॥পর্ব-২৬॥
ঠিক এমনি একাকী হলজীবনে আমার প্রথম পরিচয় আর ঘনিষ্ঠতা শর্বরীর সঙ্গে। বরিশালের মেয়ে শর্বরী দাস। বাংলা ডিপা্টমেন্ট থেকে পরবর্তী সময়ে ও একসময় মাইগ্রেশন নিয়ে চলে যায়। ভর্তি হয় ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টে। তখন আমার ওর সঙ্গে সক্ষতা কেবল হলের ভেতরে। বিকেলের অবসরে। কখনো-সখনো ওর সঙ্গে হলের গেটের বাইরে বের হই। কখনো একটু মাঠেও বসি। বিডিআর তিন নম্বর গেটেও যাই এটা সেটা কিনতে। তারপর একে একে মনিরা রহমান রূপা লুবনা শরমিন মাহমুদা খানম রীতা রাহেলা বেগম ডেইজি সাবিহা মুন্নিসহ আরও অনেক অনেক বন্ধু হয়ে যায় হলের ভেতর। ওরা সবাই যখন ক্লাস সেরে কিংবা ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা দেয় কলাভবনে। তখন আমি হলে। নিজের কাজ সারি। পথের দিকে তাকাই। বিকেলে ছাদে বসি। একদিন কলাভবনে ক্লাস শেষে ওদের সঙ্গে আড্ডায় বসি। হঠাৎ দেখতে পাই স্রোত আবৃত্তি সংসদের কর্মশালার মাধ্যমে আবৃত্তিকার তৈরির বিজ্ঞাপন। কলা ভবনের দেয়ালে সাঁটানো। যার হাল ধরে আছেন তখনকার স্বনামধন্য…।
কেবল তখন কেন এখন অবধি নিজের নাম ধরে রেখেছেন যিনি দারুন মেধা আর কর্মের মাধ্যমে সেই মাহিদুল ইসলাম। আমি আর শর্বরী দু’জনেই ঠিক করি কর্মশালাতে যোগ দেব। হাতে যা পয়সা কড়ি ছিল সব খালি করে দু’জনে ভর্তি হয়ে যাই স্রোত আবৃত্তি সংসদে। তখন থেকেই একটু একটু করে ময়মনসিংহের নানা সংগঠনের সঙ্গে কবিতা নিয়ে কাজ শুরু। ডা. স্বপন একসময় ধরে বেধে নিয়ে গেলেন চারণে কবিতা পড়ার জন্য। খুব চেষ্টা করলেন কিছুদিন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফন্টে কাজ করাতে। তাছাড়া ময়মনসিংহে থাকতে মেঝোভাইয়ার সঙ্গে যেতাম উদীচীতে। সেখানেই শ্রী স্বপন সরকারের সঙ্গে পরিচয়। যিনি পরবর্তী সময়ে আমার গানের ওস্তাদ। শেখাতেন শাস্ত্রীয় আর নজরুল সঙ্গীত। সখ্য সোবহান স্যারের সঙ্গে। তিনি শেখাতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। সম্পর্কে তিনি ছিলেন শামীম আরা নিপার বোনের হাজব্যান্ড।
আর সবচেয়ে যে জ্ঞানতাপসের সঙ্গে পরিচয় হয় তার নাম যতীন সরকার। যতীন সরকার কার্ল মাকর্সে ওপর ক্লাস নিতেন উদীচীতে। সেই থেকে তার সঙ্গে সখ্য। আর ছিলেন সুমিতা নাহা। তখন ময়মনসিংহ শহরের বামদলের অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথিত যশা তুখোড় নেতা শ্রী আলোকময় নাহার স্ত্রী সুমিতা নাহা। পরবর্তী সময়ে যাকে পেয়েছি কলেজে বাংলার শিক্ষিকা হিসেবে। পড়াতেন নাটক। আজও যিনি আমার টাইমলাইনে নানা লেখা পড়েন খুব মনোযোগে। গুরুত্বপূর্ণ কমেন্টও করেন প্রয়োজনমতো। এ আমার এক জীবনের অনেক বড় পাওয়া। হারিয়েছি কেবল সুনন্দাদিকে। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন তিনি। কী তার রঙ, কী তার রূপ! বন্ধুরা, যারা বেশ কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করি, তারা খুব জানি নির্মলেন্দু গুণের নাম। তখন বয়স কতই বা। ১৬/১৭। সেই গুণের প্রিয় সখী ছিলেন আমাদের সুনন্দাদি। দুধে আলতা গায়ের রঙে উজ্জ্বল কপাল। সেখানে দারুণ এক লাল টিপ আর সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুরে ক্লাসে ঢুকতেন রোজ। কলেজ জীবনে বাংলার শিক্ষক। মূর্তিমান চোখের সামনে। পড়াচ্ছেন কবিতা। আর কী সে কবিতা পরানের ভেতরে পশে। তার মনোহর সৌন্দর্য দেখি দু’চোখ ভরে। কবিতার ক্লাসে। বন্ধুরা কানাকানি, ফিসফাস করি, এই, এই দেখেছিস। এই সেই সুনন্দাদি; নির্মলেন্দু গুণের প্রেমিকা।
