॥ দশ॥
আবির তার বোনকে পড়াতে চায়, শিক্ষিত করে তুলতে চায় কিন্তু সে নিজে বিয়ে করতে চায় অশিক্ষিত ইভাকে। এ বিষয়টা মা তাকে বুঝিয়ে বলার পরে আবির নিজের ভেতর শামুকের মতো গুঁটিয়ে যায়। এর পর থেকে জীবনে আর কোনো দিন মনের কথা মায়ের কাছে প্রকাশ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে।
কয়েকদিন ধরে আবিরের কাছে বিষয়টা বিশাল আকাশজুড়ে বিরাজ করে। একটা সময় সে বাস্তবতা অনুভব করে। এখনই যদি সে বিয়ে করে বসে তাহলে মোকসেদা আর মোরশেদার কী হবে? আগে মোকসেদার অন্তত বিয়ে হোক। তারপরে না হয় আবির বিয়ে করবে। সেদিনই আবির মোকসেদাকে সেলাই মেশিন কিনে দেওয়ার বিষয়টি প্রথম ভাবে।
কয়েকদিন পর্যন্ত ইভার বুকের স্মৃতি তার চোখ জুড়ে, মন জুড়ে সারা দেহ জুড়ে থাকে। আবির অনুভব করে মানুষের বুক অন্য বুকের সংস্পর্শ চায়। শৈশবে সে মায়ের বা বাবার বুকে মিশতে চায়। কৈশোরে বন্ধু-বান্ধবীর। তারুণ্যে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের বুকে মিশে থাকতে চায়। এর পরে চায় সন্তানের বুকে জড়াতে। যখন একঘেয়েমি চলে আসে, যখন সন্তান বড় হয়ে যায় তখন অপেক্ষায় থাকে নাতি-নাতনীকে বুকে জড়িয়ে ধরার।
কেউ কেউ চার প্রজন্ম পর্যন্ত বুকের আশা পূরণ করতে পারে। তার পরে মাটির বুকে মিশে যেতে হয়।
ইভাকে মায়ের প্রত্যাখ্যানের কারণগুলো নিয়ে আবির ভাবতে থাকে। ভেবে সে কোনো আগামাথা পায় না। এখানকার মানুষেরা তাদের চৌরা বলে। তার মাকে চৌরা মাতারি বলে। শুধু যে বলে তাই না, নানাভাবে হেয় করার চেষ্টা করে। বরিশালের লোকদেরও ছোট চোখে দেখে। তাদের বরিশাইল্লা বলে। সেদিনই আবির একটা ঘটনা দেখতে পায়। মুক্তারপুর বাজারে দুটি কিশোর ছেলে ঝগড়া করছিল। একজন অন্যজনকে ঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে। মার খাওয়া ছেলেটা অপেক্ষাকৃত দুর্বল। কেউ কাছে গিয়ে ধরে নাই। একজন দৌড়ে গিয়ে বলে, এই ব্যাটারা রাস্তাঘাটে মারামারি শুরু করলি ক্যান? দুর্বল ছেলেটি তখন বলে, ও মোরে মারলে কা?
