(পর্ব-১৫)
অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকের অধ্যাপকদের অন্যতম। এমএসসি পরীক্ষার পরেই সেই ১৯২১-২২ সালে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯২১ থেকে ১৯৪৫-৪৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রভাষক। মাইনে পেতেন দু’শো টাকা। অথচ এ নিয়ে কোনও অনুযোগ ছিল না তাঁর। সরল আত্মভোলা মানুষ হিসেবে তাঁর খ্যাতি সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক-সকল মহলে ব্যপ্ত। বিষয় এক না হলেও অধ্যাপক রাজ্জাকেরও অধ্যাপক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। এসব কথা উঠে এসেছে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম এবং অধ্যাপক রাজ্জাকের মাঝে এক আলাপচারিতায়।
দাবা খেলার প্রতি অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের একাগ্রতার কথা অনেকেরই জানা। এমনকি তাঁর কিশোর ছেলে পুকুরে ডুবে মারা গেলে, সেই খবরটি জানানোর জন্য তাঁকে খুঁজে বের করতে গিয়ে দেখা গেলো—তিনি দাবা খেলছেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ছিলেন তাঁর দাবা খেলার সঙ্গীদের একজন। কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে দাবা খেলতে গিয়ে একবার বেকায়দায় পড়েছিলেন রাজ্জাক। ১৯৭৬ সালে সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সেই ঘটনা উল্লেখ করেন তিনি। অধ্যাপক রাজ্জাকের বর্ণনাটি এরকম—১৯৪২-৪৩ সালের ঘটনা। কাজী সাহেব থাকেন গেট হাউসে। তখন মাঝে মাঝে রায়ট হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি বন্ধ। সন্ধ্যা থেকে কারফিউ। ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং মানে বর্তমানের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দক্ষিণ মাথায় ইউনিভার্সিটি শিক্ষকদের ক্লাব। বিকেলের দিকে এসেছি। আসাতেই কাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা।
এই যে এসেছো? ভালো হয়েছে। অনেকদিন খেলা হয়নি।
আমি বললাম—না স্যার, খেলতে বসবো না। খেললে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। কারফিউ, তখন বাসায় ফিরতে পারবো না। অসুবিধা হবে। আমার কথা শুনে কাজী সাহেব তো আকাশ থেকে পড়লেন—তুমি ভেবেছো আমার এসব জ্ঞান নেই? সন্ধ্যা পর্যন্ত কি রাখবো? তার আগেই তোমাকে ছেড়ে দেবো। আর কী করা! বসলাম, খেলতে। সন্ধ্যা বলতে রাত দশটায় খেলা শেষ হলো।
খেলা শেষ হলে আমি কাজী সাহেবকে বললাম—স্যার, এই সময়ে যাইতে বললেও আমি যাইতে-টাইতে পারুম না। বার হইলেই রাস্তায় আমারে গুলি করবে।
কাজী সাহেব চিন্তিত মুখে বললেন—তাইতো!
আমি বললাম—নিচে আপনার ড্রইং রুম আছে। আমি সেখানে শুয়ে থাকবো।
নিচে মশা আছে যে!
আমি বললাম—না স্যার, মশা-টশায় আমার অসুবিধা হবে না। আমি ওখানেই থাকবো।
তুমি খাও-দাও নাই কিছু।
আমি বললাম—না স্যার, আমি কিছু খাবো না।
কাজী সাহবে বললেন—আচ্ছা। এই বলে উনি ওপরে চলে গেলেন। আমি শোবার চেষ্টা করছি। কিন্তু মশার কামড়ে ঘুমানো কি যায়? হঠাৎ রাত দু’টা-আড়াইটার সময়ে গেটে হই-চই। কী ব্যাপার? বাইরে কারফিউ। পাঠান পুলিশ, এরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইউনিভার্সিটির ভেতরেও ফেকু দারোয়ান ও তার দলবল পাহারা দিচ্ছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, হইচইটা কিসের। ব্যাপারটা বোঝার জন্য কাজী সাহেবের নিচের তলার ড্রইং রুমের দরজা খুললাম। তখন ওপরে কাজী সাহেবের স্ত্রীরও গলা শুনতে পেলাম। তিনি আমার দরজা খোলার শব্দ শুনে জিগ্যেস করছেন কাজী সাহেবকে—নিচের দরজা খুললো কে? নিচের ঘর তো খালি। শুনলাম, কাজী সাহেব তাঁর স্ত্রীকে বলছেন—ও কিছু না। কাজী সাহেবের স্ত্রী বলছেন—ও কিছু না, মানে কী? দরজা খুললো কে?
