পর্ব-১
দুপুরের পর কাস্টমার তেমন একটা থাকে না কারখানায়। ক্যাশের গদিতে বসে ঝিমোয় হাজী বক্কর আলী। ভাদ্রের গরম টিনের চালে আগুন ঢালে এ সময়। বক্কর আলীর গৌরবর্ণ ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে আরও। সুন্নতি তরিকায় কামানো দাড়ি বেয়ে পানের খয়েরি কষ আপসে গড়ায়। মাথার ওপর ফুলস্পিডে ঘুরতে থাকা ফ্যান যেন লু হাওয়া ছাড়ে। শরীর জ্বলে, চিটচিটে হয়ে ওঠে ঘামে। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ঘেমে লেপ্টে যায় শরীরের সাথে, মাথায় প্যাচানো পাগড়ি বেয়ে ঘাম গড়ায়, কানের পাশ দিয়ে ক্ষীণধারায় নামতে থাকে।
বক্কর আলী গা করে না তেমন। গদিতে বসেই ভাতঘুমের সুখটা ষোলোআনা উসুল করতে তৎপর সে, উদগ্রীব। জীবনের এতসব উটকো ঝামেলাকে আমলে নিলে জীবন আর জীবন থাকে না শেষতক। ঝুটঝামেলায় গিলে খেলে জীবন হয়ে ওঠে নর্দমা, জানে বক্কর আলী। সে তাই যতটা পারে সুখ আদায় করে নেয় জীবনের ঝোলা নিংতে। যে দু চারজন কাস্টমার আসে এ অলস সময়টায়, বেনু একাই তখন সামলায় তাদের। দুজন কর্মচারীই দুপুরের খাবার খেতে যাওয়ার নাম করে হাওয়া হয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে উল্টোপাশের নারকেল গাছের ছায়া স্থূল থেকে কৃশ আর খর্বকায় হয়ে ওঠে অনেকটাই। বেনু তার অকেজো, অসাড় আঙুলগুলো, বেঁকে যাওয়া ডানহাত, অনর্থক শরীরের সঙ্গে ঝুলিয়ে, প্রায় অচল ডানপা ছেঁচড়ে ঘূর্ণায়মান মেশিনের মধ্যে বামহাতের সবটুকু শক্তি জড়ো করে কাস্টমারদের এগিয়ে দেওয়া বস্তার ভেতরের বস্তুগুলো ঢালে, মেশিনের ভটভট শব্দের সঙ্গে তারও শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে অদ্ভুত ছন্দে, আর সে, নির্ণিমেষ সেদিকে তাকিয়ে থাকে, যতক্ষণ না মেশিনের হা করা মুখ গিলে নেয় তার মধ্যে ঢেলে দেওয়া সবিশেষ বস্তুটুকু। বেনুর লালচে ফর্সাগালগুলো লাল হয়ে ওঠে আরও, ফর্সা,ভারী শরীর রঙিন হয়ে ওঠে বহুবিধ মসলার রঙে, পিঠময় ছড়ানো ঢেউ খেলানো চুলে মসলার গুঁড়ো যেন রঙিন ঢেউ তোলে আরও।
বিষচোখে সেদিকে আরেকবার তাকিয়ে সদ্য আসা বুড়োটার দিকে তাকায় বেনু। বলে, এই তো চাচা, এরপরেই উওর সিরিয়াল। হয়া যাবিনি খানিক বাদেই।
সে একমনে মেশিনের উদরস্থ বস্তুটুকু বামহাতের ধরা ব্যাগে গড়িয়ে হওয়া পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। সবটুকু গড়িয়ে গেলে ব্যাগ ফেলে অদ্ভুত ক্ষীপ্রতায় বন্ধ করে মেশিনের সুইচ। তারপর, সামনে অপেক্ষমান কাস্টমারের হাতে ব্যাগ বুঝিয়ে দিয়ে নতুন কাস্টমারের হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নেয় বাড়িয়ে দেওয়া ব্যাগ, ঢেলে দেয় আগের মতোই মেশিনের হা করা মুখে। সময়টা পুনরাবৃত্তির ভারে হাঁপিয়ে ওঠে, মেশিনের একঘেয়ে শব্দ নাভিশ্বাস উগড়ে দেয় বিরক্তিতে, বেনু তবু চিত্রার্পিতের মতো কাজ করে যায় নিজের। তার মুখের রেখায় বিরক্তির লেশমাত্রও ফোটে না, পড়ে না হাঁপিয়ে ওঠার ক্ষীণ কোনো ছায়াও। কাস্টমারদের কেউ কেউ বেনুর শরীরের অসামঞ্জস্যতায় আড়চোখে তাকায়, নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে, কেউ বা হঠাৎ বিস্ময়ে শব্দ তোলে অস্ফুট। বেনু সেসবে গ্রাহ্যমাত্রও না করে নিজের কাজ করে যায়। তাকে নিয়ে পৃথিবীর অহেতুক কৌতূহল আর অকারণ গুঞ্জনে বিন্দুমাত্রও আগ্রহবোধ করে না সে, নিজের আচরণে সে কথা সে জানিয়ে দেয় অকপটে। মাঝে মাঝে সে গদিতে বসা বক্কর আলীর দিকে তাকায়।