ভাষা শুনেই বরিশালের ছেলে দেখে লোকটা সরে আসে। দুর শালাশ্শালারা, বরিশাইল্লা শালারা। দেশে গিয়া কাইজ্জা কর গিয়া।
রক্তাক্ত ছেলেটা অসহায়ভাবে ঘুষি ফিরিয়ে দিতে দিতে চিৎকার করতে থাকে। কেউ এগিয়ে যায় না। আবির গিয়ে থামায়। সে ভাবে, আজ যদি স্থানীয় দুটি ছেলে ঝগড়া করতো তখন যে কেউ গিয়ে মিটমাট করে দিতো।
বরিশালের লোকদের কি মানুষ মনে করে না? চৌরাদের কি মানুষ মনে করে না? রংপুরের, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামের মানুষদের বলে মফিজ্জা। তাদেরও ছোট চোখে দেখে। সেই দোষ তো আবির নিজের মায়ের মধ্যেও দেখতে পেল। না হলে মা কেন ইভার ব্যাপারে কিছু না জেনে, না শুনে শুধু বরিশালের মেয়ে বলেই সরাসরি প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করলো? যদি মা বলতেন, তুই শিক্ষিত মাইয়া বিয়া করিস, তাইলে একটা অজুহাত অন্তত দেখা যেতো। কিন্তু এভাবে মানুষকে ছোট ভাবা তার উচিত হয় নাই।
ইভা সুস্থ হয়ে ডিউটিতে আসে চার দিন পরে। আবির ডিউটিতে যাওয়ার পরে দেখা হওয়ার পরেই ইভা এসে একটা শপিংব্যাগ আবিরের হাতে দিয়ে বলে, এইডা দিলাম, বাড়িতে গিয়া খুলবেন।
আবির হাতে টিপে বুঝতে পারে ভেতরে কাপড় আছে। সে নিতে চায় না। কিন্তু সে না করতেই ইভার সুন্দর মুখটা কালো হয়ে যায়। এই কালো মুখ দেখা অসহ্য যন্ত্রণার বলে মনে হয় আবিরের কাছে।
রাতে ইভার উপহারের ব্যাগটা খুলে দেখে ভেতরে একটা শার্ট পিস আর একটা প্যান্ট পিস। ওভারটাইমের টাকা দিয়ে ইভা এগুলো কিনে উপহার দিয়েছে। আবির এই উপহার রাখবে কেমন করে? এই উপহার তো শুধু উপহার না, গরিবের উপহারে কি অঙ্গীকার থাকে না? আবির তো তাকে ভালোবাসার অঙ্গীকারই করতে পারে না। অথচ ইভা অঙ্গীকার চায়। আসলে গত চার দিনে আবিরের ভেতরটাও অনেক বদলে গেছে।
উপহারটা রাখা যেমন কঠিন, ফিরিয়ে দেওয়া আরো কঠিন। আবির ঘরে ট্রাঙ্কের ভেতর ভাঁজ করে রেখে দেয়।
বন্যার সময় আবিরের এক খালা বেড়াতে এসেছিলো। আসলে বেড়াতে আসার কথা বললে ভুল হবে, তিনি আবিরদের খোঁজ-খবর নিতে আসেন। শাহেদা খালা আবিরের একমাত্র আপন খালা। থাকেন ঢাকার মিরপুরে। মিরপুর উঁচু জায়গা, কিন্তু ঢাকার নিচু অঞ্চল দিয়ে আসার সময় পানির স্রােত দেখে এসেছেন। তিনি আবিরদের ঘরের অবস্থা দেখে অবাক হলেও নিরুপায় অবস্থা বুঝতে পারেন। তিনি মোরশেদাকে সাথে করে ঢাকা নিয়ে যান। এর কয়েকদিন পরে আবিরের ছোট কাকা শাহজাহান মালয়েশিয়া থেকে দেশে এসে নারায়ণগঞ্জে মেজ ভাই শাহ কামালের বাসায় ওঠেন। তিনি আবিরদের খোঁজ নিতে আসেন বন্যার শেষের দিকে। তখন ঘর থেকে পানি নেমে গেছে, উঠানের কাদা আছে, তবে শুকিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় সামান্য পানি আছে।
কাঁচাভিটির ঘর, অনেকদিন ঘরে পানি থাকায় মাটি নরম হয়ে গলে গেছে। এখন উঠানের এক কোণে গর্ত করে মাটি তুলে ঘরের ভাঙ্গা ভিটি আর পিড়া মেরামত করছেন জায়দা, তাকে সাহায্য করছে মোকসেদা। বাড়িওয়ালা এই দৃশ্য দেখে খুশিই হয়েছেন। তিনিই গর্ত করে মাটি তোলার জায়গা দেখিয়েছিলেন। এবার তিনি বলেন, আবিরের মা গো, কী কমু, চল্লিশ বছর দইরা ঘর ভাড়া দেই, কত্ত দেশের কত রকমের ভাড়াইট্টা দেখলাম। বিদেশি ভাড়াইট্টা আমার ভালা লাগে না ক্যান জানো? এই যে বানের পানিতে ভিটির মাটি ক্ষয়া গেছে, হাতের কাম কইরা এট্ট ঠিকঠাক কইরা নিলে কি হাত ক্ষয় হইয়া যাইবো? মাগিরা এইটুকু কামও নিজ হাতে করবো না। সব রেডি কইরা দিলে গরে থাকবো, নাইলে থাকবো না।
জায়দা কাদাভরা হাত দিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে কাজ করতে থাকেন। বাড়িওয়ালা বলে যান, জানো বিদেশি মর্দা শালারাও খারাপ, ঘরের আড়া বুঝলা, শক্ত কাঠের আড়া কাইট্টা, পুইড়া খাইয়া থুইয়া গেছে। এহন আমার অরিশাইল্লা-বরিশাইল্লা দেকতে মোনে চায় না। বুঝলা?
