৫মপর্বের পর:
বুটের শব্দগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসে। ওরা মেয়েটাকে হয়তো নিয়ে গেছে। কী ঘটবে আসলে তার ভাগ্যে! আমি আবার নড়াচড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু হাতের বাঁধনটা যেন আরও এঁটে বসে আছে। অনেকক্ষণ ধরে এক অবস্থায় বসে থাকার ফলে পিঠেও ব্যথা করছে। মাঝে-মাঝেই পুরুষ কণ্ঠের গোঙানিটা শোনা যায়। এবার কার পালা, ওর নাকি আমার? এভাবে কতক্ষণ চলে যায়, আমি জানি না। নাকি সময় স্থির হয়ে গেছে। হঠাৎ আবার ঠকঠক বুটের আওয়াজ পাওয়া যায়। ওয়েল প্রফেসর, আশা করি নারী সঙ্গীটির জন্য আপনার মন খারাপ হচ্ছে না। না কি নারীসঙ্গ খুবই পছন্দ আপনার, হা হা! স্যরি, জাস্ট কিডিং।
মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো?
ওর গন্তব্যে। তার কাছ থেকে আমাদের কিছু জানার আছে। তারপর যা ঘটার তাই ঘটবে। ওর জন্য আমরা খানিকটা এন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থা রেখেছি।
তোমরা এভাবে স্বেচ্ছাচার করতে পারো না। সব কিছুর একটা সীমা আছে। সীমা অতিক্রমের ফল কিন্তু ভালো হয় না। আর আমার চোখ ও হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হোক।
ভুল প্রফেসর, সব কিছুর সীমা নেই। আবার সীমা অতিক্রমেরও একটা নষ্ট আনন্দ আছে। ঠিক যেমন রাষ্ট্রের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে আপনারা যে আনন্দ পেয়েছেন। আর আপনার চোখের বাঁধন অবশ্যই খুলে দেওয়া হবে। কারণ মত প্রকাশের মতো দৃষ্টিও আপনার অধিকার। আর আপনার নারী সঙ্গীটির নগ্ন শরীরও বেশ উত্তেজনাপূর্ণ।
মানে কী বলতে চাইছো তোমরা?
মানে কিছু নয়। যতদূর ওই সেক্সি লেডিকে চিনি, তিনি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন না। তাই তাকে মেরে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তবে ওই যে বলেছিলাম, কিলিং ইজ অ্য আর্ট। ওর মৃত্যুর আগে ওকে দিয়েই আপনাদের খানিকটা এন্টারটেইন করতে চাই। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা আসছে না। লোকগুলোর হঠকারিতা, নির্মমতা দেখে ঠিক কী বলা উচিত, ভেবে পাচ্ছি না। মেয়েটি গর্ভবতী।
ঠিক ধরেছেন প্রফেসর। প্রতিটি মানুষই যতটা না প্রাণী, তার চেয়ে বেশি কাজের জিনিস। সুস্থ সবল আছেন, তবেই আপনি সমাজে বসবাসযাগ্য। শ্রম থাকলে শ্রম দিন, মেধা থাকলে মেধা, মনোরঞ্জন থাকলে মনোরঞ্জন, যৌনতা থাকলে যৌনতা। যখন আপনার কিছুই নেই, তখন আপনি একদলা মাংসপিণ্ড ছাড়া আসলে কিছুই নন। আর যেহেতু ওই মেয়েটি কোনো কাজে আসছে না, ও এখন তাই। হোক সে গর্ভবতী, যৌনতা তো এখনো ফুরিয়ে যায়নি। মানে কী বলতে চাইছো তোমরা?
