॥দুই॥
আবির ছোটবেলা থেকেই বন্ধুবৎসল। স্কুলে পড়ার সময় সে বাড়ি থেকে পাকা আম, আলুপোড়া ইত্যাদি পকেটে করে নিয়ে যেতো। বন্ধুদের ভাগ করে দিতো। চৈত্র-বৈশাখ মাসে কাচা আম, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে পাকা আম, বর্ষাকালে সবুজ পেয়ারা, শীতকালে পাকা বড়ই ইত্যাদি যা তাদের বাড়িতে গাছে ধরতো, যা তাদের ক্ষেতে চাষ হতো সবই সে স্কুলে নিয়ে যেতো। বাড়িতে একটা খেজুর গাছ ছিল, উজ্জ্বল কমলা রঙের খেজুর গাছ থেকে পেড়ে পকেটে করে নিয়ে যেতো। বন্ধুদের দিয়ে বলতো, লবণ দিয়া ভিজাইয়া রাখবি, দেখবি কাউলকা পাইক্কা যাইব। অনেক সময় আবির নিজেই লবণগোলা পানিতে ভিজিয়ে দেশি জাতের খেজুর পাকাতো। তার পরে বন্ধুদের জন্য নিয়ে যেতো।
গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে তখন ছাত্রসংখ্যা ছিল কম। তাদের মধ্যে সে প্রথম হয় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠেই। এরপর সে সর্বদাই ছিল ক্লাস ক্যাপ্টেন। ক্লাস ফাইভে সে প্রাইমারি বৃত্তি পেয়েছিল। হাইস্কুলে যেতে হয় অনেক পথ পাড়ি দিয়ে। কয়েক গ্রাম পেরিয়ে যেতে হতো। সে জেলা শহরের সেরা বালক স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু পড়ার খরচ দিতে পারে নাই তার মা। বাবার তখন কোনো কাজ ছিল না। বাড়ির সামনে ছোট একটা নিচু জমি, সেখানে আলু আর ধান দুই ঋতুতে দুই ফসলের চাষ হতো। এর বাইরে তাকে অন্যের জমিতে কাজ করতে হতো। বর্ষাকালে নদীতে এবং বাড়ির আশেপাশে বরশি দিয়ে মাছ ধরতো। মাছ বেচে সংসার চলতো না। বড় টানাটানি ছিল।
মেঘনা নদীতে তখন ছিল এলাকার প্রভাবশালীদের কতগুলো ড্রেজার। এখন সংখ্যায় অনেক বেড়েছে; কয়েক শ হবে। তখন থেকেই বৈধ এবং অবৈধভাবে সব ড্রেজার মালিকই বালু তুলতো। টাকা দিয়ে প্রশাসনকে হাত করে তারা অবাধে বালু তুলে বাল্কহেডে ভরে শহরে নিয়ে বেচতো। প্রাকৃতিক বিপদ যখন আসে সে শ্রেণীবিচার করে আসে না। নির্বিচারে বালু তোলার ফলে মেঘনার এই পাড়ে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। বড় বড় গিরস্তের কয়েকটা জমি নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার পরে আবিরের বাবা শাহ আলম মিজির একমাত্র ছোট জমিটিও ভাঙতে থাকে। একরাতে জমিটা ভেঙে সেখানে এক অতল গহ্বরের সৃষ্টি হয়। এ ভাঙন নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়।
নদীর ভাঙনের মুখে পড়া কয়েক গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত গিরস্ত মিলে শহরে এসে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। এই মানব বন্ধনের পেছনে ছিলেন আবিরের বাবা শাহ আলম মিজি। তিনি আগেই সবাইকে সতর্ক করেছিলেন, ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা ভালো না। তার বাপ-দাদারা ডুবিয়ে বালু তুলেছে। পেশাগতভাবেই তারা বালুর ডুবুরি ছিলেন। যখন ড্রেজার আসে, মেশিন দিয়ে কেটে বালু তোলা হয়, তখন থেকেই তিনি বাধা দিয়েছেন। ড্রেজার একটি