এই পর্যন্ত শুনলাম। আর কিছু শুনলাম না। দুই-তিন মিনিট পরে কাজী সাহেব আসলেন—এই দ্যাখো, কী সব বলছে আমাকে।
আমি বললাম—কী বলছে খেলতে এনে রেখে দিয়েছি। তোমাকে যেতে দেইনি। শোবার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাকে যাতা বলছে। আচ্ছা তুমিই বলো, আমি তোমাকে বলিনি, এখানে মশাটশা আছে? তুমি কেমন করে থাকবে?
আমি বললাম—হ্যাঁ, স্যার, তাতো কইছিলেনই। আমিই না করেছি।
কাজী সাহবে বললেন—দেখোতো, আমার কথা শুনে না। আমায় বলছে, আমি তোমাকে খেতে বলিনি। আমি তোমাকে খেতেও তো বলেছিলাম।
আমি বললাম—হ্যা, স্যার আপনি তো খেতেও বলেছিলেন।
এখন আমার কথা কিছু শুনছে না। তোমাকে ওপরে যেতে বলছে। চলো ওপরে।
আমি ওপরে গেলাম।। একদিকে মিসেস হোসেন থাকেন। আরেক দিকে কাজী সাহেব। আমি বললাম—এই রাতে আমি আর খাবো না। তবে শুতে হবে ওপরে। নিচে আর শোয়া যাবে না। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতা-সরদার ফজলুল করিম)
পরবর্তীকালে এই নিরাপদ কাজের মধ্য থেকে আরেকটা মনোভাব গড়ে উঠলো যে, কোনো একখানা বইকে ভালো লাগলে অপর বন্ধুকে না বলে, এমনকি না শুনিয়ে স্থির থাকতে পারতাম না।
কাজী মোতাহার হোসেনের ছেলে সেবা প্রকাশনীর মালিক কাজী আনোয়ার হোসেন ‘মাসুদ রানা’ নামে সিরিজ লিখে খ্যাতি পেয়েছেন। কাজী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী এক সময়ের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন। তার অন্য চার বোন নিলুফার ইয়াসমিন, সাবিনা ইয়াসমিন, ফৌজিয়া ইয়াসমিন, নাজমা ইয়াসমিন। নিলুফার এবং সাবিনাও গানের জগতে ধ্রুবতারা। সবার বড় ফরিদা ইয়াসমিন ‘ফেলে আসা দিন’ নামে আত্মকথায় লিখেছেন কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী ও ঢাকার স্মৃতি। দেশভাগের কারণে তাদের পরিবার কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে স্থায়ী হয়েছিল। কবির সুমনকে বিয়ে করে সাবিনা ইয়াসমিন এখন কলকাতার বাসিন্দা। এ প্রসঙ্গে ফরিদা ইয়াসমিন লিখেছেন, ‘সাবিনা কলকাতায় থাকে তাই মনে হয়, আব্বার অতৃপ্ত আত্মা বুঝি শান্তি পাচ্ছে। উনি তো ওখান থেকে আসতে চাননি। মজা করে সাবিনাকে বলি, আমরা চার বোন ওপারে জন্ম নিলাম, এপারে থাকি আর তুই ঢাকায় জন্ম নিয়ে এখন কলকাতায় থাকিস।’
কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন কবি নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঢাকা এলে কাজী সাহেবের বাসা বর্ধমান হাউসে উঠতেন নজরুল। কাজী সাহেবের মেয়ে যোবায়দা মির্জা তখন শিশু। কবি যতদিন ঢাকায় থাকতেন যোবায়দা তাঁর পিছু ছাড়তেন না, কবির কোলে-পিঠে চড়ে আনন্দ পেতেন। নজরুলের অট্টহাসি আর অন্যকে হাসানোর স্মৃতি পরিণত বয়সেও যোবায়দার মনে গেঁথে আছে। এসব তুলে ধরেছেন তিনি তাঁর ‘সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলো’ গ্রন্থে। যোবায়দা লিখেছেন, ‘তাঁর সেই হাসি ফুরিয়ে যাবে বলেই কি তিনি একসাথে সব হাসি হেসে নিয়েছিলেন! আগে থেকেই জানতেন যে, সব হাসি কান্নার পাঠ চুকিয়ে একদিন তিনি এই বর্ধমান হাউস থেকে মাত্র কয়েকশ’ গজ দূরে মসজিদের পাশে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে থাকবেন! কোথায় হারিয়ে গেলো সেই আনন্দমুখর দিনগুলো, সেই হৈ-হুল্লোড়!’
