‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’
এক.
রুপালি রৌদ্দুরের এক ঢেউলাগা সকালে এসএসসি পরীক্ষা পাসের খবর এলো। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছি, ইজ্জত রক্ষা। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্যারেরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরের বছর থেকে আব্বাকে বলতেন, মাইজা মিয়াসাব দিলুরে কিন্তু পড়াইবেন, এক চান্সে সে ম্যাট্রিক পাস করবে। ভাগ্যিস, স্যারদের কথা সত্য হয়েছে, নইলে কী যে হতো! নিঃসন্দেহে অকালে হাতে মেহেন্দি পরে বিয়ের পিঁড়িতেই বসতে হতো।
আমাদের অজপাড়াগাঁ থেকে ওই বছর তিন জন পরীক্ষার্থী ছিলাম। আমরা পাশাপাশি বাড়ির। আমার চাচাতো ভাই আখতার উদ্দিন টুটু তৃতীয় বিভাগ পেলো বলে তার পরিবারসহ সবারই খুব দগ্ধপ্রাণ, মন খারাপের একশেষ। আমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশেই মুন্সী বাড়ির ছোট ছেলে বিজ্ঞানের ছাত্র ইমদাদুল হক বাবু, সেও পেলো দ্বিতীয় বিভাগ। ছেলেদের নিয়ে তো কোনো চিন্তা নেই, যেকোনো কলেজেই তারা ভর্তি হয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
মেয়ে বলে আমাকে নিয়েই আব্বা-মায়ের অক্লান্ত রাত্রি জাগরণ, তুমুল স্বপ্ন আর দুশ্চিন্তার পাশাপাশি শয়ন। কোথায় ভর্তি করবেন এবং কোথায়, কার বা বাড়িতে আবার বাসস্থান হবে আমার, সেও এক নিরন্তর চিন্তার বিষয়। অন্যের বাড়িতে মেয়ে রেখে পড়াশোনা করানো, চাট্টিখানি কথা তো নয়। সারাক্ষণ মেয়ে সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি উদ্বেকাকুল মন নিয়ে বাস করতে হয় মা-বাবাকে। এছাড়া যে উপায়ও নেই, দেবেন্দ্র কলেজে মেয়েদের জন্যে কোনো হোস্টেল নেই। ছেলেদের জন্যে মেসবাড়ির মতো ব্যবস্থায় একটা হোস্টেল গড়ে উঠেছিল প্রথম, সেটিও দেশ স্বাধীনের অনেক পরে।
আব্বা-মায়ে মিলে কী চিন্তা করছেন, আমি তার কিছুই জানি না। পরবর্তী কলেজ জীবন আমাকে হাতছানিতে ডাকলেও সে ডাকে আমি সাড়া দিতে পারবো কি না, কিছুই তখন পর্যন্ত বুঝতে পারছি না। এরমধ্যে আব্বা একদিন তার মৃত স্ত্রীর বাবার বাড়ি গিয়ে ঘুরে এলেন। পরদিন সকালে উঠে বললেন, চলো তোমাকে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি করে দিয়ে আসি।
চাপাকণ্ঠে কেন যেন আমাকে একটু আঁচ দিয়ে রাখলেন তরু আপা, হতে পারে তা ট্র্যাফিক সিগন্যালের লালবাতির সংকেত। তবে তরু আপার নিজের মুখে লাজরক্তিম সেই গল্পের সূত্র ধরে দুজনের কলেজে পৌঁছুতে তেমন ক্লেশই হতো না তখন।
আমাদের বাড়ি থেকে সে কলেজের দূরত্ব তিন মাইলের একটু বেশিই হবে। পায়ে হেঁটে প্রতিদিন তো আসা-যাওয়া সম্ভব নয়, তাহলে? মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে দক্ষিণে কোয়ার্টার মাইল দূরে সেই নতুন বস্তি গ্রাম। এই গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক পরিবারের আদুরে কন্যা ছিলেন আমাদের বড় মা। তার মৃত্যুর পরেও এই বাড়ির সঙ্গে আব্বার সম্পর্ক অমলিন। যেকোনো অনুষ্ঠানে আব্বা-মা আমাদের নিয়েই উপস্থিত থাকেন। মন চাইলে বড়’পা হাওয়া আপা দুই বোন মায়ের স্মৃতি কাতরতায় এসে বেড়িয়ে যান, দুই মামার অংশে দুদিন থাকেন। পরে মামারাই পৌঁছে দিয়ে যান আমাদের বাড়িতে।
