পর্ব-০১.
সাক্ষাৎ
গাছপালা, ঝোপঝাড় দেখে মনে হবে কত বড় জঙ্গলই না হবে। ‘আমি তোমার ভেতর হারিয়ে যেতে চাই। জঙ্গল, আমাকে তোমার বুকের অন্তস্থলে নিয়ে নাও।’ হাঁটতে হাঁটতে মনে এসব বাক্য খেলা করছিল। ‘বাঘ, অজগর, যার পেটেই যাই না কেন—তোমার যেন উত্তম খাদ্য হই।’ কিছুদূল হেঁটে একটা ধ্বংসস্তূপের সামনে এসে দাঁড়ালাম। একদা যেন একটা বাড়ি ছিল—দেখলে মনে হবে। আরও কিছু দূর গেলে আরও কিছু ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়লো। যত ভেতরে যাচ্ছি, গাছপালা তত কমে আসছে, ধ্বংসস্তূপের পরিমণ বেড়ে যাচ্ছে। একদা আমি ধ্বংস্তূপের পেটর ভেতর সেঁধিয়ে গেলাম।হঠাৎ এই অপরিচিত ধ্বংসস্তূপের ভেতর একটা শব্দ কানে এলো। আর্তনাদের মতো। যেন কেউ কাৎরাচ্ছে।
প্রথমে মনে করলাম কোনো প্রাণীর ডাক হবে হয়তো। কিন্তু দুয়েক পা যেতেই আর্তনাদটা একটা গোঙানিতে পরিণত হলো। তখন আমার টকন নড়লো! সঙ্গে সঙ্গে সেই গোঙানির উৎস আবিষ্কারে লেগে গেলাম। একটু খোঁজাখুঁজির পর দেখি, কতগুলো কাঠের ওপর আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছে কিছু। ঠোঁট একটু একটু নড়ছে। থেকে থেকে, যন্ত্রণায় বোধ হয়, গোঙানির শব্দটা বেড়ে যাচ্ছে। বুকটা অনিয়মিত ওঠানামা করছে।
আরে শালা এ আবার কী! অত কিছু ভাবার সময় নেই। ‘হাঁট্’ বলে ফের হাঁটা দিলাম। কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে এলাম। এসে দেখি সে-বস্তু আগের মতোই পড়ে আছে। ‘ধেৎ’ বলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে পা আপনি থেমে গেলো। আর এগুতে চাইলো না। অগত্যা ফিরে এলাম।
‘এই যে, এই যে’ বলে দুবার ডাকলাম। কোনো সাড়া নেই। পাখির বাচ্চার মতো চিঁচিঁ করছে আর থেকে থেকে গলার ভেতর থেকে গোঙানি ঠেলে বেরুচ্ছে। ঝুঁকে পড়ে মুখটা ভালো মতো পরখ করে নিলাম।
ভাবলাম একটু বসাই। ওমা! গায়ে হাত দিয়ে দেখি পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। তুলতে গিয়ে দেখি ওজন বলতে কিছু নেই গায়ে।
একদিক ধরলে অন্যদিক দিয়ে পানির মতো গলে পড়ছে। কী করবো ভেবে পেলাম না। দিশেহারা বোধ যাকে বলে! এমনিতে পরোপকারের অভ্যাস নেই আমার। তাতে আবার এমন উদ্ভট জায়গায়, এমন বিদঘুটে ঝামেলা কে নেবে?
কিন্তু এতো জ্বর গা-জুড়ে, পুড়ে যাছে। কী করবো? শত হোক একটা প্রাণ তো। এমন এক জায়গায়, যেখানে দ্বিতীয় লোক আসার সম্ভাবনা নেই-ই বলা যায়। রেখে গেলে মরে যাবে, থেকে একটু যত্ন করলে হয়তো বেঁচেও যেতে পারে।
এসব যখন ভাবছি, তখন মনে হলো—পানি হলে বেশ হতো। কিন্তু ব্যাগে যে পানি আছে, তা তো খাওয়ার। এই জ্বরের শরীরে ভালো করে গা ধোয়া দরকার। তারপর কিছু খাওয়াতে পারলে, জ্বরের টেবলেট আছে, খাইয়ে দিতাম। তারপর যা হয় হবে। কারণ এর বাইরে তো আমার কিছু করার নেই।
আশপাশে খুঁজতে লেগে গেলাম যদি একটু পানি মেলে। কিছুদূর এগুতেই অনেক পাখির শব্দ কানে ভেসে এলো। শব্দের উৎসের কাছে গিয়ে আমার চক্ষু ছানাবড়া!
