॥এক॥
একে তো বর্ষাকাল, তার ওপর একাদশী। চন্দনা আর চন্দনা থাকে না, নির্লজ্জ নারী হয়ে ওঠে। প্রিয়স্পর্শের জন্য ব্যাকুল হয় সে। মতিভ্রম হয়। মধুমতির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে সে ঢুকে পড়ে হারু মাঝির হলুদ ক্ষেতে, নয়তো বিলাস বাউড়ির গোয়াল ঘরে। ব্যস্ত হয়ে ওঠে সমস্ত গ্রাম। কিছু যায়-আসে না চন্দনার। যায়-আসে না গ্রামের কিশোর-কিশোরীদেরও। চন্দনার শরীর উপচানো নতুন জলে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের হুল্লোড়। শুরু হয় জলের সঙ্গে মাতামাতি। কলাগাছের ভেলা ভাসিয়ে হারু মাঝির এগারো বছরের কিউপিড ছেলে লগি হাতে বরুণ দেবকে চ্যালেঞ্জ করে। ওপাশে জোড়া বুনো নারকেল ভাসিয়ে নিয়ে সাঁতার শেখে তারই সহোদরা হালিমন। চন্দনার শরীর উপচানো জলে গাঁয়ের উত্তর পাশে কলিম ব্যাপারী, মনা মাঝির আউশগুলো লকলক করে বেড়ে ওঠে। ওপাশে হোগলার বাঁদার মধ্যে ডাহুক পাখা ঝাপটায় ডাহুকির সঙ্গে। ধইঞ্ঝার ক্ষেতে একহাঁটু জলে হাঁসেরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে খোঁজে গুগলি শামুক। খয়েরি হাঁসটা সাদা হাঁসটার মাথায় ঠোঁট রেখে জলে ডুবে যায়। হারু মাঝিদের বাড়িটা পাশ কাটিয়ে বশিরের ঘাট বরাবর শ্মশান খোলার কাছে কুণ্ডুলি পাকিয়ে বাঁক নেয় চন্দনা। কোনোদিকে ফিরে তাকানোর ফুরসত নেই চন্দনার। সে নিম্নগামী হয়।
এই স্রোতে গা ভাসিয়ে ১০-১২ খান নৌকা এসে লাগে বশিরের ঘাটে। ঠিক বশিরের ঘাটে নয়, তার থেকে একটু পশ্চিমে সরে পুরনো শ্মাশান খোলার কাছে। ঠিক চন্দনার নাভিমূলে। প্রতি বছরই নৌকাগুলো আসে এখানে। শ্মশান খোলার পাশে বেশ খানিকটা খোলা মাঠ। সেখানেই বিষু সর্দারের দল নৌকা ভেড়ায়। লগি পুঁতে সে লগি ধরে তাকায় এদিক-ওদিক। বোঝার চেষ্টা করে তার আশপাশে আর কোনো বেদে বহর আছে কি না। নৌকা ভিড়তেই কোলাহল শুরু হয়। বাচ্চাগুলো হুড়হুড় করে বের হয়ে আসে ছইয়ের ভেতর থেকে। শ্মশান খোলার দেড়শ বছরের প্রাচীন নীরবতা ভেঙে ক’জন ঝপাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে চন্দনার জলে। বাকিরা স্বভাবমতো সেঁধিয়ে যায় কাদার মধ্যে যেন কাদাখোঁচা চ্যাগা পাখি সব। সবশেষে যে নৌকার মধ্য থেকে নামলো, সে এসে দাঁড়ায় চ্যাগাগুলোর পাশে। সবচেয়ে যে ছোটটা সারা গায়ে কাদা মেখে হাওয়ায় ভাসছে, তাকে ডেকে বললো—আবার তুইনি আমার কঁকই ধরছিলি?
