পর্ব-২
উল্টোদিকের নির্মিয়মান বিল্ডিংংয়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে দরজায় কড়া নাড়ে মেহেরবানু। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে প্রায়। ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই। বিরক্ত মেহেরবানু কড়া নাড়া ছেড়ে মিস্ত্রিদের ব্যস্ততা দেখে একমনে। খালি পায়ে ধূলোর পুরু আস্তরণ, ফাটা জায়গাগুলোতে ক্ষীণ রক্তের দাগ শুকিয়ে কালচে রঙ নিয়েছে। মেহেরবানুর সেসবে তোয়াক্কা নেই। হাতের পুটুলিটা একহাতে বুকের সঙ্গে আগলে রেখে অন্যহাতে জটাচুলে আঙুল চালায় সে। উকুন বাসা বেঁধেছে জটার ভেতর, কামড়ে পাগল করে দিচ্ছে তাকে। মিস্ত্রিদের কাজে ভাটা পড়ে, বিকেল গড়ালে তারা সেদিনের মতো কাজে ইস্তফা দিয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরে।
মেহেরবানুর অগত্যা আবার মনে পড়ে দরজায় কড়া নাড়ার কথা। ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার একমাত্র ছেলে হাজী বক্কর আলীর বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ে সে। হাজী বক্কর আলী এ পাড়ার রহমত মিয়ার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে উঠেছে সে-ও প্রায় বছর ত্রিশেক হলো, মাকে পরিচয় দেয় না প্রায়, শ্বশুরের রেখে যাওয়া ‘বেনু মসলাঘর’ দেখাশোনা করে, ক্যাশ সামলায়। মেহেরবানু তবু ছেলের টানে মাঝেমধ্যে আসে এ পাড়ায়, উঁকি-ঝুকি দেয় এ বাড়ির দরজায়, কোনোদিন দরজা খোলে, কোনোদিন না। মেহেরবানু তবু আসে। একমাত্র ছেলেটার মুখটা একনজর দেখলে পরান জুড়ায় তার, যেন কাঠফাটা মাঠে সহসা শীতল বৃষ্টি নামে একটুকরো।
তুমাক না কইছি কতবার, এই বাড়িত আর আসপা না তুমি। তাও আসো কোন কামে? বেনু এসপ পচন্দ করে না, তা-ও বারবার হেনে আইসে ঝামেলা বাড়াও ক্যা আমার, অ্যাঁ?
-পেছনে হাজী বক্কর আলীর কণ্ঠ যেন আগুন ঢালে হঠাৎ। আমসি মুখে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় মেহেরবানু। বেতো শরীর থরথর কাঁপে। হাতে আর পায়ে রাবারের চুড়ি দিয়েছে কদিন আগে এক বেদেনী। বেতের ব্যথা কমেনি তাতে, শরীরের কাঁপুনি বরং বাড়ছে ক্রমশ। সুরুৎ করে ভেতরে ঢুকে যায় হাজী বক্কর আলী। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে যায় দুম করে। ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহেরবানু, ঘুরে দাঁড়ায়। মন্থর, শ্লথপায়ে এগোয়। বেশিরভাগ দিন স্টেশনে থাকে সে, কিংবা পথের ধারে কোনো সুবিধে মতো জায়গায়। পথই ঠিকানা তার, পথই আশ্রয়। অন্যমনস্ক মেহেরবানুর মনে হয় পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকে, মনের ভুল, ভেবে আবার এগোয় সামনের দিকে। শব্দটা জোরালো হয় এবার। আছড়ে পড়ে কানে। মেহেরবানু দাঁড়ায় ঘুরে। শব্দ লক্ষ্য করে তাকায়। হাজী বক্কর আলীর দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে কণা আবার ডাকে, ও দাদি!
নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না মেহেরবানুর, কানকেও। ঘোরতর অবিশ্বাসে কণার ঝুঁকে পড়া অবয়বের দিকে ক্ষীণ হয়ে আসা দৃষ্টিতে তাকায় মেহেরবানু। কণাও মেহেরবানুর দিকে তাকিয়ে আগের মতোই ঝুঁকে পড়ে বলে, ও দাদি! কোনে যাচ্চিস তুই? ভিতরে আসিসনে ক্যা?
আমাক কচ্চিস, ইঁ বু?
কা’ক কবো তয়? ভিতরে আয় তুই! -ধমকে ওঠে কণা, কণ্ঠে স্পষ্ট শাসন। মেহেরবানু ভ্যাবাচ্যাকা খায়। এ বাও পুরোই অচেনা তার, এমন অভিজ্ঞতাও এই প্রথম। সে আবার বলে, কী কচ্চিস, ও বু? কোনে আসপো আমি?