ছোট্ট একটা পুকুর। যা সালিমা সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে আর তাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছিল। পরে সে যার স্থানীয় নাম বলেছিল ‘সঞ্জীবনী’।
এমন এক স্বর্গের পুকুর, যার চারদিক গাছ দিয়ে ঘেরা। নারকেল গাছ, আম, জাম, লিচু, আনাড় মাই আপেল আঙুর গাছও আছে। ফলে ফলে ছেয়ে আছে। কয়েকটা পাখি ঠুকরে খাচ্ছে। বেশির ভাগ পেকে পেকে পড়ছে মাটিতে।
ফলফুল দিয়ে ঘেরা সেই পুকুরে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে এলাম। নামতে একটু ভয় হলো। কে জানে হয়তো কুমির, না হয় এনাকোন্ডা পানির তলে ওঁৎ পেতে আছে।
কিন্তু ওজন বয়ে নিয়ে এসে এত কিছু ভাবার সময় কোথায়? তা সে যত কম হোক না কেন, বহনের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো বোঝার ওজনও বাড়তে থাকে। যদিও সহ্যক্ষমতা কমে এসেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কারণ বস্তুর ওজন তো সেই আগেরটাই থাকে। মেয়েটা তেমনই একটা নির্জীব বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। প্রাণ বলতে অনিয়মিত ও ক্ষিণ ওই শ্বাস-প্রশ্বাসটুকোই।
পানিতে নামিয়ে ভালো করে গা ধুইয়ে দিলাম।
কতদিন যে হলো গোছল করে না কে জানে। গা থেকে ঝুরঝুর করে ময়লা ঝরছে। বগলের নিচে ইয়া বড় বড় চুল, চুলে জমেছে খার। উরুসদ্ধিও চুলের দঙ্গলে ঢাকা। এ দেখে বোঝার উপায় নেই, এ মেয়ে না ছেলে। যৎসামান্য বুক, তা থেকে বোঝা যায়, সম্ভবত মেয়ে।
হাত দিয়ে ঘষেমেজে যা পারা যায় ময়লা সাফ করলাম। মেয়ে সেই আগের মতো গা-ছেড়ে দিচ্ছে। চোখটা আধবোজো। পিটপিট করছে। সব যেন দেখছে, কিন্তু সে চোখে কিছু অনুধাবন হচ্ছে না।
কাপড় পালটে আমার প্যান্ট আর গেঞ্জি পরিয়ে দিলাম। তারপর আগের জায়গায় মেয়েটাকে কোলে করে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলাম। ডাব পেড়ে আনলাম। কাটার যন্ত্র খুঁজতেই ভাঙা দেয়ালে গাঁথা দেখলাম একটা চাকু। তাই দিয়ে কেটে পানি খাওয়ালাম। সঙ্গে আম আনার-লিচু।
টেবলেট খাইয়ে দিয়ে কাঠের ওপর শুইয়ে দিলাম। ব্যাগে জামাকাপড় যা ছিল, তাই দিয়ে ঢেকে দিলাম। ভাবলাম, এবার যাই।
কিন্তু কিছুতেই মন সরলো না। এমন এক রোগীকে ফেলে রেখে কিভাবে যাই? মন চাচ্ছে না। কেন জানি না। মনে হলো, এই ঘটনার সঙ্গে আমি অদৃশ্য সুতোতে বেঁধে গেছি।
সেবাশুশ্রূষায় সে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করলো। সুস্থ হওয়ার পরও একমাস সে আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। শুধু বসে থেকেছে আর আমার গতিবিধি লক্ষ করেছে। আমি ধরেই নিয়ে ছিলাম, মেয়েটা বোবা এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। পুরোপুরি কখন ও বল ফিরে পেলো, তাও জানলাম না কিন্তু।
কারণ ও তো শুধু বসে থাকে আর আমার গতিবিধি লক্ষ করে। বাকি সময় ঘুমায় পড়ে পড়ে। এমনকি কিছুটা বল ফিরে পাওয়ার পর কখন সে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে যায় তাও বলতে পারবো না। হয়তো দেখেছি জায়গায় নেই, কী একটা করছি, এই ফাঁকে কখন যেন এসে বসে আছে।
