॥পর্ব-৩২॥
এর মাঝে জন্ডিস বাঁধিয়ে বসে। মা-মরা অসহায় একটি ছেলে। বাবা ছেলের খবর নেন কী নেন না। ময়মনসিংহ শহরের ছোট বাজার এলাকার কোনো একটা জায়গায় তার বাড়ি। একদিন ওদিকেই কোথাও দাঁড়িয়ে আমাকে বলেছিল সে কথা। কিন্তু জানতে চাইলে দূর থেকে আঙুল নির্দেশ করেও দেখায়নি বাড়িটি সে আমাকে। বরং তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি পৌঁছে যাই কি না সঠিক ঠিকানায়, তা নিয়েও ছিল তার সতর্ক প্রহরা। আমার এমনই মনে হয়েছিল সেদিন। বাড়ির ঠিকানা জানানো তো দূরের কথা, ওই সুদূরস্থিত এমনকী কল্পনারহিত বাড়িটির মা-হারা একমাত্র ছেলেটি অসহায়, মারাত্মক জন্ডিসে আক্রান্ত, চোখ হলুদ হয়ে আছে, ডাক্তার দেখাচ্ছে কী দেখাচ্ছে না, জানি না। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি থেকে ফোন করে আমাকেই ওর বন্ধু তৌহিদ। ভাইজান তখন দেশের বাইরে গেছে কিছুদিনের জন্য। ভাইজানের বাসায়ই হয় তখন ওর আশ্রয়। আর আমি রোজ ক্লাস সেরে, বিডিআর তিন নম্বর গেইট থেকে রিকশায় রামপুরা যাই। ওর জন্য দরকারি রান্নাবান্না সেরে ওষুধ খাইয়ে রেখে গেট বন্ধ হওয়ার আগে পড়িমড়ি করে এসে হলে ঢুকি। ডাক্তারের হাজারটা ওষুধ নির্দেশ উপদেশ তত্ত্ব-তথ্য আর পথ্যের ব্যবস্থা করতে করতে আমি বাড়ির ছোট মেয়েটি যেন নিজের অজান্তেই একজন অভিভাবক হয়ে উঠি। হাত শূন্য হতে থাকে। মাস শেষ হতে অনেক বাকি। কী করে চলবো, জানি না বাকি পুরোটা মাস। কাউকে বলতে পারি না। অসহায় ছেলেটিকে ফেলে চলে যেতে পারি না। ডাক্তার অবশেষে খাবারের পথ্য হিসেবে দিলো ছোট মাছের ঝোল। আমি বাজার থেকে শিং মাছ কিনে আনলাম। জীবনে প্রথম পাশের বাড়ির মামির কাছ থেকে মাছ কোটা দেখে নিয়ে মাঝ কুটলাম। ঝোল রান্না করে দিয়ে এলাম। পরদিন আবার মুরগীর স্যুপ রান্না করলাম। জীবনের প্রথমবার। আমি বাড়ির ছোট মেয়ে। সবার আদরে কাজ চুরি করে করে বড় হয়েছি। সংসারের কাজে আমার কোনোদিনই আগ্রহ নেই। রান্না কুটাবাছা তো রীতিমতো বিরক্তিকর। সেই আমি প্রেমিকের জন্য রান্না করি। স্যুপে সম্ভবত লবণ কম হয়েছিল। এক চামচ মুখে তুলেই আমার মুখের ওপর ছুড়ে মারলো সেদিন স্যুপের বাটি। আমি কোনো কথা না বলে বের হয়ে এলাম। আর ওদিকে যেতে মন চাইলো না। সে সুস্থ হয়ে ময়মনসিংহ চলে গেলো। পাশের বাসার মামি যা নয় তাই বলে ভাইজানের মন আবারও নতুন করে বিষিয়ে তুললেন। কিছুদিন পরই আবার ঢাকা এলো। আমিও ভুলে গেলাম সব। মাঝখানে ভাইজানের সন্দেহ, টাকা পয়সার অনটন, তার আস্ফালন, অপমান—এসব নানা জটিলতা পাক খেতে খেতে দ্বিধান্বিত আমি, বিধ্বস্ত আমি। জীবনের গভীর বোধে অপরিপক্ব আমি অবশেষে সিদ্ধান্ত নেই বিয়ে করবো। তাতেই সব সমস্যার সমাধান হবে। দুজনেই এরকম ভাবতে থাকি। অবশেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই—ছুটিতে ময়মনসিংহ যাব। তারপর বন্ধুদের সহায়তায় বিয়ে।
যথারীতি সকাল সকাল স্নান সেরে বসে আছি। বুক দুরুদুরু। ভয় উত্তেজনা টেনশন। কয়েক কপি ছবি প্রিন্ট করে রাখা নিজের কাছে। এর বেশি কাজ নেই আমার। সকাল দশটা একগারোটায় আসার কথা তার। কোনো এক ছুঁতায় বের হয়ে যাব আমি। এরপর সোজা কাজি অফিসে। আমি অপেক্ষায় বসে আছি। দশটা বাজে। সাড়ে দশটা বেজে যায়। পৌনে দশটায় এসে পৌঁছায় আসিফ। যথারীতি তার ভুবন ভোলানো হাসি। আমার ঘরে বসে। হাসতে হাসতেই কথা শুরু করে, লঘু তার কথার চলন। বরাবরের মতো ঠাট্টার ছলে শুরু
—কী? শুনলাম বিয়ে করবা?
-আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি।
আসিফ, জাহাঙ্গীর, সেতু, রিপন, সজল—এরা ময়মনসিংহের বন্ধু আমার। অনুশীলন কোচিং সেন্টারে পড়ার সময় নানাভাবে ওদের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল আমার দারুণ আন্তরিকতা।পরবর্তীসময়ে ইকবাল ভাইরা যখন অনুশীলন কোচিং সেন্টারটা ওদের হাতে ছাড়েন, তখন আমি ওখানে যেতাম প্রায়ই। মাঝে-সাঝে দুই-একটা ক্লাসও নিয়েছি। ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবের কাছে ছিল কোরায়শী প্রাঙ্গণের অফিস। কোরায়শী প্রাঙ্গণ সজলের বাবা সামদানী কোরায়শীর প্রতিষ্ঠা করা, ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে বড় প্রেস। সজলের বড় ভাই কাজলদা ওটা দেখাশোনা করতেন। আমরাও মাঝে-সাঝে ওখানে যেতাম। আড্ডা হতো খুব। কখনো কোরায়শী প্রাঙ্গণ আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানেরও উপস্থাপনাও করেছি। চারণে কাজ করেছি। পরবর্তী সময়ে আসিফের সঙ্গে আমাদের পরিবারেরও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তার প্রশ্ন,
—আমি তোমাকে কিছু কথা বলবো আজ। যা ওর বন্ধু হিসেবে আমার বলা উচিত নয়। কিন্তু তোমার কথা ভেবে আমার মনে হলো তোমাকে আমার জানানো উচিত।
আমি উদ্বিগ্ন হই। আর কী আছে এমন! ওর চরিত্রের ক্রুরতা, মেজাজের লাগমহীন ঔদ্ধত্য অনিয়ন্ত্রিত ছোড়াছুড়ি আমার চেয়ে আর কে বেশি জানে? ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওর উদাসীনতা আমার চেয়ে কে বেশি সয়! আরও কিছু রয়েছে অজানা? আজ আর কী বলবে আসিফ আমাকে! চিন্তার জাল ছিন্ন হয় আসিফের প্রশ্নে,
—ওর মা বেঁচে আছেন। তুমি জানো?
আমি বিস্মিত চোখে তাকাই ওর দিকে। কয়েক সেকেন্ডে মুখে কোনো কথা সরে না। এত বড় ব্ল্যাকমেইল! ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। এ যাবত জেনে এসেছি তিনি নেই। মা হারা একটি বাউণ্ডুলে ছেলের হাহাকারের একটা সূক্ষ্ণ সূতোই কেবল আমাকে বারবার পিছে টেনে ধরেছে। ক্ষমা করতে বাধ্য করেছে তার বারবার উদ্ধত অহঙ্কারী বিধ্বংসী আচরণ। আর আজ এসব কী শুনছি? আসিফকে অবিশ্বাস করতে পারি না আমি। ও আবার বলতে শুরু করে,
—তিনি একজন সনাতন। ওর বাবাকে ছেড়ে আবার বিয়ে করেছেন। আলাদা সংসার করছেন। সে সংসারেও ওর আরও ভাইবোন রয়েছে।
আমি মাথা নিচু করে শুনে চলি আসিফের সব কথা। এরপরও ভয়ঙ্কর কিছু বাকি আছে ভাবিনি। আর তখনই কথাটা বলতে শুরু করে আসিফ,
-দেবী নামের একটি মেয়ের সঙ্গে ওর সব ধরনের সম্পর্ক রয়েছে।
আমি আরও নিশ্চুপ হয়ে যাই। মানুষের বিবেকহীন অমানবিক বোধ আর মিথ্যাচারের কাছে নত হতে হতে কোথায় পৌঁছেছি খুঁজতে শুরু করি। কোনো তল পাই না। আসিফ বোধ করি বুঝতে পারে সব। কথা বাড়ায় না। আমার বিস্মিত পূর্ণ উন্মীলিত নির্বাক জল ছলছল চোখের দিকে চেয়ে রয় কিছুক্ষণ। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এমন নয় যে, ও আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারে। আমার কান্নার জল ছুঁতে পারে। নাহলে হয়তো সেদিন ও আমার চোখ মুছে দিতো। তাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলে,