খুব ছোটবেলার একটি স্মৃতি এখনো মনে আছে, তখনো নতুন বস্তির নানি জীবিত ছিলেন, ছোট মামার বড় মেয়ের বিয়েতে আমার মাকে নাওর নিয়ে এসেছিল বিয়ের তিন দিন আগে থেকে। এই নানি আমার মাকেও নিজের মেয়ের মতো করে ভালোবেসেছেন। বড়’পা, হাওয়া আপার মতো একই স্নেহ ও আদরে ভালোবাসায় আমাদেরও কাছে টেনে নিয়েছিলেন। কাজেই দুই মামাবাড়িই আমাদের কাছে সমান ছিল।
নান্নুমামা ও চন্নুমামা দুই ভাই। ছোট মামা, মানে চন্নু মামা বাড়িতেই থাকেন। জমাজমি চাষাবাদ ছাড়াও কিছু ব্যবসা বাণিজ্যও করেন। ছোট মামার মেয়ে চার জন। কাউকেই পঞ্চম শ্রেণীর বেশি পড়াননি। বিয়ে দিয়ে ঝামেলা মুক্ত হয়েছেন। কেবল ছেলে দুটো বাদল ভাই আর ননী ভাইকে পড়াচ্ছেন। ননী ভাই আমাদের সঙ্গেই এসএসসি দিয়েছেন, বাদল ভাই বড়, আমাদের দুই ক্লাস সিনিয়র।
নান্নু মামার তিন মেয়ে এক ছেলে। তিনি থাকেন নরসিংদী। দুটো সেলাই মেশিন নিয়ে একটা দরজি দোকান চালান। দুই-দেড় মাস পরে বাড়িতে আসেন। বড়মামি সংসার ও ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, হাট-বাজার-রান্না একহাতেই সব পরিচালনা করেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তিনি। কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি নেই, অত্যন্ত পরিমিত আয়ে গুছিয়ে চলতে জানতেন।তার বড় মেয়ে তরু আপা আমার বছর দুয়েকের বড় হলেও একই বছরের এসএসসি পাস করেছি।
আমি থাকবো তরু আপাদের বাড়ির অংশে, কাজেই আমার কাপড়-চোপরের বাক্স-পেটরা সব তরু আপাদের ঘরে তুলেছিলাম আগেই। আপাতত, এখান থেকেই ক্লাস করবো। আমার খাওয়া খরচ বাবদ চাল-ডাল, আমাদের বাড়ি থেকেই যাবে, বাজার ঘাটের জন্যে মামির হাতে তুলে কিছু টাকা দেওয়া হবে, মোটামুটি এভাবেই আব্বা স্থির করেছিলেন সব কিছু আগেই, আমি জেনেছি পরে।
আব্বার ইচ্ছে ছিল আমাকে ডাক্তারি পড়াবেন, সেজন্যে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করার কথা আলাপ করলেন দুই মামার সঙ্গে। ছোট মামা আব্বাকে বললেন, দুইলামিয়া সাব, মেয়েকে যে ডাক্তারি পড়াইতে চান, অনেক খরচ কিন্তু তার চাইয়া মানবিক বিভাগে ভর্তি কইরা দেন।
আব্বা মনে হয় মামাদের কথা শুনে একটু দমে গেলেন। আমারও যেহেতু ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু নেই কাজেই চুপচাপ আছি। আমার হিসাব অন্য জায়গায়। এত সীমাবদ্ধতার পরেও আমাকে যে কলেজে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অভিভাবকরা, এতেই আমি অধিক আপ্লুত, এরপরে আবার চাহিদা কিসের? আমি তো মেয়ে, সমাজের ভ্রূকুটি কি আমি টের পাই না? পাই।
ফলে বিজ্ঞান বাদ দিয়ে তরু আপা আর ননী ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে তিন জনেই মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়ে ফিরে এলাম। আব্বা সরাসরি চলে গেলেন আমাদের গড়পাড়ার বাড়িতে। দু’দিন পরেই তিনি ঢাকা চলে যাবেন কর্মস্থল সদরঘাটের৪/২ বাদামতুলিতে প্রতিষ্ঠিত তার প্রাণের প্রতিষ্ঠান ‘দ্য বখসী আর্ট প্রেস’তদারকিতে।
বড় মামির বাড়িতে বরাবরই সকালের নাস্তা মানে প্রত্যেকের জন্যেই হিসাব করা দুটো আটার রুটি, এক কাপ দুধ চা। সবার জন্য সমান। অমৃতের মতো মনে হতো সে নাস্তা। নিয়ম অনুযায়ী সকালে মামির সন্তানদের সঙ্গে আমিও চুলার পাশে বসে গরম গরম সেঁকা রুটির সঙ্গে চা দিয়ে নাস্তা শেষ করতাম। মনে হতো, আহা, চায়ের কাপটা একটু বড় হলো না কেন!
