॥ পর্ব-২॥
যে মেয়েটি কাঁকই খুঁজছিল, তার দায়িত্ব পড়ে ডুকনির ওপর অর্থাৎ বেদে বহরের সবচেয়ে বয়সী নারীর ওপর। তার কাছ থেকেই শিখে নিতে হয় নানা কৌশল। এগারো বছর বয়স হলেই বেদেকন্যারা নানি-দাদির অভিজ্ঞতার পাঠ নেয়। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে যায় গাওয়ালে। এভাবেই সে পাকাপাকি বেদেনী হয়ে ওঠে। নানি-দাদির কাছ থেকে ছলাকলার নানা কৌশল শিখে সেও বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। যে মেয়েটি কঁকই খুঁজছিলো তাকে কথা শোনানো যাচ্ছিলো না কিছুতেই। শেষমেশ ডুকনি বহ্নি বুলবুল করে ওঠে, ‘বিছুট পোদেলী’ শুসকার পোদলী-কালনাগিনীর ছাও, চন্দ্রবোড়ার ছাও। কিছু আসে যায় না মেয়েটির। কালসাপের ফণার মতো দু’পাশে দুই বেণী নাড়িয়ে সে ফের বলে, ‘তু আর বেশি কানি বিয়ইস নিঠু’ কিছু জানিস নে তু-চুপ রাও বুড়ি! ডুকনি খেপে যায়। রাগে কাঁপতে থাকে। পুঁচকে মেয়েটা বলে কিনা সে কিছুই জানে না। অথচ চিরকাল সর্দাররা ডুকনিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সর্দারি করছে আর এই পুঁচকে মেয়েটা বলে কিনা সে কিছুই জানে না। এবার মেয়েটি হিলহিল করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বুড়ির গায়। সেই হাসির শব্দে চন্দনার শরীরখানাও কেমন মোচর দিয়ে ওঠে। নৌকার নিষ্প্রাণ দেহে প্রাণের স্পন্দন সঞ্চারিত হলে সেও দুলতে থাকে। চোখে-মুখে কৌতুকের ভাবখানা বজায় রেখে নৌকার দুলুনি উসকে দিয়ে বলে, ই দেখ বুড়ামা-তু দেখ মোসিলের সাথে কেমনি লাচতে হয় তা কোঠিখানাও শিখে লিছে। এবার বুড়ি তার ফোকলা দাঁতের হাসি উপহার দেয় মেয়েটিকে। বৃদ্ধা দুখানা পা টান হরে পাশে রাখা সাপের ঝাঁপিতে হেলান দিয়ে বসে তরুণীর একটা হাত নিজের শীর্ণহাত দিয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নেয়। বলে, ‘শোনরে গুমো!’
হ্যাঁ গুমোই বটে জাত গোক্ষুর-সত্যিই বড় ভয়ানক সাপ! চোখ পিটপিট করে তাকায় মেয়েটার দিকে। ছানিপড়া অভিজ্ঞ চোখ। বুঝতে চেষ্টা করে নাতনি তার সত্যি ভয়ানক কিনা কিংবা গোখারোন মতো অবিশ্বস্ত কিনা। তারপর আসল কথাটা ভুলে গিয়ে বলে, ‘বুজলি বাইদ্যার সোমাজই সব। সোমাজের বাইরে কোন বাইদ্যা নাই, মাঙ্গতা নাই। সোমাজের বাইরে তার কুনো পরিচয় নিঠু। কেমতে হইলো তোর সোমাজ? বুড়ি হিস হিস করে ওঠে। রাম রাম! ওকি কথা! সমাজ তোর লয়? আবার কুশনি শরীর দুলিয়ে চোখ নাচিয়ে খিলখিল করে হাঁসে। বুড়ি বিরক্ত হয় না। পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, ‘অত হাসিস না-অত নি হাসতে হয়? ফের সেই হাসি। এতা কাজোদের কথা। ভদ্দর নোকের মেয়াদের বেশি হাসতে মানা। হাম কবে ভদ্দর নোকের মেয়া হলাম, না তোর সোমাজ ভদ্দর নোকের সোমাজ হলো বুড়িমা? অভিজ্ঞ ডুকনি মনে মনে প্রমাদ বকে। এ মেয়ে একদিন বাইদ্যা সমাজের মান না খুইয়ে ছাড়বেনা। ঢের দেখা তার। কত ঘটনার সাক্ষী সে। কিন্তু তাতে কী এসে যায়? সব ঘটনা তো বলতে হয় না! এ জ্ঞান সে