দানবীয় যন্ত্র। যন্ত্রের কখনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। যে মানুষ এমন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তখন সে আর মানুষ থাকে না; যন্ত্র হয়ে যায়। তিনি বাধা দিয়েছেন মানুষের অন্তরাত্মার দিকে চেয়ে। নির্জ্ঞান একটি যন্ত্রের সাহায্যে বালু তুললে অধিক মুনাফার লোভ চলে আসে মানুষের মনে। অধিক লাভের লোভে পড়ে অনেক মানুষ দিন দিন ড্রেজার কিনতে শুরু করে। এর পরিণতিতে একদিন মেঘনার তীরের এই এলাকার মানুষের দশ পুরুষের ভিটামাটিকে নদী গ্রাস করবে, এ কথা শাহ আলম মিজি অনেকবার বলেছেন। কেউ তার কথা শোনে নাই। নদীভাঙ্গা এবং চরপড়া এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নষ্ট হবে। নদীতে কৃত্রিম কারণে ভাঙন দেখা দেবে কিন্তু একূল ভেঙে আর ওকূল গড়বে না। এখন সবাই দেখতে পাচ্ছে শাহ আলম পাগলার কথাই সত্য। ড্রেজারের কারণে নদী ভাঙছে কিন্তু চর জাগছে না। নদীর তলে বালু জমাট হওয়ারই সুযোগ পায় না। ড্রেজারের দানবীয় ধারালো পাঙ্খা দিয়ে কেটে কেটে সেই বালু পাইপ দিয়ে তুলে আনছে।
তবে প্রগতির চাকা কোনোভাবে বন্ধ রাখা যায় না। প্রগতি যে শুধু কল্যাণমূলক তাও না। সে মূলত ন্যায়নিরপেক্ষ। প্রগতি যন্ত্রনির্ভর অন্ধশক্তি, তাই তার কাজ এগিয়ে যাওয়া। তার গতিপথ নির্দেশ করে দিতে হয় সমাজের কল্যাণকামী মানুষদেরই। কেউ সে পথ নির্দেশ না করলে সে প্রগতি মানুষের জন্য আত্মঘাতী হয়। এসব কথা বয়াতী গানের ভক্ত শাহ আলম মিজি বইয়ের ভাষায় লিখতে পারতেন না, গুছিয়ে বলতেও পারতেন না। শুধু শোনা গানের মুখস্ত বাণীর মাধ্যমে বলতে পারতেন, অথবা মেঘনার চরাঞ্চলের আঞ্চলিক উপভাষায় কইতে পারতেন। তার কথা কেউ বিশ্বাস করে নাই। নদী যখন হেঁটে বাড়ির কাছে চলে আসে তখনো তিনি সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন। তিনি উত্তেজনা নিয়ে ঘুমাতেন আর প্রায় প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখতেন। তিনি ভাবতেন, স্বপ্নে তাকে জানানো হচ্ছে। আসলে তাকে দিয়ে জানানো হবে সবাইকে। তাই তিনি সবাইকে জানানো কর্তব্য মনে করতেন। ভাঙনের মুখে পড়া জমির মালিকদের ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝিয়েছেন মেঘনা কিন্তু প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। নদী যখন প্রতিশোধ নেয় তখন সব দ্রুত ভাঙে, কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। এই গ্রামে নদীর পাড়ে কোনো সাধক পুরুষের আবির্ভাব হয় নাই। এখানে কোনো সাধকের কবরও নাই। কবর থাকলে এভাবে ভাঙতো না। আর থাকলেও মেঘনা নিজের থেকে না ভাঙতে চাইলেও মানুষের লোভের পাপের ভাঙন ঠেকানো যায় না। তখন সবার টনক নড়েছে।
