পর্ব: ১০
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে ছিল অনেক দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ। এ সম্পর্কে মহিউদ্দীন খান লিখেছেন, ‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অবসর সময়ের সবটুকুই কাটাতেন লাইব্রেরির ভেতরে। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিটা ছিল বেশ বড়। বিরাট একটা হলের কামরাজুড়ে ছিল শুধু বই আর বই। পাশের ছোট একটি কামরায় বসে তিনি লেখাপড়া করতেন। লিখতেন কম, পড়তেন অনেক বেশি। লাইব্রেরির ভেতরে তিনি কাউকে বড় একটা ঢুকতে দিতেন না। কিন্তু আমার জন্য ছিল অবারিত দ্বার! শেলফে রাখা বই-পুস্তক ঝাড়-মোছ করেও আনন্দ পেতাম। বইগুলো বিষয়ভিত্তিক সাজানো ছিল। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখতাম। বাংলা-ইংরেজি-আরবি-ফারসি-উর্দু-হিন্দি-পালি-সংস্কৃত প্রভৃতি কত ভাষার যে বই ছিল, তা শুমার করে শেষ করতে পারতাম না। এসবের মধ্যে পৌরাণিক অভিধান এবং জি-উশ এনসাইক্লোপিডিয়া নামক দুটি বই নাড়াচাড়া করতে আমার খুব ভালো লাগতো। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যতদিন জীবিত ছিলেন তার লাইব্রেরিতে নিয়মিত যাতায়াত করেছি।’
‘বইয়ের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ ছিল ছোটবেলা থেকেই। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার লাইব্রেরি দেশের সেরা একটা সংগ্রহ বলা যেতে পারে। আমি যখন আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র তখন লাইব্রেরিটা ছিল তদানীন্তন ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজের ইমারতে। মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমার জন্য সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় স্থান ছিল লাইব্রেরি। লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক আমাকে বিশেষ খাতির করতে শুরু করেন। তাঁর সহযোগিতায়ই আমি অনেক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ এবং পাণ্ডুলিপির সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলাম।’
মুহিউদ্দীন খান আরও জানান, ‘মুসলিম-স্পেনের বিভিন্ন সমৃদ্ধ নগরীর কৃষ্টি-কালচারের বয়ান আমরা বিভিন্ন বই-পুস্তকে পড়েছি। বাগদাদ, কায়রো, দামেস্ক ও ইসতান্বুলের নাগরিক জীবনের অনেক কথা শুনেছি। আমাদের এই উপমহাদেশের প্রাচীন জীবনাচারের অনেক দিকই আমাদের জানবার সুযোগ হয়। এসবের মধ্যে রুচিবান নাগরিকদের গ্রন্থপ্রীতির দিকটা সর্বাপেক্ষা বেশি উল্লেখ করার মতো। রকমারি বই-পুস্তকের প্রতি আকর্ষণ ও বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে গর্ববোধ করার রুচি আমাদের এতদ্বঞ্চলেও ছিল। এখন থেকে আড়াই-তিন দশক আগ পর্যন্তও তা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ইদানিং হঠাৎ করেই যেন তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জ্ঞান চর্চার এই প্রধান আলোকরশ্মিটি নিভে যাওয়াটা জাতির জন্য আত্মহননের আলামত কি না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।’ (জীবনের খেলা ঘর: মুহিউদ্দীন খান)
ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ পি জে আবুল কালাম। পেশাগত জীবনে মহাকাশ রকেট বিজ্ঞান ও ক্ষেপনাস্ত্র গবেষণার সব জটিল বিষয়ে পড়াশোনায় এমনভাবে ডুবে থাকতেন যে, মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলতেন। এরকম এক সংকটময় পরিস্থিতিতে এক দিন বার্নার্ড শ-এর একটি উদ্ধৃতির মাঝে সমাধান খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। শুনুন তার নিজের ভাষ্যে—‘কেউ একজন অভিজাত লাউঞ্জের সোফার ওপরে একটি বই ফেলে রেখে গিয়েছিল। বইটা তুলে নিলাম, সেটি ছিল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত একটি জনপ্রিয় বই। আমি আসলে পড়ছিলাম না। শুধু প্যারাগ্রাফগুলোর ওপরে নজর বুলিয়ে যাচ্ছিলাম আর পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম। অকস্মাৎ বইটির একটা প্যাসেজের ওপরে আমার চোখ পড়লো, অংশটা ছিল—জর্জ বার্নার্ড শ-এর রচনা থেকে একটি