॥ তিন ॥
সাধারণ মনোবিজ্ঞানের ক্ষতিপূরণের সূত্রে আবির ক্লাস নাইনে রেজাল্ট ভালো করতে পারে। আরও একটি কারণ, সে নবম শ্রেণীর ছাত্রদের চেয়ে এক বছরের বড়। মাঝে মাঝে ক্লাসে যেতো। স্যারেরা, আপারা যা পড়াতেন, মনোযোগ দিয়ে তা বোঝার চেষ্টা করতো। একবছরের জুনিয়র ছাত্রদের মধ্যে সে বেশ মেধাবী বলেই গণ্য হয়। সে দিনরাত যখনই সময় পায়, পড়তে থাকে। তবে মুদি দোকানের কাজ তার ভালো লাগে না। এই কাজটা সে কখনোই ভালোবাসে না। তার ধারণা সারাদিন মুদির দোকানে একটা পিড়িতে বসে থাকলে আর হাতের কাছে চাল, ডাল, মুড়ি, চিনি বেচলে মানুষ খাটো হয়ে যায় আর পেট মোটা হয়ে যায়। উচ্চতায় বাড়ে না। কোমরে চর্বি জমে পোটলার মতো হয়ে যায়। এই কাজটা সে ছাড়তে পারলে বাঁচে। বুড়াকালে এদের ডায়াবেটিসে ধরে।
তবে এই মুদি দোকানে কাজ করতে গিয়ে সে পুরান বইয়ের সাথে পরিচিত হয়। সে মিরকাদিম বন্দরে যাওয়ার সুযোগ পায়। মালিক তাকে সেখানে মোকামে পাঠায়। বিভিন্ন মাল পাইকারি কিনে আনার জন্য। বেশিরভাগ সময় মালিক নিজে বকেয়া টাকা দিতে গিয়ে নতুন মালের অর্ডার দিয়ে আসে। হাতে করে কিছু মাল নিয়ে আসে। বাকিগুলো আনার জন্য আবিরকে পাঠায়। আবির মাসে এক-দুইদিন এই সুযোগে বাইরে ঘুরতে পারে। এছাড়া মুদি দোকানের কর্মচারীদের আর কোনো ছুটি নাই। বছরের কোনো দিনই দোকান বন্ধ থাকে না। এমনকি ঈদের দিনেও না।
মিরকাদিম বন্দরে গেলে আবির নিজে বাছাই করে বিভিন্ন পাঠ্য বইয়ের গাইড বই, নোট বই বেছে নিয়ে আসে। সে এসএসসির সব বিষয়ের গাইড বই এভাবে যোগাড় করে ফেলেছে। বাড়িতে নিয়ে পড়তে থাকে। কয়েকদিনে সে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব প্রশ্নের উত্তর কণ্ঠস্থ করে ফেলেছে। এর পরে সে কলেজ পর্যায়ের যে কোনো বই পেলেই ঘরে নিয়ে আসে। সে কলেজের শিক্ষা পদ্ধতি ও ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা রাখতো না। সব ধরনের বই সে হাতের কাছে পেলেই কিনে আনে। তার ইচ্ছা এসএসসি পাস করে কলেজে পড়বে। তখন যদি বইয়ের দাম বেড়ে যায়!