আবৃত্তির প্রতি নেশা আর ভালোবাসা সেই ছোটবেলা থেকে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে নানা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে যেতাম। সেতো আগেই বলেছি। তখনো ভর্তি হইনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেঝো ভাইয়ের সঙ্গে এসেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন টেস্ট দিতে। আগের দিন আমি আর মেঝোভাই কার্জন হলে সিট প্ল্যানিং দেখে ঢুকলাম বই মেলায়। তখন টিএসসি থেকে শুরু করে বাংলা একাডেমি ছাড়িয়েও দোয়েল চত্বর অবধি বিশাল বিস্তৃত ছিল বই মেলার পরিসর। যদিও বাঙলা একাডেমির বাইরের অংশটায় বেশির ভাগই ছিল কবিতা আবৃত্তির ক্যাসেটের স্টল। তখন ছিল ক্যাসেটের যুগ। বিশাল বিশাল সাউন্ড সিস্টেমে বাজানো হতো নানা ক্যাসেটের কবিতার আবৃত্তি। একটা স্টল থেকে বাজছিল অসাধারণ কণ্ঠের আবৃত্তি,
অনুরাধা তুমি কোনদিন পপি ফুলের নাম শুনেছ? পপি ফুল।
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী আর ছোঁয়াচে জিনিষ
এখন আমার ঘরে সেই ফুলের নিকষ ঘ্রাণ
ঝুরঝুর ছন্দময়
ঘর অন্ধকার।
অথচ বাইরে পাখি ডাকছে বউ কথা কও বউ কথা কও
তাহলে কি শাশ্বত দিন এসেছে?
আমার বাড়ির সামনে বৃদ্ধ বটগাছটায়ও হাজারো পাখি বুঝি গাইছে বউ কথা কও।
বউ কথা কউ…
আবৃত্তিকারের নাম আগেই জানি। মাহিদুল ইসলাম। আমি তখন কিনে ফেললাম ‘অভিমানের খেয়া’। পরের দিন ক ইউনিটের পরীক্ষার হলে বসে মনে হলো আমি যদি সাইন্স নিয়ে পড়ি, তাহলে আমার আর আবৃত্তি কিংবা লেখালেখির সময় বের করা সম্ভব হবে না। প্র্যাকটিক্যালের ল্যাবে পড়ে পড়েই বিকেল সন্ধ্যে শেষ। আমি সাদা খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হই। আর মনে মনে ঠিক করি আটর্স ফ্যাকাল্টিই আমার শেষ আশ্রয়। যথারীতি সাইন্সের কোনো সাবজেক্টে চান্স না পাওয়ায় মায়ের কষ্ট পাওয়ার আর শেষ নেই। এত ভালো ছাত্রী তার মেয়েটা। কেন যে কোনো ভালো সাবজেক্টে চান্স পেলো না। এ আমার মায়ের সারাজীবনের আক্ষেপ। সে বছর ঘ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়েছিল ১৬০০ ছাত্রছাত্রী। আমি ভাগ্যের জোরে ঘ ইউনিট দিয়ে মেধা তালিকায় ৯২ স্থান পেয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে ঢুকে গেলাম বাংলা ডিপার্টমেন্টে। সিট নির্ধারিত ছিল রোকেয়া হলে। আমি নিলাম বাংলাদেশে-কুয়েত মৈত্রী হল। ক্লাস শুরু হতে দেরি। কোনোমতে ময়মনসিংহ এসে দিনরাত শুনি তার পড়া আর কবিতা। কত কত কবিতা মুখস্ত হয়ে গেল মাহিদুল ইসলামের পড়া শুনতে শুনতে। জীবনের দ্বিতীয় আর ঘটনা দুর্ঘটনা জয়-পরাজয়ের সবিশেষ জীবন শুরু হলো আমার তৃতীয় ঘরে।
স্রোত আবৃত্তি সংসদের ওয়ার্কশপ হতো তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসিতে)। ওয়ার্কশপের নানা গ্রুপ ওয়ার্ক থাকতো সারাদিন ধরেই। ছোট ছোট নানা দল করে দিতেন মাহি ভাই। সারা সপ্তাহ ধরে সেই দলগুলো কাজ করতো। আর সপ্তাহ শেষে কর্মশালার দিন সেগুলো উপস্থাপন করতে হতো। আমি কলাভবনের ক্লাস সেরেই চলে যেতাম টিএসসি। আবার দু ঘণ্টার বিরতিতে আবৃত্তির গ্রুপ ওয়ার্ক শেষ করে এসে ধরতাম কলাভবনের ক্লাস। দিনে দিনে শখ নেশায় রূপান্তরিত হতে শুরু করে। ক্লাসমেটদের সঙ্গে দলবেঁধে আড্ডা ক্লাস পড়া সব তুচ্ছ হয়ে পড়ে তখন সেই নেশার কাছে। সেই থেকে টিএসসিতে কবিতার সঙ্গে আমার দ্বিতীয় ভালোবাসার আশ্রয়। আমার তৃতীয় ঘরে…
চলবে…