জানা হলো না, উর্দুভাষার প্রেমপত্রে কী ছিল!
এক.
সময় ১৯৬৭ সাল। মির্জাপুর হাইস্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ শেষ করেছি, এবার সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হবো ভৈরব বাজার রেলওয়ে হাই স্কুলে। এই প্রথম আমার রেলপথে ভৈরব বাজারে যাওয়া। তখনো ফুলবাড়িয়া থেকে ট্রেন ছাড়তো। দেশের সর্ববৃহৎ কমলাপুর রেলস্টেশন যদিও ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু তার কার্যক্রম শুরু হয়নি তখনো। ১৯৬৯ সালে এই স্টেশন থেকে প্রথম ট্রেন যাত্রা শুরু হয়েছে।
গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে যখন ট্রেনটি ছাড়লো, ‘পথের পাঁচালি’র অপু-দুর্গার মতো আমিও ট্রেনের বাঁশি শুনে চমকে উঠেছিলাম সেদিন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাসের অপু ও দুর্গা এক সন্ধ্যাকালে দু’জনে দূরাগত ট্রেনের বাঁশি শুনতে পেয়ে যেমন আনন্দ পেয়েছিল, আমার আনন্দও তার চেয়ে কিছু বেশি বৈ কম ছিল না।
দ্রুতগতির ট্রেন একটার পর একটা লোকালয়ের নতুন নতুন বাড়ি-ঘর পেরিয়ে যাচ্ছে। ঘনসবুজ বাঁশবন, কাশবন, শ্যামল শস্যের মাঠ, ঝাঁজালো দুপুরের আকাশ মাথায় নিয়ে ঘামতে ঘামতে ছুটছে তো ছুটছেই বিরামহীন। পাকাধানের আটি মাথায় বোঝাই করে নিয়ে কৃষক যেমন আনন্দে ছুটে যায় বাড়ির পানে, এই ট্রেনটিও সেভাবে বেড়ানোর আনন্দ বুকে নিয়ে ছুটে চলছিল যেন।
এই প্রথম অনুভব করলাম কোনো ব্রিজের ওপরে চাপলেই ট্রেনটির কণ্ঠস্বর কেমন পাল্টে যায়। বেশ কিছুক্ষণ উচ্চস্বরে ঝনাৎঝনাৎ হেইহেই রইরই ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে তার প্রবল দাপুটে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে যেন পুরবাসীকে। নতুন নতুন দৃশ্যকল্প জুড়ে দিয়ে যেন এক মনোমুগ্ধকর বাইস্কোপ তৈরি হচ্ছে আমার দুচোখের সিনেপ্লেক্সে।
আমি হতবাক।
জানালার বাইরে হাত রেখে তর্জনি দিয়ে বাতাস কেটে কেটে ভাগ করছি। বাতাসের গতির তীব্রতা অনুভব করছি ত্বকের স্পর্শে। জানালা থেকে চোখ ফেরাতে ফুসরত পাচ্ছি না কিছুতেই। ভাবছিলাম, সেই সুদূর-দূর সময়ের কথা, ১৮৬২ সাল। আজ থেকে প্রায় ১৫৮ বছর আগে এদেশে রেলপথের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ছোট ছোট রেলপথ সেকশন চালু করতে থাকে। প্রথম দিকে শুধু অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু হয়েছিল। ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে’ নামের কোম্পানি প্রথম বাংলাদেশে রেলপথ স্থাপন করে।
আমাদের ‘দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া’ পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথম রেলযুগে প্রবেশ করেছিল, সে তো আজকের কাহিনি নয়। ১৯৩৭ সালের ৬ ডিসেম্বর, মেঘনা নদীর ওপর স্থাপিত কিং ষষ্ঠ জর্জ ব্রিজ চালু করা হলে আশুগঞ্জ ও ভৈরববাজারের মধ্যে প্রথম রেলপথ সংযোগ স্থাপিত হয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমেই মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। ভাবলে অবাক লাগে, কতটা সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা।
আহা, আমার প্রাণের ভৈরব বাজারের কথা বলি একটু। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত একটি বাণিজ্যিক শহর তো বটেই। তার নামকরণেও রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
আঠারো শতকের রেনেলের মানচিত্রে ভৈরবের কোন অস্তিত্বই ছিল না। মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পলিবিধৌত বদ্বীপ এককালে‘উলুকানদি’নামে পরিচিত ছিল। মুক্তাগাছার জমিদার ভৈরব রায় তার জমিদারি সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে নতুন জেগে ওঠা এই এলাকায় মানববসতি গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে জমিদারের নামা অনুসারেই এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় ভৈরব বা ভৈরববাজার।
প্রাণোচ্ছ্বল সেইসব সাহিত্যিক ও কবি-প্রাণের আর্তি সুরে-সুরে হয়তো এখনো কোনো নিশুতি রাতে গুনগুন করে ওয়ারির বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে।