কানে শোনো না তুমি? বয়রা হইচো? বাড়ির ভিতরে আসো!
কণার ধমকে কুঁকড়ে যায় মেহেরবানু। কী করবে ভেবে পায় না, ইতস্তত করে।
ভিতরে আসতি কচ্চি তুমাক! তাড়াতাড়ি আসো কলাম! এখনই আসপা! কণা তাড়া দেয় আবার।
স্টেশনের শূন্য প্লাটফর্মে পাতা নিজের তেল চিটচিটে বিছানাটার জন্য বড্ড মন কেমন করে মেহেরবানুর, উতলা হয়ে ওঠে মন।
মেহেরবানু করুণ গলায় বলে, বু রে, আমি যাই, তুমার বাপ লাগ হরবিনি, মা তুমাক গাইল পাড়বিনি, আমি যেনে যাচ্চি সেনেই যাই। -বলে পা বাড়ায় মেহেরবানু। এক পা ফেলতেই পেছনে কণার কণ্ঠ ফুঁসে ওঠে, এই হারামি বুড়ি, তোক ডাকতিচি পচন্দ হচ্চে না সিডা, তেয় না? তাড়াতাড়ি ভিতরে আয় কলাম, নায়তে চ্যাংদুলা কইরে তুলে আনব কিন্তুক!
উপায়ন্তর না পেয়ে অগত্যা দাঁড়ায় মেহেরবানু। অসহায়ভাবে বলে, কেবা আসপো, ও বু? দরজা তো বুঁজোনে লয়চে!
তুই দাঁড়া হোনেই, আমি খুলতিচি আইসে!
বারান্দা থেকে মুহূর্তেই কণার ছায়া মুছে যায়। উল্টোদিকের বাড়িটার ছায়া ততক্ষণে লম্বা হয়ে গিলে নিয়েছে রহমত মিয়ার পুরোনো বাড়ি। তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে কণা। এক ঝটকায় হাট করে খুলে দেয় বাড়ির সদর দরজা। পুরোনো সেকেলে আমলের বাড়ির দরজায় শব্দ ওঠে ক্যাঁচক্যাঁচ। মেহেরবানুর বুকের ভেতরও শব্দ ওঠে জোর। ভয়ে বুকের ভেতরটায় কেমন ঢিব ঢিব করে।
আয়! কণা ডাকে জোরগলায়।
আইজ বিজিন কিয়ামত অবিনি, ও বু! বিড়বিড় করে মেহেরবানু।
চুপ করতো দাদি! যা অয় অবিনি, তোর ওসপ চিন্তা করা লাগবিনানে, তুই আয়!
দুরুদুরু বুকে একপা দু পা করে এগোয় মেহেরবানু, সামনে কণা। দোতলায় নিজের ঘরের বারান্দায় বসে এতক্ষণ মেয়ের কাণ্ড দেখছিল হাজী বক্কর আলী। বের হয়ে আসে এবার। ছেলেকে দেখে কণার পেছনে জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মেহেরবানু, সভয়ে কণার দিকে তাকায়। সেদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করে সোজা কণার মুখের দিকে তাকায় হাজী বক্কর আলী। কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে, কী হচ্চে এসপ অ্যাঁ? কী করতি চাচ্চিস তুই?
প্রায় তুড়ি মেরে বাপকে উড়িয়ে দেয় কণা। মুখে বলে, নিজির কামে যাও তো! দাদিক বাইত নিয়ালাম, আজকেত্তে দাদি আমা সাতে থাকপি! কোনো কতা কবা না।
ঝামেলা টাইনে বাইত নিয়ালি? তোর মা মানবিনি মনে করিচিস?
না মানলি আমু দাদির সাতে বাইত্তে চইলে যাবনে। তুমরা দুই জন সেহন শান্তিত থাইহেনে বাইত, কেমুন?
বক্কর আলী শেষবারের মতো বলে, তুই তো চইলে যাবিনি দুইদিন পরে হোস্টেলে, সেহুন করবিনি কী? তোর মা এই আপদ বাইত রাকপিনি মনে করিচিস?