এ চিন্তা করে সে সব ধরনের বই দিয়ে ঘর ভরে ফেলেছে। কিছুদিন পরে সে কলেজের বইগুলোতেও চোখ বুলাতে থাকে। এক আধটু পড়তে ইচ্ছাও করে। মাঝে মাঝে সে বিজ্ঞান বিভাগের বইগুলো পড়ে। স্কুলে সে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। আর এখন সে এসএসসির পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের সবগুলো গাইড বই পড়ে ফেলেছে। তাই উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞানের বইগুলো ভালো বুঝতে পারে। সমাজকর্ম, সমাজবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, ইতিহাস, পৌরনীতি, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, ইসলাম শিক্ষাসহ অনেক ধরনের বই সংগ্রহ করেছে। সবগুলো সে বোঝে না। বুঝুক আর না বুঝুক সে পড়তে থাকে। কিছুদিন পরেই আবির অনুভব করে, এ যুগে জ্ঞান অর্জন করা কঠিন কিছু না। বাজারে যত ধরনের বই পাওয়া যায়, স্কুলে তত ধরনের বই পড়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। তাহলে প্রকৃত শিক্ষা আসলে প্রতিষ্ঠানে নয়, প্রতিষ্ঠানের বাইরে নিজের ইচ্ছার ভেতর লুকানো থাকে। চাইলেই সেখান থেকে নেওয়া যায়।
আবিরেরা ঘর ভাড়া নিয়েছে একটি কাঁচাভিটির টিনের দোচালা ঘরের এক রুম। এর মধ্যে একটি চৌকি আর মিটসেফ আছে আসবাবের মধ্যে। চৌকিতে ঘুমায় আবির আর মোকসেদা। নিচে এক ফালি জায়গায় ঘুমান জায়দা আর কোলের ছেলে আজিম। মোরশেদা মাঝে মাঝে চৌকির ওপরে মোকসেদার সাথে ঘুমায় আবার বোনের সঙ্গে ঝগড়া লাগলে নিচে মায়ের কাছে চলে আসে। কখনো চৌকিতেই বড় ভাইয়ের উল্টাপাশে ঘুমায়।
জায়দার মাসে দশদিন নাইট ডিউটিতে যেতে হয়, মিলে বলা হয় সি শিফটে যাওয়া। রাত সাড়ে নয়টায় বেরিয়ে গিয়ে দশটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি করে ফেরেন সাতটার দিকে। ফিরে এসে রান্না করতে বসেন। চোখে থাকে ঘুম। চুলার ওপর ঝিমিয়ে পড়েন মাঝে মাঝে। রান্না শেষ হলে সবাইকে খেতে দেন। খাওয়ার পরে ওরা স্কুলে চলে গেলে তিনি ঘুমানোর জন্য দরোজা বন্ধ করেন।
মা এবং আবির দুজনে একই শিফটের ডিউটিতে গেলে ভালো লাগে। সে যখন বাড়িতে থাকে ততক্ষণ মায়ের সাথে দেখা হয়। কিন্তু দুজনেই ডিউটিতে থাকলে বাসাটা খালি হয়ে যায়। দুটি বোন আর একটি ছোট ভাই বাসায় থাকলে দুজনেরই চিন্তা থাকে। আর দুজনের একসাথে নাইট ডিউটি হলে ওরা সারা রাত বাসায় থাকতে ভয় পায়। বি শিফটের—মানে বিকালের উিউটি হলেও সন্ধ্যার পরে ভয় পায় ওরা। দুপুর দুইটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকতেও ওরা সাহস পায় না।
