পর্ব-৭
যখন আমরা ফিরলাম তখন সন্ধ্যার ভুতুড়ে ছায়া চারদিকে ছেয়ে গেছে। অন্ধকারে বিধস্ত নগরীর নানা কোণ বিকটদর্শন দাঁত খিচিয়ে মুখ ভেঙচাচ্ছে। স্নাইপার আমাদের আগমন টের পেয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিয়েছে। আমি কুৎসিত আঁধারের হাত থেকে চোখ বাঁচাতে দেয়ালের ওই ঝাপসা ছবিটার দিকে চোখ ফেরালাম। মনে হলো, সেখানে একটা নীলচে প্রজাপতি দেখতে পেলাম।
বিছানায় গিয়ে ধপ করে বসেই শুয়ে পড়লাম। ওঠে ভাঙা জানালা গলে ওপাশে গেলাম। যেখানে সালিমা সাপটাকে কেটেকুটে নিচ্ছে।
: তোমার শরীরে কী ক্লান্তি নামে না? আমি তাকে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। সে গাছাড়া গোছের উত্তর দিলো, হয় বৈকি!
: বৈকি!
: হবে না কেন? আমি তো আর যন্ত্র না। তবে এই ইটপাটকেলদের সঙ্গে থেকে কেমন যেন হয়ে গেছি। কখনো এই মৃত নগরীরর একটা ধ্বংস স্তূপ ছাড়া কিছু মনে হয় না। মনে হয় একটা কল আমি; একখানা চাবি দিয়া ছাইড়া দেওয়া একটা পুতুল। নেচে চলেছে। কোনো অনুভূতি নেই।
: আমার শরীর যে ক্লান্তিতে ভেঙে আসে। বলে আমি তার পাশেই শুয়ে পড়ি।
: কী মানুষ; সেই ওর মতো আলসে। সালিমা ওর মতো বলে কাকে বোঝাচ্ছে, সেটা আমি বুঝি। রুকনকে বোঝাতে চায় সে। কিন্তু আমি ছোটখাটো একটা ঈর্ষাকাতর মানুষ। রুকন হয়তো লম্বা, সুঠাম আর মেধাবী ছেলে ছিল। যদিও জানি, সব হারানো এই মেয়েটির স্বস্তির জন্য আমি যেকোনো কিছু করতে পারি। হয়তো রুকনকে মনে করে ওর কষ্টই হচ্ছে। তাই প্রসঙ্গটি আমি পালটাতে চাই। এটা ঈর্ষার বশে না, শুধু তাকে কষ্টের হাত রক্ষা করতে।
একটা পর্দা বিছিয়ে স্নাইপারের কাছেই শুয়ে গেলাম। একটু পর সালিমা আমাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বললো, এপাশে এসো।
তাই প্রসঙ্গটি আমি এড়িয়ে যেতে চাই, তাতে কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি ও প্রসঙ্গ ঢাকা দিতে বললাম,
: ওই যে প্রোর্টেটটা; এক নবদম্পতির মাঝে ছোট্ট একটা বাচ্চা। মাথায় প্রজাপতিওয়ালা বেন্ড; ওটা তো তুমি। চলো না ছবিটির একটা প্রতিচ্ছবি তৈরি করি।
: তুমি রঙ পাবা কোথায় এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে?
: রক্ত দিয়ে রাঙাবো।
: রঙে আছ দেখি। নিজের না মশার?
: হলে সমস্যা কী! অনেক মশা ধরে বেশ করে করে খাওয়াবো; না হয় আমার একটা আঙুলে আলতো করে তোমার এই তুখোড় ছুরিটা এভাবে বসিয়ে দেবো। বলে ছুরিটা সত্যি সত্যি বাম হাতের তর্জনিতে বসিয়ে দিলাম।
: কী সব যা-তা করছ?
: যা-তা’র কী হলো? তুমি আমাকে বিশ্বাসই করো না।
: বিশ্বাস কী সেটা? আর কিভাবে করতে হয় বলবে? সালিমা ইতোমধ্যে দুর্বা এনে মুখে চিবিয়ে আঙুলে লাগিয়ে হাতে মুঠি করে ধরে আছে।
: বিশ্বাস হলো রক্ত। যার রঙ, গন্ধ ও আকার আছে। যা আমি তোমার চোখে দেখছি এখন।
: হয়েছে। জ্বলছে না?