বক্কর আলী এ সময় যোহরের নামায সেরে বসে বসে ভাতঘুম সারে ঠিকই, তবে কাস্টমারদের কাছ থেকে কড়ায়গণ্ডায় হিসেবও সে বুঝে নেয় ফাঁক-ফোকরে। তার চোখ এড়িয়ে কোনো কাস্টমার পয়সা মেরে দিয়ে পালাবে, তেমন যো নেই, জানে বেনু। আর তাছাড়া কাস্টমারদের সবাই প্রায় চেনা, একই মহল্লার। হঠাৎ হঠাৎ দুচারজন আসে বটে দূর থেকে, তবে তারা কেউ পয়সা মেরে দেওয়ার ধান্দায় থাকে না। বেনুর চোখ অন্যদিকে। ও পাড়ায় ধুমসি বিধবা মাগি নাজিফা এ পাড়ায় দুধ বিলি করতে আসে এ সময়টায়। বেনু মসলাঘরের কাছাকাছি এসেই তার চলার গতি শ্লথ হয়ে আসে ইদানীং, হাজী বক্কর আলীর দিকে সে কেমন রহস্যময় চোখ-মুখ নিয়ে তাকায়, দেখেছে বেনু। আর হাজী বক্কর আলীও যেন বেমক্কা পাঁজি হয়ে ওঠে তখন, কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে তার তাকানোর ধরন-ধারণ। বেনুর সেসব ভালো ঠেকে না মোটে।
ডানপাশটা প্যারালাইজড হওয়ার পর থেকেই ব্যাপারটা যেন বেশি করে চোখে পড়ছে আরো। নাজিফার আসার সময় হলেই কেমন উদাস উদাস হয়ে ওঠে বক্কর আলী, ছটফট করে। ক্যাশের গদি ফাঁকা রেখে উঠে গিয়ে সামনের দিকে পায়চারি করে অকারণ, একপাশের ধূলোপড়া বেসিনের আয়নায় মুখ দেখে খানিক পর পর, চুলে টেরি কাটে মাথার পাগড়ি নামিয়ে, দাড়িও আঁচড়ায় মাঝে সাঝে। বেনু আড়চোখে দেখে। মুখে বলে না কিছুই। তক্কে তক্কে থাকে সে। হারামজাদি নাজিফাকে একদিন আচ্ছামতো ঝাড়বে সে, সবকটা পিরিতের পোকা সে বেছে বের করে দেবে মাগিটার মাথা থেকে, মনে মনে সেটা ঠিক করা আছে তার।
বোকা নয় বেনু। হাজী সাহেবের পাঁজি হওয়ার সাধে আপাতত ঘোল ঢালবে না সে, রঙ্গ দেখছে সে, দেখবে দিনকতক। তারপর মওকা মতো ধরবে গলা টিপে। হাজী মিনসের রস চিপে বের করবে সে, বিধবা মাগির পিরিতের নেশাও টুটাবে জন্মের মতো। ঘুঘু দেখেছ, বেনুর ঘুঘুধরা ফাঁদ আজও দেখনি হে সোনাচান্দেরা! -মনে মনেই কথাগুলো আওড়ায় বেনু, উল্টোদিকের পথ দিয়ে দুহাতে পাস্টিকের বোতলে ভরা দুধের ভারী ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাওয়া নাজিফার ভরাট শরীর আর ক্যাশের গদিতে বসা বক্কর আলীর চকচকে মুখের দিকে তাকিয়ে।
কী রে? এখুনও হয়নিকো তোর? -শুঁটকো নাতিটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে আসে তার বহুমূত্র রোগে ভোগা বুড়ো দাদা। সেদিকে তাকাতে গিয়ে বক্কর আলী আর তার পিরিতের ময়না নাজিফার দিক থেকে চোখ সরে যায় বেনুর। সেই ফাঁকে তার নজর থেকে পিছলে যায় নাজিফা, চলে যায় বেনু মসলাঘরের আড়ালে। বক্কর আলীর চোখ তখনও নাজিফার চলে যাওয়া পথের দিকে। বিষচোখে সেদিকে আরেকবার তাকিয়ে সদ্য আসা বুড়োটার দিকে তাকায় বেনু। বলে, এই তো চাচা, এরপরেই উওর সিরিয়াল। হয়া যাবিনি খানিক বাদেই।
বেনু মসলাঘরের একচ্ছত্র মালিকানা তার, কাউকে গ্রাহ্য করার তার সময় নাই, দরকারও নাই।
ও। আজ এমুন ভীড় যে এ সুময়? তোর মেশিন তো এ সুময় খালিই থাহে জানতাম। সেজনি্যই তো উওক এ সুময় পাটালাম।
আর কবেন না চাচা। হারামজাদা ছেঁড়াদুডে সেই যে দুপুরি খাবি কয়া বারায়চে, আর আসার নামগন্দও নাই তারে। তা না হলি মেশিন তো দুডে খালিই যাচ্চে। আমি একলা হাতে আর কত সামলাব কন। আরেকজন তো গদিত বসে রঙিন স্বপন দেহায় বিরাট ব্যস্ত, দেহেন না!
