নিজ বাসভবনে ভিসি যেন এক সিংহপুরুষ। রুদ্ধদ্বার কক্ষে আমরা একজন একজন করে ১১ জন তার সামনে দাঁড়াই। সঙ্গে প্রক্টর আর প্রভোস্টরাও আছেন। সেখানে প্রথমবারের মতো নিজেরা জানতে পারি—আমরা কত খারাপ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় বসবাসরত ছাত্রীরা কত জঘন্য, নোংরা চরিত্রের অধিকারী! কী কী খারাপ কাজ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রীহল সন্ধ্যা ছয়টার বদলে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত খোলা রাখার পক্ষে আন্দোলন করে চলেছি আমরা! আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হবে। সারাদেশের আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন পড়তে না পারি, তার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু আমরা তখনো নির্বিকার, এত-এত ত্রাসের সামনে দাঁড়িয়েও অবিচল, ভিসির রুদ্রমূর্তির সামনেও ভাবলেশহীন। ততদিনে সারাদেশের সুশীল সমাজ জেনে গেছে আমাদের আন্দোলনের কথা সঙ্গে শিক্ষক-শিল্পী-সাহিত্যিক সমাজ এ আন্দোলনকে যুগোপোযোগী বলে মেনে নিয়েছে।
এরপর আমরা আবার মাঠে। কোনো ভয়-ভীতি আমাদের তখন আর পরাজিত করার শক্তি রাখে না। আমাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া তখন দুঃসাধ্য। অন্যদিকে প্রত্যেকের বাড়ি থেকে একের পর এক শাসন-বারণ চলছেই। বারবার সতর্ক করা হচ্ছে বাড়ি থেকে—যেন সবকিছু থেকে সরে থাকি। আরও কোনো ঝামেলা করেছি শুনলেই বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হবে। তখন আমরা ঠিক করলাম, অভিভাবকরা তাদের কাজ করুক। আমরা আমাদের কাজ করে যাব। সিন্ডিকেট মিটিং অ্যারেঞ্জ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে খুব প্রেসার ক্রিয়েট করা হলো নানাদিক থেকে। হলো না। সিনেট মিটিংয়ের তো প্রশ্নই ওঠে না।
প্রথমে সিন্ডিকেট, তারপর সিনেট এপ্রুপভ না করলে ১৯২২ সালের প্রকটোরিয়াল রুলস্ অ্যান্ড রেজুল্যাশনকে ১৯৯৫-৯৬ সালের উপযোগী করে পাস করা একেবারেই অসম্ভব। কারণ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করে সিনেট মিটিং কল করা যেনতেন কথা নয়। যারা এটা অ্যারেঞ্জ করবে, তারাই তখন আমাদের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা আবার নতুন ধারায় ঘুরে দাঁড়ালাম। শেষ চেষ্টা আমাদের। ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ে যদি নারীজীবন ও চরিত্রের ওপর এত-এত নোংরা কাদাই ছোড়া হয়, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ পদাধিকারী যদি মানুষকে মানুষ না ভেবে নারী হিসেবে ট্রিট করতে লজ্জাবোধ না করেন, তবে আমরা আমাদের কাজ করে যাবই। ভবিষ্যৎই বলবে—এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল। সময়ই সব ক্ষতের সঠিক নিয়ামক। এসব জঘন্য ক্ষত আমাদের বুকের ভেতর থেকে একদিন সারিয়ে তুলবেই সময়। এই আমাদের নিজেদের প্রতি সান্ত্বনা। আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন তো শেষ হতেই চলল। কোনো আইন পরিবর্তনের দরকার নেই আর আমাদের। কোনো বাক-বিতণ্ডা কিংবা চাপের দরকার নেই। আমরাই তৈরি করব নতুন প্রথা। শক্তিশালী হয়ে উঠবেই যা একদিন আইনের চেয়েও বেশি। আমরা শুরু করে দিলাম চর্চা। একসঙ্গে তিনটি হল—বেগম রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল আর বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীরা সন্ধ্যা ছয়টায় হলের গেটে ঘণ্টা বাজালেও কেউ ভেতরে প্রবেশ করে না।