ব্রিটিশ আমল থেকে ‘ভৈরব’ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। ভৈরবকে তাই অনেক সময় ভৈরব বাজার বলেও অভিহিত করা হতো। এভাবেই মুখে মুখে ভৈরব বাজার নামটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রথম মুসলমান ব্যবসায়ী হিসেবে যিনি ভৈরব রায়ের জমিদারিতে আসেন, তিনি হলেন হাজী শেখ নূর মোহাম্মদ মিয়া। তিনি একজন তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন ও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে অচিরেই ভৈরবে তার আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন এবং সেই ব্রিটিশ আমলে তিনি হাতিতে করে চলাফেরা করতেন।
জমিদার ভৈরব রায় তার জমিদারি সুপরিচালনা করার জন্য ভৈরব বাজারে রাজ কাচারী ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। যা এখন উপজেলা ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমার জন্মের এক বছর পরে ১৯৫৬ সালে ভৈরব পৌরসভা গঠিত হয়। যদিও ‘ভৈরব’থানা হিসেবে ঘোষিত হয় ১৯০৬ সালে। পরে ১৯৮৩ সালে এই থানাকে বর্তমানের ভৈরব উপজেলায় উন্নীত করা হয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধের সময় তৎকালীন ভৈরব বাজারে পাক বাহিনী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল খুব দ্রুত। কেন, এত দ্রুত, সে কথা পরে বলবো। যুদ্ধের শেষ সময়ের দিকে পাকবাহিনী ভৈরব রেলওয়ে সেতু বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। বর্তমানে এই উপজেলায় ১টি পৌরসভা, ৭টি ইউনিয়ন, ৩২টি মৌজা ও ৮৪টি গ্রাম রয়েছে। ভৈরবের মোট জনসংখ্যা আড়াই লক্ষের অধিক। এই বন্দরনগরী ভৈরবের বেশিরভাগ মানুষ ব্যবসায়ী। দেশের কয়েকটি পাইকারি কয়লা বিক্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ভৈরব বাজার তার অন্যতম একটি।
ভারতের মেঘালয় থেকে সুনামগঞ্জের তাহেরপুরের টেকেরঘাট হয়ে নদীপথে ভৈরবে কয়লা আমদানি করা হয়। ইটভাটা ও রড তৈরির কারখানায় ভৈরব থেকে প্রতি মৌসুমে গড়ে প্রতিদিন তিন হাজার টন কয়লা যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। জুতা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পুরান ঢাকার পরই ভৈরবের অবস্থান। বর্তমানে ভৈরব পৌর এলাকা ও উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০টি গ্রামে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় মিলিয়ে সাত হাজারেরও বেশি জুতা তৈরির কারখানা।
দুই থেকে আড়াই লাখ শ্রমিক ভৈরবের এ জুতা শিল্পে জড়িত। জুতার ব্যাগ তৈরির কারখানা রয়েছে দুই-তিন হাজার। সেখানেও কাজ করছে ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক। মেঘনা নদী বিধৌত ভৈরবের বিশাল এলাকাজুড়েই জলাভূমির আধিক্য। পেশাজীবী নৌকার মাঝি ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে এক শ্রেণীর লোক নৌকা কিনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে লোকজন পাড়াপাড় করেমাঝি হিসেবে বাড়তি উপার্জন করে থাকে। বন্দরনগরী ভৈরবের রাতের মাছের আড়ত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মাছের আড়ত হিসেবে পরিচিত।
এখানে দুই শতাধিক মাছের আড়ত রয়েছে। এ আড়তকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে শতাধিক বরফ কল, হোটেল, বিভিন্ন মনোহরি ও প্রসাধনীর দোকান। দর্শনীয় স্থান হিসেবে আছে সিরাজীয়া দরবার শরীফ, কালিকা প্রসাদ ও মেঘনা ব্রিজ। এই ভৈরবের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ। অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকারী বিপ্লবী নেতা রেবতী মোহন বর্মণ (১৯০৫ -১৯৫২)। যিনি বিশ শতকের একজন সাম্যবাদী ধারার লেখকও বটে। তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করে বাংলাদেশ অঞ্চলে মার্ক্সবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
জিল্লুর রহমান (১৯২৯—২০১৩)বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলীয় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার স্ত্রী আইভি রহমান (১৯৪৬—২০০৪) আওয়ামী লীগের একজন নেতা ছিলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় তিনি আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের উত্তরাধিকার নাজমুল হাসান পাপন বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। ড. আবদুল লতিফ ভূইয়া সাবেক এমপি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন সাইন্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতায় তার অবদান রয়েছে।
দুই.