এখানে কয়েক মাসেই আমি সকালে চা-রুটির ভক্ত হয়ে উঠলাম, সারাজীবনও যা ছাড়তে পারিনি। আমাদের বাড়িতে চা ছিল সৌখিন ব্যাপার, বিকেলের নাস্তা হিসেবে চানাচুর, মুড়ি কিংবা বিস্কুটের সঙ্গে। এখানে চা হলো নাস্তার প্রয়োজনীয় উপকরণ। সকালের চায়ের ধোঁয়া মানে সারা দিনের কর্মযাত্রার বাতাবরণ খুলে দেওয়া।
সকালের নাস্তা খেয়েই আমি আর তরু আপা কলেজ যাত্রা করি পায়ে হেঁটে। তখন নতুনবস্তি গ্রাম থেকে মানিকগঞ্জ শহরের মেইনরোড পর্যন্ত নতুন একটা সড়ক তৈরি হচ্ছিল। পায়ে চলা হালটের ওপর মাটি ফেলে উঁচু ও চওড়া করা হচ্ছে। কলেজে যাওয়ার সময় সকালেই দেখতাম মাটিকাটা মিনতিরা দলবেঁধে পরস্পর তিন মাথা বদলের পরে অকুস্থলে ঝুপঝাপ ধ্রুম-ধ্রাম শব্দে মাটি ফেলছে সাঁজি থেকে। আর এক দল একটু দূরে খালের পার থেকে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে সাঁজি ভরে তৈরি করে দিচ্ছে। হলুদ শর্ষে ক্ষেতে মৌমাছিদের গান শুরু হলে যেমন পথচারীর মনের মধ্যেও সেই গান বাজতে থাকে, নতুন এই রাস্তাকে ঘিরে নিরন্ন মানুষের জীবনের গান যেন পান পাতার মতো বেয়ে ওঠে ওপরে। আমিও বুঝতে পারি তাদের সুখের পান-সুপারির সুর-ঝংকার।
জুঁই ফুলের মতো এক থালা ভাতের স্বপ্ন ছাড়া বেশি কিছু তো নেই তাদের। মাটিকাটার কাজটুকু তাই স্বপ্নপূরণের মস্ত হাতিয়ার। এজন্যে এত উল্লাস। এবড়ো-খেবড়ো কাঁচা মাটির নতুন সড়ক বরাবর হেঁটে যেতে কেন যেন খুব ভালো লাগতো আমারও। মনে হতো জীবনের এক নতুন সন্ধান খুঁজে পেয়েছি আমি, যার নাম কলেজ জীবন। একহারা স্বাধীনতা, বঙ্কিম কিছু শাসন; তদুপরি স্বর্ণলতার মতো সূর্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে আরও একটু অসীমকে স্পর্শ করার বাসনা। জ্ঞানের আলোর মতো সকালের উদ্ভাসিত সূর্য-আলোতে মাখামাখি কায়া, পায়ের তলায় উঁচুনিচু নতুন কাঁচা মাটির ডেলা, মাটির সোঁদা সুগন্ধ নাকে পুরে খোরগোশের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে পথ চলাতেই যেন রাজ্যের আনন্দ।
তরু আপা আর আমি দুজনেই প্রতিদিন শাড়ি পরে কলেজে যাই। আমার আব্বা তো স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, কলেজে শাড়ি পরে যেতে হবে। সালোয়ার কামিজ পরে স্কুল বালিকার মতো যেন না যাই। কেননা, মেয়ে বড় হয়েছে, কলেজপড়ুয়া শাড়ি পরা সন্তানের সেই বড় বড় ভাবখানা দেখে পিতাও যেন আশ্বস্ত হতে চান। তখন খুব ফিনফিনে সুতার গেরুয়া-কমলা রঙের ঢাকাই সুতি শাড়ি ছিল দুটো, পরে দুজনে পাশাপাশি হাঁটি, ননী ভাই কোনোদিন সঙ্গে থাকেন, কখনো আবার নিজের রুটিন মাফিক অতি ভোরে কলেজে চলে যান।
তরু আপা, বাদল ভাই; দুই চাচাতো ভাই-বোনের স্বাভাবিক সম্পর্কের বাইরেও যে, ভালোবাসার নামের উহু আহা এক গল্প তাদের ঘিরে রেখেছে রহস্য জালে, প্রথমদিনেই তাদের দুজনকে দেখে কিছুটা অনুমান করেছিলাম। ভালোবাসা এমনই এক আলো, যা সূর্যের আলোর চেয়ে প্রখর ও দীপ্তিময়, এমনকী যা দর্শকের চোখ ফাঁকি দিয়ে খুব বেশি দূর যেতে অপারগ। চাপাকণ্ঠে কেন যেন আমাকে একটু আঁচ দিয়ে রাখলেন তরু আপা, হতে পারে তা ট্র্যাফিক সিগন্যালের লালবাতির সংকেত। তবে তরু আপার নিজের মুখে লাজরক্তিম সেই গল্পের সূত্র ধরে দুজনের কলেজে পৌঁছুতে তেমন ক্লেশই হতো না তখন।
দুই.
