আজন্ম বনপাহাড়ের কাছ থেকে পাওয়া আমার উচ্ছ্বল জীবন-চারিত্র্যের বেশ খানিকটাই স্তিমিত হয়ে এলো ময়মনসিংহের সংকীর্ণ গলিপথে স্কুলে যেতে-যেতে। বাকিটাও যেন ধুয়ে গেল সেদিন সন্ধ্যার মুষলধারে ঝরে পড়া বৃষ্টির তোড়ে। আমার আদিগন্ত সবুজ ফসলের মাঠ,আমার বিস্তৃত নীলাকাশ, পূর্ণরাত্রিতে সেজে থাকা আমার চাঁদের প্রহরগুলো যেন আজ স্বপ্ন, যেন কেবলই মায়া। মনে হতে লাগলো, কবে যেন এসব আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি ধীরে চলি, ধীরে বলি। আর কেন যে খুব সন্তর্পণে মনের অজান্তেই সেই হাত দু’টি খুঁজে ফিরি। ওই দু’টি হাত ছাড়া আর কিছু আমার চোখের সামনে আসেনি সেদিন। না কারও মুখ না কারও শরীর। আশেপাশের অলিতেগলিতে,স্কুলে যাওয়া-আসার পথে যে ছেলে ছোকরাগুলো আমাদের পিছু নেয়,এটা-সেটা বলে,তাদের হাতের দিকে চেয়ে দেখি আড়চোখে। এদের কেউ সেদিন আমার রিকশার পেছনে উঠেছিল? নাহ! মেলে না কিছুই। ধীরে-ধীরে খোঁজাখুঁজিও একদিন স্তিমিত হয়ে আসে। ভুলেও যাই সব। সত্যি কথা কি আজ ‘নারী’র পর্ব–১০ লেখার আগে বোধ করি, বছর-বছর, যুগ-যুগ এই ঘটনাটি মনেও পড়েনি আর। কিন্তু এই ঘটনাটি সত্যি এক অদ্ভুত নারীকে জাগিয়ে দিয়ে যায় আমার ভেতরে। আমার পারিবারিক পরিমণ্ডল, আমার নিসর্গ আর তার অপরূপ ভালোবাসায় সাজানো লালমাইয়ের উদারতা আমাকে কোনোদিন কোনো বাঁধনে কিংবা শাসনে জড়াতে পারেনি। আসলে জড়ায়নি বলাই মনে হয় ভালো। আমার মা পারতেন বলতে, ‘বড় হয়েছ, এই বন-পাহাড়ের পথে যখন-তখন হেঁটো না।’ পারতেন বলতে, ‘তুমি মেয়ে, তুমি অত জোরে হেসো না। তুমি পুকুরে এপাড়-ওপাড় করো না আর।’ এমনকি সেদিনের ঘটনার পর তিনি বলতে পারতেন,‘এখন থেকে বোরকা পরো। কালো নেকাবে মুখ ঢাকো।’ আমার পরিবেশ, পারিবারিক পরিমণ্ডল তার কিছুই করেনি। আর তারই বিশালতা নিয়ে বুঝি সেদিনের পর জন্ম হলো আমার ভেতরে আরও এক পূর্ণ মানবসত্তার। আমি সতর্ক হতে শুরু করলাম। আমি দ্বিধান্বিত হতে শুরু করলাম। আমি সন্ধিহান হতে শুরু করলাম। জন্মকাল থেকে যে আমার মধ্যে মানুষ সম্পর্কে শুধু ভালোলাগা, ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু ছিল না, সে আমিই যেকোনো ছেলে মানুষকেই সন্দেহ করতে শুরু করি। যে আমার মধ্যে প্রকৃতির যেকোনো পালাবদলে নতুন প্রাণের উন্মেষ ঘটতো– কী বর্ষা-বাদলে, কী বসন্তে ফুলের ঘ্রাণে, কী শরতের আকাশে তুলোতুলো সাদামেঘে; আজ সেই আমার মনে বৃষ্টি আনে ক্ষীণ ভীরুতা। শীতের কুয়াশা আচমকা আচ্ছন্ন করে তোলে আমার মনকে তীব্র ধুম্রজালে। মানুষ আমার মনে আনে দুঃসহ যাতনা। যখন শুনি ক্লাসমেট বান্ধবীরা পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে, তখন ওই ছেলেরা আমার মনে আনে দারুণ অবিশ্বাস, ভীষণ অস্থিরতা। এর বেশি কিছু নয় আর।