উদ্ধৃতি। ওই উদ্ধৃতির মর্মকথা ছিল এই যে—বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা নিজেদের মানিয়ে নেয় দুনিয়ার সঙ্গে। কেবল মুষ্টিমেয় কিছু বিচারবুদ্ধিহীন মানুষ নিজেদের সঙ্গে দুনিয়াকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। দুনিয়ার সব অগ্রগতি নির্ভর করে এই বিচারবুদ্ধিহীন লোকজন ও তাদের উদ্ভাবনমূলক প্রায় অনিশ্চিত কাজকর্মের ওপরে। বার্নার্ড শ-এর প্যাসেজ থেকে আমি উদ্ধৃতি পড়তে শুরু করেছিলাম। বইটির লেখক শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে উদ্ভাবনা প্রক্রিয়া ও ধারণা যেসব নির্দিষ্ট মিথে বোনা, তা বর্ণনা করেছেন। আমি কৌশলগত পরিকল্পনার মিথ সম্পর্কে পড়ি। সাধারণভাবে এটা বিশ্বাস করা হয় যে, কৌশলগত এবং প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা ‘বিস্ময়’ নয় ধরনের ফলাফল প্রচণ্ডভাবে বাড়িয়ে দেয়। লেখকের মতামত ছিল যে, একজন প্রকল্প ব্যবস্থাপকের পক্ষে অনিশ্চয়তা নিয়ে জীবনযাপন করতে শেখাটা অত্যাবশ্যকীয়।’’
এ পি জে আবদুল কালামের জীবনের আরেকটি ঘটনা—‘‘আমার কাছে একটা ফোন এলো ইন্ডিয়ার কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ (ইনকসপার) থেকে। রকেট ইঞ্জিনিয়ারের একটা পোস্টে আমাকে ইন্টারভিউ দিতে ডাকা হলো। ইন্টারভিউতে হাজির হতে আমি বোম্বাই (বর্তমানের মুম্বাই) গেলাম। ইন্টারভিউতে আমাকে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে সে সবের ধরন সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম। এ নিয়ে পড়াশোনার করার অথবা অভিজ্ঞ কোনও ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার মতো সময় ছিল না হাতে। আর তখনই লক্ষণা শাস্ত্রীর কণ্ঠে ভগবৎ গীতা প্রতিধ্বনিত হলো আমার কানে: ‘সকল প্রাণী দ্বিত্বের মোহ নিয়ে জন্মায়… অভিভূত থাকে কামনা ও ঘৃণা থেকে উত্থিত দ্বিত্বের দ্বারা… কিন্তু যাদের মাঝে পাপ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যারা দ্বিত্বের প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত, তারা স্থিরচিত্তে আমার উপাসনা করে।’
বার্টান্ড রাসেল বলে গেছেন, ‘যে যত বেশি বইয়ের গভীরে ডুবে থাকতে পারবে, এই দুনিয়ার যাতনা লাঘবের ক্ষমতা তার তত বাড়বে।’
‘‘আমি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, বিজয়ী হওয়ার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে ‘বিজয়ী হওয়ার দরকার নেই’ মনে করা। তুমি যখন স্বাভাবিক আর সন্দেহমুক্ত থাকবে, তখনই তুমি ভালো ফলাফল করতে পারবে। ঘটনা যেভাবে ঘটবে সেভাবেই নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। যেন অধ্যাপক এমজিকে মেননের সফর কিংবা ইন্টারভিউতে হাজির হওয়ার জন্য টেলিফোন ইত্যাদিতে আমার কিছু যায় আসে না, এটাই সর্বোত্তম মনোভাব হবে বলে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ইন্টারভিউ নিলেন ড. বিক্রম সারাভাই এবং অধ্যাপক এমজিকে মেনন। ইন্টারভিউয়ের পর বোম্বেতে কয়েকদিন থেকে যাওয়ার জন্য আমাকে পরামর্শ দেওয়া হলো। যা হোক, পরদিন সন্ধ্যায় আমাকে নির্বাচন করার কথা জানানো হলো। রকেট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমাকে আত্মভূত করা হবে ইনকসপারে। ঠিক এরকম একটা ব্রেকথ্রু’র স্বপ্নই দেখে আমার মতো কোনও তরুণ।’ (উইংস অব ফায়ার:এ পি জে আবদুল কালাম)।
হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘‘আমি ১৯৬৪-৬৫ সালে একটি কবিতা লিখেছিলাম। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই কবিতাটির একটি লাইন ছিল ‘আজ রাত্রে সারা বঙ্গে আমি হই একমাত্র কবি’। আমি এই কবিতাটি কবি আহসান হাবীবের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। আহসান হাবীব বললেন যে, বঙ্গ তো লেখা যাবে না। কারণ ’৬৫ সালে বঙ্গ লেখা যায় না। তো আমি বললাম, ‘সারা পাকিস্তানে আমি একমাত্র কবি’ এটা খুব কাব্যিক বলে মনে হয় না। পাকিস্তানে যে কোনও কবি আছে এটিও কাব্যিক বলে মনে হয় না। আমি ছাত্র অবস্থায় এই গুরুদের কাছে যথেষ্ট আতঙ্কের বিষয় এবং শ্রদ্ধেয় ছিলাম। তারা আমাকে শ্রদ্ধাও করতেন এবং ছাত্র হিসেবে আমার নানা কৃতিত্বের জন্য, আমার স্পষ্ট কথার জন্য তারা কিছুটা ভয়ও পেতেন। তিনি বললেন, ‘আপনি যদি কবিতাটা কিছুটা বদলে দেন তবে আগামী সপ্তাহেই ছাপানো হবে।’ আমি দেখলাম যে, আগামী সপ্তাহে আমার কবিতাটি ছাপা হওয়া দরকার। আমি বঙ্গের জায়গায় ‘আজ সারা রাত্রে আমি হই সারা বিশ্বে একমাত্র কবি’ লিখলাম। তো এই হচ্ছে পাকিস্তান সময়ের অধিকারের চিত্র। একটি শব্দ প্রয়োগের অধিকার তখন ছিল না।’’
