ক্ষমতা, অক্ষমতা ও খুন হওয়ার গল্প
কী কারণ তোমার আমার কাছে আসার? কী এমন অপ্রাপ্তি কিংবা চাহিদা যার খোঁজে এসেছ? খুলে বলো।
না সাধুজি, আমার তেমন কোনো চাহিদা নেই, কেবল আপনার সঙ্গলাভই একমাত্র বাসনা।
কী লাভ তাতে? আমার সঙ্গলাভে এমন অনেকেরই যা ছিল পূর্বে তাও ছুটে গেছে, কেউ হয়েছে সর্বহারা, কারও এমন অক্ষমতা এসেছে যে, কোনোমতে হাত-পা ছুড়ে ধরতে চাইছে এখন যেনতেন কিছুকে।
কেবল আপনার চরণে আশ্রয় দিন আমাকে, কৃপাপাশে আবদ্ধ করলেই আমার মুক্তি, আর কিছু চাই না বাবা।
ফারহান, বহুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে করতে এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে পা দু’টো জড়িয়ে ধরে বসে আছে সাধুর। তার দিকে তাকিয়ে তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর আবারিও বলে উঠলেন, আমার কাছে ক্ষমতা বা শক্তিলাভের জন্য এসে থাকলে মনে রেখো তুমি ভুল করেছ, যদি তোমার নিজের ক্ষমতা ও শক্তি কোনো কাজেই না লাগে। তবে, তা হারানোর জন্য আসতে পারো। আমি মানুষের ক্ষমতার ব্যাপারি নই, অক্ষমতাও তৈরি করি না, আমি কেবল যার ক্ষমতা আছে, তা ভুলিয়ে দেই, যার অক্ষমতা তাকে ভিত গড়ে দেই।
ফারহান নওয়াজ, মাথা নিচু করে বসে আছে। অনেক সাধুসঙ্গ করেছে সে, ঘুরেছে নানান আশ্রম-ধাম-তীর্থ। নিজের ভেতর একটা শক্তির পরিচয় সে পেয়েছে। তা নিয়ে তার উচ্চাশা। লোকের অনেক কিছুই আগ বাড়িয়ে বলে দিতে পারে, ঠিক ভবিষ্যদ্বাণী নয় কিন্তু চোখের সামনে দেখতে পায় নিকটভবিষ্যতের ঘটনা যেন। এসব নিয়ে তাকে মানুষ নানান কথা বলে, সেও ব্যাপরটিকে নিজের ভেতর অতিপ্রাকৃত অস্তিত্বের নমুনা হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে। কিন্তু তার চাই শক্তি, ক্ষমতা, যা তাকে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। এই গ্রহণযোগ্যতার খোঁজেই অনেক ঘুরেছে সে, অবশেষে সাধুর কাছে এসে বসে আছে আজ। কিন্তু সাধু, মানুষকে পাঠ করার অন্তরতম গভীর সংবেদী চোখ নিয়ে তার আগেই যে বসে আছেন।
ফারহানকে নিয়ে সাধু একটুপর হাঁটতে লাগলেন আশ্রমের পেছনের বাগান ধরে। সেখানে একটা বেলগাছের ছায়ার নিচে বেঞ্চিতে বসলেন দু’জনে। ফারহানের জীবনকথা শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। কথা বলতে বলতে সূর্য ডুবে যাওয়ার উপক্রম। সন্ধ্যার আগমুহূর্তের ক্লান্ত হাওয়ায় খুব ধীরে কয়েকটি শুকনো বেলপাতা ঝরে পড়লো তার পায়ে। সাধু যেখানে বসেছিলেন ঠিক তার পাশে একটি কুচকুচে কালো গামলায় ভরা কাকচক্ষু জল, তার ভেতর কয়েকটি পদ্মফুলের কলি উঠি-উঠি করছে। হাত ডোবালেন সেখানে, সহসা বললেন ফারহানকে লক্ষ করে, তুমি পারবে ইচ্ছে করলেই এই কলিগুলিকে এইমুহূর্তে ফোটাতে?
ফারহান থতমত খেয়ে বললো, না না অসম্ভব!
তবে কেন তুমি মানুষের জীবনকলিতে লুকিয়ে থাকা মুহূর্তকে বলে দিচ্ছ, প্রস্ফুটিত করছ, সময়ের আগেই? যা অপ্রয়োজন ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
ফারহান অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো কালো কুচকুচে গামলার দিকে। সেখানে কাকচক্ষু জল, জলের ভেতর উঁকি দিচ্ছে পদ্মফুলের কলি, যার রঙ নিশ্চিত নয়, কাল নয়তো পরশু ফুটবে, কেউ হয়তো ছিঁড়ে নিয়ে যাবে, কোথায় কোন থালায় শোভা পাবে কিংবা কোনো নারীভক্তের খোঁপায়, জানা নেই।
তুমি কলির দিকে তাকাও, ভালো করে দেখো, যার ভেতর ভবিষ্যতগুলো লুকানো তার ভেতর থেকেই তা ঠিকরে বেরুবে, প্রকৃতিলব্ধ শক্তি ও সক্ষমতা নিয়ে। সময়ের একমুহূর্ত আগে বা পরে নয়। তুমি তোমার ভেতরের সেই শক্তির দিকে, সক্ষমতার দিকে তাকাও যা কৃত্রিম নয়, যা দিয়ে অন্যকে নয় তোমাকেই দেখতে পাবে তুমি। আমার কাছে থেকে কেবল অকৃত্রিম সহজ শক্তিকে ধারণ করতে চেষ্টা করো এবং ভুলে যাও মনের অপ্রয়োজনীয় ও বিষাক্ত ক্ষমতাকে। সক্ষমতা বা অক্ষমতা এসবের ধারেকাছে যেও না, কেবল প্রাণশক্তিকে ধারণ করো। নিজের সম্পর্কে নিজের জেনে নেওয়াই আত্মশক্তি, অন্যের সম্পর্কে জেনে নেওয়া আত্মভ্রম। ভ্রমে পড়ো না, বিভ্রমে থেকো না, যে শক্তি সম্পর্কে তোমার নিজেরই ধারণা নেই, তার প্রেমে পড়ো না, বরং খুন করো নিজেকে, নতুন করে জন্মানোর প্রত্যয়ে।
চলবে…