আরেক মনীষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, দরদাম না করে কখনও রিকশায় উঠতেন না। দরে না বনলে যতক্ষণ রিকশা না মিলতো ততক্ষণ সামনে হেঁটে চলতেন। এ বিষয়ে তাঁর নীতি ছিল—‘রিকশায় যখন উঠি, আমি যাত্রী সে মালিক। তার সঙ্গে চুক্তি না করে আমি কেন উঠবো এবং চুক্তির ক্ষেত্রেও তার যেমন দাবি থাকবে, আমারও তেমনি বক্তব্য থাকবে। আর রিকশা না পেলে এক পাও হাটঁতে পারবো না এবং রিকশা পেলেই উঠে পড়বো, নতুন যুগের এমন নীতি নিলে পায়ের বল যা আছে, তাও তো আমি হারিয়ে ফেলবো।’
ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের মানুষ ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। যে কোনও সভা-সমিতির নিমন্ত্রণ পেলে তিনি না করতে পারতেন না। কেউ হয়তো ফোনে বলছেন, ‘স্যার, আগামী মাসের অমুক তারিখে আপনি আমাদের স্কুলের মাহফিলে প্রধান অতিথি হবেন।’ তিনি ফোন ধরে বলছেন, ‘একটু অপেক্ষা করুন, আমার নোট বইটি দেখে নেই।’ এরপর নোট বই মিলিয়ে নিতেন যে ওই তারিখে এর আগে অন্য কাউকে ওয়াদা করেছেন কিনা। কেবল শহরের অনুষ্ঠানই নয়। দেশের এমন কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চল ছিল না, যেখান থেকে শহীদুল্লাহ’র ডাক না আসতো। প্রতিটি ডাকেই তিনি অবধারিতভাবে সাড়া দিতেন।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করছি, সৈয়দ আলী আহসান তখন বাংলা অ্যাকাডেমির পরিচালক। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ এবং ‘ইসলামি বিশ্বকোষের’ প্রধান সম্পাদক। সাড়ে ন’টা অফিসের সময়। তরুণরা যদিওবা বিলম্বে আসেন, ড. শহীদুল্লাহ’র কোনও বিলম্ব নেই। একবার নাকি পরিচালক অফিস সময়ের নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনতে অফিসের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে ড. শহীদুল্লাহ সেদিন কয়েক মিনিট দেরিতে পৌঁছেছিলেন। পাছে তিনি মনে করেন যে, তাঁর কারণেই পরিচালক প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছেন। এদিকে শহীদুল্লাহকে আসতে দেখে সৈয়দ আলী আহসান দ্রুত সটকে পড়েন। কিন্তু শহীদুল্লাহ সাহেব নিজেকে ক্ষমা করেননি। নিজের ছাত্রকে যেমন মোবারকবাদ জানিয়ে পরিচালক মেনেছেন, তেমনই উন্মুক্ত হৃদয়ে পরিচালককে গিয়ে বললেন, ‘দেখো, আজকে আসতে আমার একটু দেরি হয়ে গেছে।’ তাঁর এ কৈফিয়ত পরিচালকের জন্য অধিক বিব্রতকর হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনি আমার অপরাধ মাফ করবেন। আপনার জন্য বিলম্বের কোনও প্রশ্ন নেই। আপনি যখন আসা সম্ভব মনে করবেন তখন আসবেন।’ কিন্তু এত আমাদের অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য যে, শহীদুল্লাহ কখনও নিয়ম ভঙ্গ করেননি, বরাবর নিয়ম মেনে চলেছেন। এখন থেকে ৫২ বছর আগে ১৯৬৯ সালে ড. শহীদুল্লাহ সম্পর্কে এক নিবন্ধে এসব কথা বলেছেন সরদার ফজলুল করিম।