খালুজানের পোশাকি নাম আবদুল জলিল, ডাক নাম মাখন। পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। এরা আমার মায়ের ফুপাতো ভাই-বোন। তৃতীয় নম্বর ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আমার মায়ের মেজো বোন সাজির সঙ্গে। মুসলমান পরিবাবের আগের দিনে এমন আত্মীয়তার বিয়ের প্রচলন খুব বেশিই ছিল।
খালুজানের দুই বোনের মধ্যে বড় জনের নাম রাবেয়া বেগম, ছোট বোন খোদেজা বেগম। খোদেজা বেগম কবি জানাহানার আরজুর মা। বড়জন গিনি ভাইয়ের মা। ঢাকা টু মির্জাপুর যাতায়াতে বেশির ভাগ সময় ঢাকার বনগ্রামে গিনিভাইর বাসায় উঠতেন খালুজান, সঙ্গে আমিও। গিনি ভাইয়ের বাসাটি ছিল আমাদের পান্থনিবাস। এই বাসা থেকে কবি জাহানারা আরজুর বাসায় হেঁটে যেতে লাগতো দশ মিনিট। সেখানে মাঝে মধ্যে বেড়াতে যেতাম খালুজান কিংবা বড়মার সঙ্গে। কিন্ত অধিকাংশ সময়ে রাত্রিবাস হতো বনগ্রামে গিনি ভাইয়ের বাসায়।
আরও একটু পেছনে তাকালে বলা যায়, বনগ্রামের এই বাসাটায় দীর্ঘদিন আরজু আপাই বাস করেছেন তার সন্তানাদি নিয়ে। তাদের কলকাতার সম্পত্তির সঙ্গে আওয়াজ-বদল করে যখন র্যাং কিং স্ট্রিটের বাসায় উঠে যান, তখন বনগ্রামের বাড়িটি খালাতো ভাই গিনির নামে বরাদ্দ করে দিয়ে গেছিলেন।
আরজু আপা তার নতুন বাড়ির নাম রেখেছিলেন কবিতাঙ্গন। চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট দশকের অধিকাংশ কবি শিল্পী সাহিত্যিক ‘কবিতাঙ্গন’-এর নিয়মিত সাহিত্য আড্ডায় মিলিত হতেন। কবি আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান থেকে শুরু করে আবিদ আজাদসহ অনেকেই এসেছেন এই বাড়িতে। সংস্কৃতি জগতের এই জ্ঞানী-গুণীদের পদধুলিতে একদা ‘কবিতাঙ্গন’সাহিত্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পত্র-পল্লবে পরিণত হয়েছিল। যারা ছিলেন সেই সময়ে, তাদের অনেকেই আজ অনন্তের সুনাগরিক। এখনো অনেকের মনের মধ্যে কবিতাঙ্গনের আড্ডার অবিস্মরণীয় স্মৃতির হাসিরা অমলিন। সর্বশেষ আরজু আপার শবমেহের কবিতার চলচ্চিত্রায়ণের মহরতে বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে রফিক আজাদ, আমি ও আমার বন্ধু ডলি জহুর, ছবির নির্মাতাসহ অনেকেই সেদিন কবিতাঙ্গনের ফ্লোরে বসে শবমেহের নামের চরিত্রে ডলি জহুরের অনবদ্য অভিনয় উপভোগ করেছিলাম।
মনে হয় এই তো সেদিন। কিন্তু সময়ের ঘাট পেরিয়ে কখনো কখনো কালের তরী অঘাটে গিয়ে ভেড়ে। সেই নিয়মেই কবিতাঙ্গনের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলো, সবকিছু যেন মুহূর্তেই হারিয়ে গেলো ইটকাঠের স্তূপে। শত শত পদচ্ছাপও ধুয়েমুছে নিয়ে গেলো সময়ের ঢেউ এসে। প্রাণোচ্ছ্বল সেইসব সাহিত্যিক ও কবি-প্রাণের আর্তি সুরে-সুরে হয়তো এখনো কোনো নিশুতি রাতে গুনগুন করে ওয়ারির বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে।
তিন.
আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, তখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমি মির্জাপুরে পড়তে আসার সুবাদেই এই মাতৃকুলীয় আত্মীয়-স্বজন ও তাদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছি। খালুজানের দুই বোনই ছিলেন আমার প্রিয় খালামনি। দুজনেই জীবিত তখন। একজন অশীতিপর, অস্যজন পঞ্চাশোর্ধ। দুই বোনেরই দুধে-আলতা গায়ের রঙ, প্রিয়দর্শিনী, অসাধারণ সুন্দরী তো বটেই। খোদেজা খালা সেই সময়ে আধুনিক মন ও মননের অধিকারী হিসেবে পরিবারে সবার আদর্শ ছিলেন। উপরন্তু সন্তান মানুষ করার ক্ষেত্রে তিনি অনেকের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। কেননা, ইতোমধ্যে তার বড় মেয়ে জাহানারা আরজু, কবি হিসেবে খ্যাতিমান, মেয়ে জামাই হাইকোর্টের বিচারপতি। সেজো ছেলে আবু সদ্য ডাক্তার হয়ে বেরিয়েছে।
এজন্যে খুব মন খারাপ লাগে। অঙ্ক বেশি করে প্র্যাক্টিস করো, দেখো তখন সব পারবে। আচ্ছা বলে, মূল সমস্যা পাশ কাটিয়ে যাই আপাতত।
ঝর্ণা আপাও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পাস করে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছেন। শবনু আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রী। থাকেন শামসুন্নাহার হলে। এই হলে আমিও উঠেছিলাম শবনু আপার ডাবলিং লেটারের জোড়ে। আরজু আপার সুপারিশে। আরজু আপা ও গিনি ভাইয়ের মা; দুই খালাই বেশ দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। গিনিভাইর মায়ের মাথায় তখন কাশফুলের মতো সাদা চুল, ধবধবে সাদা বসনে ফুরফুরে এক সৌম্যমূর্তি যেন। বেশিরভাগ সময় বসে থাকতেন বিছানায়।
পাকা পেয়ারের মতো তার মুখখানা খুব ভালো লাগতো আমার। বনগ্রামের বাসায় যে কদিন থাকতাম, আমি কেন যেন এই বুড়িখালাকে ঘিরেই ঘুরপাক খেতাম বেশি। এটা সেটা হাতের কাছে এগিয়ে দিতাম। গিনি ছিলো তার একমাত্র পুত্র, বাকি তিনজন কন্যা ছানা, পটল ও রেনু। বাড়ি থেকে নানিকে ছেড়ে এসে, সেই অভাববোধ থেকেই বুঝি নানির মতো বয়েসী কাউকে আশ্রয় করে সময় কাটাতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। তিনিও আমাকে বলতেন, ও আমার ঝাড়ুন-গামছা, তুমি আমার কাছে এসে বসে থাকো।
গিনিভাই তার মায়ের ঘরে ঢুকলেই বলতেন, আহা আমাদের লেবুর মেয়েটা কি লক্ষ্মী হয়েছে, দেখছ গিনি? হুম, ওর মা, লেবু খালা তো আমার সমান বয়সী ছিল, তাই না মা?
-হুম, তোমার সমান বয়সী ছিলো, লেবুর মেয়েটা লেবুর মতোই স্নিগ্ধ হয়েছে খুব, তাই নারে গিনি।
গিনিভাইও বিয়ে করেছিলেন তার আর এক মামাতো বোন রেখা আপাকে। রেখা আপা কী যে চমৎকার নিভৃতচারী মানুষ এবং রন্ধনশিল্পী ছিলেন। তার মতো মানুষ আমি দুজন দেখিনি আত্মীয়স্বজনের মধ্যে। সকালে পুরনো ঢাকার মিষ্টির দোকানের বুনদিয়া ও ডিমভাজি সহযোগে রেখা আপার হাতের পরোটা ভাজা খাওয়া আর অমৃত লাভ করা সমান কথা। লুচি, সূচি দুই কন্যা ও একপুত্র লুনাকে নিয়ে এক আদর্শ পরিবার।