—এবার তুমি যা করবে ভেবে করো।
আর পেছনে ফেরে না। চলে যায়। খুব দ্রুত তার গতি। আমি বিশ্বাস করতে পারি না। গত তিন/চারটি বছরের বিসর্জন কিংবা বিতরণকে এই মুহূর্তে এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি আর কনসিডার করতে পারি না। বুঝতে পারি না কিছু তবু ইতিহাস ঘাঁটি। এ কি নিপীড়ন না কি নির্যাতন! এ কি শোষণ না কি শাসন! আক্রোশ না কি প্রতিশোধ! বিন্যাস না কি বিনাশ! সমাজতন্ত্রের এক দারুণ সৈনিক—যে কি না স্বপ্ন দেখে চলেছে শোষণহীন সমাজব্যবস্থার। সমাজের পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এতটাই সোচ্চার যে, বারবার নিজের প্রেমিকাকে অকারণে ‘বুর্জোয়া’ গাল দিতেও বাধেনি যার, তার এই মারাত্মক আ্গ্রাসন! এতটা স্বৈরশাসন নিজেরই প্রিয়ার প্রতি! সে গাইছে প্রতিনিয়ত দিনবদলের গান! সে বদলাবে সমাজকে পুঁজিবাদের কবল থেকে সাম্যবাদী সমাজে! ধন্ধ লাগে আমার। আর ওই অধঃপতিত জীবনের সঙ্গে আমারই যোগ! আমার চলাচলকে এভাবে কলঙ্কিত করে দিলো? আমি বিশ্বাস করতে পারি না। কবে যেন আমি তার ‘বান্ধবী’ নামে ‘দেবী’র নামও শুনেছিলাম তারই মুখে। এই মুহূর্তে আমার স্মরণে আসে। এও শুনেছিলাম ময়মনসিংহ শহরের কোথায় যেন দেবীর বাসা। পরদিন সকালেই আমি বের হয়ে যাই দেবীর বাড়ির উদ্দেশে। নাহ্, নতুন বাজারে আর দেবীরা থাকে না। ওখানকার লোকের দেওয়া ঠিকানা ধরে ধরে আমি অবশেষে বের করি দেবীর বাড়ি। আর কথাও হয় দেবীর সঙ্গে আমার। সে বলে,
—আপনি কে? আমাকে চিনলেন কী করে?
নিজের ছাত্রজীবনের পরিচয় দিয়ে তাকে বলি, তুমি তাকে চেনো?
—হ্যাঁ, চিনি।
ব্যাস ওই টুকুই। আমি আর দেবীর কাছে জানতে চাইতে পারিনি অন্য কিছু। আমার মুখে কথা সরেনি সেদিন আর। লজ্জা-সংকোচ আজীবনের রুচিবোধ আমাকে কিছুই প্রশ্ন করতে দেয়নি সেদিন। সব অপমান পেছনে ফেলে আমি ফিরে আসি। চলে যাই নদীর কাছে। মহাদেবের শরীর থেকে প্রবাহিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে যে ধারা, ছুটে যাই সে শীতল প্রবাহের কাছে। নিচে রেখে ব্রহ্মপুত্রকে শম্ভুগঞ্জ সেতুর ওপর উঠে দাঁড়াই আবার একা। মধ্যদুপুরে মাথার ওপর দারুণ সূর্য। আমি তপ্ত শুষ্ক নিঃশেষিত।একা। নিচে তাকাই। ক্লান্ত রো্দের আক্রোশে পরাক্রান্ত জলের দিকে তাকিয়ে থাকি।অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকি। কত কত যে ব্রহ্মপুত্র মরে যেতে থাকে। চোখের সামনে থেকে সরে যেতে থাকে সব জলের ধারা। মোহনা লক্ষ নয় তার। ওপারে গ্রামগুলো আবছা দেখা যায় হঠাৎ। তারপর ব্রহ্মপুত্রের জলও ক্রমশ ঘোলা হতে থাকে। চাঁদ ডুবে গেলে পর আমি সরে আসি বিপুল গাঢ় এক অন্ধকারে।যখন নদীর জলে ডুবে যেতে থাকে আমাদের প্রথম চুম্বনের প্রহরগুলো।
চলবে…