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৯ সালে বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। সেই সময় বগুড়ার ডিসি ছিলেন সৈয়দ মুর্তজা আলী। তাঁর ছোট ভাই সৈয়দ মুজতবা আলী সেখানে গিয়েছিলেন বগুড়া কলেজের একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে। সাহিত্যিক মুজতবার বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে ছাত্ররা তাঁকে তাদের কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে রাখার আবদার করেন। ফলে তিনি অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। কিছুদিন পর কলেজ ম্যাগাজিনে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের সমালোচনা করেন মুজতবা এবং লেখেন যে, রবীন্দ্রনাথ ইকবালের চেয়ে বড় কবি। এ কারণে মুসলিম লীগের সমর্থকরা তাঁর ওপরে হামলা চালায়। মুজতবা চাকরি ছেড়ে চলে যান ভারতে। পরে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ছিলেন শান্তিনিকেতনে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। অভিমানে তিনি চিরতরে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলেন আসেন।
এবার ফিরে যাই সরদার ফজলুল করিমের বই পড়ার জগতে। তিনি বলেছেন, স্কুলে থাকতেই আমার বই পড়ার এবং কেনার কিছুটা বাতিক ছিল। তার কারণ, বই পড়ার মতো সংসারে আর কোনও কাজই যে সহজ নয়, তা বেশ অল্প বয়স থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। বাড়িতে অতিথি-মেহমান এলে হুঁকায় তামাক সাজিয়ে আগুনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে (অতিথির) সামনে নিয়ে আসার চেয়ে একখানা বই পড়া বেশ সহজ ব্যাপার, তা বুঝার পর থেকেই বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকার দুষ্টবুদ্ধি আমি আয়ত্ত করেছিলাম। কিন্তু সে তো অনেক ছোটকালের কথা। পরবর্তীকালে এই নিরাপদ কাজের মধ্য থেকে আরেকটা মনোভাব গড়ে উঠলো যে, কোনো একখানা বইকে ভালো লাগলে অপর বন্ধুকে না বলে, এমনকি না শুনিয়ে স্থির থাকতে পারতাম না।
বই পড়ুয়াদের সাধারণত ভালো ছেলে বলা হয়। আসলে আমি মোটেও ভালো ছেলে ছিলাম না। তাই স্কুলে এমনকি কলেজ জীবনেও পেছনের বেঞ্চে বসা আমি উত্তম মনে করতাম। এই সূত্রে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো পেছনের বেঞ্চের ছাত্রদের সঙ্গে। পেছনের বেঞ্চের বন্ধুদের একটা গুণ ছিল যে, ওদের লেখাপড়ার ব্যাপারে কোনও অহঙ্কার ছিল না। আর বই পড়াটা যে আদৌ কোনও ক্রেডিট বা অহঙ্কারের ব্যাপার নয়, এটা বুঝতে পেরে লেখাপড়া সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে কোনও বন্ধুকে আমি সাহায্য করতে পারলে নিজেকেই ধন্য মনে করতাম। ভাবতাম তবু যা হোক, ওকে তো একটু সাহায্য করতে পারলাম।
আর এ জন্যই একটি খারাপ মানুষকেও একখানা ভালো বইয়ের চেয়ে আমি উত্তম মনে করি
তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। আমি ফজলুল হক হলের ছাত্র। এখানে এসে বন্ধুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো। এখন দেখলাম আমার একটা দায়িত্বও বেড়েছে। কোন বন্ধুর সময় কাটছে না, তাকে একটা পড়ার বই দিতে হবে। কারুর রাতে ঘুম হচ্ছে না তাকে একটা গল্পের বই দিতে হবে। হলের লাইব্রেরি যে নেই তা নয়, আছে। কিন্তু তার দরজা কি সরদারের ঘরের মতো অবারিত? এ দায়িত্ব থেকে এবার বই কেনার প্রয়োজনও বেড়ে গেলো। আমার সিটের পাশের দেয়াল-শেলফগুলো বইতে ভরে গেলো। এতদিন এর কোনও নাম ছিল না। এবার স্বাভাবিকভাবে এর নাম হয়ে গেলো ‘বান্ধব পাঠচকক্র’। আমি একটা ইস্যু রেজিস্টারও করলাম। হলের যেকোনও বন্ধু যখন ইচ্ছা শেলফ থেকে বই নিয়ে রেজিস্টারে বইয়ের নাম লিখে রেখে যেতেন।