শাহ আলম মিজির কথায় সবাই একদিন চারটি ট্রলার বোঝাই হয়ে শহরে গিয়ে মানববন্ধন করেছেন। শাহ আলম মিজি শহরে গিয়ে তার বন্ধু আলতাফ মাস্টারকে দিয়ে একটা কাগজে কিছু কথা লিখিয়ে নিয়ে আর্টিস্টের দোকানে গিয়ে একটা কালো কাপড়ে ব্যানার লিখিয়েছেন। তার পরে সবাই প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চেয়েছিলেন থানা ঘেরাও করতে। কিন্তু এটা থানা ঘেরাও করার মতো বিষয় না; এ কথা শাহ আলম মিজিই সবাইকে বুঝিয়েছেন। তবে কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন সাংবাদিক সম্মেলন করতে। এ বিষয়টা শাহ আলম মিজি ভালো বোঝেন না। বুঝলে এটার আয়োজনও তিনি করতে পারতেন। এলাকার শিক্ষিত ছেলে যারা সরকারি কলেজে পড়ছে, তাদের কাছে যেতেন, যারা শিক্ষকতা করছেন তাদের কাছে যেতেন, সেই গুণ তার ছিল। কিন্তু তিনি যা করেছেন তারই প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক, আর জীবনঘাতী।
প্রভাবশালী কারো নাম উল্লেখ না করে তারা ব্যানারে শুধু ভূমিদস্যুদের হাত থেকে কৃষি জমি উদ্ধারের কথা লিখেছিল। এই ঘটনার কিছুদিন পরে শাহ আলম মিজির লাশ পাওয়া যায় দূরের এক ধানক্ষেতে। শরীরে কোনো গুলির বা মারধর করার দাগ ছিল না। লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছিল কিন্তু সে তদন্তের রিপোর্ট পরিবারের কারো কাছেই পৌঁছায় নাই কোনোদিন। কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন করে কিছুই হয় নাই। উল্টা একজন ভূমিহীন কৃষকের প্রাণ গেল। এ নিয়ে খুব বেশি লেখালেখিও হয় নাই। ‘ধানক্ষেতে পুরুষের লাশ উদ্ধার’ এ জাতীয় হেডলাইনের ভেতরে পূর্বশত্রুতার জের বলে একটি আনুমানিক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
যখন বাবাকে মারা হয় তখন আবির এইট থেকে নাইনে উঠেছে। অনেক দূরের জেলা শহরের স্কুলে পড়ে। এ অবস্থায় গ্রামে থেকে সংসার চালানো কঠিন। চার জন ভাই বোন নিয়ে আবির গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। সংসারের বড় ছেলে বলে তাকেই ভাবতে হয়। তাদের নিকট আত্মীয় বলতে ছিল মামারা। চাচাদের মধ্যে একজন গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে নারায়ণগঞ্জে চলে গেছে। অন্যজন মালয়েশিয়া আছে। গ্রামে তাই আবিরেরা বেশ দুর্বল হয়ে যায়। মামাদের বাড়ি পৌরসভার মধ্যেই, কিন্তু সেখানে থাকার জায়গা কম। আবিরের মা জায়দা বানু ভাইদের কাছে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু সেখানে ছোট একটা ঘর; থাকার সমস্যা আর সংসার চালানোর মতো কোনো উপায় ছিল না। কাজেই ভাইদের কাছে এসে কোনো সমাধান হলো না।
দূর থেকে এই অঞ্চলের মানুষদের সম্পর্কে অনেকে বলে থাকে এরা এখনো মধ্যযুগের মতো গোষ্ঠীতন্ত্রে বিশ্বাসী। এ কথার সত্যতা আবির এবং তার পরিবার কখনো পায় নাই।