লুচি কবিতা লেখে, গান গায়, লুনার তবলার বোল কী মধুর, বলাই বাহুল্য। খালুজানের চতুর্থ ছোটভাই হামেদ মিয়া, ডাক নাম ননী। আমাদের কাছে তিনি ননী মামা হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনিই রেলের কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সুবাদে রেলের স্টাফদের বড় একটা কোয়ার্টারে থাকতেন তিনি। তার পরিবার থাকতো মানিকগঞ্জের জাবরা গ্রামে। প্রথম পুত্র সন্তান লকেট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একাই থাকতেন এই মস্ত কোয়ার্টারে।
লকেট ভাই আমার চেয়ে বছর চারেকের বড় হবেন। তখন তিনি কোরানে হাফেজি পড়ছিলেন ভৈরবের এক মাদ্রাসায়। ছোট ভাই ননীর অনুরোধে সন্তান হারানো শোকসন্তপ্ত বড়মা ও খালুজান এসে উঠলেন রেলওয়ের এই কোয়ার্টারের বাসায়। বেশ বড় বড় শোবার কক্ষ ৩/৪ টা। প্রবেশ পথের পরেই শান বাঁধানো চৌকোণ উঠান, তার কোণায় একপাশে একটা পেয়ারা গাছ। পেয়ারা গাছের তলেই ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট এক টুকরো জায়গা নিয়ে হিসু করার পেশাবখানা ছিলো। যার ইটের পাঁচিল পুরোটাই ঢাকা পড়েছিল সবুজ শ্যাওলার আস্তরে।
শান্ত ছিমছাম ছায়াঘন প্রকৃতিক আবেশে ঘেরা। সাধারণত স্টাফ কোয়ার্টারগুলো যেমন হয়। পশ্চিম দিকের একটা কক্ষে থাকি, আমার পড়ার চেয়ার টেবিলসহ। ননী মামার দুই ছেলে দুই মেয়ে। তার পরিবারের সন্তানদের মাদ্রাসা কেন্দ্রিক লেখাপড়া। যদিও তার বড়কন্যা আসমা আমার সমবয়সী। আসমার ছোটবোন নাসু মাদ্রাসা থেকে কোরানে হাফিজ হয়েছিল। তবে আসমা ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আমার সহপাঠী ছিল।
ননীমামার চেহারার মধ্যে এক ধরনের ঈমানি প্রতিজ্ঞা ও জৌলুস ছিল। বেশ প্রাণবন্ত মানুষ মনে হয়েছে তাকে। আমাকেও তিনি প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ার জন্যে তাগাদা দিতেন, আমি তা যথাসম্ভব মেনে চলতে চেষ্টা করেছি। কেননা, আমার মনে হতো তিনি আমাকে তার কন্যা আসমার মতোই ভালোবাসেন, পছন্দও করেন। এজন্যে আমিও তার ভালোবাসা না হারানোর প্রতিজ্ঞায় নামাজ পড়তে শুরু করে দিয়েছিলাম, পাঁচ ওয়াক্ত না হলেও ফজর মাগরিব তো বটেই। আমাদের বাড়ির ধর্মীয় হাওয়া ছিল অনেকটা উদারনৈতিক মানবধর্মের বাতাবরণে। ছোটবেলায় আমপারা হাতে আমরাও ধর্ম শিক্ষার জন্যে নিয়মিত রহিমুদ্দিন মুন্সীর বাড়ি গিয়ে পাঠ নিয়েছি। যথা সময়ে কোরান খতম হয়েছে কিন্তু খুব ছোট্ট বেলা থেকেই শিশুদের ওপর নিয়মিত নামাজ পড়ার এমন চাপ ছিল না। এই কোয়ার্টারের অধিকাংশ আবাসিক পশ্চিম পাকিস্তানের বিহারী জনগণ। হাতেগোনা বাঙালি পরিবার ছিল কয়েকটি মাত্র। বাকি সবাই প্রায় উর্দু স্পিকিং। কিন্তু তারা বাংলাও বলে বেশ ভালো। ভর্তির পরে রেলওয়ে হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে কয়েকদিন যাতায়াতের ফলে যে মেয়েটি আমার বন্ধু হলো তার নাম নীলু।
আমাদের বাসার উল্টোদিকের কোয়ার্টারে ছিল অন্য এক নীলু, সে ছিল নবম শ্রেণীর ছাত্রী। আমাদের সিনিয়র। দুই নীলুই পশ্চিম পাকিস্তানি, উর্দু ভাষাভাষি। বাবার রেলওয়ের চাকরি সুবাদে তারা বেশ কিছুকাল থেকেই পূর্বপাকিস্তানের এই ভৈরব বাজারে বসবাস করছে নিজদেশ জ্ঞানে। ট্রেনের মতোই লম্বা লাইনে দাঁড়ানো মুখোমুখি স্টাফ কোয়ার্টার ছিল। তার ফাঁকে ফাঁকে কতকটা খোলা জায়গায় ঢালাই করা পাড় বাঁধানো সিমেন্টের পাকা ফ্লোরে পানির কল বসানো ছিল। কিছুদূর পরপরই খেলার মাঠ ছিল সবুজ তৃণেবিস্তৃত।