মানে কিছুই নয়, আসলে ওকে গ্যাং রেপ করা হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনাআপনি ওর পেটের ভ্রূণটি বের হয়ে না আসে, হা হা…। ভাবুন একবার, ভ্রূণটি বের হয়ে এলে একটা অনাগত বিপ্লবের সফল সমাপ্তি হবে। আমাদের পোষা কুকুরগুলো এখন যৌন যন্ত্রণায় ছটফট করছে। এতক্ষণে হয়তো ঝাঁপিয়েও পড়েছে।
স্টপ, স্টপ ই্ট ইউ ব্লাডি বাসটার্ড।
না না, আপনাকে পুরা ঘটনাটারই লাইভ কমেন্ট্রি আমি দিচ্ছি। নাকি চোখে দেখতে চান? মেয়েটার ফুলে ওঠা পেট বাদ দিয়ে ওর ক্লেভেজ আর থাইটা কিন্তু অসাধারণ। কুকুরগুলোর কামড় বসাতে নিশ্চই দারুণ লাগছে, উফ। ওদের অর্গাজম শুনতে চান? আমি আবার চিৎকার করি। আর ওই কণ্ঠটা তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হেসে চলে। এদিকে ঘরের মধ্যে রাখা কোনো শব্দযন্ত্রে শোনা যায় নারী কণ্ঠের আর্তচিৎকার, গরগর শব্দ, গোঙানি। যেন অসুস্থ একটা নরকে বসে গেছে শয়তানের দরবার। আমি ছটফট করি, বাঁধা হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করি। কিন্তু তা দেখে যেন শয়তানের হাসির দমক বেড়ে যায়। এভাবে কতক্ষণ চলে জানি না। একসময় শব্দযন্ত্রের ওই নারকীয় দৌরাত্ম্য কমে আসে।
প্রফেসর, আপনাকে কতটুকু এন্টারটেইনমেন্ট দিতে পারলাম জানি না। তবে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিল না। যদিও আই লাইক ইওর স্পিরিট। আমি আগেই বলেছিলাম, রাষ্ট্রের অবাধ্যতার শাস্তিতো আপনাকে পেতেই হবে।
আমার শরীরে যেন কোনও চেতনা অবশিষ্ট নেই। মাথাটা পাথরের মতো ভারী। আমি হড়হড় করে বমি করে দিলাম। চেয়ারে বসে থাকায় বমির অধিকাংশটাই আমার বুক, পা লেপ্টে দিলো। বড় বড় করে আমি শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তবু যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘরময় তখন ছড়িয়ে আছে বমির ঝাঁঝালো গন্ধ।
ওয়েলকাম ব্যক মি. প্রফেসর। আশা করি সঙ্গীনিটির চিৎকার ভুলতে আপনার তেমন সময় লাগবে না। কারণ আপনার জন্য এই গণতান্ত্রিক মানবিক যন্ত্রণা এখনো বাকি আছে।
আমি মাথা নাড়ার চেষ্টা করলাম। প্রচণ্ড ব্যথায় মাথার ভেতরে যেন থেমে থেমে বোমা বিস্ফোরণ ঘটছে। বাঁধা হাতগুলোয় অনেকক্ষণ ধরে রক্ত চলাচল করতে না পেরে আঙুলগুলোও যেন অবশ হয়ে রয়েছে।
ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি, বাট এভরি হয়্যার হি ইজ ইন চেইন। কথাটা নিশ্চই আগে শুনেছেন মি. প্রফেসর। জ্যাঁ জ্যাক রুশো। কথা ঠিক-স্বাধীনতার জন্য এবং স্বাধীনভাবেই মানুষের জন্ম। কিন্তু মানুষ স্বাধীন নয়। সুতরাং কী করতে হবে? স্বাধীনতা অর্জন করো, গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটাও, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশ—হাবিজাবি আরও কত কি! হা হা, কিন্তু তারপরও কি পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া যায় মানুষকে? সে যে বড্ড বেয়াড়া, প্রকৃতিগতভাবেই নিচ,লোভী, স্বার্থপর। তাইতো ক্ষমতার কেন্দ্র আর বাইরে অংশের মধ্যে একটা কাঁটাতার দিতেই হয়। আপনি বা আপনার মতো যারা এই কাঁটাতার ডিঙানোর চেষ্টা করেন, সমাজের সুষ্ঠু পরিবেশের স্বার্থেই তাদের সরিয়ে দিতে হয়। মানুষের স্বাধীনতা যেখানে অপহৃত, নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, সেটা আর যাই হোক সমাজ হতে পারে না। ওটা তোমাদের সাজানো ডলস হাউজ।
আপনি যখন বুঝেই গেছেন, এই পৃথিবী ক্ষমতাবাজদের খেলনা পুতুলের বাক্স, তখন সেটা স্বীকার করে নিতে দোষ কোথায়? না কি ভাবছেন প্রাচীন যুগের মতো মানুষের মনে এখনো বিপ্লবের বীজে চারা গজাচ্ছে? জেনে রাখুন, এই পৃথিবীতে আর কোনোদিন বিপ্লব হবে না। ওটার বীজ নিয়ে যে ঘুরে বেড়াবে আপনাদের সন্তানেরা, সেটিও মেনুফ্যাকচার করব আমরা। কারণ বিপ্লবের আসল বীজ আজ বিলুপ্ত। তাইতো ওদের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে রয়েছে হাইব্রিড ডেমোক্রেসি, হাইব্রিড ফ্রিডম অব স্পিচ, হাইব্রিড সোভারেইনটি। সময়ের চাকা এখন উল্টোদিকে ঘুরছে মি. প্রফেসর।
আমি বিশ্বাস করি না। একদিন তোমাদের মতো শাসকরাই নিজ স্বার্থে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, মধ্যবিত্ততন্ত্র সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু মুক্তিকামী মানুষের সম্মিলিত বিপ্লব দুমড়ে-মুচড়ে পলিটি থেকে ডেমোক্রেসি এনেছে। ভবিষ্যতেও তোমাদের এই ছদ্ম গণতন্ত্রের মুখোশ উন্মোচিত হবে।
হা হা, দারুণ বলেছেন। সেই বিপ্লবের একটা ছোট্ট উদাহরণ তো আপনার চোখের সামনেই খতম করলাম। এবার আরেকটি বীজ ধ্বংসের পালা। আপনার চোখ বাঁধা, তাই দেখতে পাচ্ছেন না। আপনার পুরুষ সঙ্গীটির জ্ঞান ফিরে এসেছে। সত্যিই একটা অস্পষ্ট গোঙানি শোনা যাচ্ছে। ক্রমেই যেন তা একটু একটু করে বাড়ছে। ওকে নিয়ে কী করবে তোমরা?