মুন্সীগঞ্জ শহর বেশ পুরনো। মোগল আমলে বাদশা আলমগীরের যুগে এখানে শহরের পত্তন হয়। পর্তুগিজ ও মগ-আরাকানি নৌদস্যুদের হাত থেকে রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর রক্ষা করার জন্য এখানে একটি বড় দুর্গ গড়ে তোলা হয়। সেখানে কয়েক হাজার মোগল সৈন্যের থাকার ব্যবস্থা ছিল। সৈন্যদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সব কিছু দিল্লি থেকে আনা সম্ভব হতো না; স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে এটাওটা কিনে নিতো সেনারা। শহরের অদূরে গড়ে ওঠে একটি হাট। কেল্লার কাছাকাছি গড়ে ওঠে বড় বাজার। কালক্রমে সেখানে হয় একটি গঞ্জ। আজও গঞ্জ আছে। এখন জেলা সদর। এ শহরে সরকারি আমলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, সদর হাসপাতালের চিকিৎসক, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ব্যাংক, বিমা এবং এনজিও অফিসের শিক্ষিত অফিসারদের বাস। আর দোকানদারদের বসবাস। এখানে কোনো বড় ধনী নাই, শিল্পপতি নাই, শিল্প প্রতিষ্ঠানও নাই, তাই কর্মসংস্থান কম। শ্রমিক ব্যারাক নাই। বস্তি নাই। ধনীদের আলিশান ও অভিজাত বাড়িঘরও নাই। পৌরসভার মধ্যে কিছু দরিদ্র এলাকা আছে বটে, সেখানে দোকানদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং রিকশা, ভ্যান, টেম্পো ইত্যাদি পরিবহণ শ্রমিকরা বাস করেন।
এমন শহরে লাগালাগি করে তোলা ঘরের ঠাসা একটি বাড়িতে উঠে জায়দা বানু দুই ছেলে আর দুই মেয়ের মুখের আহার জোগাতে পারলেন না। বড় ছেলে আবিরকে হয়তো রিকসা চালানো, টেম্পোর হেলপারি করা, নদীতে ট্রলারে মাঝিগিরি করতে হতো। অথবা দোকানে কাজ করা ছাড়া আর কোনো কর্মসংস্থান হতো না এখানে।
ক্লাস নাইনের আবির কয়েকদিন লঞ্চঘাটে গিয়ে ঘুরেছে। কোনো কাজের মিল করতে পারে নাই। তালতলা-নারায়ণগঞ্জের এবং বরিশাইল্লা বড় লঞ্চে কয়েকদিন পাউরুটি আর কলা বেচেছে। দিনশেষে বাজার করে চাউল-ডাইল কিনে এনেছে; এর পরে সবার মুখে ভাত জুটেছে। এ কাজটা তার বেশি ভালো লাগে নাই। সারাদিন বেচাবেচি করলেও আয় কম।
আবির এর মধ্যে ছোট্ট শহরটা এবং এর আশেপাশের সব এলাকা চিনে ফেলেছে। সে দেখে এসেছে শহরের পশ্চিম দিকে পঞ্চসারে- মুক্তারপুরে অনেক মিল কারখানা আছে। জাল, সুতা, দড়ি-কাছি, ধানের মিলসহ নানা রকমের কারখানা। সেখানে বিসিক শিল্পনগরীও আছে। অনেক দেশের লোক সেখানে কাজ করে খায়।
একদিন আবির এক লোকের সাথে আলাপ করে আসে। পরদিন থেকে সে দুপুর দুইটায় ডিউটিতে যায়। ফিরে আসে রাত দশটায়। তখন আট ঘণ্টা করে কাজ ছিল। সে যে লঞ্চঘাটের কাজ ছেড়ে দিয়েছে বাড়িতে জানায় নাই। পরের এক সপ্তাহ ধরে সে মিলের কাজ শিখেছে। জালের মেশিনের ববিন সুতা দিয়ে ভরতে হয় মোটরচালিত ওয়াইন্ডিং মেশিন দিয়ে। সে দ্রুত কাজটা ধরতে পেরেছে। ভাঙা মাসের এক সপ্তাহ সে কাজ শিখেছে। পরের মাসে তার বেতন ধরা হয়েছে।
যেদিন থেকে আবির মাছ ধরার জালের কারখানায় বেতনভুক্ত শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত হয় সেদিনই সে বাড়িতে মাকে জানায়,
মা, আমি মুক্তারপুরে জালের ফ্যাটকারিতে কাম লইছি। সামনে মাসে আমারে বেতন দিবো। এই একমাস কষ্ট করতে হইবো। আমি ওখানেই বাসা ভাড়া লমু। সবাই ওখানে চইলা যামু।
জায়দাবানু এই কথায় খুশি হন নাই, বেজার হওয়ারও কিছু নাই। তিনি প্রথমে চুপ করে রইলেন। পরে বললেন, বাবা, এই একমাস চলমু কেমনে?