বাতাসে অক্সিজেনের অভাব ছিল না, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাসের আদর্শ স্থান তখন এই রেলওয়ে কোয়ার্টারের বসত আঙিনা। সকালে কোয়ার্টারের ছেলেমেয়েদের অনেকেই দাঁত মাজতে মাজতে কলপাড়ে এসে হাতমুখ ধুয়ে ফিরে যেতো যার যার বাসায়। কেউবা হাতে পানির জগ কিংবা ঘটি নিয়ে আসতো। ফিরে যাওয়ার সময় কল চেপে ঘটি ভরে তাজা পানি নিয়ে ফিরতো।
আমাদের বাসার গেটের উল্টোদিকেই ছিল এমন একটা কলপাড়। আমিও সকালে উঠে সেখানে মাঝে মধ্যে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসতাম। নীলুও আসতো সেখানে। ফলে স্কুলে যাওয়ার আগেই একদফা কথাবার্তা হতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বিকেলে নীলুর সঙ্গে মাঠে খেলতে যাই। ছোঁয়াছুঁয়ি, হাডুডু, গোল্লাছুট জাতীয় নানা ধরনের খেলায় নিমগ্ন থাকতাম। তখন পোশাক বলতে হাফপ্যান্ট ও ফ্রক পরি। বেশ কদিন খেলাধুলার পরে হঠাৎ খেয়াল হলো আমাদের খেলার পুরো সময়টাজুড়ে মাঠের পুবদিকে কড়ই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকে দুটি ছেলে। দুজনের পরনেই সাদা শার্ট, সাদা হাফপ্যান্ট। তার একজন আমাকে যে দূর থেকে নিবিড়ভাবে নীরক্ষণ করছে অভিনিবেশসহ, সেটি কেন যেন দ্রুতই বুঝে যাই। আমার খুব অস্বস্তিবোধ হতে থাকে। বুঝতে পারার পর থেকে সপ্তাহখানেক কাউকে কিছু বলি না। কিন্তু একটা পর্যায়ে এই অস্বস্তিবোধ যখন গা গুলাতে থাকে, ফলে মনও খুব বিগড়ে যাচ্ছে বুঝতে পারি। এ কেমন অনৈতিকতা, আমরা ছোটরা খেলাধুলা করছি, ওরা কেন এভাবে আমাদের দিকে অসভ্যের মতো তাকিয়ে থাকবে? বা এই তাকিয়ে থাকার মানে কী, তাও বুঝি না। বাধ্য হয়ে পরের দিন প্রথমে নীলুকে বলি সে কথা। নীলু বলে হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি।
জানো তো ওরা ক্লাস নাইনে পড়ে। বড় নীলুর সহপাঠী। একজনের নাম জাভেদ, আর একজনের নাম বাবু। জাভেদ তোমাকে পছন্দ করে, তাই আমাদের খেলার সময়ে ওরা দুজনেই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। তাছাড়া ওরা দুজনেই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে একসঙ্গে সময় কাটায়।
-এসব কী বলো নীলু। তুমি জানো আমাদের পরিবার খুব রক্ষণশীল। আমাদের বাড়ির মেয়েদের কখনো এমন সম্পর্কের রেকর্ড নেই। এটা জানলে তো আমার পড়ালেখা বন্ধই করে দেবে। তুমি তা জানো। প্লিজ নীলু তুমি ওর মাকে বলে দেবে ছেলেকে শাসন করতে, নইলে কিন্তু আমার লকেট ভাইকে জানিয়ে দেবো আমি, আমার হয়তো পড়া বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু ওরও ক্ষতি হবে অনেক। আচ্ছা, আমি ওর মাকে জানাবো বলে চলে গেলো সেদিন নীলু। স্কুলে যাই বটে, মনটা কেমন যেন খচখচ করে সারাক্ষণ, কেন এমন হলো, আমার বেলায় কেন এমন হলো। মা-বাবা, ভাই-বোন ছেড়ে শুধু লেখাপড়ার জন্যে এখানে নিঃসঙ্গ পড়ে আছি, সে পড়াটাও কি ভালোভাবে করতে পারবো না, ওই কুপুত্রদের জ্বালায়?