এসময় আবিরদের শাহজাহান কাকা উঠানে এসে দাঁড়ায়। মোকসেদা দেখে জিজ্ঞাসা করে, ‘কাকা কবে আইছেন?
শাহজাহান ঘরে যাওয়ার মতো অবস্থা নাই দেখে উঠানে দাঁড়িয়েই কথা বলে। গত শুক্রবারে আইছি। আইজ চাইরদিন। তোরা কেমন আছোত? ভাবি কেমন আছেন?
জায়দা প্রথমে চুপ করে থাকেন। পরে বলেন, কেমুন আছি দেখতেই তো পাইতাছেন।
হ। হেইডা ঠিক। এত বড় বন্যা গেল। মালয়শিয়া বইয়া তো সব খবর পাইতাম না, শুদু শুনতাম সারা দেশ ভাইসা যাইতাছে। তয় বাড়িঘরের কী অবস্থা?
আমাগো আবার বাড়িঘর কই? গাঙে লইয়া গেছে। এহন এই দেশে ভাড়াইট্টা থাহি।
ভাদ্র মাসে ইলিশ মাছ মাইর দেয়। একজোড়া বড় ইলিশ মাছ এনেছিল শাহজাহান। সেগুলো কেটে-কুটে রান্না করে দেবরকে খাইয়ে দেন জায়দা। যাওয়ার সময় শাহজাহান ভাবীতে পাঁচশো টাকার একটা নোট দিয়ে যান। সে টাকাটা মোকসেদা ব্যাঙ্কে রাখার পক্ষে।
আবিরেরা আর কোনোদিন গ্রামে যায় নাই। এটা নিয়ে অনেক কথা হয়। সেসব কথা উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে এখানেও আসে। দুইটি ইলেকশন গেছে। তারা ভোট দিতে গ্রামে যায় নাই। একটি জাতীয় নির্বাচন, একটি মেম্বর-চেয়ারম্যানের ইলেকশন। অনেকে এখানে এসে ভোট চেয়ে গেছে। জায়দা চেয়েছিলেন গ্রামে গিয়ে ভোট দিয়ে আসবেন। কিন্তু আবির নিষেধ করেছে।
মা, তুমি কারে ভোট দিতে যাইবা? যারা আমার আব্বারে খুন করছে তাগো? যারা কোনোদিন আব্বার হত্যার বিচার করার কথা কইতে আসে না, শুধু নিজেগো স্বার্থে ভোট চাইতে আসে তাগো ভোট দিতে যাইবা? কোনো দরকার নাই। তোমারে কইলাম, তুমি যাইবা না।
জায়দাকে ভোট দিতে মোকসেদাও নিষেধ করেছে। সে বলেছে, মা, যেই গেরাম থিকা আমরা জান লইয়া পলাইয়া আইছি, সেই গেরামে তুমি ভোট দিতে যাইবা ক্যান? সন্তানদের দিকে চেয়ে জায়দা ভোট দিতে যান নাই। তবে ছোট মানুষ আজিম বলেছিল, মা, আমি ভোট দিতে দেখমু।
ইলেকশনের দিন মিল-ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকে না যদিও, নাইট ডিউটি থাকায় আবির তার ছোট ভাই আজিমকে নিয়ে মুক্তারপুর স্কুল কেন্দ্র, জুনিয়ার স্কুল কেন্দ্র, মিরেরসরাই মাদরাসা কেন্দ্র, নয়াগাঁও স্কুল কেন্দ্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। রাতে ডিউটিতে যাওয়ার আগে সে ফলাফল জেনেই গিয়েছে। সে যেন এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। সে এখানকার নির্বাচনের উত্তাপ অনুভব করে। স্থানীয় প্রার্থীদের সবাইকে চিনে না, সবার পরিচয়, বাপ-দাদা ও গোষ্ঠীর খবর জানে না। তবু খেলার মাঠের দর্শকের মতো কিছু সময়ের মধ্যে সে কোনো একটা পক্ষে চলে গেছে।