কিছু হলেও ঘুম দরকার কিন্তু। এভাবে আরও কয়েক মুহূর্ত যায়। আমি তো কোনো কথা বলি না।
খাবার জন্য যা বাড়িয়ে দেই, তাই খায়। কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু ঢেপঢেপ করে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না, আগ বাড়ি কিছু ধরেও না, এমনকি পানিও না।
সেদিন পুকুর পাড়ে গেছি, ফিরে এসে দেখি মেয়েটা নেই। সে প্রথম যেদিন একা প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিল—সেদিনের কথা মনে পড়লো। হঠাৎ দেখি সে জায়গায় নেই। কিছুক্ষণ পর দেখি পরনের পাজামার কয়েক জায়গায় ভেজা। ধীরে ধীরে নিজের জায়গায় গিয়ে ‘দ’ হয়ে শুয়ে পড়লো। সে কথা ভেবে আজও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
কিন্তু সময় বয়ে যায়, তার ফেরার নাম নেই। দীর্ঘ সময় তার জন্য বসে আছি। সে আর ফেরে না তো ফেরেই না। এর আগে এমন হয়নি। সন্ধ্যা হয়ে এলো তাও সে এলো না। পরিস্থিতি দেখে আমার একটু যেন মনটা কেমন করে উঠলো। কিন্তু ততধিক দ্রুততায় নিজেকে ঠিক করে ফেললাম। ভাবলাম গিয়েছে, বেশ হয়েছে। মরে গিয়ে থাকলে ভালো, পালিয়ে গিয়ে থাকলে আরও ভালো। আপদ দূর হলো। তাছাড়া সে কোথায় যাবে আমাকে তা কেন জানতে হবে?
এবার আরও ভেতরে চলে যাব এই বিধস্ত নগরীর এবং হয়তো আমিও একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণহ হবো।
এসব নানা ভাবনা যখন মাথায় খেলছে, তখনই দেখি মেয়েটা কতগুলো কাঠের টুকরো মাথায় করে নিয়ে এদিক আসছে। কাঠের টুকরোগুলো আমি যে জায়গায় এ কয়দিন ঘুমালাম সেখানে রাখলো। ভালো করে বিছিয়ে দিলো। বললো—এখানে শুলে একটু আরাম পাবেন।
এই সালিমার সঙ্গে আমার প্রথম কথা এবং জানলাম সে বোবা-কালা নয়। আমি বললাম, ধন্যবাদ। সে আর কিছু বললো না।
ধ্বংসস্তূপে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়।
কাঁধের ওপর কী একটা ঠাণ্ডা বস্তু লাগছে আর আমি ছুটে বেরিয়ে যেতে ক্ষিপ্রগতিতে হাত ছুড়লাম। প্রচণ্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম।
ঘুম ছুটে গেলো। চারদিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। ডানার কোথায় যেন জ্বলছে। হাত দিয়ে দেখলাম নুন ছাল ওঠে গেছে কনুইতে। সেখানে একটু থুথু লাগিয়ে দিলাম। আরও জ্বলে উঠলো। পাশে দেখলাম, সালিমা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে কতগুলো কাঠের টুকরোর বিছানায়। তার বুক চাঁদের মৃদু আলোতে সমান্তরালে ওঠা-নামা করছে।
সালিমার পাশে এক রাত
ভেসে আসা ভেলায় চড়ে আমরা রাতের শেষ প্রান্তে চলে এলাম। রাতের ভেতর একটা ঝা-ঝিমভাব ধরে আছে। শক্ত করে মুঠো পাঁকিয়ে রাখার মতো। যেকোনো সময় খুলে যাবে আর মূল্যবান সেই কোহিনুরের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠবে গোটা চরাচর। সালিমা মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে।
: ঘুমিয়ে গেলে?