টিফিন আওয়ারে আমরা মেয়েদের কমন রুমে গিয়ে বসি, ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে উলুঝুলু চুল হাত দিয়ে ঠিক করে নেই। টিফিন বক্স খুলে এক কোণায় বসে নীলু আমি দুজনে মিলে সামান্য কিছু খাই। নীলু ছাড়া আরও বাঙালি দুই একজন বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলি, ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী ক্লাসে ঢুকে যাই। একদিন কমন রুমের বাইরে উঁকি দিতেই দেখি, ওই দুই বন্ধু মেয়েদের কমন রুমের খোলা দরোজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওই একই ভঙ্গিতে।
অস্বস্তি আরও বেড়ে যায় আমার, মনের মধ্যে মরচেপড়া এক পেরেক এমনভাবে ঢুকে গেলো যে, খেলতে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। বাসায়ও মনমরা হয়ে বসে থাকি। একদিন লকেট ভাই জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে দিলু? বললাম, না কিছু হয়নি। ক্লাসে অঙ্ক বেশি বুঝি না তো, অ্যালজাবরা তো আরও বুঝি না। এজন্যে খুব মন খারাপ লাগে। অঙ্ক বেশি করে প্র্যাক্টিস করো, দেখো তখন সব পারবে। আচ্ছা বলে, মূল সমস্যা পাশ কাটিয়ে যাই আপাতত।
চার.
সেদিন নীলু কলপাড়ে দাঁড়িয়ে বললো, আমি জাভেদের মাকে জানিয়ে দিয়েছি যে, জাভেদ তোমাকে খুব ডিস্টার্ভ করছে।
-কী বললো জাভেদের মা?
-আর বলো না। জাভেদকে খুব পিটিয়েছে। তারপর খাটের পায়ের তলায় ওর হাত চাপা দিয়ে রেখে শাস্তি দিয়েছে, যেন তোমার সঙ্গে অমন ব্যবহার আর না করে, সেজন্যে।
শুনে আমি আশ্বস্ত হলাম। আবার মাঠে গিয়ে আগের মতো খেলাধুলায় মেতে উঠলাম।
ওমা! দুদিন না যেতেই আবার দুই বন্ধু মিলে সেই একই দৃশ্যের অবতারণা। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে অবলোকন। আমার খেলার দৌড়-ঝাঁপ অনুসরণ করে প্রতি মুহূর্তে তার দৃষ্টির লেন্স পাল্টায়। দুচোখে রাজ্যের দুষ্টুমি, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসির মিনতিধরে রেখে একই ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ না আমাদের খেলা সাঙ্গ হয়। এছাড়া যেন আর কোনো ব্রত নেই ছেলেটির।
আমি আগামীকাল বাড়ি যাচ্ছি ঢাকা হয়ে, তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছিলাম। আসি, কেমন!
খেলা শেষ করে বাসায় ফেরার পথে নীলুকে আবার চেপে ধরলাম।
-নীলু, তুমি যে বললে, জাভেদ ভালো হয়ে গেছে মায়ের পিটুনি খেয়ে। সে তো আবার আমাদের খেলার সময়ে হাজির হয়েছে। এর মানে কী?
-আমি কী বলবো বলো, জাভেদ তোমাকে একটা চিঠি লিখেছে উর্দু ভাষায়। জাভেদের সহপাঠী বড় নীলুর কাছে সে দিয়েছে চিঠিটি তোমাকে যেন পড়ে শোনায়।
-চলো, বড় নীলুর বাসায় যাই, সে তোমাকে জাভেদের দেওয়া চিঠি পড়ে শোনাবে।
-এসব কী বলো নীলু। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমি কেন ওই চিঠি শুনতে যাবো? কস্মিনকালেও না।
আমি রাগে-দুঃখে-অভিমানে নীলুর সঙ্গে কথা বললাম না দুদিন। স্কুলে গিয়ে সে আবার স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো আমাকে। নীলু ছাড়া আমারও তো তেমন আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু কেউ নেই, বাসার কাছাকাছি। আরও দুজন আছে কিন্তু তারা ভৈরবের বাঙালি পরিবারের মেয়ে, তাদের বাড়িও স্কুল থেকে অনেক দূরে। কাজেই হরহামেশার বন্ধু বলতে ওই নীলুই সম্বল।