নিজির মাক আপদ কতি তুমার লজ্জা করে না আব্বা? আমি চইলে গেলিই কী? দাদির কাচে মুবাইল দিয়ে যাবনে, ঘুণ্টায় ঘুণ্টায় খবর নেবনে ফোনে যে, আপদ বিদাই করার জন্যি তুমরা কী মন্তর জপতিচো হেনে বইসে।
মুখ চুন করে সরে যায় বক্কর আলী। তসবি নিয়ে বসে আবার বারান্দায়। দুনিয়াদারি পানসে লাগে। জীবন বড় বেশরম, বেরহম। যত সে চায় ঝুটঝামেলা থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে, কালিঝুলি গায়ে না মাখতে, ততই ঝুটঝামেলা এসে আঁকড়ে ধরে তাকে, কালিঝুলি তত এসে জাপটে ধরে গা-গতর। ভালো লাগে না তার। তসবি গোনা দ্রুততর করে অজান্তেই। বেনু বাড়ি ফেরেনি এখনো আজ। না জানি কী তুলকালাম সে বাধাবে বাড়িতে, বক্কর আলীর আধাপাগল মাকে বাড়িতে দেখে! ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে বক্কর আলীর, ঠোঁট নড়ে বিড়বিড়।
মেহেরবানুকে নিজের ঘরে এনে সাবান, শ্যাম্পু দিয়ে বাথরুমে পাঠায় কণা। পইপই করে শিখিয়ে দেয় ভালোমতো গোসল সেরে বের হতে। মেহেরবানুকে বেনুর একটা ম্যাক্সি পরিয়ে হেসে গড়ায় কণা। মেহেরবানুর ছোটখাটো শরীরটা বেনুর লম্বা ম্যাক্সির মধ্যে হারিয়ে গেছে প্রায়, পায়ের নিচে গড়িয়ে পড়ছে অনেকটা। হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলে কণার গায়ের ওপরই পড়ছিল সে। জটাবাঁধা চুলে চিরুনি চালাতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে কণা, জেরবার হয় ঘেমে।
কতবছর চুলে চিরুনি দেও না, ও দাদি? বিরক্ত হয়ে বলে কণা।
আমি কাঁহই কোনে পাব রে বু, যে চুল আইচড়োবো? মেঝেতে পা মেলে বসে, নাতনির এই অনাস্বাদিত আদরটুকু চোখ বুঁজে নিতে নিতে উত্তর দেয় মেহেরবানু। উত্তরটা কণার কানে খট করে লাগে। জেদি, একরোখা স্বরে সে বলে, শোনো বুড়ি, এই যে তুমাক বাড়িত উটোলাম আমি, যদি এই বাড়িত্তে এক পা বাড়ায়চো আবার কোনোদিন, তালি কলাম খবর আচে তুমার, হুঁ!
তোর মা-বাপ থাইকপের দিলিসিন! ফুট কাটে মেহেরবানু।
চোপ বুড়ি! যে যা কয় কোইকগো, এক কান দিয়ে শুনবি, আর এক কান দিয়ে বাইর করে দিবি, কিন্তুক এই বাড়ির বাইরে যাবিনে এক পা-ও, বুচ্চিস?
হ, যাব নানেকো। আরামে প্রায় ঘুমিয়ে পড়ে মেহেরবানু, উত্তর দেয় জড়ানো স্বরে।
বেনু ঘরে ফিরেছে অনেকক্ষণ। মেয়ের কাণ্ড দেখে অধিক শোকে পাথর বনে গেছে সে। থমথমে মুখে কাজ করছে সংসারের। কণা সেসব গায়ে মাখে না। নিজের ঘরে মেহেরবানু আর তার খাবার এনে খায়, মেহেরবানুকেও ধমকে নির্দেশ দেয় খাওয়ার। খিদেয় পেট জ্বলছিল মেহেরবানুর, গপাগপ খায় সে, এক চুমুকে পানি খায় অনেকটা। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ কণা প্রশ্ন করে, দুপুরি কী খাইচিলি, ও দাদি?
মেহেরবানু খানিকটা অবাক চোখে তাকায়, বোকাটে মুখে প্রশ্নটা বুঝতে চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। যেন বুঝেছে, এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলে, ও, দুইপর বেলা? সেহুন আবার কী খাব রে বু! ওদো পানি খাইচিলাম মজ্জিদির কলেত্তে।
মেহেরবানুর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয় কণা। কী বলবে ভেবে পায় না আর। খাওয়া সেরে মেহেরবানুকে নিজের বিছানায় শুইয়ে দেয়, নিজে মেঝেয় বিছানা পেতে শোয়। মেহেরবানু টুকটুক গল্প জমাতে চায় তার সঙ্গে। সাড়া দেয় না কণা। মেহেরবানু উসখুস করে। কণার পরিষ্কার, নরম বিছানায় গা কুটকুট করে তার। স্টেশনের শূন্য প্লাটফর্মে পাতা নিজের তেল চিটচিটে বিছানাটার জন্য বড্ড মন কেমন করে মেহেরবানুর, উতলা হয়ে ওঠে মন।
চলবে…