আমার সেজো চাচা আফসার উদ্দিনের মেজো পুত্র টুটু ভাই ভর্তি হয়েছে ঢাকার বোরহান উদ্দিন কলেজে। তার বড় বোন রেনু আপার মিরপুরের বাড়িতে থেকেই সে কলেজ করে। আর মুন্সীবাড়ির এমদাদুল হক বাবু ভর্তি হয়েছে দেবেন্দ্র কলেজে। বিজ্ঞান শাখায়। কলেজে এলে খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। আমাদের গ্রাম থেকেই প্রতিদিন যাতায়াত করে সে বাইসাইকেলে। বাড়ি থেকে কোনো খবর পাঠানো প্রয়োজন মনে করলে, মা বাবুর হাতে পত্র পাঠান, আবার কোনো ভালো খাবার-দাবার তৈরি হলেও পাঠান। আমি আসার মাস খানেক পরে আমাদের দোয়াইরে ধরা অনেকগুলো ডাসা ডিমওয়ালা চিংড়ি মাছ, আধামন চাল, আমাদের ক্ষেতের কিছু তরিতরকারিও মা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাবুর হাতে। বাবু তা পৌঁছে দিয়ে গেছে মামার বাড়িতে। এছাড়া সিরাজভাইয়ের স্ত্রী রাজেদা ভাবির সবচেয়ে ছোটভাই রাজা বেয়াই একই কলেজে আমার সহপাঠী। তার সঙ্গে আমার সাবজেক্ট একই ছিল বলে শ্রেণীকক্ষে ঢুকেই তার সঙ্গে দেখা হয় বেশি। অন্যান্য ছেলে সহপাঠীর সঙ্গে খুব বেশি কথা হতো না, কেবলই চোখের চেনা ছিল তারা।
আমিও তখন ওই রকম একটা সময় পার করছিলাম যেন। যখন বয়সটা হৃদয়ের মধ্যে ঢুকে যেতো অনায়াসে। যা দেখতেও পেতাম না মোটে। রবীন্দ্রনাথের সেই গান ছিল রাত্রিদিনের প্রার্থনায়, অচেনাকে যেন চিনতে পারি!
আর মেয়ে বন্ধুদের মধ্যে খসবু, রেখা, আফরোজা অধ্যক্ষ জলিল স্যারের মেয়ে শেলির সঙ্গে খুব ঘণিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। নতুনবস্তি এবং গুইলটা থেকে আসে রেখা নামের আরও দুই সহপাঠী, তাদের সঙ্গেও উঠতি বয়সের মান-অভিমান-হাসি আনন্দে জড়িয়ে ছিলাম খুব। মানিকগঞ্জ শহরের বাইরের দূর-দুরান্ত থেকে আসা এই বান্ধবীদের সঙ্গে গড়ে ওঠে আমার বহির্জাগতিক লেনদেন।
স্যারদের ক্লাস শেষ করেই মেয়েরা আমরা দোতলার মেয়েদের কমন রুমে ঢুকে যাই। কেরাম, লুডু খেলি কখনো সখনো, বাকি সময় মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে কাটাই, গল্পের বিষয় অনেক সময় সহপাঠীদের প্রণয় বিষয়ক। আমাদের ক্লাসের সুন্দরী আফরোজা প্রেম করে এক ক্লাস সিনিয়র হিটলু ভাইয়ের সঙ্গে। ওদিকে আমাদের সিনিয়র হাফসা আপার সঙ্গে ঝোলাঝুলি প্রেম চলছে জাসদ নেতা বাদল ভাইয়ের সঙ্গে। এইসব নানা প্রসঙ্গে গল্প চলে কলেজ ছুটির আগ পর্যন্ত। ফাঁকে ফাঁকে ক্লাস। আলী আসগর স্যার নিতেন অর্থনীতির ক্লাস। নানা বিষয়ে গল্প করে পড়াতেন তিনি। একদিন ক্লাসে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন বেহেশত দোজখ আছে বলে কি বিশ্বাস করো তোমরা?
