॥এক॥
বেশিরভাগ টেলিভিশনে স্ক্রল দেখিয়েছে ‘পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় নিবন্ধন পরীক্ষার্থীর আত্মহত্যার চেষ্টা’। কিন্তু পরদিন দৈনিক পত্রিকাগুলোয় দেখা গেলো ভিন্ন ধরনের সংবাদ। ‘ট্রাকের ধাক্কায় নিবন্ধন পরীক্ষার্থী আহত: চালক আটক’ এবং ‘ট্রাকের ধাক্কায় গৃহবধূ মারাত্মক আহত: ট্রাকচালককে গণপিটুনি’। এ ধরনেরই নিউজ এসেছে বেশিরভাগ পত্রিকায়। এক দিনেই নিউজটা বদলে গেছে। তবে যাত্রাবাড়ীর মতো ব্যস্ত এলাকায় একজন নারীর আহত হওয়ার সংবাদ জাতীয় গণমাধ্যমে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। গৃহবধূটি বা পরীক্ষার্থী মারা গেলেও গুরুত্ব পেতো না হয়তো।
কিন্তু মামলাটা ঢাকায় হয়েছে। এই মামলাটি মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তর করার জন্য একটি আবেদন জমা পড়েছিল। আহত গৃহবধূ ওরফে নিবন্ধন পরীক্ষার্থীর স্বামী ব্যবসায়ী মানুষ, তিনি ব্যস্ততার কারণে ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করতে পারবেন না, তাই জেলা শহরে মামলাটি স্থানান্তর করার জন্য আবেদন করেছেন। আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। আটক ট্রাকচালকের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে, তিনি থাকেন ঢাকার দয়াগঞ্জে। মামলা স্থানান্তরের ব্যাপারে তার মত জানতে চাওয়ায় বিপত্তি দেখা দেয়। তিনি প্রথম দিন চেয়েছেন মামলা ঢাকায় হোক। পরে তিনিও চান মুন্সীগঞ্জে চলুক। ট্রাকের মালিকের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের পাগলায়। মালিক যাত্রাবাড়ী থানায় উপস্থিত হয়ে বলেন, মামলাটি মুন্সীগঞ্জে হলে ভালো হয়। কী ভালো হয়, কার ভালো হয়, কেন ভালো হয়, এ ব্যাপারে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। এখান থেকেই তরুণ সাংবাদিক নাঈমা পারভেজের সন্দেহ হয়। মামলা হয়েছে সরকারি পক্ষে। কিন্তু ভিকটিমের স্বামী ও একিউজড উভয়ের ইন্টারেস্ট কেন মামলাটি মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তর করার এই প্রশ্নটি মাথায় নিয়ে তিনি অনুসন্ধানে নামেন।
নাঈমা পারভেজ প্রথমে জানতে পারেন ভিকটিমের স্বামীর সঙ্গে ট্রাকমালিকের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। আরও পরে আবিষ্কার করেন ট্রাকটির মালিকানা আসলে দুই জনের। ভিকটিম রেশমার স্বামী কবির হোসেনের আপন ভগ্নিপতি এই ট্রাকমালিক হাজি গোলাম রসুল। তিনি ট্রাকটি সম্বন্ধী কবির হোসেনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন, কিন্তু কবির হোসেন ট্রাকের মূল্যের সব টাকা পরিশোধ করে দেননি এখনো। আপাতত যৌথ মালিকানায় চলছে।
ট্রাকচালক বাহাদুর খান হাজি গোলাম রসুল কর্তৃক নিযুক্ত। পাঁচ বছর ধরে তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে গাড়িটি চালিয়ে আসছেন। এই পাঁচ বছরে তার নামে কোনো থানায় মামলা হয়নি। তিনি কোনো এক্সিডেন্ট করেননি। তবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদক নাঈমা পারভেজ ট্রাকচালক সমিতিতে বাহাদুর খানের প্রতিপক্ষের কাছ থেকে জানতে পারেন, গত বছরও তিনি এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে গেছেন। ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
নাঈমা পারভেজ নতুন করে অনুসন্ধানে নামেন, ট্রাকচালক বাহাদুর খান তার নতুন মালিক কবির হোসেনের স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে আহত করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন কেন? এরই মধ্যে ঘটনাটি মিডিয়ার আড়ালে চলে গেছে। একটি আহত হওয়ার নিউজের ফলোআপ ছাপাতে রাজি নন বার্তা সম্পাদকেরা। নাঈমা পারভেজ ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তিনি এই অহেতুক কাজে সময় দিতে আর পারছেন না। অন্য কাজ নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
নাঈমা পারভেজ একদিন এমনিতেই ভাবছিলেন, দুটি প্রশ্ন ছিল তার মাথায়। এক নম্বর প্রশ্ন, চালক কেন নতুন মালিকের স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, কবির হোসেন কেন মামলাটি মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তর করতে চেয়েছেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরের ভেতরে থাকতে পারে, চালক হয়তো চিনতে পারেননি। অথবা তিনি ইচ্ছা করেই কাজটি করেছেন। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আছে কবির হোসেন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন তাই তিনি মামলাটি মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তর করতে চেয়েছেন। তার নিজের সুবিধার জন্য। নাঈমা অন্য কাজে একদিন মুন্সীগঞ্জে গেলে কৌতূহলবশত জানতে পারেন রেশমা আক্তারের স্বামী কবির হোসেন নিজে কোনো মামলাই করেননি। স্ত্রী টাকের ধাক্কায় আহত হয়েছে তবু তিনি কেন মামলা করেননি? এর উত্তর হতে পারে নিজের পোষ্য ড্রাইভারের বিরুদ্ধে মামলা না করে এমনিতে ডিশমিশ করতে চেয়েছেন।
এরপর হঠাৎ করে স্ত্রীহত্যার একটি ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। স্বামী ভাড়াটে খুনি দিয়ে নিজের স্ত্রী এবং সন্তান খুন করায়। এ ঘটনায় নাঈমা আবার কৌতূহলী হন। তিনি সন্দেহ করেন যাত্রাবাড়ীতে ট্রাকের ধাক্কায় আহত রেশমার স্বামীকে। তিনি নিজে স্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করাননি তো নিজের পোষ্য ড্রাইভারকে দিয়ে?