ওদের বাসা বাড়িটায় বড় বড় আম গাছ আছে। এক পাশে ডোবা গর্ত। সেদিক দিয়ে তাকালে অনেক দূর পর্যন্ত ফসলের জমি দেখা যেতো। পাশের বাড়িতে আছে পুকুর, সেখানেই গোসল করে এই বাড়ির সবাই। এমনকি ভাড়াটেরাও। এখন মুক্তারপুরে এক বর্গ ইঞ্চিও কৃষিজমি নাই। তখন অনেক জমি ছিল। অনেক খোলামেলা ছিল। বড় বড় ফলের গাছ ছিল। কাফিলা, মান্দার, হিজল, বরুণ, বড়ই, গাব, কড়ই গাছ এবং বাঁশঝাড়সহ অনেক অন্ধকার ছিল। এখন তো এলাকাই আর চেনা যায় না। মিল-কারখানা বেড়েছে অনেক। কোনো খালি জমি নাই। গাছ নাই। সবাই শুধু ঘর তুলে ভাড়া দিচ্ছে। গ্যাস আছে, ঘর তুলে ভাড়া দিলেই চলে। কারো ঘর খালি থাকে না। আর অলিগলিতে ভরে গেছে। গলিতে গলিতে দোকানও চলে। এলাকায় সিনেমা হল আছে। কয়েক বছর আগে তৈরি হয়েছে। নারী-পুরুষ সবাই সিনেমা দেখতে যায়। মাসের শুরুর দিকে নতুন ছবি লাগালে ভিড় বেশি হয়। তখন সবাই বেতন পায়; হাতে টাকা থাকে। তখন এলাকার দোকানগুলোতেও বেচাকেনা বাড়ে।
আবির তার মায়ের পরের শিফট নিয়েছিল। মা যখন ডিউটিতে যান, আবির তখন ঘরে থাকে। মায়ের ফিরে আসার সময় হলে আবির বেরিয়ে যায়। আবিরের যখন সকালে ডিউটি মায়ের তখন নাইট ডিউটি থাকে। সকাল আটটার দিকে মোরশেদা না হলে মোকসেদা টিফিন ক্যারিয়ারে করে সকালের খাবারের ভাত দিয়ে আসে। যখন আবির যখন দুপুর দুইটায় ফিরে আসে। তখন মা ঘুম থেকে উঠে ওদের খেতে দেন। চারটার দিকে মোরশেদা আর মোকসেদা স্কুল থেকে আসে।
আবির যখন হারুনের ষড়যন্ত্রে চাকরিচ্যুত হয়ে দোকানে কাজ নিয়েছে তখন বাসাটায় নিরাপত্তাসংকট বাড়ে। আবিরের ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। দেখা যায় মা তখন বি শিফটের উিউটিতে গেছেন। এর মধ্যে মোরশেদা আর আজিম পড়তে বসে না খেয়ে ঘুমিয়েও পড়ে।
এখানে আসার পরে একটা ভালো হয়েছে, প্রাইমারি স্কুল যেমন কাছে পাওয়া গেছে। তেমনি হাইস্কুলও দেখা গেল অনেক কাছে। এতকাছে না হলে হয়তো ওদের পড়ালেখা হতো না। মোকসেদা ফাইভ পাস করার পরেই তাকে হাই স্কুলে সিক্সে ভর্তি করিয়ে দেয় আবির। অংক-ইংরেজি নিজেই পড়ায়। এ শিফট আর সি শিফটের ডিউটি থাকলে সন্ধ্যার পরে আবির ওদের নিয়ে পড়াতে বসে। নিজেও পড়ে। আর বি শিফটের ডিউটির সময় সকালে সে ওদের নিয়ে বসে। তবে আবিরের যে সময় ডিউটিই থাকুক, সকালে আর রাতে ওদের পড়তে বসতেই হয়।
মাঝে মাঝে ওরা ফাঁকিও দেয়। যখন আবির বি শিফটে থাকে তখন ওরা বাড়িওয়ালার ঘরে টিভি দেখতে যায়। ছোট ভাই আজিম মাঝে মাঝে মাকে বলে, মা, আমাগো একটা টিভি কিনতে কও ভাইয়েরে।
প্রায়ই আজিম বায়না ধরে। মাঝে মাঝে মোরশেদাও বলে। একদিন জায়দা কথাটা আবিরকে বলেন। আবির বলে, মোকসেদা মেট্টিক পাস না করলে ঘরে কোনো টিভি আনমু না।
এই টার্গেট আবিরদের পরিবারের সবার আত্মস্থ হয়ে যায়।
আসলে মোকসেদার ম্যাট্রিক পাস অনেক দূরের কথা। বরং আবিরের নিজের এসএসসি পরীক্ষা তখন ছিল অতি সামনে। মুদির দোকানে কাজ করে সে শুধু রাত জেগে পড়তে পারতো কিন্তু স্কুলে ক্লাস করার সুযোগ পেতো না।