হা হা, উত্তরটা তো আপনি জানেন। তবে ওই যে বলেছিলাম, খানিকটা এন্টারটেইনমেন্ট এখনো বাকি। যাই হোক আপনি এবার বলুন, ঠিক কেন কিছুদিন ধরে আপনি ক্রমাগত সরকারবিরোধী লেখা লিখে যাচ্ছেন? আমাদের ধারণা, আপনি বা আপনারা কোনো গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয়।
এবার আমি হাসলাম। নিশ্চই কণ্ঠস্বরের মানুষটি আমার দিকে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে। দেখেছেন, এতকিছুর পরও বিপ্লবের আশঙ্কা, ভয়, আপনাদের কিভাবে তাড়িয়ে বেড়ায়? সব কীজ চাইলেই উপড়ে নেওয়া যায় না। বেশ, আমি জানতাম অন্যদের মতো আপনার কাছ থেকেও কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। সেজন্যই আপনাদের ধরে আনা হয়েছে। আর আপনার ওই পুরুষ সঙ্গীটি কী করেছে জানেন? ওর বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৫০টি খুনের অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে কতগুলো শিশু আছে জানেন? সর্বশেষ আমাদের একটা স্কুলে হানা দিয়ে ওর দল নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১২টি শিশুকে হত্যা করেছে। কত মানুষ আহত হয়েছে জানতে চান? অবশ্য এর আগেও ওর দলের বিরুদ্ধে ডাকাতি, রাহাজানি, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জোর প্রমাণ রয়েছে। সেদিন স্কুল থেকেই ওকে আটকানো হয়েছে। ওর বাকি তিন সাগরেদ মারা গেছে। আর আমরা ওর পায়ে গুলি করেছি। গোঙানো কণ্ঠস্বরটা এবার কথা বলে ওঠে। উচ্ছ্বিষ্ট খাওয়া শুকরের পাল, সাহস থাকলে বুকে গুলি করতে।
হঠাৎ করেই আবার ধুপ, ধুপ আওয়াজ ভেসে এলো, সেইসঙ্গে পুরুষ কণ্ঠস্বরটির আর্তচিৎকার। যেন অন্ধ কোনো আক্রোশে কতগুলো মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে কারও ওপর। এভাবে মিনিট দুই চলে নরক গুলজার। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে কণ্ঠস্বরটা আবার সরব হয়: মি. প্রফেসর, আমরা ঠিক করেছি ওর ক্ষতস্থানটাতে একটা গরম লোহার শিক ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই অবশ্য ক্ষতটা পচতে শুরু করেছে। গরম লোহার শিক তাতে আরও খানিকটা আরাম যোগাবে। বিষয়টা বেশ উত্তেজনাকর হবে, তাই না?
