॥পর্ব-ছয়॥
আবিরকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এখানেই তারা থাকবে। গ্রামের বাড়ি নদীতে ভেঙে গেছে সেখানে নতুন করে চর জাগে নেই। জাগার কোনো সম্ভাবনাও নেই। বাবাকে মেরে ফেলার পরে তারা গ্রাম ছেড়েছে। ভাঙা ঘর আর কে নেবে, শুধু গরু-বাছুরগুলো বিক্রি করে গ্রাম ছেড়ে এখানে চলে এসেছে। এরপরে কয়েক মাস আর তারা গ্রামে যায়নি।
এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে হলে সমাজে নাম তোলাতে হয়। অনেকেই বছরের পর বছর ধরে থাকছে কিন্তু স্থানীয় সমাজে নাম লেখায়নি। সমাজ মূলত মসজিদভিত্তিক। অনেক বছর থাকার পরে, জমি কিনে বাড়ি করলে সাধারণত নাম তোলা হয়। কিন্তু আবিরের ভাগ্য ভালো, ফুটবল খেলার মাঠে যে ছেলেদের সঙ্গে খেলা হয়, দেখা হয় সেই ছেলেরাই বাড়ি বাড়ি হেঁটে সমাজের চাঁদা আদায় করে। তারাই আগ্রহ করে আবিরদের নাম উঠিয়ে দিয়েছে। কুরবানির ঈদের সময় সমাজে যতজন গরু কুরবানি করেন, তারা গরুর মাংসের এক তৃতীয়াংশ সমাজে প্রদান করে। সব মাংস একত্র করে সমাজের খাতায় যতগুলো পরিবারের নাম আছে তাদের সদস্য সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথা পিছু বরাদ্দ নির্ধারণ করে মাংস বণ্টন করা হয়।
খালেক বেপারির পাশের বাড়ির অনেক পুরনো ভাড়াটে যারা চার-পাঁচ বছর ধরে এই সমাজে বাস করে আসছে তারা মসজিদ থেকে ঈদের সময় ভাগের মাংস পায়নি কিন্তু আবিরেরা পেয়েছে। এটা দেখতে খারাপ লাগে আবিরের নিজের কাছেও। আসলে তারা সমাজে গিয়ে থাকায় নাম তোলেনি, জুমার নামাজে, রমজানে তারাবিতে. ঈদের জামাতে যায় না, চাঁদা দেয় না, ইমামের বাৎসরিক বেতনও দেয় না তাই নাম তোলা হয়নি।
এটি আবিরের বুঝার ভুল ছিল। আসলে আগে নাম লেখানো, পরে নিয়মিত চাঁদা পরিশোধের বিষয়টি আসে। তবে মসজিদে, সমাজে যাতায়াত করতে হয় এটা সত্য। যারা এদেশে বাস করে, এখানে কামাই-রোজগার করে, সন্তানদের স্থানীয় ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়, মারা গেলে স্থানীয় গোরস্থানে কবর দেওয়ার আবদার করে কিন্তু স্থানীয় মানুষদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে চায় না, সমাজ তাদের সদস্য করে নেবে কেন? সমাজকে আপন ভেবে যারা সমাজের অংশ হতে চায় তাদের অনেকে স্বেচ্ছায় সমাজের লোকদের কাছে গিয়ে তদবির করে নাম লেখায়।
আবিরদের ঈদের দিনে সমাজের মাংস পেতে দেখে পাশের বাড়ির অনেকেই এটা ভেবেছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী বাড়ির কয়েকজন ভাড়াটে। তারা মুখ খুলে বলেই ফেলেছে, সাড়ে তিন দিন ধইরা ঘর ভাড়া নিয়া সমাজের ভাগের মাংস খাওয়ার জন্য নাম লেখাইছে।