তখন পড়ছি ক্লাস এইটে। বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। দারুণ এক প্রধান শিক্ষয়িত্রী পেয়েছি ছাত্রজীবনের মাঝখানে। তার নাম ফুলরাণী সরকার। দীর্ঘাঙ্গিনী শ্যামলা বর্ণের এক উজ্জ্বল মহান নারী। তার সিঁদুরের লাল রঙ আমাকে পুড়িয়েছে,খাঁটি সোনা বানিয়েছে আর দিয়েছে সারাটি জীবনের জন্য সুন্দরের এক অসাধারণ উপমা। কত বড় হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত-কত অসাধারণ সুন্দরী দেখলাম। এরপর আরও বড় হলাম। কত দেশি-বিদেশি সংস্থায় চাকরি করলাম। কত কত সুন্দরী দেশি কিংবা বিদেশি নারীর রূপে মুগ্ধতায় বন্ধুদের বিমোহিত হতে দেখলাম। কিন্তু আমার সুন্দরের বোধ পড়ে রইলো আজও সেই কিশোর বয়সের দারুণ অবেলায়। তার মতো অসাধারণ আমি আর কখনো দেখিনি এ জীবনে। না রূপে,না গুণে,না ব্যক্তিত্বের তীব্র প্রখরতায়। মা বলতেন ‘ফুলরাণী খুব কষ্ট করে বড় হয়েছে। জানিস?’ আমি বলি, ‘না মা। কী কষ্ট?’ মা বলেন, ফুলরাণীর বাবার বাড়ি আমার বাবার বাড়ির পাশেই। ওর বাবার একটা চায়ের দোকান ছিল। আর সে দোকানে ছোটবেলায় ফুলরাণী বাবার সঙ্গে বসতো। চা বানাতে সাহায্য করতো।’ আমি বড় বড় চোখে তাকিয়ে শুনি আমার মায়ের কথা। কী বলছেন, মা এসব। এই বড় আপা? এমন তেজস্বী যার রূপ, এমন তীব্র যার দৃষ্টি, এমন সোহাগে শাসনে জড়ানো যার ভালোবাসা, এমন দারুণ যার হেঁটে চলার ছায়া,তিনি বাবার সঙ্গে চায়ের দোকানে চা বিক্রি করতেন? আমার মনের প্রশ্নগুলো মুখে সরতে সাহস পায় না। কারণ আমি তো জানি, মা মিথ্যা বলছেন না। কিন্তু আমি বুঝে পাই না, কী করে তিনি এত এত বড় হতে পারেন? মা আবার বলতে শুরু করেন: ‘যাওয়া-আসার পথে দেখতাম,সারাক্ষণ ফুলরাণীর হাতে একটা বই ধরা। যখন লোক আসছে চা খেতে, বাবার সঙ্গে চা ছাকতে,চা এগিয়ে দিতে সাহায্য করছে। আর হাতের কাজটা সারা হয়ে যেতেই হাতের বইটা মেলে ধরতো চোখের সামনে। সারাক্ষণ তার হাতে থাকতো একটা বই। বহুদিন পরে অনেক অনেক বড় হয়ে একদিন বুঝতে পেরেছিলাম,ওই যে হাতে ধরে থাকা বইটি। এই বইটিই তাকে দিয়েছিল পায়ে হেঁটে চলে যাওয়ার পথের দিশা। তার ব্যক্তিত্বে ফেলেছিল প্রতাপশালী এক সুদীর্ঘ তীব্র মধুর ছায়া। তাকে বানিয়েছিল মানুষ। আর এই মানুষের সান্নিধ্যে আমার কেটেছিল জীবনের উজ্জ্বলতম ৬টি বছর। আমরা ১১ জন বন্ধু যখন শুধু বিদ্যাময়ী নয় পুরো ময়মনসিংহ শহরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় স্টারমার্কস পেলাম,তখন তিনি আমাদের সম্মানিত করেছিলেন এই ভাষায়–‘বিদ্যাময়ীর আকাশে এই ১১টি তারা সারাজীবন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে থাকবে ।’ জানি না—সে আকাশ কত বড়। কত দূর তার গতিপথ। জানি না—সে আকাশে জ্বলি কি না আমরা এগারো জন। তবে ফুলরাণী আমার জীবনের এক অসাধারণ পাওয়া, এক উজ্জ্বলতম নারী। এ কথা আমার যুদ্ধবাজ জীবনের প্রগাঢ় এই বেলায়ও স্বীকার করি আর স্যালুট জানাই তাকে। তার সংগ্রামের ইতিহাসে সার্থকতার প্রতি জানাই অভিবাদন।