চাপা গোঙানিটা তখনো বন্ধ হয়নি। কেউ একজন বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। আমি ঠিক কী বলব, বুঝতে পারছি না। এ কেমন অনুভুতি! তোমরা বদ্ধ উন্মাদ। ক্ষমতার নেশায় তোমরা পিশাচ হয়ে গেছো। ওই লোকটা যত বড় অপরাধীই হোক, ওর সঙ্গে এমন পাশবিক ব্যবহার তোমরা করতে পারো না। কী ভেবেছ তোমরা, যা খুশি তাই করবে, যেভাবে চালাচ্ছো সেভাবেই চলবে? মনে রেখো, এর জন্য জবাব তোমাদের দিতেই হবে।
হা হা, পূর্ণ বয়স্ক একজন মানুষের যখন শেষ উপায়টুকুও ফুরিয়ে যায়, তখন সে আপনারই মতোই এমন শিশুতোষ কথাবার্তা বলতে শুরু করে। কার কাছে জবাবদিহি করতে হবে? মানুষ না কি তথাকথিত ঈশ্বরের কাছে? হাহ, বেশ ফানি। সবচেয়ে মাইজার ক্যাপিটালিস্টেরও নাকি একসময় মনে উদার অনুশোচনা আসে। অবশ্য প্রবৃত্তি পরক্ষণেই সেই অনুশোচনাকে বদলে দেয় হারানোর ভয়ে। আর কট্টর কমিউনিস্টরাও নাকি চরম সংকটে কখনো কখনো বসে যান ঈশ্বরের আরাধনায়। ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমরা এর কোনোটিই নয়।
হঠাৎ কেউ তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠলো। যেন পশু জবাইয়ের পর তার শেষ চিৎকার ধ্বনিত হচ্ছে। জান্তব একটা নরক যেন ঘরের ভেতর এমাথা ওমাথা শব্দ হয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে। এর সঙ্গে পাল্লাদিয়ে হা হা শব্দে শয়তান হাসে। আমি মাথা নাড়ি, ঘাড় মোচড়াই, ঠোঁট কামড়ে রক্ত আনি, তবু যেন মুক্তি নেই। ওর গুলি খাওয়া ক্ষতস্থানে একটা লাল করে গরম করা মেটাল রড ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওহ, প্রফেসর যদি দৃশ্যটা একবার দেখতেন। সন অব অ্য বিচটা কেমন কাটা মাছর মতো তড়পাচ্ছে, হা হা। মার খেয়ে খানিক আগে একটা চোখ গলে গিয়েছিল। ওটার আর পায়ের রক্তে বেজন্মাটা স্নান সেরে নিচ্ছে। বন্ধ করো, প্লিজ বন্ধ করো। ওকে প্লিজ মেরে ফেলো।
হুম বন্ধ করার সময় চলে এসেছে। আপনার চোখটা খুলে দেব না কি প্রফেসর? দেখবেন ওটা কেমন রক্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে? বলেছিলাম না, আমরা অপরাধের যোগ্য বিচার করি। সে বিচার এমন দৃষ্টান্ত, যেন তা দেখে আর কেউ কোনো ষড়যন্ত্রের সাহস না করে। হঠাৎ কেউ একজন আমার সামনের টেবিলটাতে কিছু একটা আছড়ে ফেললো। সেই জান্তব কণ্ঠস্বরটা এবার কাছাকাছি হয়ে যেন আরও গোঙাচ্ছে, বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। কেউ একটা ভেজা হাত রাখলো আমার গায়।
প্রফেসর, শুয়োরের বাচ্চাটাকে আপনার সামনে নিয়ে এসেছি কেন বলতে পারেন? যেন আপনি ওর মরণটা খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারেন। মানুষকে মরতে দেখার মধ্যে আলাদা আনন্দ আছে। আমার হাতে একটা রিভলবার আছে। ওটার চেম্বারে এখন আছে ছয়টা গুলি। এরমধ্যে শুয়োরটার জন্য একটাই যথেষ্ট। ওর মাথাটা টেবিলে চেপে ধরে একেবারে ঠিক কাছ থেকে গুলিটা করতে হবে। যেন মগজটা ছিটকে বেরিয়ে যায় চারদিক, হা হা।
আহত জান্তব কণ্ঠস্বরটা খুব কাছ থেকে কথা বলে ওঠে: প্রফেসর, আমার সঙ্গীদের সঙ্গে যদি কোনাদিন দেখা হয়, তবে বলো, এর প্রতিশোধ নিতে। এই কুকুরগুলোর পরিবারের সবাইকে যেন এভাবেই মারা হয়। ওদের মারবার জন্যই ওদের কাছ থেকে কেনা অস্ত্র আর গোলাবারুদগুলো আগের জায়গাতেই আছে।
