॥পর্ব-৩৪॥
খঞ্জনপুরে গিয়ে আমি অভিভূত রুক্ষ্ণ ঊষরের আতিথেয়তায়। দারুণ দারুণ পরমাত্মীয় সব। মা-বাবা-ভাই-বোন, বোনের স্বামী-ভাগ্নেরা। অসাধারণ। দারুণ সময় কেটে যায় আমাদের। আমার কোনো গ্রাম নেই। সেই কবে জামালপুরে মালেকা জারিনুসের তালুক-গ্রামে গেছি। নানা ইসমাইল তালুকদার আগেই গেছেন। তার সঙ্গে দেখা নেই আমার কোনোকালেই। নানু মারা যাওয়ার পর ওদিকে আর নয়। মামার দোর্দণ্ড প্রতাপে আমরা ছিন্নভিন্ন। ওদিক আমাদের নয় আর। এরপর আর কোনো গ্রাম নেই আমার। বন্ধুর বড় ভাই তখন ইতালি থেকে ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিস্ট্রিতে এমএ করে ইতালিপ্রবাসী তিনি। একমাসের ছুটি শেষে আবার ফিরে যাবেন। লেখালেখিও করেন। আমি লিখি শুনে আগ্রহ প্রকাশ করেন আমার লেখার পড়ার। তখন আমার একটি মাত্র প্রকাশিত বই। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে আগে বইটি বের হয়েছে ময়মনসিংহ থেকে। কবিতার বই ‘এই পৃথিবী এই দেশ’। তিনি বইটির বিষয়ে খুব আগ্রহ দেখান। আমি বলি ‘ঢাকা ফিরে আপনাকে বই পাঠাবো’। তিনি আমায় ঘুরিয়ে দেখান খঞ্জনপুর গ্রাম। এমনিতেই গ্রামের নামের সঙ্গে এক অপরূপ নম্রতা মাখা স্নিগ্ধতা জড়ানো রয়েছে। আমি মুগ্ধে চোখে দেখি খঞ্জনপুর। ঘুরে ঘুরে দেখি গ্রাম। লালমাটির মায়া বুকের গভীরে আলপনা আঁকে নীরবে গোপনে, কেউ জানে না। আমি হতচিত্ত। আমি প্রতারিত। আমার বন্ধুরা সবাই জানে এ কথা। তাই আমার আলপনাগুলো আড়ালে, কেবল লাইন ড্রইংয়ে। রঙ দেওয়ার সাহস আমার গেছে কবেই। পায়ে চলার পথে হাঁটি আমরা, মনে পড়ে কাঁটা কবিতার সেই ক’টি লাইন, আমি আনমনে পড়তে থাকি ‘তোমার পায়ে কাঁটা ফুটেছিল, টিটলাগড়ের আলপথে, তুমি উহ বলতেই….’—ঠিক এমনি সময়ে তার প্রশ্ন।
—তুমি কবিতা পড়ো?
আমি সন্ধিগ্নপূর্ণ উন্মীলিত চোখে তাকাই তার চোখে, প্রথম। আমি বিস্মিত। আমি যে মনে মনে ‘কাঁটা’ কবিতার লাইন পড়ছি, তা তিনি কেমন করে জানলেন! না কি আমিই আনমনে প্রক্ষেপণে এনেছি তাকে বেঁধে। আমার দৃষ্টির সামনে কী তিনি খানিকটা কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন? ইতস্তত করে আবার প্রশ্ন করেন।
—না, মানে আমার দুটো কবিতার বই তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম।
—অহ।
আমি আশ্বস্ত হই। তাহলে আমার ‘কাঁটা’ তিনি শুনতে পাননি! আবার চলতে শুরু করি। মাটির ঘরে আন্তরিক আতিথেয়তা। নাড়ায় পোড়ানো ধানক্ষেত, সবুজ সারি সারি গাছের মায়া। বিকেলের আলস্যে ক্ষীণ হতে থাকা রোদের মায়া। সর্পিল রাস্তা ধরে আমি হাঁটি বহুদূর তার সঙ্গে। মাটির ভারে চা খাই। হালকা কুয়াশার ফিনফিনে চাদর ছড়িয়ে পড়েছে তখন দূর দূর সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে। আমাদের বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় যুগ যুগ ধরে চলুক এই অনন্ত গ্রামান্ধ-মুগ্ধতা। সুদীর্ঘ হোকনা আজকের এই অপরূপ ক্ষণকাল। কী এসে যায়! অদ্ভুত সুন্দর এখানের ঊষর লাল মাটি। সরল এখানে জলজমনের মানুষ। তবু ফিরে আসি বাড়ি। রাতে ছাদে আসর বসে। জোৎস্না আমার মুখে গড়াগড়ি গেছে সে রাতে। ছাদের বসন্তে ছিল বাতাসের হিল্লোল। আমি নিজেই হার্মোনিয়াম বাজিয়ে গাইছিলাম—‘আর ফেরানো যায় না কেন…’। পূরবীর সে রাগ হৃদয়ে গেঁথে পৌঁছে গেছিল ভৈরবী পর্যন্ত। উত্তাল অতল। বুঝতে অত দেরি। বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে পথে সঙ্গে সঙ্গে বাসস্ট্যান্ড অবধি তিনিও। সম্মোহিত পদযাত্রা। তারপর বা-বাই। গাড়ি ছেড়ে দিলো। এখানেই একটা শুরু ছিল। আমি সেদিন বুঝতে পারিনি তার আরম্ভ। মনে তখনো লেগে থাকা সদ্য প্রতারণার কালোটুকু অন্ধকার তাড়াতে পারেনি খুব একটা। তাই আলো জ্বালানোর সাহস নেই আর।