‘‘এখন আমরা সেই পূর্ব পাকিস্তানের থেকে খারাপ ‘বাংলাস্তানে’ বাস করছি। এখানে কারো অধিকারের স্বীকৃতি নেই। এখানে কে আছেন যে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে বলতে পারেন, আজ তিনি একা বাংলাদেশ ঘুরতে পারবেন? ঢাকা থেকে পেরুনোর আগেই হয়তো তিনি আক্রান্ত হবেন।’’ (আমার নতুন জন্ম: হুমায়ুন আজাদ, ২০০৫)
ভারত ভাগের সময় মুক্তাগাছার জমিদার জীবেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী এবং তার পরিবারের সদস্যরা সবাই ভারতে চলে যান। বাড়িতে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে যান পারিবারিক লাইব্রেরিটি, যা গড়ে তুলেছিলেন ওই পরিবারের পূর্ব পুরুষ রাজা জগৎকিশোর। তাঁর উত্তরাধিকারী জমিদার জীবেন্দ্রকিশোর ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরীর (পরে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি) বন্ধু। কলকাতায় তারা একই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা করেছেন। যদিও জমিদার জীবেন্দ্রকিশোর ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরীর জুনিয়র।
দেশ স্বাধীনের পর আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, আর ড. এনামুল হক পরিচালক। এনামুল হক একদিন চৌধুরীকে বললেন, ‘এই বইগুলো তো পড়ে আছে মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে। এভাবে থাকলে চুরি হয়ে যাবে। এগুলো কি আনা যায়?’ এরপর আবু সাঈদ চৌধুরীর বাবা আবদুল হামিদ চৌধুরী চিঠি পাঠালেন পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে কুমার জীবেন্দ্রকিশোর আচার্যের কাছে। ফেরত ডাকে জীবেন্দ্রকিশোর লিখলেন, ‘‘আমি খুব খুশি হলাম যে আমার বইগুলে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলো। আপনি এটাকে ‘লেটার অব অথরিটি’ মনে করে বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে বইগুলো নিয়ে আসতে বলুন।’’
তারপর ড. এনামুল হক লোকজন নিয়ে ট্রাক বোঝাই করে বইগুলো এনেছিলেন। এ ক্ষেত্রে জীবেন্দ্রকিশোরের একটি অনুরোধ ছিল— ‘‘বইগুলো যেন আলাদা রাখা হয় এবং ‘মুক্তাগাছার লাইব্রেরি’ হিসেবে যেন চিহ্নিত করা হয়।’ বাংলা উন্নয়ন বোর্ড আলাদা শেলফ তৈরি করে বইগুলো সেভাবেই রেখেছিল। পরে অবশ্য বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলা একাডেমি এক হয়ে গেলে বইগুলো বাংলা একাডেমিতে স্থান পেয়েছিল। আবু সাঈদ চৌধুরী এসব কথা এক সাক্ষাৎকারে বলে গেছেন জাতীয় জাদুঘরকে। তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জীবন বাবু বাংলাদেশে এসেছিলেন। মুক্তাগাছায় গিয়েছিলেন। তিনি মুক্তাগাছা থেকে যেদিন এলেন, সেদিন বিকেল বেলাতেই বাংলা একাডেমিতে গেলেন। তার লেখা ‘আমি’ বইটিও তিনি ওখানে গিয়ে দিয়ে এনেছিলেন।’
জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের সাক্ষাৎকারে আবু সাঈদ চৌধুরী আরও বলেছেন, ‘‘জীবেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী ‘আমি’ বলে একটা বই লিখেছেন, সেটা সবারই পড়া উচিত। ওই বইতে তৎকালীন জমিদারদের কীর্তিকলাপ জীবন বাবু যা কিছু দেখেছেন, তারই বর্ণনা দিয়েছেন। কীভাবে ময়মনসিংহের রাজপরিবার, মানে এই জমিদার পরিবারগুলো কেমন আচরণ করতো, সেসব কিছু তুলে ধরেছেন তার অংশীদার হয়ে। সে কারণেই তিনি বইটার নাম দিয়েছেন ‘আমি’।’’ (প্রতিচিন্তা, সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ২০১২)
বার্টান্ড রাসেল বলে গেছেন, ‘যে যত বেশি বইয়ের গভীরে ডুবে থাকতে পারবে, এই দুনিয়ার যাতনা লাঘবের ক্ষমতা তার তত বাড়বে।’
চলবে…