: উহু। তবে ঘুমানো উচিত। আমাদের অনেক কাজ কাল। ঘরদোর সাজানো, কাঁথা-কম্পল, আরও কত কী সংগ্রহ করতে হবে।
: সে এক সপ্তাহ লেগে যাবে। আমি বলি। সালিমা উত্তর দেয়—
: যদি করি। না করলে এক বছরেও শেষ হবে না।
: এক জীবনেও না।
: হুম।
: শীত লাগছে?
: ওলের সোয়েটারে অনেক ওম।
: সেই মেয়েটা আমাকে এই সোয়েটারটা বানিয়ে দিয়েছিল। তাকে যে আমি ভালোবাসতাম তা এতদিনে বুঝতে পাারি। অবশ্য কবি যখন বলেন—‘মরা আলোর নিচে যারা অনুমোদন নিয়ে আগন্তুকের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, তারাও নারী। মমতা ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ জঙ্ঘার ওপর কাপড় তোলেনি।’ সেও তুলেনি, আমিও তুলিনি। তা বুঝতে পারি আজ। যেকোনো কিছু বুঝতে আমার বড় বেশি দেরি হয়ে যায়।
সালিমা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তাতে ততটুকো বাতাস বেরোয়, মাকড়শার জাল আলতো দুলে ওঠে। আমি তার দীর্ঘশ্বাসের পেছনে বলতে থাকি—সেই মেয়েটি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসতো, তখন বুঝিনি, আমিও তাকে ভালোবাসতাম। এ যেন হিরের ফলকে দু’টুকরো হয়ে যাওয়া। মরে যাচ্ছি, কিন্তু তার বেদনাটা বুঝতে পারছি না। শরীরে মন ছিল, প্রেমের মন যে সেখানেই লোকানো ছিল—তা আর তখন ধরতে পারিনি?
প্রেম—সার্চ লাইটের মতো মাঝে মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিতো। সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েও যেতো। আমি আর দেখতে পেতাম না। বুঝতেও পেতাম না। এই শরীরই যে প্রেমের সেতুবন্ধ—তা এতদিনে না এসে বুঝি। এখন যখন তাকে চেয়ে পাই না, তখন মনে হয়, আমি শুধু শরীর চাচ্ছি না, চাচ্ছি সেই মেয়েটাকে; মেয়েটার প্রেমকে। যাক সে কথা, তুমি রুকনের কথা কিছুই বললে না।
: শুনবে? তবে না শোনাই ভালো। পুরুষরা আবার খুব ঈর্ষকাতর কিনা। সালিমার কথায় আমি যেন আঁতে ঘা খাই। তখনই কিছু আর বলি না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সালিমা আকাশের দিকে আঙুল তাক করে দেখালো—রুকন? সে ওই ঐখানে থাকে। সালিমা চাঁদের দিকে ইঙ্গিত করে, যাকগে, যে যাবার চলে গেছে। যে আসার সে এসেছে। এখন বরং যে আছে তাকে নিয়েই থাকি। কী বলো! আমি তাও কিছু বলি না। জানি এখানে বলা যেতো, কে কাছে বললে? এভাবে এই সংলাপটা দীর্ঘ করা যেতো।
কিন্তু আমি নীরবতার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। কারণ দেখেছি, কখনো কখনো এটি এমনভাবে কাজ করে, মনে হবে ম্যাজিক। নীরব থাকার এ এক দৈব। আমার নীরবতায় সালিমাই ফের কথা বললো, পরে একদিন বলবো, কেমন? আজকে ঘুমাও গো। কিছু হলেও ঘুম দরকার কিন্তু। এভাবে আরও কয়েক মুহূর্ত যায়। আমি তো কোনো কথা বলি না।
চলবে…