না না প্রথম স্পর্শ-টর্শ বলে কিছু নয়। নিজের আনস্মার্ট কাজটার জন্য লজ্জা। একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছি কবিতা পড়তে। কপালে কাজল লেপ্টে। ছিঃ ছিঃ কী লজ্জা! সে হেসেই চলছে। সম্পর্কটাও এমন নয় যে ফাজলামো করে হালকা করবো।
আমরা ফিরে আসি আবার ঢাকায়। ঝাঁপিয়ে পড়ি আবার কবিতার সঙ্গে। তখন পদ্য বাউল প্রযোজনাটি একবার মঞ্চস্থ হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের আমন্ত্রণে দ্বিতীয় বার মঞ্চস্থ করার আয়োজন শেষ। আমি যাব কবিতা পড়তে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আমার প্রিয় কবিতা। খুব দেরি হয়ে গেছিল। শ্রোতা-দর্শক বুঝি চলেই এসেছে এতক্ষণে। দ্রুত শাড়িটা পরে কোনোমতে চোখে কাজলের একটা রেখা টেনে দিয়েই বের হয়ে পড়ি। টিপের পাতাটা হাতের কাছে পেলাম না একেবারেই। আই লাইনার দিয়েই ছোট একটা টিপ কপালে এঁকে দৌড় দেই নিচে। তখন মোবাইল ফোনের যুগ নয়। যখন তখন যোগাযোগ অসম্ভব। ঢাকা আসার পর আর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি আমার। আমি নিচে নামছি দ্রুত। পাঁচতলার সিঁড়ি ভেঙে। সে কোথাও ছিল না। আশেপাশে আছে কি না, তাও জানা নেই। আসারও কোনো কথা ছিল না। নিচে নেমেই তাকে দেখে অবাক হওয়ারও সময় আমার নেই তখন। ভেতরে তখন কেবলই শক্তি—‘একা লাগে ভারী একা লাগে/তোমাদের ছেড়ে এসে অমূল বৈরাগে’। ভেতরে তখন সত্যিই এক দারুণ বৈরাগ। আমার ভেতরে তখন আরও আরও বেশি শক্তি—‘যে যায় সে দীর্ঘ যায়/একজন মানুষ সামনে থেকে চলে গেল দূরে।’ বুকের ভেতর ছিঁড়ে খুঁড়ে খায় এক অজানা দহন। এভাবেই তখনো আমার দিনরাত।নিচে নেমেই সামনে একটা রিক্সা পেয়ে যাই। ঝটপট উঠে পড়ি। কোনো কথা নেই। সেও উঠে পড়ে। অদ্ভুত! আমার কোনো বাঁধন নেই। নেই কোনো বিরক্তিও। এমনকি নেই কোনো নিষেধ। চলছি দু’জনে।
—কোথায় চলেছি?
তার প্রশ্নের উত্তরে প্রথম কথা বলি,
—ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার । ধানমন্ডি । প্রোগ্রাম আছে।
—চলো, আমিও যাচ্ছি।
তিনি তো যাচ্ছেনই। ঝুপ করে উঠে পড়লেন রিকশায়। আমার শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে বসে পড়লেন পাশে। কোনোই বিকার নেই। কোনো অনুমতির তোয়াক্কা নেই্। কোনো ভদ্রতার বালাই নেই। এই অভদ্রতাটুকু যখন একটু একটু করে ভালো লাগতে থাকে তখনই বলেন,
—একটা কথা বলি?
আমি হা না বলি না। প্রশ্ন চোখে তাকাই শুধু, তার ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি দেখে অবাক হই। বুঝতে পারি না কিছুই। কিছুক্ষণের মধ্যেই রহস্য প্রকাশিত।
—তোমার কপালে কাজল লেপ্টে গেছে। ছোট লুকিং গ্লাস আছে সাথে?
—না। বড্ড তাড়াহুড়ো করে বের হয়েছি।
—যদি কিছু মনে না করো আমি ঠিক করে দেই?
আমি কিছু বলার আগেই টিস্যু বের করে থুতনিতে আলতো স্পর্শ একহাতে। অন্য হাতে কপালের টিপ সংস্করণের চেষ্টা। যথারীতি সংস্করণে ব্যর্থ হয়ে টিপটা মুছে ফেলা। তার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমীর একটা হাসির রেখা লেগে রয়েছে। অদ্ভতু মনোহরণ সে হাসি। আমার ভীষণ লজ্জা। মুখ লাল হয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা। না না প্রথম স্পর্শ-টর্শ বলে কিছু নয়। নিজের আনস্মার্ট কাজটার জন্য লজ্জা। একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছি কবিতা পড়তে। কপালে কাজল লেপ্টে। ছিঃ ছিঃ কী লজ্জা! সে হেসেই চলছে। সম্পর্কটাও এমন নয় যে ফাজলামো করে হালকা করবো। তিনি নির্বাক। একা একাই আমার অস্বস্তিটুকু যেন প্রাণভরে উপভোগ করছেন। আমিও নির্বাক। কোনো কথা নেই। অধরা অনামা সব। বাইরে তখন দারুণ বিকেল। সোনালি বিকেল। সমস্ত দিনটুকুর রোদেলা অবসাদ সব। পথচারী তাকিয়ে দেখছে—হুড ফেলে দিয়ে একটা রিকশা ছুটে চলেছে। একজন যুবক একজন যুবতীর কপাল স্পর্শ করেছে।
চলছে…
নারী: আ হান্ড্রেড ফেসেস অব ওম্যান-৩৩॥ শাপলা সপর্যিতা