আজিম মাঝে মাঝে গ্রামে বেড়াতে যেতে চায়, কিন্তু সে যাবে কার সাথে? আবির বোঝে এই ভাড়াবাসায় কয়েক বছর ধরে থাকতে থাকতে সবার মধ্যেই এক ঘেয়েমি চলে এসেছে। এ কারণে সে সময় পেলেই আজিম আর মোরশেদাকে নিয়ে যেখানে মনে চায় বেড়াতে চলে যায়। একদিন সে তার ফ্যাক্টরিতে তার ডিউটি তার মেশিনের অন্য শিফটের অপারেটর সুজনকে তার বদলি ডিউটি করতে দিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢাকা বেড়াতে যায়। কারো বাসার উদ্দেশে যায় নাই কিন্তু চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখার পরে মিরপুরে ছোটখালার বাসায় বেড়াতে যায়। এত কাছে এসে না গেলে খালা বেজার হবেন ভেবে গিয়েছেন। খালা ও খালু খুব খুশি হয়েছেন। এরপরে আবির কয়েকবার আজিম আর মোরশেদাকে নিয়ে ঢাকার বাণিজ্যমেলায় ঘুরতে গেছে। বইমেলায় বেড়াতে গেছে। জাতীয় জাদুঘর, সদরঘাট, আহসান মঞ্জিলসহ ঢাকার অনেক জায়গা ঘুরেছে। নিউ মার্কেট, চাঁদনি চক, গাউসিয়া, মৌচাক মার্কেটও ঘুরেছে। মাঝে মাঝে সময় পেলে এমনিতেই বেরিয়ে পড়ে আজিমকে সাথে নিয়ে। মুক্তারপুর থেকে টেম্পোতে উঠে দিঘিরপাড়ে পদ্মা দেখাতে নিয়ে যায়। পদ্মায় নতুন চর পড়েছে, সেখানে হাঁটতে যায়। মুন্সীগঞ্জ শহরের স্টেডিয়ামে যে কোনো অনুষ্ঠান দেখাতে নিয়ে যায়। গানের অনুষ্ঠান, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবেসের প্যারেড, ব্যান্ড শো, নাটক হলে দেখাতে নেয়। মাঝে মাঝে মোরশেদাকেও নেয়।
একদিন আজিম আর মোরশেদাকে সাথে নিয়ে মুন্সীগঞ্জ থেকে লঞ্চে উঠে কাঠপট্টি, আবদুল্লাহপুর, বেতকা হয়ে তালতলা যায়। তালতলা বাজার থেকে মিষ্টি খেয়ে আরেক লঞ্চে ফিরে আসে। আরেকদিন কাঠপট্টি গিয়ে সেখান থেকে লঞ্চে উঠে আবদুল্লাহপুর, বেতকা, তালতলা, ঘুরে সিরাজদিখান যায়। আবার একদিন একইভাবে বালিগাঁওয়ের লঞ্চে উঠে শিলিমপুর, সুবচনী হয়ে বালিগাঁও যায়। এভাবে মুন্সীগঞ্জ জেলার অনেক জায়গা ঘোরা হয়, দেখা হয়।
ঘুরতে ঘুরতে আবির দেখে মুন্সীগঞ্জের অন্য এলাকার সাথে তাদের চর অঞ্চলের একটি প্রধান পার্থক্য আছে। চর অঞ্চলে ফসলের জমি বেশি, গাছপালা, ভিটা এবং পরিত্যক্ত জায়গা একেবারে কম। নাই বললেই চলে। কিন্তু মুন্সীগঞ্জের অন্য সব এলাকায় প্রচুর গাছপালা, ঘন সবুজ। আর সেখানে নানা রকম পশুপাখি দেখা যায়। নানান রকম পাখির ডাক শোনা