পর্ব-৯
মেয়েটার জন্য প্রচণ্ড খারাপ লাগছে তার। কিন্তু তার যেহেতু বাবা, সেহেতো কোনো-না-কোনোভাবে রেহায় পেয়েই যাবে। আমার অবস্থা। ভাবতেও গা শিউরে ওঠে ইনসানের। এত কষ্টে গড়া এই দেহটাকে শুধু একটা সামান্য আবেগের বোকামির জন্য বলি দেওয়ার কোনো মানেই নেই। পরের বাড়ি কাজ করে আনা মায়ের এঁটো খাবারে তিলে তিলে তৈরি এই শরীর। এই শরীর ময়নাদের মতো কোরমা-পোলাও খাওয়া নাদুস-নুদুস শরীর না। যখন তোমরা তুলে খেতে পারো না, তখন ইনসান নিজের খাবার নিশ্চিত করতে চৌধুরী সাহেবের পেটে তেল মালিশ করে। ফাঁকেফুঁকে ক্রিকেট খেলে। তার ফাঁকেই যায় স্কুলে। ফলে খবরদার একটা টু-শব্দ হবে না। তবে হ্যাঁ, এই এখন যদি পেছন থেকে এসে কেউ ধরে ফেলে আর মামার দায়ের বাঁকানো মাথাটায় ইনসানের মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দেয়, সে অন্য কথা। স্বাদের জীবন তখনই শেষ। অবশ্য ইনসানের কাছে স্বাদ, অস্বাদ আর বিস্বাদ বলে কিছু নেই; একটা হলেই হলো। জীবনটা নিয়ে যদি সবার চোখে ধুলো দিয়ে কোনো মতে পালিয়ে যাওয়া যায়। শহরটা থেকে বেরুনো যায়; ব্যস হয়ে গেলো। বাকি কিছু নেই, এবার চলো ইনসান অর্থাৎ এই আমি। কোথায়? সামনে।
ফোন দিলাম বাড়ি আসছি মাকে জানাতে। পাশের বাড়ির চাচি জানালেন, মা নেই। তখন আমি পার্কে লেকের সামনে বসা। সিমটা খুলে পুকুরে ফেলে দিলাম। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যার জন্য আমার একটি সিম থাকতে হবে। এন্ড্রোয়েডটা বেচে দিলে কিছুটা অর্থও হাতে এলো। অতপর চলা। চলতে চলতে এহাতক, বুঝলে? সালিমার কোনো সাড়া নেই।
: ঘুমিয়ে গেলে?
হ্যাঁ, সালিমা ঘুমিয়ে গেছে। আর আমিও হাওয়ার গতিবেগ মেনে, চোখের ঈশারায়, পাখির উড়ে চলা পথে, জলে, ফড়িয়ের পেছন পেছন দৌড়ে চলে এলাম মানুষের পৃথিবী ছেড়ে অনেক দূর। সে এক অদ্ভুত জায়গা। যেন একগুচ্ছ পরিচিত অক্ষর, একবার অন্য দিকে ফিরেছি কি একবার চোখ মুদেছি, ইত্যোবসরে অক্ষরগুলো ইরেজারে মুছে কতগুলো চায়নিজ আঁকিবুকি হয়ে গেলো। যা আমি পড়তেও পারছি না, অর্থও বুঝছি না। কিন্তু কেউ যেন এসব পড়তে আমাকে তাড়া করছে।
তারা ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। এবার ব্রাকেটে আমার কথাটা বলি। আমি পেশায় একজন সাংবাদিক। টুকটাক লেখালেখির শখ। ইনসান নামে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার হাসপাতালে পরিচয়। রাজনৈতিক এক সমাবেশে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি আহত হয়ে হাসপাতালে আসি। আমার বাম পা আর ডান হাত প্লাস্টারে বাঁধা। আমার পাশের বেডে আছেন লোলচর্ম এক ভদ্রলোক। হা-হা করে হাসছেন আর আমার দিকে ফিরে মাঝে মাঝে চোখ টিপছে; এ তার গল্প; তার জীবনের গল্প।
দুই ছেলে, ছেলেদের বউ, তাদের ছেলেমেয়ে আর অবিবাহিত একটি মেয়ে নিয়ে বর্তমানে ইনসানের সংসার। পুরো সংসার পরিবৃত্ত হয়ে বসে আছেন তিনি আর তার মুখে কথার খই ফুটছে।
ভদ্রলোক বাথরুমে পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছেন। সদ্যই হারিয়েছেন বিধ্বস্ত নেই নগরীতে পাওয়া সেই স্ত্রীকে। যার নাম সালিমা। নিজ থেকেই তিনি তার পারিবারিক ছবি দেখাবেন বলে জানিয়েছেন। তার কথায়, সব গল্পে জেনেও যদি তার ছবি না দেখো, তাহলে সেটা তোমার কাছে নিছক গল্প বলেই মনে হতে পারে বলে আমি আশঙ্কা করছি। সুতরাং ছবিই গল্পের সত্যতা প্রমাণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া তিনি বললেন, তার মেয়ে এলে যেন আমি তার মুখের আদল খেয়াল করি, একদম হুবহু তার মুখটা কেটে বসিয়ে দেওয়া। বিধস্ত নগরী থেকে জনপদে এলে তাকে ঠিক ওমনই দেখা যেতো।
এখন যখন তিনি পরিবারের সঙ্গে বসে আছেন, আমি যে কয়বার চোরাচোখে দেখলাম, ভদ্রলোক পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলছেন ঠিকই কিন্তু তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে।
এখন তো ঝগড়ার কেউ নেই। আজকে বুঝি ঝগড়া কতটা দরকারি বেঁচে থাকার জন্য। বুঝলে ছোকরা?
ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু আগেই তর্ক হচ্ছিল। কথায় কথায় বললেন বিয়ে করি না কেন? বলেছি, আমি ওসব সাধিসুধায় নেই। টাকা দিয়ে বাজার থেকে পারাধীনতা খরিদ করার মতো অতটা বোকা আমি নই।
: এ দেখছি বোকারও বোকা।’ ভদ্রলোক বললেন। ‘এ দেখি নিজের বোকামিটাও ধরতে পারে না। কার যেন কথা আছে, ঝগড়া করার জন্যও তো একজন লাগে। এক চাকায় কোনোদিন গাড়ি চলে? সঠিক, সুস্থভাবে এগিয়ে যেতে চাই দুটো চাকা। স্ত্রী হচ্ছে নেই দুই চাকা। আমর কথা না। ইবসেন না বারনার্ড শ; কার যেন কথা, এখন মনে পড়ছে না। যখন কথা বলার লোক পাবে না, তখন পাগলের মতো হাওয়া-বাতাসের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মানুষ পাগল ভেবে পাবনার পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেবে।
: প্রথমে তো আপনিও তাই ছিলেন।’ আমি ভদ্রলোককে বলি। ‘পরে কোনো এক বিধ্বস্ত নগরীতে গিয়ে রাজকন্যে পেয়ে গেলেন। সবার বেলায় তো আর তা হয় না। ছয় মাসের সেলারি বাকি, বিশ্বাস হয়!
: আরে রাখো তোমার কথা। এ সময় এসে কেউ না খেয়ে মরে না। মরে খেয়ে আর দুঃশ্চিন্তা করে।
: আহা, কি মিথ্যা কথা।
: আরে শোনো আমার কথা, বুদ্ধি থাকলে কেউ আটকায় না বুঝলে?’ আমি তাকে কী করে বলি আমি যে আটকে গেছি। এখন যত ফালতু দার্শনিক কথাই উনি আওড়ান, তা স্রেফ বাকওয়াজি ছাড়া আমার কাছে ন্যূনতম মূল্যও রাখে না। এ তাকে কী করে বোঝাই। তিনি বলছিলেন,
: এই যে হাত-পা বেঙে পড়ে আছ। এক সপ্তাহ হলো, কোথায়, কাউকেই তো দেখলাম না এসে খোঁজ নিতে। শুন, মানুষ প্রাণীটা হলো এমনই; সে বিয়ে করবে। বউয়ের অসুখে সে পাশে থাকবে, তার অসুখে বউ পাশে থাকবে। মানুষ তো আর ঈশ্বর না, তাই না?
: আশ্চর্য যুক্তি!
: হ্যাঁ, এখন কত কী মনে হবে। পরে দেখবে তুমিও সেই কথাই পাড়ছ। ঠিক যেভাবে হাসে পাড়ে, মুরগী পাড়ে; তুমিও পাড়বে।
: আপনিও পেড়েছেন। হাহাহাহাহ।
: একদম। ঘোড়ার ডিমের মতো। আমরা যে জীবনে কী পরিমাণ ঝগড়া করেছি। কখনো কখনো মনে হতো, সেই আগের মতো বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু ওই যে মায়া, বেরুতে দিতো না। এখন তো ঝগড়ার কেউ নেই। আজকে বুঝি ঝগড়া কতটা দরকারি বেঁচে থাকার জন্য। বুঝলে ছোকরা?
: আমাকে ছোকরা পেয়ে ভূগোল বোঝাচ্ছেন এই তো? আমি হালকা খোঁচা দিয়ে বলি। কিন্তু বুড়োটাও ছাড়ার পাত্র নন,
: তুমি ছোকরা না গো। বেশ ঝানু আছো। একদম ঝুনো নারকেল।
চলবে…
বিধ্বস্ত নগরী: পর্ব-৮ ॥ রাশেদ সাদী