বিদ্যাময়ী স্কুলে ঢোকার মুখেই বাঁধানো বটতলা। বামে বিশাল বাঁধানো পুকুর। সোজা চলে গেছে পায়ে চলা পথ ধরে মেয়েদের হোস্টেল পর্যন্ত। তারই বামে টালির ছাদে বাঁধা আর ফুলের বাগানে সাজানো ফুলরাণীর দোতলা বাসভবন। ডানে রাণী বিদ্যাময়ীর রাজপ্রসাদ আমাদের স্কুল। তারই সামনে বিস্তৃত ঘাসের মাঠ। দু’পাশে দু’টি দালানে জোড়া লাগানো তিনতলা বিল্ডিংটি আমাদের স্কুল ঘর। আমরা সেদিন দাঁড়ানো তিনতলার বারান্দায়। শিক্ষক আসতে খানিক দেরি। তাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বরাবর গল্প করি বন্ধুরা। শিক্ষক আসতেই পড়িমরি করে ক্লাসে ঢুকি। সেদিনও তেমনি দাঁড়িয়েছি। গল্পে মশগুল। আমাদের চোখের ঠিক সামনেই স্কুলের প্রধান গেট, যেখানে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো অবস্থায়ই স্কুলের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা ছাড়া বাইরের কোনো ছেলে স্কুলে প্রবেশের কোনো সুবিধাই নেই। তিনতলা থেকেই দেখছি আমাদের এক বড় আপা বটতলায় আড্ডা দিচ্ছেন বান্ধবীদের নিয়ে। তিনি তখন ক্লাস টেনে পড়েন। ময়মনসিংহ শহরের নামকরা সুন্দরী। তার ছোট বোন আমার সহপাঠী। হঠাৎ একদল ছেলে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে স্কুলে। হাতে বেশ কিছু যন্ত্রপাতিও রয়েছে। দূর থেকে এটুকুই বুঝতে পারি। আরে ওখানে তো মিঠু ভাইকেও দেখছি। হ্যাঁ,আমাদের পাড়াই থাকেন। দেখতে সুন্দর। সভ্য ভদ্র আচার ব্যাবহারই দেখেছি তার বরাবর। দারোয়ানকে এক ঝটাকায় ফেলে দিয়ে একদল ছেলে তার সঙ্গে ঢুকে পড়ে স্কুলে। সোজা চলে আসে বটতলায়। এসেই তারা আপার হাত ধরে টেনে তোলে। আমরা বিস্ময়ে স্তব্ধ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপার পিঠের ওপর ছড়িয়ে থাকা এক ঢাল লম্বা চুলের মুঠি ধরে টেনে ওঠায়। আর ঠাস্ ঠাস্ চড় লাগাতে থাকে। আমরা ভয়ে কুঁচকে যেতে থাকি। আরও কী কী ঘটতে পারে এখন? এরপর কী হবে? কেন এভাবে দিনদুপুরে একজন নারীকে এমন অসম্মান? কী উদ্দেশ্য এ ঘটনার? তারপর? আর কোন দিক হবে ওই ছেলেগুলোর যাত্রা দিক কিংবা লক্ষ্য?
চলবে…
নারী: পর্ব-৯॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৮॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৭ ॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৬ ॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৫॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৪॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৩॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-২॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-১ ॥ শাপলা সপর্যিতা