যায়। শিয়াল, বাড়াল, বাঘডাশা, গুঁইসাপ, ভোঁদরসহ কত প্রাণী এখানে দেখা যায়, যা চর অঞ্চলে দেখা যায় না। এখানে আসার পরে নানা রকম গাছ, নানা রকম ফুল, ফল এবং পাখি চিনতে পারে, এসব তাদের অঞ্চলে নাই। তার কাছে সবই ভালো লাগে। এ কারণেই সে বেড়াতে ভালোবাসে। একদিন তাদের শিফটের সুপারভাইজার নূরুল আমিনের বিয়ের দাওয়াত পায়। টঙ্গিবাড়ির ব্রাহ্মণভিটায় বিয়ে খেতে যায়। তাদের শিফটের তিনজন একত্রে যায়। গ্রামটি দেখে তার খুব ভালো লাগে। তখন ছিল বৈশাখ মাস। প্রচুর আম গাছ সেখানে। গাছে গাছে সবুজ আম ঝুলছিলো। কন্যাদের বাড়িতে বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিলো, সেটি পাশের একটি গ্রাম। সেখানেও আবিরের ভালো লাগে। বড় বড় দিঘি, স্বচ্ছ পানি, শীতল ছায়াঘেরা রাস্তা, হাঁটতেও ভালো লাগে।
চর অঞ্চল আর মূলভূমির পার্থক্য থেকে আবির এই সিদ্ধান্তে আসে, এইসব এলাকায় ফসলের জমি কম। কিন্তু চর অঞ্চলের মানুষেরা জমি খালি রাখে না। তাই সেখানে ফসল হয় বেশি। আর সেখানে গাছপালা কম বলে মানুষের গায়ের রঙও বেশি কালো। এই এলাকার কালো মানুষের চেয়ে মেঘনার তীরের কালো মানুষেরা বেশি কালো। এখানে প্রচুর সুন্দর মানুষ আছে। অনেক মেয়ে দেখতে নায়িকাদের মতো। চর অঞ্চলের সুন্দর মেয়েদের গালে মেছতা পড়ে, যা এদিকের মেয়েদের গায়ে দেখা যায় না।
এই অঞ্চলের মানুষের চেহারা বিচিত্র। কিন্তু চর অঞ্চলের মানুষের চেহারা মাত্র কয়েক ধরনের। মুক্তারপুর এলাকার অনেকেই চরের মানুষদের দেখামাত্র চিনতে পারে। বিষয়টা নিয়ে আবির অনেক ভেবেছে। কেমন করে তা সম্ভব? এমন কী লক্ষণ আছে যা দেখে সহজে চেনা যায়। পরে সে লক্ষ্য করেছে।
চর অঞ্চলের মহিলাদের কথা বললেই দেখা যায় পাঁচ রকমের। এক ধরনের মহিলা বা নারী দেখা যায় যাদের গায়ের রঙ ফরসা, কিন্তু নাক চ্যাপ্টা। নাকের উপরের দিকে, কপালের নিচের দিকে একেবারে চ্যাপ্টা। যেন হাতি পাড়া দিয়েছে। আরেক ধরনের দেখা যায় নাক পাতলা, চ্যাপ্টা এবং বোঁচা কিন্তু নাকের আগা চিকন ও চোখা। আরেক ধরনের নারী দেখা যায় যাদের চোখ নীলচে বা বিড়ালের মতো- ক্যাটস আই। আরেক ধরনের দেখা যায়, তাদের নাক মোটা। বেশ মোটা। আর একেবারে ঘন কালো রঙের নারীরা তো আছেই।
