পড়ন্ত বিকেলগুলো আমার মুখর হয়ে ওঠে আবার। তারপর সব কিছু অন্যরকম। দিনে দিনে ভেসে আসে বসন্ত বাতাস। তিনি আসতে থাকেন বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে প্রায় প্রায়ই। মৈত্রী হলের ঘাসের মাঠে বসা হয় না আর আগের মতো। আমি বোধ করি, এরই মাঝে আমার প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইটি পাঠিয়েছিলাম বুক পোস্ট করে খঞ্জনপুরের ঠিকানায়। তিনি তখন ঢাকায়। আর সেই বই গিয়ে পড়েছিল লিপি আপার হাতে। সঙ্গে সঙ্গে পরিবারে আর হকিপ্লেয়ার বন্ধু মহলে রাষ্ট্র হয়ে যায় সকল, যদিও তখন কিছুই নয় ঘটনা। আর আমি প্রথমবারের মতো দেখতে শুরু করি নারীর আরও এক মুখ-আ নিউ ফেস। একে তো ভাইজানের চক্ষুশূল হয়েই ছিলাম। আমার রুমমেট করবী আপা তখন পুরোদমে আমার বড় ভাবি। ভাইজানের সঙ্গে নতুন সংসার শুরু হয়েছে তার। প্রেম-বিরহ, দুঃখ-দৈন্য বাড়ির লোকেদের চেয়ে হলের রুমমেটরাই বেশি জানেন হলজীবনে। এটা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনযাপন করেছেন তারা জানেন। এরই সুবাদে আমার পুরনো প্রেমের সব কাসুন্দি ভাবি আমার ভাইয়ের কানে প্রচুর পরিমাণে প্রবহমান রেখেছেন। বহুদিনের যে নারী বন্ধুরা আমার হলের ভেতর, তারা সবাই ভাগ হয়ে গেছে দুই ভাগে। আমার দিকে একজনও নেই। অথচ আমি যখন খুব ব্যথিত, খুব যন্ত্রণাকাতর, ভীষণ বিধ্বস্ত, তখন সবচেয়ে আপন হয়ে উঠেছিল এরাই।
হলের ভেতরে যাদের সঙ্গে বহু বহু রাত্রিযাপন, বৃষ্টিতে ভেজা ভেজা আধোদিন, উৎসবে মুখর করা রাত, দুঃখ-আনন্দ-বিরহ-বেদনার অনিঃশেষ সময়যাপন, এবার তারাই হঠাৎ গোপনে আমার পেছনে মুখর। আমি তখন একেবারেই কনফিউজড। তবে কি আমার এই বান্ধবীরা আমার এতদিনের যাতনাগুলো উপভোগ করেছে! আদৌ কি তারা আমার ওয়েলউইশার! না হলে কোনো কারণ নেই, কেউ আমার কাছে জানতেও চাইলো না ঘটনার আসল কী আর নকলই বা কিছু আছে কি না এখানে? আমার যাতনা, আমার দহন আর বিরাগ, আমার বিস্বাদ, আমার বিষাদ—সব আমারই। ওরা কলাভবনে ক্লাস শেষে আড্ডা দিতো, যখন আমি যেতাম টিএসসিতে কবিতা পড়তে। ওরা যখন বিকেলে নিয়ম করে গল্প-গুজব করে আলসে সময় কাটায় বন্ধুদের সঙ্গে, আমি তখন আবৃত্তির রিহার্সেলে, কবিতার অলিন্দে প্রকোষ্ঠে প্রাণ খুঁজে মরি। ফলে আমার যা আন্তরিকতা বান্ধবীদের সঙ্গে, সেটা গড়ে উঠেছিল হলের ভেতরে কেবল রাতের বেলা। যদিও আজকাল লুবনা সেখানে অনুপস্থিত। লুবনার সঙ্গে আমার যোগাযোগও বেশ কম ইদানীং। ও বাদে হলের নারী বন্ধুরা আমার আর হকি প্লেয়ার যে বন্ধু সার্কেলটি ছিল, তারা সবাই একপক্ষ। আমি আর তিনি দুজন একপক্ষ। একটা কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধের ক্ষেত্র গড়ে দিলো। তবু কিছু করার নেই। মদনের ইচ্ছের বাইরে যাওয়া তখন আমাদের পক্ষে দূরূহ। মধু-মধু দিনগুলো তখন আমাদের। আমার নতুন করে ভালো লাগতে শুরু করে সব।
অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। ভাইজানের মানসিক নির্যাতন চূড়ান্ত। তার ইচ্ছে, হল ছেড়ে আমাকে তার বাসায় থাকতে হবে। আমি খারাপ হয়ে গেছি। আমি প্রেম করছি। আমি যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি নষ্ট, আমি ভ্রষ্ট। বাড়িতে গেলেই মায়ের কাছে শুনি ভাইজান সাবধান করে দিয়েছে পরিবারের সবাইকে যে, আমি সেজভাইয়ের মতো পরিবারের মুখ ডোবাবো। এটা নিশ্চিত সে। সেজ ভাই পড়তে গিয়েছিল মস্কোতে ডাক্তারি। ভাইজানের অতিরিক্ত খবরদারির কারণে সেখান থেকে মাইগ্রেট করে মিনস্কে চলে গেলো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। প্রেম করে বিয়ে করেছে পর্তুগিজ ইঞ্জিনিয়ার ইজাবেলা রদ্রিগ্যাজকে। বাবা মায়ের অভিমতের তোয়াক্কা করেনি। কেউ কারও ধর্ম বদলায়নি। ইজাবেলা খ্রিস্টান আর সেজ ভাই মুসলমান। তার ওপর জন্ম দিয়েছে তাদের প্রথম সন্তান।