বর্ষাকালে নদীতে পানি বাড়ে। খাল-বিল-পুকুর সব জায়গায় পানিতে একাকার হয়ে যায়। তখন জাল, সুতা, কাছির চাহিদা বাড়ে। আর চাহিদা বাড়লে দামও বাড়ে। তখন শ্রমিকদেরও দাম বাড়ে। একদিন আবিরকে দোকানে একা দেখে সেই জালের ফ্যাক্টরির এক মুরুব্বি শ্রমিক সদাই নিতে এসে বলেন, তুমি আগে নেইট মেশিন চালাইতা না? ছাইড়া দিলা ক্যান? এহন তো অপারেটরগো বেতন বাড়তাছে।
আবির বলে, মেশিন পাইলাম না দেইখা ছাইড়া দিছি।
কাম জানলে মেশিনের অভাব? মুরুব্বি আবিরকে বলেন, তুমি কি আবার মেশিন চালাইবা? তাইলে একদিন আমার লগে লও, আমি সাবেরে কইয়া দিমুনে।
মুদি দোকানের চৌদ্দ ঘণ্টার কাজ থেকে মুক্তির ইশারা পেল যেন আবির। সে পরদিন পেট খারাপের মিথ্যা কথা বলে দোকান থেকে ফাঁকি দিয়ে সেই মুরুব্বির সাথে গিয়ে মালিকের সাথে দেখা করল। মালিক বলে, আরে চৌরা, আমিতো কইছিলাম তুই বেশিদিন কাম করতে পারবি না। দৌড় দিবি। ঠিকই তো দৌড় দিলি।
আবির কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু মুরুব্বি তাকে কথা বলতে হাতের ইশারায় নিষেধ করলেন। মালিক-মহাজনদের মুখের ওপর কথা বলতে হয় না। তারা আয়- রোজগারের ব্যবস্থা করেন, এটা মেনে চলতে হয়। এরা মনে করে ফ্যাক্টরির মালিকেরাই বুঝি রিজিকের মালিক।
মালিক আবার বলে, তুই যদি কাজ করতে চাস নতুন মেশিন আইতাছে পাঁচটা। সামনে শুক্কুরবারে আইসা লাইগা যাবি। নতুন মেশিনে সুতা লাগাইয়া রানিং করতে পারবি?
পারমুনা ক্যান।
শুক্রবারে নতুন মেশিন আসার পরে কাজে লেগে যাবার কথাতেই থাকে আবির। এর পরে সে আর মুদি দোকানে যায় নাই। মালিক জিজ্ঞাসা করতে করতে বাসায় এসে আবিরকে খুঁজে গেছেন। আবিরের মা বলে দিয়েছেন, ও তো মেট্টিক পরীক্ষা দিবো এখন কয়েকমাস দোকানে যাইতে পারবো না।
পরের শুক্রবারে আবির বেপারি সাহেবের ফ্যাক্টরিতে গিয়ে দেখে ট্রাক থেকে নতুন মেশিন নামানো হচ্ছে কপিকলের সাহায্যে। ক্যারক্যার আর হেঁইয়ো হেঁইয়ো আওয়াজ হচ্ছে। একটা মেশিন ফ্যাক্টরির ভিতরে ঢুকেও গেছে। এই মেশিনগুলো আকারে অনেক বড়, ওজনেও অনেক বেশি হবে বলে আবির ধারণা করে। দৈর্ঘ্যে বারো ফুটের কম হবে না। প্রশস্ত হবে ছয় ফুট। আর উচ্চতায় সাত-সাড়ে সাত ফুট। মিলের ভিতরে গিয়ে আবির দেখে একটা মেশিন প্রায় চালু করা হয়েও গেছে। মেশিনের শাটেলের সুতা ঠিকই আছে। কিন্তু উপরের সুতা আপার হুক থেকে টেনশন রোলারের নিচ দিয়ে উঠে মাথার একফুট উপর দিয়ে পিঠের পিছনে ববিনের ক্যারিয়ারে বসানো হয়েছে। জাপানের তানিমুরা কোম্পানির মেশিন। মেশিনের বিশালতা আর আকারের ভিন্নতা দেখে আবির কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। এই মেশিন সে আগে দেখেছে, কিন্তু চালানোর অভ্যাস নাই। মেশিনগুলোর আপার হুক প্রতিটি ভিন্ন। সেগুলোর প্রতিটি ছোট