সবাই চুপচাপ, দুই একজন ছাত্র পজেটিভ উত্তর দিলো। তাদের কাঁচা উত্তর শুনে স্যার বললেন, শোনো, আমার ফরমুলা হলো যে, জীবনে তুমি এমনভাবে চলবে, এমনভাবে জীবন-যাপন করবে এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার হয় যেন মধুর। ফলে, বেহেশত-দোজখ থাকলেও যেন তা পেতে অসুবিধা না হয়, না থাকলেও ক্ষতি বৃদ্ধি নেই। বুঝলে তো?
জ্বি স্যার বলে সেদিন স্যারের আধুনিক এই চিন্তার সঙ্গে সকলেই সহমত পোষণ করেছিল।
কৃষ্ণচূড়ার লালে রঙিন দেবেন্দ্র কলেজ মাঠের সবুজ নালি ঘাসের ওপর রুমাল বিছিয়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছি অনেকদিন। কলেজের বিশাল মাঠের পরেই একটা দীর্ঘ খাল। আমাদের ছোট বেলায় এই খালে বর্ষাকালে নৌকাবাইছ দেখতে আসতাম। খালের দুই পারের জমির মালিকেরা যে যতো পারে নিজের দখলে নেওয়ার প্রচেষ্টায় খালটি এখন সুতানলি সাপের মতো এঁকেবেঁকে তার কঙ্কালখানা দেখা যায় শুধু। কলেজের মাঠ থেকে ছোট একটা ব্রিজ পার হয়ে এলে হাতের বাম দিকে যতীন ঘোষের মিষ্টির দোকান, যেখানে কলেজের ছেলে মেয়েরা মলিনার বিখ্যাত দই মিষ্টি খেতে ভিড় জমাতো। হাতের ডানদিকে ব্রিটিশ আমলের তৈরি কোর্ট-কাছারির লাল ইটের বিল্ডিং সারি সারি। কলেজ সংলগ্ন এই অংশটুকু এলাকাবাসীর কাছে মূল মানিকগঞ্জ হিসেবে পরিচিত।
মেইন রোডঘেঁষে মলিনা মিষ্টির দোকানলাগোয়া পর পর চারটি স্টেশনারি দোকান আছে আমাদের পরিবারের, তা সবই তখন ভাড়ায় চলতো। মধ্যেখানে প্রধান সড়কের পুবে মানিকগঞ্জের দাসরা বাজার। এই বাজারে একটি মাত্র স্টুডিও। রেখাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন ছবি তুলতে এলাম।
মায়ের কাঞ্জিভরম শাড়িখানা পরে বড় হওয়ার কি আত্যন্তিক প্রচেষ্টা। স্টুডিওতে গিয়ে বিনুনী ছেড়ে সিনেমার নায়িকাদের মতো পোজ দিয়ে ছবি তোলার কী যে আকূতি, রেখার সঙ্গে আবার যৌথ ছবি। সেই ছবির ভেতরে ফিরে ফিরে নিজেকে দেখা। কী যে! ভীষণ এক নার্সিসিজমে আক্রান্ত সময়, নিজেই নিজের প্রেমে যেন বিভোর। সদ্য এই তরুণ বয়সের যে পরিবর্তন, তাকে রবীন্দ্রনাথ শনাক্ত করে বলেছেন, ‘কিশোর বয়সে মন যখন জেগে ওঠে, তখন তার যে ভালোবাসা, তার সামনে তো প্রত্যক্ষ নেই কোনো; সে তোভালোবাসাকেই ভালোবাসে।’
আমিও তখন ওই রকম একটা সময় পার করছিলাম যেন। যখন বয়সটা হৃদয়ের মধ্যে ঢুকে যেতো অনায়াসে। যা দেখতেও পেতাম না মোটে। রবীন্দ্রনাথের সেই গান ছিল রাত্রিদিনের প্রার্থনায়, অচেনাকে যেন চিনতে পারি!
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
তোমায় দেখতে আমি পাইনি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি,
আমার হৃদয়-পানে চাইনি॥
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-১৮॥ দিলারা হাফিজ