: উহু। ধরে রাখো। ভালো লাগছে। এমন সেবার জন্য এখন দেখছি মাঝে মাঝে হাত কাটতে হবে।
: কী অদ্ভুতুড়ে খেয়াল তোমার। এমন মানুষ আমি দেখিনি মানতেই হবে। যেন লাল দেখতে ভালো লাগবে বলে একটা গলা কেটে ফেলবে। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই সালিমার কথায়। কী পরিণত আর অর্থবহ! যদিও এর কোনো উত্তর হয় না, তর্কের খাতিরে তারপরও আমি বললাম, হোক না তাই। সে যদি হয় নিজেরই গলা কাটে, তাতে তো কারও ক্ষতিবৃদ্ধি হলো না।
: হলো।
: কার?
: সবার। তুমি তো আর আকাশ থেকে হঠাৎ করে পড়ো নাই। এতে পৃথিবীর প্রতিটি ধুলিকণা থেকে নিয়ে প্রতিটি জলবিন্দুর হাত আছে। প্রত্যেকের কাছে তুমি দায়বদ্ধ।
: আমি কারও কাছে দায়বদ্ধ না।
: গায়ের জোরে সেটা বলতে পারো এবং সেভাবেই চলতে পারো। কিন্তু একবার যদি এটা উপলব্ধ হয়; তোমার যদি শুধু ক্ষুধা না থাকতো; তোমার দিকে ফনা তুলে ছুবলে উদ্ধত সাপকেও তুমি মারতে পারতে না।
: ক্ষুধা তো আমার আছে।
: তাই তো বলছি, এবার সাপটায় হাত লাগাও। একদিক পুড়ে পাথর হলো। আমি ওর কথামতো শিকে গাথা আগুন দগ্ধ সাপটি উল্টে দিলাম। বললাম, চলোনা, কালকে আমরা মাছ মারি।
: কোথায়, নদীতে? হ্যাঁ, নদীতে মাছ আছে। একদা শহরের সমস্ত বর্জ্য এসে এই নদীতে পড়তো। শহরের সব কল-কারখানা এবং বাসা-বাড়ির কেমিক্যাল আর নোংরা। নদীর নামটা অনেক সুন্দর জানো ‘মা’।
: মা! শুধু মা?
: হ্যাঁ মা। মাকে তার সন্তানরা এতটাই অত্যাচার করেছে যে, এই মায়ের আর্তনাদ শুনতে শুনতেই প্রকৃতি এমন ক্ষমাহীন ওঠে আর নষ্ট সন্তানের বুকে থাবা বসিয়ে কলজে ছিনিয়ে নিয়েছে। মাকে যদি তুমি দেখো, তোমার মায়া হবে। কত সুন্দর ছোট্ট একটা নদী! ঠিক আমার শৈশবের মতো।
: তাহলে সে কথাই থাকলো।
: কোন কথা? সালিমা দুষ্টুমির হাসি দিয়ে সাপের মাংসে কামড় দেয়। তার উত্তরে আমি কিছু কাব্য করার সুযোগ পাই,
ওই চাঁদ যে কথা বলছে।
: কী বলে সে?
: হে আদম-হাওয়া! তোমরা আগামীকাল সুন্দর ছোট্ট নদীতে যাবে, স্নান করবে। আর হে নরাধম, (আমাকে উদ্দেশে তার বাণী) তুমি নিজের চোখকে সংযত করবে।
: আচ্ছা।
: তোমার সঙ্গে আমাকে শুতে নিতে তাহলে।
তোমার থেকে আমি আরও কিছু আবিষ্কার করতে পারতাম
পাশাপাশি স্রেফ হেঁটে তোমাকে মনে হয়েছে একটা নিঝ্ঝুম ঝাউবন
যদি চুমু দিতে তা হলে তোমার ঠোঁটে
আমি কাগুজি লেবুর গন্ধ আবিষ্কার করতাম
যদি জিড়য়ে ধরতে, অতঃপর চুমু, হাত ধরে
বিছানায় নিয়ে যেতে; বিবশ্র আদম-ইভ
তোমাকে এভাবে দেখার পর আমার প্রথম কাজ
নিজেকে অন্ধ করে ফেলা, কারণ ওই সৌন্দর্য আবলোকনের পর আমি পৃথিবীর আর কিছু দেখতে চাই না
অতঃপর একটি করে ইলিয়াড, ওডিসি লিখতাম।
কবিতার নাম হোমার।
: কার কবিতা?