হঠাৎ খুব কাছ থেকে বিকট একটা গুলির শব্দে সমস্ত ঘর যেন কেঁপে উঠলো। আর থ্যাপ করে গরম কিছু একটা ছিটকে এসে লাগলো আমার মুখে-শরীরে। না, আমি আর কিছু ভাবতে চাই না। এখন আমার শরীরভর্তি রক্তঘাম ছাড়াও আর কী লেগে আছে, তা আমি ভাবতে চাই না। তবু গা ঘিনঘিন করে,রক্তের তীব্র একটা গন্ধ যেন অজগর সাপ হয়ে পেঁচিয়ে ধরে ক্রমশ। সাপটা তার বাঁধন শক্ত করতে থাকে। আমি আবার নিজের গায়েই হড়হড় করে বমি করি।
বিষয়টা আপনার এতটা খারাপ লাগবে বুঝতে পারিনি। তবে রিয়েলি আই অ্যাম এনজয়িং। মানুষকে আমরা কিট পতঙ্গের মতো মারতে শিখেছি প্রফেসর। মানুষেরই প্রয়োজনে, ক্ষমতার প্রয়োজনে। নয়তো শুনলেন না, ওই যে বললো, আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে যেন মারা হয়। ও তাহলে তুমিও মৃত্যুকে ভয় পাও পিশাচ। তুমি মনে করেছ, তোমার এই ভয়ের কথা আর কেউ জানে না? অনুশোচনা হয় না, লজ্জা করে না ক্ষমতার এই গুটি হয়ে বেঁচে থাকতে।
বেশ মজার একটা অ্যাঙ্গেল খুঁজে নিয়েছেন প্রফেসর। সত্যি বলতে কি, এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে এখন সে মানুষরাই সবচেয়ে স্বাধীন স্বতন্ত্র আর সুখী, যারা আপনাদের মতো এত যুক্তি-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না খুঁজে শুধু বেঁচে থাকার তাড়নাতেই বেঁচে থাকে। আমি মানে আমরা সেভাবেই তৈরি হয়েছি। ওই যে বলেছি, এভরিথিং ইজ হাইব্রিড। এমনকি প্রত্যেকটি ভ্রূণের জন্মও।
আমি অনেকটা নেশাগ্রস্তের মতোই মাথা দুলিয়ে হাসলাম। পাগলা কুকুরের মতো আমারও তখন মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। লুকোছাপার কৃত্রিম কৌশলটা বেশ সহজ সরল। পলকেই সত্য চকচক করে। হে কণ্ঠস্বর, আপনার কথায়ও কোথায় যেন বিদ্রোহ, অভিমান, দুঃখবোধ! হঠাৎই চোয়ালের ওপর একটা তীব্র আঘাতে আমি চেয়ার নিয়ে উল্টে পড়লাম। তবু শরীরে যেন এখন আর কোনো শোধ নেই। কেউ একজন আবার আমাকে চেয়ারসহ টেনে তুললো। ইউ ব্লাডি সোয়াইন, চোখের সামনে দুই জনকে মরতে দেখেও তাহলে শিক্ষা হয়নি!
হাহ, ভয় পেয়েছ? সত্য বলে ফেলেছি? তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য। আজ তুমি আমার কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিতে পারো। নৃশংসতার চূরান্ত রূপ দেখাতে পারো অন্যকে। তবু যেন বিপ্লবের বীজ কখনোই ধ্বংস না হয়। আজ এখানে তাকে ধ্বংস করলে কাল ওখানে তা আবার গজাবে। প্রফেসর আমি চেয়েছিলাম আরও কিছুক্ষণ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু সেই সুযোগ তুমি গ্রহণ করলে না। আমার রিভলবারটা ঠিক তোমার দুচোখের মাঝখানে তাক করা। আমি একটা শেষ অনুরোধ জানাতে পারি? আমার চোখ খুলে দেওয়া হোক। আমি তোমার মুখটা একবার দেখতে চাই। আমি বিশ্বাস করতে চাই, মানুষ জন্মগতভাবে নৃশংস নয়। পরিস্থিতি ও সমাজ তাকে নৃশংস হিসেবে গড়ে তোলে।
এরপর কেউ একজন আমার চোখের বাঁধন খুলে দিলো। আমি চোখদুটো তখনো মেলতে পারছি না। তীব্র আলো যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। তবু আলোর ওই সাদা পর্দা ভেদ করে আমি দেখার চেষ্টা করি। টেবিলের ওপারে বসে আছে এক উর্দিপরা তরুণ। তার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, তবু কী আশ্চর্য! তরুণের চোখ দু’টি যেন কিছু বলতে চায়! কেমন ভেজা ভেজা আর আদ্র সেই চোখ। ওর মুখে কেমন যেন প্রশান্ত কান্তি, আহা কী মাহাময়! অথচ আগ্নেয়াস্ত্রটার ট্রিগারে কেমন আলগোছে চাপ বাড়াচ্ছে ওর আঙুল!
- শেষ