গুটিকতেক মীরজাফর ছাত্রী ছাড়া আর সবাই আমরা যার যা-যা কাজ, সবই করি রাত নয়টা পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর যেদিন কোনোই জরুরি কাজ থাকে না, পরীক্ষাও থাকে না, পড়ার চাপও কম থাকে, সেদিন আমরা এমনিই এমনিই হল গেটের সামনেই খোলা মাঠে বসে-বসে সময় কাটাই। বন্ধু-বান্ধব মিলে গল্প করি। আবাহনী ক্লাবের একদল হকি খেলোয়াড়ের সঙ্গে তখন আমাদের হলের অন্য বান্ধবীর মাধ্যমে পরিচয়, তখন ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওরা প্রায়ই দল বেঁধে হলে আসে।
তবে আমি ওই আড্ডায় সময় কম দিতাম। কারণ আমার আসলে জায়গা ছিল তখন কবিতা আবৃত্তিতে। স্রোত আবৃত্তি সংসদের সঙ্গে। যে কয়দিন সময় পাই, তখন ওদের সঙ্গে গল্প গুজবে আমারও বন্ধুত্ব বেশ প্রগাঢ় হয়ে যায়। আরও যার যা-যা বন্ধুবান্ধব আছে, সবাই ইচ্ছা করেই সন্ধ্যা ছয়টার পর থেকে গল্পে আড্ডায় মেতে থাকি, ঠিক হল গেটের সামনে বসেই। এভাবেই বাতি নিভে আসতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের। শেষ পর্ব শেষ করি যখন, তখন আমি জীবনের দায়ে অলরেডি ছুটতে শুরু করে দিয়েছি।
ক’দিন পরই তো হল ছাড়তে হবে। ঢাকায় বড় ভাই থাকেন। তার ইচ্ছা আমি যেন তার বাড়িতেই উঠি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে। রাশিয়ার মস্কোয় অবস্থিত প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে সদ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আমার ভাই। এমএসএ দুর্দান্ত রেজাল্ট তার। পৃথিবীর ২২টি দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন। ফিরে এসেছেন দেশে। গর্বে আমার বুক ফুলে যায়। আমার প্রিয় বড় ভাই। যিনি আমাকে নিজ হাতে ধরে শিখিয়েছেন সাঁতার। শিখিয়েছেন পুকুরের গভীরে ঝাঁপ দিয়ে কিভাবে একবারেই কতদূর যাওয়া যায় কিংবা কী করে জলকে জয় করে নিতে হয়। যে ভাই আমায় তার প্রতিটি কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে বা প্রতিযোগিতায় নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে।
কতই বা বয়স তখন। সাত কি আট। ঝাঁকড়া চুলের শাসনে অবাধ্য আমি তখন লালমাইর ঘনচূড়ায় স্বপ্ন দেখি নতুন ঘর। পেয়ারা বনে গভীর অন্ধকারে খুঁজি সূর্যের সোনা রং। দূরের গ্রামে খুঁজি ছায়া-ছায়া ভালোবাসা। লজ্জাবতির লজ্জা ভেঙে দেই পাতা আলতো ছুঁয়ে। আর ছুটে বেড়াই গ্রাম থেকে গ্রামের সবুজে। ধানক্ষেতে। জমির আলে। বকের পাখায় আর রাতের অন্ধকারে দূরগ্রামের আলোর লহরে। সবুজ ধানক্ষেতে বিশাল একটা ঘর থেকে অনেক বড় একটা ধারায় প্রচুর পানি পড়তে থাকে। সারাটা ধানক্ষেত ভরে যায় সেই জলে।
আমি ঝুল বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে খুব স্বপ্ন দেখি—একদিন যাব ওই সাদা ফেনা ওঠা ব্যাপক জলরাশির কাছে। কুয়াশার ফিনফিনে চাদরে জড়িয়ে থাকে শীতের স্বপ্ন আমার। ভাই তখন মাকে বলতেন, ‘মা ওর চুলগুলো বেঁধে দিন। সঙ্গে নিয়ে যাই।’ আমি জানতামও না কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। ভাই নিয়ে চলছেন সেটিই বিশাল আনন্দ আমার। মা খুব পরিপাটি করে মাথায় রং-বেরংয়ের ফিতে দিয়ে বেশ টান করে চুল বাঁধতেন আমার। আমি ভাইয়ের হাত ধরে চলতাম ঝরনার বেগে। উদ্দাম উল্লাসে। চলবে…
মন্তব্য