পিনিয়মে বসানো। সাড়ে তিন বা চারশো হুকের সবগুলো একসাথে ঘোরে। একবার ঝাঁপ ওঠার সময় টেনশন রোলার যতটুকু সময় নেয় ততক্ষণে পিনিয়মগুলো দুইবার ঘোরে। আবির খুব সহজেই বুঝতে পারে এই সব মেশিন অনেক দামি। কারণ এর প্রোডাকশনও উন্নত। আপার হুকগুলো জড়ানো সুতা নিয়ে দুইবার পাক খেয়ে ঘোরে বলে জালের সুতার গিঁটগুলো হয় ডাবল। জাল শক্ত হয়। সহজে ছিঁড়বে না, ফেঁসে যাবে না।
আবির প্রথমে খেয়াল করে নাই, পরে দেখে মেশিন এসেছে মাত্র পাঁচটা, অপারেটর লাগবে পনেরো জন। কিন্তু এর মধ্যে বিশ-বাইশ জন অপারেটর এসে এখানে সেখানে ঘুর ঘুর করছে। তিন-চারজনে মিলে একটা মেশিন চালুও করে ফেলেছে। আবির সাহস হারিয়ে ফেলে। সে প্রবল হতাশ হয়। মালিকের কাছে দেখা না করেই সে সরে যায়।
পরদিন আবির বেকার কাটায়। সারাদিন বই পড়ে, বিকালে স্থানীয় মাঠে গিয়ে দলে ভিড়ে ফুটবল খেলে। স্থানীয় ছেলেদের দুটি দল বল খেলছিল। বাইরের ডিস্ট্রিক্টের কাউকে নেয় না ওরা। বাইরের বলে, ভাড়াটে বলে আবিরকেও নেওয়ার কথা না। সে প্রথমে মাঠের কিনারে বসে দেখছিল, আর মাঠের বাইরে চলে যাওয়া বল শুট করে, কখনো হেড দিয়ে প্রত্যাঘাত করে ফিরিয়ে দিয়েছে। এতে সহজেই সে খোলোয়াড়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়।
একটু পরে একজন খেলোয়াড়—বাড়ি থেকে ডাক আসায় চলে যায়, সে শূন্যপদে আবির নিযুক্ত হয়। আবিরদের দল তিন-দুই গোলে জিতেছে। আবির তার দলের হয়ে তিনটি গোলের মধ্যে একটি গোল করার সুযোগ পায়। তিনবার সে গোল খাওয়া থেকে দলকে রক্ষা করে। সে ভালো খেলে দেখে দুই দলের কাছেই কদর পায়। সন্ধ্যায় খেলা শেষ হলে স্থানীয় ছেলেরা পরদিন খেলার অগ্রিম নিমন্ত্রণ করে রাখে।
কিন্তু রাতে আবিরের বেকার দিন কাটানোর কারণে আফসোস হয়। সে বাজারে গিয়ে হাঁটে, কিন্তু কাজ ছেড়ে আসা মুদি দোকানের সামনে যায় না। এসময় সে হারুনের সেই ভাগ্নেকে দেখতে পায়। যার কারণে তার চাকরি গেছে। মাথা নিচু করে সরে যাওয়ার সময় হারুনের ভাগ্নে আবিরের দিকে এগিয়ে এসে কথা বলে,
তুমি আবির না? আমি আনোয়ার, হারুনের ভাইগ্না। তুমি হারুন মামার হেলপার আছিলা না?
শেষের বাক্যটি অপমানজনক মনে হয় আবিরের কাছে। আনোয়ার আবিরকে ওর মামার হেলপার হিসাবেই চিনলো? সে যে স্বয়ং মালিকের কাছ থেকে মেশিন পেয়ে অপারেটর হয়ে গিয়েছিল, হারুন মামার চেয়ে বেশি প্রোডাকশন দিতে পেরেছে সে সব কথা মিথ্যা হয়ে গেল? অপমানে সে চুপ করে রইল। আনোয়ার নিজেই আবার কথা বলা শুরু করে,
আমি শুনলাম তুমি মাস্টার সাহেবের মেইলে মেশিন চালাইতাছো!
এই বাক্যটিও কাঁটাঘায়ে নুনের ছিটার মতো লাগল। তবে এবার আবির আর চুপ করে রইল না। সে বলল,
আমি তোমার কারণেই তো মেশিন ছাইড়া দিয়া আইলাম, এখন কও আমি মাস্টারের ওখানে মেশিন চালাইতাছি?