এক মহিলার মুখে কথাটা শুনে আবির নিজের ভেতর সংকুচিত হয়ে যায়। কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আবির নিজে যায়নি এখানকার সমাজে নাম লেখানোর জন্য। সে মসজিদে যায় জুমার নামাজে। জুমার নামাজের সময় দানবাক্সে কম-বেশি যা পারে টাকা গুঁজে দেয়। ঈদের জামাতে গামছায় টাকা দেয়। এভাবে যে কেউ দিতে পারে। বাজারের মসজিদ, ফেরিঘাটে আটকে পড়া গাড়ির যাত্রীরা, পথিকেরা নামাজে গেলে পকেট থেকে মসজিদের দানবাক্সে কম-বেশি দান করে।
নানাজন নানা কারণে মসজিদে দান করে। কেউ ধর্মবোধ থেকে, কেউ টাকার গরম থেকে, কেউ বিবেচনাবোধ থেকে। কেউ মনে করে, ইমাম সাহেব একজন সামাজিক মানুষ, দেশের বাড়িতে তার পরিবার-পরিজন আছে। সন্তানেরা পথ চেয়ে আছে ঈদের দিন সন্ধ্যায়, রাতে বা পরদিন তাদের বাবা নতুন জামা-জুতা-সেমাই ইত্যাদি নিয়া বাড়ি আসবেন—সে দৃশ্য কল্পনা করেও কেউ দান করেন মানবিক বোধ থেকে।
আবির নিজে এই দলের।
এই সমাজে এবং আশেপাশের সমাজের রীতি-নীতি প্রায় একইরকম। আবির মাঝে মাঝে এমনও শোনে, কখনো কাছ থেকেও দেখা যায় মসজিদের উন্নয়নের জন্য ঘরে ঘরে চাঁদা নিতে আসে ছেলেরা। রসিদ ছাড়া চাঁদা তোলা হয়। আবির নিজে শিকার না হলেও স্থানীয় অনেক সমাজে দরিদ্র লোকের ওপর, পরিবারের ওপর চাঁদার বোঝা চাপিয়ে দিতে দেখে সে ব্যথিত হয়েছে। সে দেখেছে মুলি-বাঁশের বেড়া, একটিমাত্র ভাঙ্গা ঘর এমন ঘরেও ধনীদের সমান, যাদের তিন-চার জন ছেলে বিদেশে আছে, ইউরোপে আছে তাদের সমান চাঁদা ধরা হচ্ছে। খবর নিয়ে দেখা যায়, তাদের মুখের কথা থেকেই বেরিয়ে আসে ভেতরের গোপন অভিলাষ। যদি বলা হয়, গরিব মানুষ, সংসার চলে না এত টাকা আামাদের চাঁদা ধরলে কেমনে চলি? তখন বাড়ির জমির দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়, এত্ত বড় বাড়ি, এত জায়গা, আর তোমরা কও গরিব মানুষ!
এই কথার অর্থ জমির প্রতি সমাজপতিদের কুদৃষ্টি পড়েছে।
মেট্রিকের টেস্ট পরীক্ষার আগে কয়েকবার আবির স্কুলের হেডস্যারের সঙ্গে কথা বলেছে। স্যার তো বলেছেন, তুই নিয়মিত ক্লাসে আসিস না, তোকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না।
আবির তার পছন্দের এক স্যারকে দিয়ে সুপারিশ করিয়েছে। তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে গ্রামের বাড়িতে। এরপরে তারা এখন আর বাড়িতে থাকে না। তাকে কাজ করে সংসার চালাতে হয়। এজন্য নিয়মিত ক্লাস করতে পারে না। মাঝে মাঝে আসে। নাইট ডিউটি থাকলে সারা রাত কাজ করে দিনের বেলা না ঘুমিয়ে ক্লাস করে। দুপুরে ডিউটি থাকলে তিন ক্লাস করে চলে আসে। এসব শোনার পরে হেড স্যার নরম হয়েছেন। আবিরের কথাবার্তা শুনে হেডস্যার মন্তব্য করেছেন, ছেলেটা তো ভালোই কথা শিখেছে।
টেস্ট পরীক্ষায় আবির সব সাবজেক্টে পাস করেছে। এবং সম্মানজনক রেজাল্টই করেছে। বরং নিয়মিত অনেক শিক্ষার্থীর চেয়ে ভালো করেছে। এর পরে স্কুলের সব শিক্ষক আবিরের প্রতি সদয় হন এবং সৃদুষ্টি রাখেন।