আবির বলে, তুমি মামার কাছ থিকা কিছু টেকা ধার আনো। মাস শেষে বেতন পাইলে দিয়া দিমুনে।
আবিরের কথামতো তার মা ভাইয়ের কাছ থেকে ধার করে টাকা আনে। আবির মুক্তারপুরে বাসা নেয়। ছোট ভাই বোনদের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। মোকসেদা ভর্তি হয় ফাইভে। মোরশেদা থ্রিতে। আর ছোট ভাই আজিমকে ভর্তি করায় প্রথম শ্রেণীতে।
তিন জনের পড়ার খরচ, পাঁচজনের খাওয়া, পরা এবং বাসার ভাড়া একজনের আয়ে চলে না। কিছুদিন পরে মোকসেদাকে রান্না বান্না এবং ঘরের কাজ শিখিয়ে জায়দা বানুও সুতার ফ্যাকটরিতে কাজে লেগে যায়। এখানে অনেক মহিলা কাজ করে। নানা ধরনরে কাজ আছে তাদের জন্য। দিনে বারো ঘণ্টা করা যায়; মেশিন থেকে বের হওয়া জাল ছেঁড়া থাকলে তা সেলাই করা। আরেক ধরনরে কাজ আছে কারন্টে জাল মেশিন থেকে আড়াআড়ি বের হয়, সেগুলো স্টিলের বড় রডে গেঁথে লম্বালম্বি করে ডোর লাগানো। এই কাজটাকে বলে ‘মালাগাঁথা’। এর পরে বড় বয়লারের গরম পানির ভাপে ইস্ত্রি করে টান করা হয়। এখানে নারী শ্রমিকদরে আরেক ধরনের কাজ আছে সুতার ফ্যাক্টরিতে। বিদেশ থেকে আসা কাঁচা সুতা আধা পাকা করার টুইস্টিং মেশিন চালানো। যে সব নারী টুইস্টিং মিলের মেশিন চালায় তাদের ডিউটি আট ঘণ্টা। ঘুরে ঘুরে তিন শিফট। নাইট ডিউটিও আছে। যার যে কাজ ভালো লাগে সেটা শিখে নিতে হয়। জায়দা বানু মেশিন চালানের কাজই বেছে নেন।
এবার দুইজনের আয়ে একটু স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার মতো অবস্থা হয়।
আবির প্রথমে মেশিন হেলপার হয়। বেতন সামান্য পায়। এই অঞ্চলের একটি কথায় আছে,
ভরার চেয়ে শূন্য ভালো, যদি ভরতে যায়
আগের চেয়ে পিছে ভালো যদি ডাকে মায়॥
দূরের যাত্রায় ঘরে অভাব দেখে গেলে তা ভালো লক্ষণ বলে বিবেচিত হয়। কারণ মনের ভেতর প্রবল প্রবণতা থাকে আয় করে ঘরে ফিরতে হবে। আর যদি ভরা দেখে যায় তাহলে বেশি আয়ের আকাক্সক্ষা মনে থাকবে না, তাই আয়ও কম হবে। আবির যেদিন প্রথম শ্রমিক জীবনের পথে এগিয়ে যায় সেদিন সে ঘরে প্রবল অভাব দেখেই গিয়েছিল। চর অঞ্চলের ছেলে না হলে হয়তো চোখ মুছতে মুছতেই যেতো। অভাবের প্রভাবেই আবির দ্রুত উন্নতি করতে থাকে। মাত্র এক সপ্তাহে সে কাজ শিখে ফেলেছে। সাত দিন পরেই সে হাজিরা পেতে শুরু করেছে। মাত্র তিন মাস মেশিন হেলপার হিসাবে কাজ করার পরেই সে জাল বোনার বড় মেশিন চালাতে শিখে গেছে। কিন্তু মেশিন সে খালি পায় না। কোনো একজন মেশিন অপারেটার চলে না গেলে মেশিন পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