: কারও তো নিশ্চয়ই। ধরো আমারই। পৃথিবীর সব ভালো কবিতাই তো আমার। পৃথিবীর সব গান যেমন আমার, পৃথিবীর সব…
: নারীরাও তোমার, এই তো?
: একদম না। বিধস্ত নগরীর একজন মাত্র আমার।
: আরে হয়েছে তো, এবার থামো। সালিমা খাবারের অবশিষ্টাংশ স্নাইপারকে দিলো। কিন্তু স্নাইপার খাচ্ছে না।
: কী হলো, খা। সালিমা অবাক হয়ে বললো। স্নাইপার সালিমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। সালিমা খাবার রেখে চলে গেলো শুতে।
এরপরই চরাচরে নেমে এলো ততধিক নীরবতা। চায়ের কাপে গলে গলে পড়ে বিস্কুটের মতো আঁধার, আঁধারের বুকঘেঁষে রুপালি চাঁদ।
আমি স্নাইপারের কাছে গেলাম। তাকে আদর করলাম। স্নাইপার আমার দিকে করুণ চোখে তাকালো। চাঁদের আলোয় মনে হলো ওর চোখে জল। মনে হলো, এই শূন্য পৃথিবীতে আমরা একে অন্যের মনের অবস্থা বুঝছি। সে জিব দিয়ে চেটে আমাকে আদর করলো। আমিও তাকে চুমু খেলাম। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে স্নাইপারের জন্য। খাবারগুলো ওকে হাতে তুলে খাওয়ালাম। একটা পর্দা বিছিয়ে স্নাইপারের কাছেই শুয়ে গেলাম। একটু পর সালিমা আমাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বললো, এপাশে এসো। কেঁদে-কেটে সালিমার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। আমি কিছু না বলে তাকে অনুসরণ করলাম। মনে মনে এই এই কয়টা পঙ্ক্তি আওড়ালাম,
‘মেয়েরা কী আদ্ভুত স্বার্থপর, বিড়াল বুকের ওপরতুলে, বালিশে চুমু খায়,
লাঠি হাতে বৃদ্ধের দিকে বাড়িয়ে দেয় হাত,
বন্ধবীকে বুকে জড়িয়ে নেয় আর রাতের আঁধারে একা একা কাঁদে
এইসব তারা করবে, করেই চলবে, কিন্তু
তোমার থাকবে না একটু অনুপ্রবেশের অধিকার
তার ঠোঁটের জন্য তোমার যে মন কেমন করে,
তার অশ্রুর তরে তুমি অকাতরে বিলিয়ে যেতে পার প্রাণ- সেটা সে
দেখেও দেখবে না, প্রয়োজনও বোধ করবে না
মেয়েরা হয় অদ্ভুত স্বার্থপর
পিপাসায় মরে গেলেও সে তোমার দিকে মুখটি ফেরাবে না
অথচ চোখে এমন করে কাজল মাখবে, তোমার বুক জ্বলবে,
এমনকি অভিমানে তোমার আত্মহত্যা করতে মন চাবে।
ঘুমের আয়োজন চলছে। সালিমা আমার বিছানার খড়ের বিচালিগুলো একটু নাড়িয়ে দিলো। তাতে বিছানাটা আরেকটু আরাম দায়ক হয়ে উঠলো। কিন্তু দেখলাম সালিমা তার বিছানার খড় নাড়ালো না। সালিমাকে শোয়া থেকে টেনে তুললাম। আমার বিছানা থেকে বেশ কিছু খড় দিয়ে, আগেরগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বললাম, এই খড় কোথায় পেলে?