এমএ পরীক্ষা হয়ে গেছে। কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করলাম। বছরখানেক না কাটতে শুনতে পেলাম আমি নাকি বহু অন্বেষিত ব্যক্তি। কিন্তু আমার চিন্তা সেজন্য নয়। চিন্তা হলো বাক্সভর্তি বইগুলো নিয়ে আমি কী করি। একবছর দু’বছর নয়, বহু বছর ধরে বৃত্তির টাকায় কিংবা নাস্তার পয়সা বাঁচিয়ে তৈরি করেছি আমার এ লাইব্রেরি। একদিন এটা ছিল কত তরুণ মনের প্রিয়। কিন্তু আবহাওয়াটাই এমন হয়ে উঠলো যে মনে হলো, বইমাত্রই যেন নিষিদ্ধ বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরাট একটা বাক্সভর্তি করে রাতের অন্ধকারে বইগুলো নিয়ে এ বন্ধুর বাড়ি ও বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠি, অনুরোধ করি—আমাকে রাখার দরকার নাই, আমার এ বইগুলো রাখো। আমার প্রস্তাবে ওরা আঁতকে ওঠে, বলে তোমার চেয়েও ওরা বিপজ্জনক।
অবশেষে এক বন্ধুর বাড়িতে গছিয়ে দিয়ে এলাম আমার বইভর্তি ট্রাংকটা—সেই ‘বান্ধব পাঠচক্রের’ মূল পুঁজিকে। মনে আশা ছিল আবহাওয়ার পরিবর্তন একদিন নিশ্চয়ই হবে। সেদিন আমি না থাকি কিংবা এই বইগুলো আমি না পড়ি, আর পাঁচ জন তরুণ তো পড়তে পারবে।
তারপরে প্রথম কিস্তিতে এক দুই তিন করে প্রায় ছয় বছর পরে কারাগার থেকে একদিন মুক্তি পেয়ে প্রথমেই খোঁজ করতে লাগলাম সেই বন্ধুর কাছে গচ্ছিত আমার বইগুলোর। অনেক চেষ্টার পরে তার সাক্ষাৎ না পেলেও আমার ট্র্যাংকটার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। ট্রাংকটা আমাকে ফেরত দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে বই ছিল না একখানাও। তাতেও আমার আফসোস ছিল না। ভাবছিলাম—বইগুলো হয়তো বিভিন্ন বন্ধু পড়তে নিয়ে গেছে। তারই হদিস করতে জিজ্ঞাসা করায় জানলাম, না কেউ পড়তে নেয়নি, পাছে কেউ পড়ে সেই আতঙ্কে বইগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ পোড়ানোর চেয়ে বই পোড়ানো সহজ। বই একটু বাধা দেয় না। হাত-পা ছুঁড়ে না।’’
বত্রিশ বছরের তরুণ তখন গোর্কি। ১৯০০ সাল। ঋষি টলস্টয়কে দেখতে গিয়েছিলেন। হয়তো তাঁকে উপহার দিয়ে এসেছিলেন নিজের কোনও বই বা রচনা। ফিরে এসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন, যদি কোনও কথা আসে, আসে কোনও বাণী, যুগোত্তীর্ণ সেই ঋষির কাছ থেকে।
কয়েকদিন পর সত্যিই এলো কয়েকটি ছত্র। ‘প্রিয় আলেক্সি পেশকভ, আপনার লেখা আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু তার চেয়েও ভালো লেগেছে আপনাকে।’
গোর্কি জবাব পাঠালেন টলস্টয়কে। তাতে কেবল কৃতজ্ঞাই নয়, নিজের জীবন বোধের প্রকাশও সেখানে অকম্পিত—‘প্রিয় লিও নিকোলায়েভিচ, আপনি আমাকে আপনার যে ছবিখানি পাঠিয়েছেন এবং আমার প্রশংসা করে যে কথা বলেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমার রচনার চেয়ে আমি ভালো কিনা তা আমি জানিনে, কিন্তু এ কথা জানি, লেখককে তার নিজের রচনার চেয়ে, নিজের বইয়ের চেয়ে উত্তম হতে হবে। নিজের রচনার ঊর্ধ্বে তাকে উঠতে হবে। কারণ, বই আসলে কী? একখানা বই, সে যতই উত্তম হোক না কেন, সে শব্দের কালো ছায়া ব্যতীত আর কিছু তো নয়, তার মধ্যে সত্যের আভাষ মাত্রই থাকতে পারে, সত্য তো নয়। অথচ মানুষ হচ্ছে বিধাতার সাক্ষাৎ দেবালয়, এখানেই তার অধিষ্ঠান। অবশ্য ঈশ্বর বলতে আমি বুঝি ন্যায়, সত্য এবং মহত্বের জন্য মানুষের অনির্বাণ সংগ্রামকেই, অপর কিছুকে নয়। আর এ জন্যই একটি খারাপ মানুষকেও একখানা ভালো বইয়ের চেয়ে আমি উত্তম মনে করি।’ এটাই ছিল গোর্কির জীবন দর্শন।
চলবে…