেয়ার আগেই দরজায় রুনু আর শম্পার ছায়া দেখা যায়। শুকনো মুখে রুনু বলে, কী হয়েছে আপু? ডেকেছেন কেন?
কেয়া হাসিমুখে বলে, আয়, ভেতরে আয়।
রুনু আর শম্পা জড়সড় হয়ে বসে কেয়া আর কণার পড়ার টেবিল লাগোয়া চেয়ারে এসে। মুখে ভয়। কেয়া হাসে। বলে, কী রে মানিকজোড়, মুখ শুকনা কেন? নাস্তা করিসনি সকালে?
করেছি তো আপু। পড়ছিলাম।
পড়ছিলি? ভালো?খুব ভালো। মন দিয়ে পড়বি, বুঝলি?
জি আপু। -ঝটপট উত্তর দেয় দুজনে।
আচ্ছা, শওকত স্যারের কথা কী যেন বলছিলি না সেদিন? কী হয়েছে রে?
ভয়ে ভয়ে এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে রুনু আর শম্পা। বলবে নাকি বলবে না, ভেবে ঢোক গেলে তারা।
এই, এত ঢং করিস ক্যান তোরা, এ্যাঁ? তাড়াতাড়ি বল, কাজ আছে আমার, বের হবো!
ভাবতেই ফোনটা টেনে নেয় কণা। ফোন দেয় তার মা বেনুকে। ফোন বাজছে বাজছেই। ধরার নামগন্ধও নাই কারও।
ধমকে ওঠে কেয়া। কণা কথা না বলে চুপচাপ বিছানায় আধহেলান দিয়ে বসে তামাশা দেখে। কেয়া কী করতে চায় বুঝতে চেষ্টা করে সে।
ঢোক গেলে রুনু। বড় করে শ্বাস টেনে নেয়, সাহস সঞ্চয় করতে চায়। শম্পা দেখতে যেমন হোক, আদতে ভিতুর ডিম সে-ও। শুকনো মুখে কেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে ফ্যাল ফ্যাল করে। অবশেষে রুনুই মুখ খোলে।
তেমন কিছু তো হয়নি আপু। কী বলেছিলাম মনেও তো নেই এখন।
তেমন কিছু হয়নি মানে? বেয়াদব মেয়ে! চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো! সেদিন না তোরা দুজন বললি যে শওকত স্যার তোকে ক্লাস শেষে একা তার রুমে দেখা করতে বলেছিল, আর তুই সাথে শম্পাকে নিয়ে স্যারের রুমে গেছিলি বলে স্যার তোকে টিউটোরিয়ালে জিরো দিয়েছে? কী? বলিসনি? কিরে শম্পা, বলিসনি তোরা?
রুনু আর শম্পা প্রথমে থমমত খায়, আমতা আমতা করে, তারপর ঘাড় নেড়ে বলে জি আপু, বলেছি।
তাহলে বললি কেন যে, তেমন কিছু হয়নি? কেন বললি? আর তাছাড়া এসব কথা বাইরে বলবিই বা কেন তোরা? স্যারের কানে একবার এসব কথা গেলে জীবনে আর ফার্স্ট ইয়ারের গণ্ডি পার হতে পারবি তোরা? কোনোদিন ডাক্তার হতে পারবি ভেবেছিস?
ভুল হয়ে গেছে আপু। আর হবে না।
হুম। সাবধানে থাকবি, বুঝলি? আর শওকত স্যার থেকে দূরে থাকবি। ও ব্যাটার আলুর দোষ আছে, মেয়ে দেখলে হামলে পড়তে চায়। একদম পাত্তা দিবি না ব্যাটাকে।
জি আপু। এখন যাই? অনেক পড়া জমে আছে, পড়তে হবে।
যাবি? আচ্ছা যা। সারাদিন টো টো করে ঘুরিস, পড়া তো জমবেই তোদের।
শম্পা আর রুনু যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কণার দিকে তাকিয়ে চোখে টিপ দেয় কেয়া, হাসে। তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে তেমন ভাব করে বলে, এই শোন্ শোন্!