পেয়েছিলো খানিক দাদি-নানির কাছ থেকে আর বাকিটা অভিজ্ঞতা দিয়ে। বেদেদের সঞ্চয় নেই। সঞ্চয় করতে সে জানে না। সে জানে এক হলো কতা গোপন করতে, দুই গল্প ফাঁদতে। এ কাজে তাদের জুরি মেলা ভার। খলবল করে ওরা কত কথা বলে! কত ঝগড়া-বিবাদ, তবু কিছুতেই মুখ ফসকে ওরা আসল কথাটা বের করবে না। ওরা গল্পের পর গল্প বলবে তবু আসল গল্প তারা বলবেনা। কিছুতেই না। হয়তো একটা একটা গল্প ফাঁদতে ফাঁদতে ওরা আসল গল্পটাই ভুলে ভুলে বসে থাকে। এই গল্প বলা পর্যায়ক্রমে শেখাতে হয় অন্য বেদেনীকে। ডুকনি বুড়ি ছাপ্পরের ফুটা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে বাইদ্যা যেমন নাম কামায় তেমনি কামায় গল্প। ডুকনি সেই গল্পই শোনাতে চায় কুশনিকে। কিন্তু সেই চঞ্চলা হরিণীকে কথা শোনাবেকি তাই ভেবেপায় না ডুকনি। নৌকার আইন ভরায় পা দিয়ে কুশনি অন্যমনস্ক হয়। বুড়ির উপস্থিতি ভুলে সে গান ধরে,
রুমু ঝুমু বাক পরা
কানে বদম ফুল
নেচে নেচে কুল ঘুচাইস না-দি গো…
ঝুমুর গানের আকুলতা কি পৌঁছবেমনা মাঝির ভাইপোর কাছে! কুশনি জানে না। গানের তালে নিজের শরীর দুলে উঠতেই কোঠিখানায় শব্দ হয় ঢেউয়ের তালে, ‘দাত্রা হিত্বা দাং হিত্বা ঘোট্রিক।’ সে গলা চড়ায়। গত বছর মনা মাঝির ভাইপো রহমালী এসেছিলো কুশনির বাপের কাছে। বাজারে নাম করা কামার থাকতে মাছ-মারার ল্যাজা অর ঝুপি বানাতে এসেছিলো সে লস্কর বাইদ্যার কাছে। মায়ের সাথে গাওয়াল করতে গিয়ে সে রহমালীকে গল্প দিয়েছিলো, ‘আমার বাপের মতো। মাছ মারার ল্যাজ্যা ঝুপি আর কেউ নি বানাবার পারে? হাঁ তু-যাইস। বলতে গিয়ে খামুরের সাথে একবার চোখাচোখি হয়ে যায়। বুকের ভিতরডা কেমন-ঝিম মেরে যায়। তারপর সত্যি-ই সে এসেছিলো কুশনির বাপের কাছে। রহমালীও শুনেছিলো বাইদ্যাদের দিয়ে মাছ মারার ঝুপি ট্যাঁটা বাইনাইলে তাতে মাছ মারা যায় বেশি। এর জন্য দশটা টাকা আর প্রথম মাছ খান দিতে হয় বাইদ্যারে। রহমালী কখন মাছ নিয়ে দ্বিতীয়বার আসবে সেই ভাবনায় কুশনির ঘুম হয় নাই রাতে। কুশনি জানে খামুর অর্থাৎ গৃহস্থদের বিশ্বাস নাই। খামুরারাও কি বিশ্বাস করে বাইদ্যাদের? করে না। তবু কুশনির অন্য কিছু ভাবতে মন সায় দেয়না। সে ভাবে রহমালী আসবে, ঠিক আসবে। রহমালী বিরাট এক শোল মাছ নিয়ে এসেছিলো। খোলা গা, কাদায় ডোবানো পা, মাথায় গামছা বাঁধা, হাতে ঝুপি-দেখে কে বলবে সে খামুর লিমরদ। সত্যি তাকে গৃহস্থ পুরুষ বলে মনেই হয়নি কুশনির। মাছটা রেখে যাওয়ার সময় দুই বেনি নাড়িয়ে কুশনি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। অকারণেই হিলহিল করে হাসে। বলে ‘ইস বাবু -ছেমলো তো দিলি আর কিছু নি দেগলে? রহমালী বিব্রত হয়, ভেবে পায় না অর কী দেবে সে! মুখের দিকে ভ্যাবাচ্যঅকা খেয়ে চেয়ে থাকে আবার কুশনি হাসতে থাকে। হাসির গমকে শরীর যেন ঝুরঝুর করে ভেঙে যায়। ই বাবু! তু কেমন বিহুচেছ বাবু? কুশনি জানতে চায় কেমন আছে সে। রহমালী কেবল তাকিয়ে থাকে কুশনির মুখের দিকে।
চলবে…