কথাগুলো হাজী বক্কর আলীর দিকে ছুড়ে দিতে দিতে নিজের কাজ করে যায় বেনু। বুড়ো লোকটা বেনুর উষ্মার কারণটা ঠিক বোঝে না। সদ্য মেশিনের উদর ফুঁড়ে বের হওয়া গরম মসলার ব্যাগটা বুঝে নিয়ে লোকটা ক্যাশের গদিতে বসা বক্কর আলীর দিকে এগোয়। বাচ্চা ছেলেটা যায় পেছন পেছন। মসলাঘর থেকে বের হওয়া হরেক মসলার মিশেলের গন্ধটা ভারি ভালো লাগে তার। নাক দিয়ে টেনে নিতে থাকে যতটা পারে। মেশিনের পেট থেকে বের হওয়া বহুবিধ মসলা আর শব্দ তার মধ্যে অন্যরকম একটা আবেশ এনে দেয়। তার দৃষ্টিতে ভয় আর সমীহ ভাসে, দূর থেকে একমুহূর্ত তাকিয়ে দেখে বেনু। নিজের শৈশব ছেলেটার চোখের তারায় ছবি হয়ে ফুটে উঠতে দেখে বেনু। চোখ সরিয়ে নেয় মুহূর্তে। একটা দীঘল দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে চুপিসারে। তখনই ফোনটা সজাগ হয়ে ওঠে ভীষণ। কোমড়ে ঝুলিয়ে রাখা ছোট্ট ঝোলাটার ভেতর ফোনটা কী এক অভিমানে ফুঁপিয়ে ওঠে যেন হঠাৎ।
কাজ ফেলে ফোনটা হাতে নেয় বেনু। অনায়াস অভ্যস্থতায় কানের কাছে রেখে বলে, হ্যালো!
ওপাশ থেকে কী বলে বোঝা যায় না স্পষ্ট। মেশিন ঘরে দুম করে নামা নীরবতা চিরে আবার সে বলে ওঠে, হ্যালো, কে?
কিছুক্ষণ চুপচাপ ওপাশের কথা শোনে বেনু। রা করে না মুখে। ওপাশে যে আছে সে বলে যায় একনাগাড়ে। বেনু শোনে। হু হ্যাঁ করে মাঝে মাঝে। উপস্থিত কাস্টমারেরা উসখুস করে, দেরি হয়ে যাচ্ছে তাদের। ক্যাশে বসা হাজী বক্কর আলীও তাকায় আড়চোখে, উঁকিঝুঁকি দেয়। পাত্তা দেয় না বেনু। কোনো তাড়া নেই তার। পৃথিবী ছুটছে, জানে সে। ছুটন্ত সে পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিয়ে লাভ নাই কিছু। হুমড়ি খেয়ে পড়া ছাড়া শেষ পর্যন্ত আর কিছুই জোটে না এক জীবনে, সেটাও জানে বেনু। সে তাই তোয়াক্কা করে না কিছুর, অকারণ ব্যস্ততায় কারও কাছে বিকোয় না নিজের সুখটুকু। ওপাশের কথায় বিরতি পড়ে, হয়তো বেনুর প্রত্ত্যুত্তোর প্রত্যাশায়ই। বেনু কাস্টমারদের ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, নিচু, ধারালো কণ্ঠে ফোনটা মুখের খুব কাছে নিয়ে বলে, রঙ্গ করো আমার সাথে, না? তামশা করো? ভাবছ, কোনো খবরই আসে না আমার কানে? সব জানি। সব শুনছি। নিগ্রো বান্ধবী নিয়ে লিভ টুগেদার মারাচ্ছ ঢাকায়, সেসব খবর আমার কানে আসে না মনে করো? ফোন রাখ এখন। বহুত কাম আছে আমার। তোমার মতো সাইকেল চালায় বিশ্বজয় করার ধান্দা নাই আমার, কাম করে প্যাট চালাই, বুচ্ছ?
ঠাস করে ফোনটা কেটে কোমরের ঝোলায় রেখে দেয় বেনু। যেন কিছুই হয়নি ভঙ্গিতে মন দেয় কাজে। কাস্টমারেরা এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। কেউ বা মুখ টিপে হাসে। গ্রাহ্য করে না বেনু। একমনে কাজ করে। বেনু মসলাঘরের একচ্ছত্র মালিকানা তার, কাউকে গ্রাহ্য করার তার সময় নাই, দরকারও নাই।
চলবে..