॥আট॥
রেশমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে নাঈমা পারভেজ। এতে একটা বিপত্তিও দেখা দিয়েছে। নাঈমা এখন প্রবল অনুতাপে পুড়ছে। সাংবাদিকতার পেশার স্বার্থে ছদ্মবেশ ধারণ করে আন্দোলনকর্মী পরিচয় দিয়েছে নাঈমা, এখন তো তাকে বিশ্বাস করে বসে আছে রেশমার মতো একজন দুর্ঘটনায় আহত নারী। সচ্ছল পরিবারের অসহায় নারী। আপনযোগ্যতায় চাকরিপ্রত্যাশী একজন নারী। এখন সে কী করবে? পেশাগত কারণে এত মিথ্যা কথা বলা কি নৈতিকতার মধ্যে পড়ে? ড. শাওন্তী হায়দার ম্যাডামের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে। এই ম্যাডামের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। মার্শাল ম্যাকলুহানের কী একটা উক্তি যেন একবার এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন তিনি।
অবশেষে নাঈমা সিদ্ধান্ত নেয়, যদি এমন কোনো সংগঠন সত্যিই থেকে থাকে রেশমাকে সেখানে সদস্য করিয়ে দেবে। আর নয়তো একটা সংগঠন দাঁড় করানোর চেষ্টাই করতে হবে।
নাঈমা আসগর হোসেন মিজি ওরফে আবির সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে রেশমার কাছে।
রেশমার বাড়ি মহাকালি গ্রামে। সে মামার বাসায় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছে নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে। তখনো সেখানে অনার্স কোর্স চালু হয় নাই। তাই সে মুন্সীগঞ্জে ফিরে এসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়। তখন পরিচয় হয় আবিরের সাথে। তার কাগজপত্রে লেখা নাম আসগর হোসেন মিজি। আবির দেখতে লম্বা, পাতলা, উজ্জ্বল শ্যামল তার গায়ের রঙ। সে মাঝে মধ্যে ক্লাসে আসতো। নিয়মিত আসতো না। সে মুক্তারপুরে কাজ করতো। কী কাজ করতো প্রথম দিকে সে বলতো না। আবির রেশমার ক্লাসমেট হলেও কয়েক বছরের বড় হবে। কারণ তার শিক্ষাজীবনে পাঠবিরতি ছিল কয়েক বছরের। বয়সে একটু বড় হওয়ার কারণে আবির ক্লাসের সব পড়া সহজেই বুঝতো। আর তার বই পড়ার অভ্যাস ছিল বলে তার এটা ছিল প্লাস পয়েন্ট। দেশ-বিদেশের সব বিষয়ে খবরাখবর রাখতো। সে নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়তো। বেতারে-টিভিতে খবর দেখতো। ঢাকার বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করতো উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় থেকেই।
আবির কয়েক বছর পরে রেশমার বিশ্বস্ত হয়েছে। সে অনেক ব্যক্তিগত কিছু বলতে শুরু করে। তারপরেও অনেক কিছু লুকাতো। এসএসসি পাস করার পরে আবির আর পড়তে চায় নাই। তার ধারণা ছিল মেট্রিক পাস করলেই তাদের মতো পরিবারের একজন মানুষের চলে যাবে। সে চাকরির জন্য অনেক দৌড়াদৌড়ি করে। নানা জায়গায় ইন্টারভিউ দেয়। কোথাও কিছু করতে পারে না। ঢাকায় যাতায়াত শুরু করে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হয়। প্রতি সপ্তায় যায়। বই তুলে আনে, পড়ে, দিয়ে আসে। টিএসসিতে আবৃত্তি সংগঠনে ভর্তি হয়। কোর্স কমপ্লিট না করেই চলে আসে। এমন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কয়েক বছর কাটিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সে বিমা কোম্পানিতে চাকরি নেয়। এই একটা পেশা, যেখানে কোয়ালিফিকেশনের তুলনায় বড় বড় পদ পাওয়া যায়। সেসব পদের গালভরা নাম। জেএভিপি- জয়েন্ট এসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ পায় আবির। কিন্তু এই পেশায় টিকে থাকা কঠিন। বিমার জন্য পলিসি হোল্ডার অনুসন্ধান করতে হলে জন্য প্রথমে তিনটি টার্গেট গ্রুপ করে এগোতে হয়। প্রথমে আত্মীয় সার্কেল, দ্বিতীয় বন্ধু সার্কেল, তৃতীয় পরিচিত সার্কেল। আবিরের জন্য কাজটা কঠিন হয়ে যায়। তারা আত্মীয়হীন পরিবেশে ভাড়া বাড়িতে থাকতো। আত্মীয়-স্বজনদের এড়িয়ে চলতো। ওর বাবাকে মেরে ফেলার পরে কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি, সম্ভবত এ অভিমানে ওরা সরে রয়েছিল। সেখানে বিশ্বস্ত বন্ধু থাকারও কথা না। কাজেই সে কাজ করতে না পেরে বিশাল পদটি ছেড়ে দিয়ে আবার মিলে মেশিনচালক পদে লেগে যায়।