মাধ্যমিক ফাইনাল পরীক্ষার সময় আবিরের ডিউটি ছিল রাতে। সারা রাত মেশিন চালিয়ে সকালে পরীক্ষা দিতে গিয়েছে ঝিমাতে ঝিমাতে। দুপুর বারোটার দিকে ঘুমের প্রচণ্ড চাপ আসে। এর পরে কমে যায়। তার পরে শুরু হয় হালকা মাথাব্যথা। এভাবে দশদিন যাওয়ার পরে বি-শিফটের পরীক্ষাগুলো ভালো হয়েছে। দুপুর একটায় পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে শহর থেকে হেঁটে সরাসরি ফ্যাক্টরিতে চলে গেছে। সেদিন শরীর খারাপ লাগেনি, মনেও কোনো চাপ ছিল না। দুপুরে বাড়ি থেকে মোরশেদা টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে গেছে।
তিন মাস পরে রেজাল্ট পেয়ে দেখা গেল দৈনিক পত্রিকার রেজাল্ট শিটে আবিরের রোল নম্বর প্রথম বিভাগেই কিন্তু শেষের দিকে আছে। রেজাল্টের কথাটা সে মিলে সে পুরোই গোপন রাখলো। সে কাউকে ফাও ক্রেডিট নিতে দেবে না।
শুধু একদিন ইভা তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, এই আবির ভাই, মিষ্টি খাওয়াইলেন না?
এর মধ্যে ইভাকে আবির তুই করে বলতে শুরু করেছে। আবির ইভাকে বলে, আস্তে ক। তুই চাইলে তোরে মিষ্টি খাওয়ামু। কোন দোকানের মিষ্টি খাবি?
ইভা রহস্যের হাসি হেসে বলে, দোকানের মিষ্টি খামু না।
তাইলে কোন মিষ্টি তোরে খাওয়ামু?
ইভা এই কথার উত্তর না দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসে। অনেকক্ষণ পরে বলে, মনের থেকে যেই মিষ্টি খাওয়াইবেন, সেই মিষ্টি খামু।
আবিরের মগজের সেন্সর সচেতন করে দেয় তাকে। এ প্রতিষ্ঠানে যতগুলো মেয়ে কাজ করে তাদের মধ্যে ইভা সবচেয়ে সুন্দরী। তাকে নিয়ে অনেকের গোপন ঈর্ষা থাকতে পারে। এর মধ্যে একজন তাকে বেশ বাজে কথা বলে সাবধান করেও দিয়েছে। সে ইভাকে এই মুহূর্তে সরিয়ে দেওয়ার জন্য বলে, ঠিকাছে, তুই এখন যা। সময়মতো মিষ্টি পাইয়া যাবি।
সে মুহূর্তে ইভাকে সরিয়ে দেওয়ার যে পদক্ষেপ নিয়েছে আবির তা ইভা বুঝতে পারে। অনেক সুন্দরী মেয়েই তার রূপ সম্পর্কে সচেতন। তার রূপের প্রতিক্রিয়া আশে পাশে কী হয় তা সে জানে। আবিরের এ ধারণা সত্য প্রমাণিত হয় চলে যাওয়ার সময়কার ইভার একটা প্রশ্নে, আপনে যে আমার লগে এত কতা কন, কেউ কি আপনেরে কিছু কয় না?
এ কথায় আবির অবাক হয়। রাশিদা নামের মহিলাটি আবিরকে যে বাজে কথা বলেছে, এটা কি ইভা জানে? নাকি তার পরিবেশ-প্রতিক্রিয়াজনিত ধারণা? আবির বুঝতে পারে, সবচেয়ে সুন্দরী নারীটির সাথে অবাধ মেলামেলার কারণে রাশিদা কিংবা অন্য যে কেউ কিছু মন্তব্য করতে পারে এটা সুন্দরী নারী হিসাবে ইভার অজানা থাকার কথা না।
চলবে…
প্রাচীন স্রোতের কণা-৫॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