সুতার ফ্যাকটরিতে এসে দেখে এখানকার দরিদ্র শ্রমিকদের মধ্যেও আছে নানা রকম দ্বন্দ্ব ও ফ্যাসাদ। এখানে ফোরম্যানেরা বেশিরভাগই অশিক্ষিত। সুপারভাইজার এবং ম্যানেজাররা শিক্ষিত হলেও অশিক্ষিত ফোরম্যানের কথাতে মালিকেরা চলে, কারণ তাদের মধ্যেও বেশির ভাগ অশিক্ষিত। কয়েকজন শিক্ষিত মালিক থাকলেও তাদের আচরণ, বিচরণ ও সিদ্ধান্তে শিক্ষার কোনো ছাপ দেখা যায় না। সবাই ফোরম্যানদের কথায় সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের কথাতেই প্রতিষ্ঠান চলে।
বেশিরভাগ মেশিন অপারেটর স্থানীয় শ্রমিক। তাদের দাপট অনেক। তাদের কেউ কেউ সুপারভাইজার এমনকি ম্যানেজারদের সাথে একত্রে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে। বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা ইত্যাদি বরিশাল বিভাগীয় জেলার ছেলেরা বেশিরভাগ হেলপার। কোথাও কোথাও বরিশালের ছেলেরা মেশিন অপারেটর হয়েছে। তারা সৌভাগ্যবান। তবে মেশিন পেতে হলে তাদের স্থানীয় বড়ভাই অপারেটরদের খুশি করাতে হয়। কিছু খাওয়াতে হয়। সিনেমা দেখতে টাকা-পয়সা দিতে হয়।
একই জেলার কিন্তু চর অঞ্চলের কোনো ছেলে এখানে মেশিনচালক হতে পারে নাই। এই বাস্তবতা যেদিন আবির আবিষ্কার করেছে, সেদিন সে ধরে নিয়েছে সে আবার ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়ে থাকবে। কেন যে এই চিন্তাটা মাথায় এসেছে সে স্পষ্ট মনে করতে পারে না। কিন্তু তার কাছে বিষয়টা অতি প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে।
একদিন মালিক নিজে কারখানা পরিদর্শনে এসে আবিরকে দেখে বলে, কিরে চৌরা, কাজকাম শিখছোস নাকি? মেশিন চালাইতে পারবি?
এখানে অন্য জেলার, দেশের উত্তর অঞ্চলের বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুরের লোকেরা কুলি-মজুরের কাজ করে। বরিশালের শ্রমিকেরা হেলপার অথবা অন্য নিম্নমানের কাজ করে। কোথাও শিক্ষিত বরিশাইল্লা হইলে সুপারভাইজারি করতে পারে। তবে ছোট-বড় স্থানীয় সবাই তাদের সরাসরি বরিশাইল্লা বলেই চিহ্নিত করে। স্থানীয়দের কথাবার্তায় অনেক ধার।
মালিক সাহেবের কথায় কিসের ইঙ্গিত ছিল তা আবির বুঝতে পারে নাই। কেউ তাকে বুঝিয়েও দেয় নাই। সে দেখছে স্থানীয়রা, যারা নিজেদের বিক্রমপুইরা বলে দাবি করে, তারা সহজে আবিরের বন্ধু হতে পারবে না। আবিরকে তারা আপন করে নেবে না। কথায় কথায় চৌরা বলে ডাকে। আরে চৌরা, কিরে চৌরা, যা চৌরা, খা চৌরা ইত্যাদি। মাঝে মাঝে মনে বেশ কষ্ট লাগে। মাঝে মাঝে ওরা আবিরদের চর অঞ্চলের উপভাষার মতো শব্দের শেষ সিলেবলে টান দিয়ে ব্যঙ্গ করে কথাও বলে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে, এসব আঞ্চলিক বৈষম্য।