সামনে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা। রাত জেগে পড়তে পারি না, ঘুমিয়ে যাই। ডেকে দেওয়ার কেউ নেই। বড় মাকে সাহস করে বলতে পারি না যে, আপনি আমাকে ডেকে দেবেন। এমনিতেই শোক-তাপের মানুষ তারা দুজনেই। প্রায় সময় বিষণ্ন থাকেন। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সময়টা কেমন যেন অন্ধকার রাতের মতো ভারী ওঠে, মাকড়সার জালে জড়িয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এক অচেনা স্থবির সময়। আমি যাকে মোটে চিনতেও অপারগ।
অন্তহীন সেই বড় বেদনাকে বুকে ধারণ করে তারা দুজনেই যেন বাঁচার জন্যেই বেঁচে আছেন কেবলই। বড় মা ও খালুজান যেটুকু কর্তব্য, তার বাইরে কথাও বলেন না তেমন।
আমি ভয়ে ভয়ে চলি, সদা সতর্ক থাকি, আমার কোনো আচরণ যেন তাদের মনে দুঃখের কোনো কারণ না হয়। বড় মাকে কখনো সখনো সামান্য হাসতে দেখলে, তখন আমার ভেতরটাও মেঘ সরিয়ে হেসে ওঠে। ভালো লাগে। মায়ের মুখ মনে পড়ে বেশি বেশি।বাসার ভেতরকার গুমোট হাওয়ার মধ্যে বাস করার চেয়ে কলোনির সবুজ ঘাসে পা ফেলে একাকী হাঁটাও অনেক আনন্দের এবং সময়ে মধুরও মনে হয়। হাঁপ ছাড়তেই দৌড়ে যাই নীলুর কাছে। ওদের বাসার ভেতরে গিয়েছি খুব কম সময়। নীলু ছিল বড় সন্তান। পিচ্চি পাচ্চা মিলে অনেক ভাই-বোন ওর।
ওকে বাসা থেকে ডাকতে গিয়েছি যখন, কেবল তখনই সালোয়ার কামিজ পরা ওর মাকে দেখেছি ২/১ বার শুধু। রাতজাগার সমস্যা নিয়ে অগত্যা নীলুর সঙ্গে কথা বলি, সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে দারুণ এক সমাধান বের করে দিলো। তার কাছেই প্রথম জেনেছিলাম, কিভাবে নিজে নিজে ঘুম থেকে জেগে ওঠা যায়।
নীলুকে বলি আর একবার বলো তো কী করতে হবে?
-শোনো, ধরো তুমি ভোর চারটের সময় উঠতে চাও। তুমি মনে মনে সময়টা ঠিক করবে প্রথম। তারপর তিনবার নিচের নাম উচ্চারণ করবে, দিলু, দিলু, দিলু। এরপর বুকে ফুঁ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
দেখবে ঠিক চারটার সময় উঠে পড়েছো তুমি। তোমার ঘুম ভেঙে যাবেই সে সময়ে।
-তাই নাকি?
-আজই পরীক্ষা করতে পারো।
সত্যি নীলুর কথায় কাজ হলো। এরপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেই যখন খুশি রাত্রি জেগে পাঠ সম্পন্ন করেছি। নীলুর থেকে পাওয়া এই শিক্ষা আজও আমার কাজে লাগে।
পরীক্ষা প্রায় শেষ, ননী মামার সঙ্গে বাড়ি চলে যাবো। এই সময়ে খালুজানের নামে একটি পোস্টকার্ড এলো, মায়ের হাতের লেখায়। মায়ের জলবসন্ত হয়েছে এই বয়সে, সেসব জানিয়ে খালুজানকে লিখেছেন মা। পরীক্ষা শেষে আমাকে যেন একটু দ্রুত বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, সেই অনুরোধ জানিয়েছেন পোস্টকার্ডে।
বাড়ি যাওয়ার আগের দিন নীলুর সঙ্গে খেলার মাঠেই দেখা।
নীলু বললো, জানো দিলু, জাভেদ খুব দুঃখ পেয়েছে, তুমি ওর চিঠিটি শোনোনি বলে।
-নীলু, আমরা বাঙালি মেয়ে আমাদের তুমি চেনো না। ভীষণ একরোখা আমরা। আমি তো এখানে ছেলেখেলা করতে আসিনি। পড়তে এসেছি, কাজেই আমার সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আশা করি আর কথা বলবে না তুমি।
-রাগ করো না দিলু, জাভেদ বলেছে কী জানো? বলেছে, আমি যদি ডাক্তার হই, তবু কি ওর বাবা-মা আমার সঙ্গে ওকে বিয়ে দিতে আপত্তি করবে?
-প্লিজ, নীলু তুমি আমার বন্ধু। তুমি আমার সঙ্গে এসব আলাপ আর করবে না। আমি আগামীকাল বাড়ি যাচ্ছি ঢাকা হয়ে, তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছিলাম। আসি, কেমন!
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-১২॥ দিলারা হাফিজ