ঘটনাটি নিয়ে নাঈমা সময় দিতে পারেন না। ঘন ঘন মুন্সীগঞ্জে যাতায়াত করা তার পক্ষে হয়ে ওঠে না। মুন্সীগঞ্জ ঢাকার অতি কাছের জেলা। জেলাশহরে যাওয়ার পথও সোজা, কিন্তু বেশ সময় লাগে। নারায়ণগঞ্জ ঘুরে যেতেও অনেক সময় লাগে। কয়েকবার গাড়ি পাল্টাতে হয়। আর মুন্সীগঞ্জে তার কোনো পরিচিত লোক নেই। ওখানকার সাংবাদিকেরাও তাকে খুব একটা পাত্তা দিতে চায় না। সেটি নানা কারণেই হতে পারে। নারী বলে, অপরিচিত বলে, স্বার্থের ব্যাপারও থাকতে পারে।
এর মধ্যে নাঈমার নানা ঝামেলায় দিন যায়। তার পত্রিকা তাকে ক্রাইম বিট থেকে শিক্ষাবিটের নিউজ করার দায়িত্ব দেয়। নাঈমা অপরাধ নিয়েই নিউজ করতে বেশি আগ্রহী। তাই তাকে প্রশ্নফাঁস, নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গনের সন্ত্রাস, সরকারদলীয় ছাত্রনেতাদের চাঁদাবাজি এসব নিয়ে নিউজ করতে বলা হয়। এর মধ্যে আবার শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা চলে আসে। এই পরীক্ষায় পাসের হার কম কেন? বছরের পর বছর ধরে সিরিয়াস পড়াশোনা করেও কেন শিক্ষার্থীরা পাস করতে পারে না, এই বিষয়ে তিনি অনুসন্ধান শুরু করেন। এনটিআরসিএ আসলে কী করে? তারা কি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে না কি রেজাল্টও নিয়ন্ত্রণ করে, এই বিষয়ে প্রশ্ন জাগে তার মনে। এবার ঢাকা শহরের সবগুলো পরীক্ষাকেন্দ্র ঘুরে পরিস্থিতি দেখার চেষ্টা করেন।
ঘুরতে ঘুরতে নাঈমা পারভেজ যাত্রাবাড়ী পরীক্ষাকেন্দ্রে চলে আসেন। এখানে পরীক্ষা ভালোভাবেই চলছিল। পরীক্ষার্থীদের নকল করার, দেখাদেখি করার কোনো সুযোগ ছিল না। পরীক্ষা শেষে তিনি কয়েকজন পরীক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ করেন, কেন এই পরীক্ষায় পাস করা কঠিন? নানা জন নানা রকম উত্তর দেন। তারা বিভিন্ন রকম ধারণার কথা জানান। তাদের বেশিরভাগই আবেগপ্রবণ উত্তর দেন। সবার মধ্যেই ক্ষোভ আছে দেখা যায়। কারও কারও ক্ষোভ তীব্র। কেউ কেউ পাঁচ বছর ধরে পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু পাস করতে পারছেন না। তাদের দাবি, বয়স থাকলে তারা বিসিএসও পাস করতে পারতেন এমন সিরিয়াসভাবে পড়োশোনা করেছেন। এর মধ্যে একজন বলেন, আপা, আমার কথা বাদ দেন. আবিরের মতো ছেলে পাস করতে পারে নাই, এটা ভাবতেই অবাক লাগে?
আবির কে?
গতবারের আগের বার এখানে পরীক্ষা দিতে এসে এক্সিডেন্ট করেছিল। কয়েকমাস ভুগে মারা গেছে। ছেলেটা খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিল। এই এক্সিডেন্টের কথা ট্রাকচালক সমিতির নেতারা গত বছর বলেছিলেন।
চলবে…