আবিরের কথায় আনোয়ার বোকা হয়ে যায়। তার মুখ মলিন হয়ে গেলে আবির বুঝতে পারে এতক্ষণ আনোয়ার যা বলেছে, মনে কষ্ট দিয়ে যে কথা বলেছে তা বোধ হয় স্বেচ্ছায় বলে নাই। হয়তো বোকামি করেই বলেছে। কারণ তাকে দেখতে বেশ সহজ আর সরল মনে হচ্ছিল আবিরের কাছে।
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে আবির বলে, নতুন মেশিন আইছে দেখলাম।
আনোয়ার মুখ উজ্জ্বল করে বলে, ঐগিলি বড় মেশিন। তুমি চালাইতে পারবা না, বড় অপারেটরগো ছাড়া চালাইতে দিবোও না।
আবির বোঝে কথা সত্য। উচ্চতায় লম্বা না হলে, ডাবল নটের মেশিন চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকলে বড় মেশিন চালাতে দেবে না। তবে বড় অপারেটররা এসব মেশিনে চলে গেলে ছোট মেশিনগুলো খালি হবে। সে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি সেই মেশিনটা চালাইতাছো?
উত্তরে আনোয়ার বলে, চালাইতাছি। কিন্তু মেশিনটায় ডিস্টাব দেখা দিছে। ঘন ঘন সুতা কাটে। প্রোডাকশন কইম্মা গেছে। অন্য মেশিন লমু। তুমি চালাইবা?
আবির আবার সন্দেহ করে। এতক্ষণ সে বুঝেছে আনোয়ার না বুঝেই হয়তো কঠিন কথা বলে ফেলেছে কিন্তু এবারের কথাটায় সে আবার অপমানিত হয়। সে মনে প্রবল জিদ নিয়ে বলে, না, আমি বেপারি সাবের মেইলে একটা মেশিন লমু, কথা কইছি।
আনোয়ার বলে, তুমি সেখানে কয় বছর কাম করার কতা কইছো?
আবির বলে, দুই বছরের।
আবিরের মিথ্যা কথা শুনে আনোয়ার চলে যায়। আবির চিন্তা করে, জিদ যেহেতু করেছেই তা রক্ষা করা উচিত। সে তখনই বাজারের অন্য পাশে বেপারি সাহেবের মিলে গিয়ে হাজির হয়। ফোরম্যানকে দেখা যায় গেটের পাশে দারোয়ানের কক্ষে বসে সিগারেট খাচ্ছে। সে গিয়ে তাকে সালাম দেয়।
সালামালাইকুম। আমি আপনের কাছে আইছিলাম।
ফোরম্যান সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞাসা করে, বাড়ি কই?
দ্বিধায় পড়ে যায় আবির। গ্রামের বাড়ির কথা বললে হয়তো চাকরি দেবে না। সে তাদের বাড়িওয়ালার নাম বলে, আমরা মুক্তারপুরেই খালেক সাবের বাড়ি থাকি। আগে বেপারি সাবের মেইলে মেশিন চালাইছি।
আঞ্চলিক উপভাষার উচ্চারণেই ফোরম্যান বুঝতে পারে আবিরদের বাড়ি চরের অঞ্চলে। জিজ্ঞাসা করে, কী মেশিন চালাইছোত, সিঙ্গেল নাকি ডাবল?
সিঙ্গেল।
কয় বছর চালাইছোত?
আনোয়ার যত বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলার ধারণা দিয়েছিল সে তত বছরের কথাই বলে, দুই বছর।
একটা মেশিন খালি আছে। আউজকা রাইতে চালাইতে পারবি?
আবির বলে, পারমু।
তাইলে নাইটে আয়। আমি আছি, আমার লগে দেখা করিছ।
এখানকার চাকরি এমনই। মুখের কথায় চাকরি হয়, আবার মুখের কথায় চলেও যায়। আবির অন্য একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি যোগাড় করে ফেলেছে। বাসায় গিয়ে কথাটা সবাইকে জানিয়ে সে কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুম আসে না। একটামাত্র রুম। লাইট জ্বললে তার ঘুম হয় না। আগের রাতে ডিউটি করলে পরের দিনে ঘুমের চাপে ঘুম হয়। নাইট ডিউটি করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। নতুন একটা প্রতিষ্ঠানে ঢুকলে সারা রাত স্ট্রং ডিউটি করতে হবে। সামান্য ত্রুটি হলে বদনাম হবে। আর আবিরের বদনাম মানে তাদের চর অঞ্চলের পাঁচটি ইউনিয়নের অধিবাসী সবার বদনাম। সদর উপজেলার অর্ধেক মানুষ চৌরা—তাদের সবার বদনাম হবে।
চলবে…
প্রাচীন স্রোতের কণা-২ ॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