তবে বাস্তবতা আবিরকে বড় একটা ধাক্কা দেয়। সে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু পড়ে নাই। আর সে বছর কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অনেকে আবিরকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। তাই সে পড়ালেখা কন্টিনিউ করে নাই। যে বছর রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে, সে বছর শেষ বারের মতো সুযোগটা সে কাজে লাগায়। মানবিক বিভাগ থেকে পাস করা তার জন্য খুবই সহজ ছিল। কারণ সব বিষয়ই তার আগে পড়া। বইটই না কিনেই সে এইচএসসি পাস করে যায়।
রেশমার মতে, আবিরের ইচ্ছা ছিল পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া। মাপে ঠিক ছিল। কিন্তু অন্যান্য দিক থেকে ফিট ছিল না। তার সাইনোসাইটিসে সমস্যা ছিল। সব সময় নাকের ড্রপ পকেটে থাকতো। কিছুক্ষণ পরে পরে নাক বন্ধ হয়ে যেতো। বেশি বেড়ে গেলে এন্টিবায়োটিক খেতো। প্রায়ই মাথা ব্যথা করতো, নাকের ভেতর জ্বালা-যন্ত্রণা করতো। আইসক্রিম বা ফ্রিজের কোনো খাবার খেতে পারতো না। শীতকালে মাফলার দিয়ে নাক-মুখ বেঁধে চলতে হতো। কুয়াশা এবং ধূলাবালুতে শরীর ভীষণ খারাপ হতো। বৃষ্টিকে ভয় পেতে শুরু করে। আগে সে বৃষ্টি নিয়ে গান গাইতো-কবিতা আবৃত্তি করতো। এখন সেসব বাদ দিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন ড্রপ ব্যবহারের পরে তার অ্যাজমার সমস্যা দেখা দেয়।
ধাক্কা খাওয়ার পরে আবিরের মধ্যে নতুন এক ধরনের পরিবর্তন আসে। সে কিছুটা সাহসী আর উদ্ধত স্বভাবের হয়ে ওঠে। রেশমার মতে, অশিক্ষিত পরিবারের কেউ শিক্ষিত হলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। আর বইপড়ার একটা কুফলও আছে। যারা বই পড়ে না তাদের ছোট ভাবার অভ্যাস। এসময় সে নিজেকে ফিশিং নেট ইন্ডাস্ট্রির একজন সাধারণ শ্রমিক বলে পরিচয় দিতো। শুধু তাই না, তার মা নাকি মুক্তারপুরে মিলে কাজ করতো। সে বলতো, আমি ভূমিহীন কৃষকের ছেলে, আমি কারখানা-শ্রমিকের ছেলে। আমার মা কারখানা শ্রমিক, একথা বলে গর্ববোধ করি। আসলে ওর মধ্যে গর্ব ছিলো না; ছিলো চরম হতাশা। সে নিজেকে নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’ উপন্যাসের নায়ক পাভেল করচাগিন বলে দাবি করতো। অথচ আগে সে সব পরিচয় লুকিয়ে রেখেছে। এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতো। পরে পরে সে কমিউনিস্ট ধারার কথাবার্তা বলতো। ধর্ম নিয়ে নানা রকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতো। কমিউনিস্ট পার্টি-ওয়ার্কার্স পার্টির মিটিংয়ে যেতো। কোনো জনসভায় কেন্দ্রীয় নেতা এলে সে নিজেকে শ্রমিক পরিচয় দিতো। নেতারা ওর মতো একজন শিক্ষিত, মেধাবী ছেলেকে শ্রমিক পেশায় দেখতে পেলে খুশিই হতেন। হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমদের মতো নেতারা হয়তো ওকে নিয়ে আশু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাই দেখতেন। এখানে এলে বা ঢাকায় কোনো মিটিঙে গেলে প্রায়ই পিঠ চাপড়ানি দিতেন তারা।
কলেজে আবিরের প্রতি অনেক মেয়ের আগ্রহ ছিলো। কিন্তু আবির কাউকে পাত্তা দিতো না। সে ঢাকায় কোন এক মেয়ের সাথে প্রেম করতো বলে জানাতো। কেউ তা বিশ্বাস করতো, কেউ করতো না। কেউ মনে করতো, এইচএসসি পড়ার সময় যখন সে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতো তখনকার ঘটনা ওটা।
রেশমার ধারণা, স্বপ্নভঙ্গ, প্রেমে ব্যর্থতা, ছোটবোনেরা তখন বড় হয়ে উঠেছে ওদের বিয়ে দিতে হবে, তখন ওর মায়ের পেটে কী যেন কঠিন অসুখ ছিল। গ্যাস্ট্রিক থেকে আলসার হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়। সব দিক মিলিয়ে চরম হতাশা থেকে ব্যক্তিজীবন নিয়ে আবির বেশ উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। তাই সে সমাজজীবন এবং রাষ্ট্র নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল। সে ব্যক্তিজীবনে উন্নতির পথগুলো নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল বলে সমাজ পরিবর্তনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।
চলবে…
প্রাচীন স্রোতের কণা-৭॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