ঘুরে দাঁড়ায় দুজনেই। চোখে প্রশ্ন।
শম্পা বলে, কী আপু?
শোন, আমি তো একটু বাইরে যাবো, জরুরি কাজ আছে, এদিকে কণার আবার সকাল থেকে শরীরটা খারাপ, তাসনূভাও রুমে নেই। তোরা দুজনে মিলে একটু হেল্প কর তো সোনারা। রুনু, তুই বালতির এই কাপড়গুলো কেচে ফ্যাল, আর শম্পা, তুই ঘরটা সুন্দর করে ঝুল ঝেড়ে ভালো করে ঝাড়ু দিবি, তারপর ঝকঝকে করে মুছে ফেলবি, কেমন? পারবি তো, সোনারা?
রুনু আর শম্পার মুখে যেন একপোঁচ কালি মাখিয়ে দেয় কেউ। শম্পার মুখ কাঁদোকাঁদো।
অনেক পড়া জমেছে আপু। -সাহস সঞ্চয় করে এক নিঃশ্বাসে কথা ক’টা মরিয়াভাবে বলে ফেলে শম্পা।
আরে, সেজন্যই তো তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করতে বলছি তোদের। ঝটপট কাজ শেষ করে পড়তে যা, দেরি করিস না আর। আমারও দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাই, রেডি হয়ে নিই।
সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে গুনগুনিয়ে গান গায় কেয়া। কোন ড্রেসটা পরবে সেটা নিয়ে ড্রয়ার খুলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ভীষণ। শম্পা আর রুনু বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কেয়ার ভাবভঙ্গি দেখে হাল ছেড়ে দিয়ে তার নির্দেশমতো কাজে লেগে পড়ে অগত্যা। কণা চোখ বুঁজে সব শুনছিল এতক্ষণ। চোখ খোলে কেয়ার ডাকে।
দেখতো, এই ড্রেসটাতে কেমন মানাবে আমাকে? এটা পরব ভাবছি।
ভালো তো, পর এটাই, মানাবে খুব।
বলছিস? শম্পা দেখতো, মানাবে?
মানাবে আপু। -ফাঁসির আসামির মতো মুখ করে রায় দেয় সে। কেয়া অতসব খেয়াল করে না। সে গুনগুন করে হিন্দি গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে তৈরি হয়ে নেয়, কণাকে বাই বলে বেরিয়ে যায় একটু বাদেই। তার পারফিউমের সুগন্ধটা ছড়িয়ে থাকে ঘরময়। গন্ধটা নাক দিয়ে টেনে নিতে নিতে কণার মনে পড়ে বিপুর সাথে বিকেলে আজ দেখা করার কথা আছে তারও। মনে পড়তেই নিজের ভেতর কেমন একটা অনিচ্ছা টের পায়। ইদানীং এমন হয় তার। বিপু তাকে টানে না তেমন। বুকের ভেতর কেমন একটা বিতৃষ্ণা দলা পাকিয়ে উঠতে চায়। সেখানে অন্য ছায়া এখন। রিফাত। ছায়া গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। অস্বস্তি লাগে কণার। ছটফট করে সে। আর তখনই হুট করে মনে পড়ে, অনেকদিন মেহেরবানুর কোনো খবর নেয়নি সে। সেই যে মেহেরবানুকে বাড়িতে তুলে রেখে সে হোস্টেলে এসেছে, তারপর প্রায় পনেরো দিন হতে চলল মেহেরবানুর কোনো খবর রাখেনি সে, অবকাশও মেলেনি তেমন। ভাবতেই ফোনটা টেনে নেয় কণা। ফোন দেয় তার মা বেনুকে। ফোন বাজছে বাজছেই। ধরার নামগন্ধও নাই কারও।
চলবে…