কয়েকদিন পরে দেখা গেল ফ্যাক্টরিতে সাতটা নতুন মেশিন এসেছে। সেগুলো রানিং করার জন্য পুরানো দাপুটে অপারেটররা দৌড়ে গেল। আবিরের ওস্তাদ ছিল হারুন। সে আবিরকে সারা দিনের জন্য মেশিন দিয়ে নিজে নতুন একটা মেশিন দখল করে নিয়েছে। দুই দিনেই সে সুতা লাগিয়ে রানিং করে সেই নতুন মেশিনটা চালাতে থাকে। তবে পুরানো মেশিনটা পার্মােেনন্টলি আবিরকে দেওয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়টা স্পষ্ট করে নাই। আবির এখন অপারেটরদের মতো সমান জাল উৎপাদন করতে পারে। তার প্রোডাকশন বেড়ে গেছে।
নতুন মেশিনগুলো রানিং হওয়ার পরে একদিন মালিক সাহেব পরিদর্শনে আসে। আবিরকে মেশিনে দেখে জিজ্ঞাসা করে, কিরে চৌরা, প্রোডাকশন কত হয়? জাল ছিঁড়া-ফাঁড়া হয় নাতো?
আবির বলে, ওস্তাদের চাইতে আমার প্রোডাকশন বেশিই হয়।
মালিক সাহেব বলে, কস কী? তাইলে তো বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হইছে তোর? মেশিন একটা দিলে চালাইতে পারবি? নাকি কয়দিন পরে আবার দৌড় দিবি?
এই খোঁচাটাও আবিরকে সহ্য করতে হয়। চর অঞ্চলের ছেলেরা এখানে কাজ করে না বলেই তাকে এসব কথা শুনতে হয়। সে মাথা নিচু করে থাকে।
মালিক সাহেব বলে, তাইলে এই মেশিনটা তুই চালাইতে থাক। অন্য কাউরে দিমু না। কাজকাম করবি নাকি ট্রলার লইয়া মেঘনার পানিতে নাইমা যাবি?
এবার আবির সরব হয়, মেশিন পাইলে কাজ করমু না ক্যান?
এর পর থেকে মেশিনটা আবিরই চালাতে থাকে। দ্রুত তার বেতনও বাড়ে। তবে সে বিষয়টা নিয়ে যতোটা খুশি হয়েছিল, যতটা সহজ ভেবেছিল শ্রমিকদের মন, আসলে তত সহজ না। তিন মাস মেশিন চালানোর পরে হারুন তার এক ভাগ্নেকে নিয়ে আসে। মালিকের কাছে আবিরের নামে কিছু মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মেশিন থেকে নামিয়ে দেয়।
ওস্তাদের বেঈমানিতে আবির মানসিকভাবে প্রচ- আহতবোধ করে। চর অঞ্চলের ছেলেরা বেকার বসে থাকতে পারে না। অবসর কাটানোর মতো বিলাসিতা নাই। সে দ্রুত অন্য কাচ জুটিয়ে নেয়। কয়েকদিন একটা মুদি দোকানে কাজ করে।
মুদি দোকানে সওদা পোঁটলা বাঁধার জন্য যত বই ও পত্রিকার পাতা ছিঁড়েতে হয়, সে সুযোগ পেলেই সেগুলো পড়ে। এসএসসি পর্যায়ের কয়েকটা ইংরেজি গাইড এবং নোট বই আসে দোকানে। সেখান থেকে একটা গাইড বই আর একটা নোট বই বাড়িতে নিয়ে যায়। রাত জেগে সে বইগুলো পড়ে। ইংরেজিকে সে খুব ভয় পেত। এবার কিছুটা ভয় কমে তার।
এক বছর পিছিয়ে আবির আবার ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়ে যায়।
চলবে…
প্রাচীন স্রোতের কণা-১ ॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