জিভ উল্টে নাকের পোটা ছোঁয়ার চেষ্টা করতে করতেই হাওয়া বিবি ফিরে তাকায় অগ্রজের দিকে। হাওয়ার নির্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে একই প্রশ্ন। কিন্তু যাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করা হলো, সে একহাতের তালুতে কাদা রেখে আর এক হাতের তালু দিয়ে ঠকাস ঠকাস শব্দ করতে থাকে। রাগে-ক্ষোভে প্রশ্নকারিনীর কানের লতি যেমন কাঁপতে থাকে, তেমনি বুকের মধ্যিখানটাও ওঠানামা করতে থাকে। চোয়াল শক্ত করে সে ঠাস করে হাওয়া বিবির খোলা পিঠে চড় মেরে দুপদাপ শব্দ করে ফিরে যায় নৌকায়। হাওয়া বিবি কাঁদলো না—আপন মনে মাটি দিয়ে আপন প্রতিমূর্তি নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে গেলো
বিষু সর্দারের নির্দেশমতো অভ্যস্ত হাতে তাঁবু টাঙাচ্ছে পুরুষেরা। ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যদের চেয়েও তাদের হাতের দক্ষতা বেশি। শতাচ্ছিন্ন তাঁবুগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কমদামি পলিথিন। কাজ শেষ হতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। বিষু মান্তা নিজের নৌকায় গিয়ে বসে পাশে রাখা ময়লা গামছাটা টেনে নিয়ে ঘর্মাক্ত শরীর মুছে নেয়। তারপর গামছাটা কোমরে বেঁধে নেমে আসে। পরিত্যক্ত শ্মশান খোরাটার দিকে আগায় সে। সেখানে ঘাস আর জঙ্গলে ঢেকে আছে ভাঙাচোরা কয়খানা মঠ। বিষু বাইদ্যা টের পায় তার কাঙ্ক্ষিত প্রাণীর উপস্থিতি। সে তার অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার যথার্থতা প্রমাণ করতে খলিলকে ডাকে:
খইল্লা…খইল্লারে…
জ্বি মামু।
ই দিক্ আইসসনি একবার?
আইতাছি।
হাতের শাবল ফেলে ছুটে আসে খলিল।
কও মামু।
কান পাত, ইখানে পা রাখ্-কি বুঝলি?
হাসে বিষুবাইদ্যা। পান খাওয়া কালচে দাঁত বের করে হাসে।
খলিল সাবধানে ডান পা এগিয়ে দেয় বিষু বাইদ্যার নির্দেশিত স্থানে। তারপর স্থির হয়ে একটা কিছু বোঝার চেষ্টা করে। বড় বড় চোখ কপালে তুলে অস্ফুট স্বরে বলে, মামু! ওমো মইয়াল। ওমো আছে মামু। দূর পাগলা! তেনাদের নাম নি নিতে আছে? খলিল জানে কিন্তু আবেগে উচ্ছ্বাসে বের হয়ে যায়, মুখ ফসকে। মামা-ভাগ্নে সন্তর্পণে পা ফেলে সরে আসে দুজন। মেয়েরা কেউ এখানে নাই। সব গাওয়ালে গেছে দলে থাকে বাচ্চা, বৃদ্ধ বৃদ্ধা আর পুরুষেরা। পুরুষদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা হয় তারা কেউ যায় বান্দর নাচ দেখাতে, কেউ যায় ভেল্কি দেখাতে। যে যেখানেই যাক, সন্ধ্যার মধ্যে সবাই ফিরে আসে ছোট্ট ডেরায়। সর্দার খোঁজ নেয় প্রতি নৌকায় কে ফিরলো আর কে ফিরলো না; কে কী রাঁধলো, কে কী খেলো বা খেলো না। যার ঘরে রান্না হয়নি, খাওয়া হয়নি সেই ঘরে পৌঁছে যাবে খাবার। বছরের পর বছর এই নিয়মই চলে আসছে বেদে বহরে। কোনো ডেরায় অভুক্ত বেদে রাতে ঘুমায় না। সর্দারই তার খাবারের ব্যবস্থা করে। সর্দার ব্যবস্থা করবে বলে যে বেদেরা কাজে ফাঁকি দেব তা নয়। বেদেদের চাহিদা খুব কম। কোনোভাবে খাওন খরচ উসুল হলে তারা মেতে ওঠে খোশগল্পে। গঞ্জের কোনায় বড় আমগাছটার নিচে বনে একে অপরের মাথায় বিলি কাটে, উকুন বাছে আর পান খায়। কেউ বা দাঁতে গুল লাগায়। পিঠে বাঁধা বাচ্চাটা চ্যাও করে উঠলে বুক উদোম করে দুধ দেয়। হাঁটুরেরা ফিরেও তাকায় না। যারা তাকায়, বেদেনী টের পেলে তাদের শুনতে হয় গালাগালি—ছেনালের ঘরের ছেনাল। তারপর মুখ কাচুমাচু করে তারা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
চলবে…