এই বৈচিত্র্যের ব্যাপারে আবিরের নিজের নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। যাদের গায়ের রঙ কালো তারা আদিম অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর। যাদের নাকের উপরের দিকটা চ্যাপ্টা তারা মূলত ত্রিপুরা উপজাতির বংশজাত। এই চর অঞ্চল নাকি ব্রিটিশ আমলেও কুমিল্লা জেলার অংশ ছিল। আর কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ। ত্রিপুরা রাজ্য ছিল ত্রিপুরা উপজাতির দেশ। আর যাদের চোখ নীলচে-সবুজ বা ক্যাটস আই তারা হয়তো পর্তুগিজদের রক্তবাহী উত্তরপ্রজন্ম। ড. অতুল সুরের এক বইয়ে সে পড়েছিল এ বিষয়টা। অতুল সুর জানিয়েছেন, হুগলী এবং মুন্সীগঞ্জের ফিরিঙ্গি বাজারে এক সময় পর্তুগিজদের বসতি ছিল। মোগল বাদশা শাহজাহান এদেরকে এসব স্থানে বসতি করে দিয়েছিলেন। সেখানে এখনো নাকি নীল চোখের মানুষ দেখা যায়। এরা পর্তুগিজ বংশের লোক। আবির ফিরিঙ্গি বাজারে অনেকবার গিয়েছে। রিকাবি বাজার গেলে তো ফিরিঙ্গি বাজারের ওপর দিয়েই যায়। সেখানকার অনেকের সাথে পরিচয় আছে, কথা বলে কারো চোখ নীল দেখে নাই। কেউ সেখানে এমন আছে বলে খবরও পায় নাই।
বরং আবিরদের চর অঞ্চলের অনেকের চোখ সাক্ষ্য দেয় এখানে পর্তুগিজদের বংশধারা প্রবহমান আছে। সন্দ্বীপ যখন পর্তুগিজদের ঘাঁটি ছিলো তখন তারা মেঘনা নদী বেয়ে পাতলা ডাকাইত্তা নৌকা নিয়া আসতো, ঢাকামুখী সব নৌকা, জাহাজ লুট করতো। বর্ষাকালে খালের ভিতর দিয়া মুন্সীগঞ্জের এইসব গ্রামের ভিতর ঢুকতো। যুবক ছেলে বা যুবতী নারীদের ধরে মুখ চেপে পিছমোড়া করে হাতের তালু ছিদ্র করে বেতের আতি দিয়া বেঁধে নৌকার পাটাতনের নিচে ফেলে রাখতো। তার পরে চিটাগাং, আঙ্গারখালি ও সন্দ্বীপে নিয়া বিদেশি জাহাজে দাস হিসাবে বিক্রি করে দিতো। অনেক সময় ধরে নিয়ে যেতে না পারলে, এলাকার লোকজন বাধা দিলে গুলি করে মেরে পানিতে ফেলে দিতো।
এই পর্তুগিজ আর আর আরাকানি মগদের হাত থেকে মোগল রাজধানী ঢাকা রক্ষা করার জন্যই মুন্সীগঞ্জ শহরের জন্ম হয়। প্রথমে এখানে কিল্লা গড়ে তোলা হয়। সেখানে বাস করতো কয়েক হাজার সৈন্য। তাদের জন্য প্রয়োজন খাদ্যসম্ভার। এর পরে গড়ে ওঠে বাজার। সেখান থেকে গঞ্জ। সেই গঞ্জই আজকে টিকে আছে কয়েক শতাব্দী ধরে। দুর্গটি তখন নদীর পারে গড়ে তোলা হয়েছিল। নদী তখন ছিল উত্তর-দক্ষিণে। প্রথমে দুর্গের সামনের অংশে সম্ভবত চর পড়েছে। এর পরে চর বাড়তে বাড়তে এখন আবিরদের গ্রাম পর্যন্ত কয়েক মাইল প্রশস্ত এই চর। এখানে আছে সদর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন। আর অনেক গ্রাম।
পুরুষদেরও এমন চার-পাঁচ রকমের চেহারার দেখা যায়।
চলবে…
প্রাচীন স্রোতের কণা-৯॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