: ওই কিছু খাস-বিচালি শুকিয়ে নিয়েছি।
: বুদ্ধি বটে। কালকে আমরা ইট দিয়ে একটা ঘর বানাবো। ওপর দিয়ে টিনের ছাউনি দেবো। আরও কিছু থালাবাসান খুঁজবো। তেল পেলে একটা কুপি বানিয়ে নেবো। আর নয় মৌচাক থেকে মোমবাতি বানাবো। একটা জাজিম আর দুটো বালিশ হলে বেশ হয়।
: আর কী লাগবে তোমার? সালিমা প্রহসনের মতো বললো।
: আর, আর তোমাকে।
: এত কিছু লাগে, তাহলে এই বিধ্বস্ত নগরীতে কেন?
: কারণ তুমি আছ?
: আমি আছি তা তো জানতে না। এসেছ জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে।
: তোমাকে পেতে।
: হয়েছে আর পাম দিতে হবে না। হিহিহিহি। আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে সালিমা বললো, এত কিছু দিয়ে কী হবে?
: দেখোই না কী হয়?
: তুমি জাদু জানো নাকি?
:জানতেও তো পারি। ছোটকালে দাদি আমাকে মচকে যাওয়ার ঝাড়ফুঁকের মন্ত্র শিখিয়েছিল। সেখানে একটা লাইন ছিল এমন, ‘যদি না সারিস তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর মাথা খা।
: তোমাকে প্রেত বলে আমার ভয় হচ্ছে।
: একটু ভয় থাকা ভালো। তাতে যদি নারী-পুরুষের উঁচু-নিচু স্তরটা প্রতীয়মান হয়। যা আর যাই হোক আমার জন্য ভালো।
: তোমাদের পুরুষদের দেখা আছে। সব ভীতুর ডিম। নারীরা আগলে না রাখলে যে তোমাদের কী হতো তাই ভাবি।
: এখন না হয় কেউ ভাবে। এতদিন তো কেউ ভাবতো না। এর উত্তরে সালিমা আর ‘টু’ শব্দটি করলো না। আমি দেখেছি, ও সব সময় দুঃখের পরিস্থিতিটা এড়িয়ে যেতে চায়। যেন এমন, দুঃখ-কষ্ট তো আর কম সইলাম না, সয়েও যাচ্ছি। তাই বলে কি কাঁদবো? বরং দুঃখের ওপর একটা কৌতুকের সস দিয়ে সেটা কুড়মুড় করে খেয়ে ফেলবো।
কিন্তু আমি তো খেতে পারি না। আমার সব সময় মনে হতে থাকে, মানুষের এঁটো খেয়ে আমি মানুষ। বাবা ডাকলে কেমন লাগে জানি না। মাকেও সেভাবে পাইনি। পড়ালেখা করে চাকরির বদলে পেয়েছি বঞ্চনা। এত দুঃখের মধ্যে এমন একটা নিঃসঙ্গ বিধ্বস্ত নগরীতে নির্বাসনে এসে যখন সালিমার মতো একজন মা, মেয়ে, প্রেমিকা পাওয়া যায়! এতে কি দুঃখের মতো সুখ হয়! সে তো আমি জানি। যে সুখটা ক্রমেই বাড়ে আর সুখীকে অসাহায় করে তুলে।
: সালিমা তুমি যদি হিমালয়ের পাদদেশেও থাকতে, আমি হয়তো সেখানেই যেতাম।
সালিমা কোনো কথা বলছে না। আমিও নিশ্চুপ। রাতের বুকে প্রহর ঘোষণা করে গেলো মধ্যরাতের শেয়ালরা। প্রতি উত্তর করল স্নাইপার,‘কুউ, কুউউউ, বুক বুক….’।
এরপরই চরাচরে নেমে এলো ততধিক নীরবতা। চায়ের কাপে গলে গলে পড়ে বিস্কুটের মতো আঁধার, আঁধারের বুকঘেঁষে রুপালি চাঁদ। রাতের যে পোকাগুলো ডাকছিল, সেসব ডাকগুলো যেন এই রাতকে আরও গভীরতর করে তুলেছে। যেখানে মিহিসুরে একটা ঝর্ণা বইছে।
চলবে..
বিধ্বস্ত নগরী: পর্ব-৬ ॥ রাশেদ সাদী