সোভিয়েট ইউনিয়নে তখন গ্লাসনস্ত পেরস্ত্রয়িকা চলছিল। সুবিশাল সোভিয়েট ইউনিয়ন ভাঙতে শুরু করেছে কেবল। খাবারের ভীষণ সংকট। এরই মাঝে দুজন ভিনদেশির সন্তান হিসেবে ওদের বাচ্চা রাজনের বেবিফুড—ইভেন দুধও পাওয়া যাচ্ছিল না। বাবা-মা দুজনের একজন অন্তত রাশান না হলে বেবিফুডও দেওয়া হচ্ছে না। এসবের নানা ধকল ভাইজান সয়েছে তখন। অতএব পরিবারের মুখে তো একেবারেই কালি লেপে দিয়েছে সেজভাই। পরিবারে দ্বিতীয় আর একজন রেডি হচ্ছি আমি। রাতে-দিনে এসব শুনতে শুনতে আমি মর্মাহত। আমি বিভ্রান্ত। আমি হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছি। সঙ্গে অফুরন্ত অবসর। তবু কবিতার ঘর—স্রোত আবৃত্তি সংসদে রিহার্সেল শেষ করে টিএসসিতে মুখর আমার সময়। আবৃত্তিকার বন্ধু মাসুদুজ্জামান, মাসুম, সোহেল ভাই, আমার আবৃত্তি শেখার পরম গুরু মাহিদুল ইসলাম, শিমুল মোস্তাফা, শান্তা আপা, সোহেলি আপা, শারমিনের সঙ্গে বেশ জমে গেলো তার।
তিনি তিন মাসের ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছেন। ফিরে যাবেন আবার রোমে তার কর্মস্থলে। তিন মাস কোথা দিয়ে পার হয়ে গেলো, কেউ জানে না। আমরা তখন দুজনে দুজনার। গোপনে লুকিয়ে পালিয়ে বন্ধু মহল থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাই। ক্লাস নেই। পরীক্ষার তোড়জোড় নেই। যখন-তখন যেমন-তেমন। ঝুম বৃষ্টি ভেজা ভোর। হঠাৎ কল। নিচে নেমে দেখি, তিনি বাইকের ওপর বসে হাসছেন। গায়ে রেইনকোট-টোট কিছু নেই। আমার হাতে ছাতা নেই। আমি ভদ্রতা করে নেমেছি তাকে বিদায় করে দিয়ে আবার ঘুমোবো বলে। তাই আমি হলের গেটের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকি, আমার প্রশ্নচোখ দেখে তিনিই ইশারা করেন,
—বাইরে এসো।
—এই বৃষ্টিতে!
—এসোনা।
একপলক ওপরের দিকে তাকাই। এই প্রচণ্ড বৃষ্টিতেও দেখি দোতলার কোনো এক রুম থেকে মুখ বের করে আছে কেউ একজন। আমি দ্বিতীয়বার ভাবি না। বাইকের পেছনে চড়ে বসি। তুমুল ঝড়োবৃষ্টি-বাতাস উপেক্ষা করেই উঠে পড়ি। ভেতরের তুমুল ক্ষোভের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে বাইক। মুখর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে উড়ে যাই হাওয়ায় হাওয়ায়। এই এলাকাটি তখন আমাদের বিচরণের জন্য বিষাক্ত হয়ে উঠেছে—মৈত্রী হলের বান্ধবী আর বন্ধুদের গোয়েন্দাগিরিতে। তাই হারাই দুজনে অন্য কোথাও। বাতাসে ভেসে ভেসে হারিয়ে যাই কোথায়, কেউ জানে না। বহু দূর দূর যাই। দূর দূর তখন আমাদের ভালোবাসা। খুব ঘন হয়ে আসে আমাদের যাপনের কাল।
মাত্র ২৩ বছর বয়সে এত ভার, ভেতরে দারুণ ক্ষোভ, নিদারুণ ক্রোধ, বিষাক্ত বেদনার ক্লেদ, প্রতারণার যাতনা, বড়ভা্ইয়ের লেপে দেওয়া কাঁদায় ক্লেদাক্ত যখন চারপাশ, বন্ধুদের বিশ্বস্ততা যখন চরম অবিশ্বাসে ভারাক্রান্ত, তখনই তার কবিতার ঘর আমার মাঝে। তিনি লিখতেন পেন্সিলে। হাতের কাছে খাতা কলম নেই। ঢাকায় থাকতেন ছোট বোনের বাড়ি বাপ্পীদার বাসায়। ভাগ্নের পেন্সিল আর খাতার কাগজ ছিঁড়ে লিখতেন কবিতা। আমি প্রতিদিন একটা করে কবিতা চাইতাম। যখন ঢাকা ছাড়তেন, তখন খঞ্জনপুরে বসে পেন্সিলে চিঠি লিখতেন। আমি হয়তো তখন সত্যিই খুঁজছিলাম কোনো সহৃদয় হাতের আলতো পরশ! খুঁজছিলাম হয়তো কোনো পরম প্রিয় মানুষ। তিনিই কি সে জন? সময় খুব দ্রুত গড়িয়ে চলেছে। তার যাওয়ার সময় তিনমাস পার হয়ে গেছে কবেই।
আমি যখন খঞ্জনপুর গেছিলাম, তখন বন্ধুর যে মা-বোনেরা আমাকে ভীষণ ভালোবেসেছিলেন, যাদের পরম ভালোবাসা আর আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছিলাম, পরম সম্মানে তুলে নিয়েছিলাম মাথায়, তাদেরই কাছে আমি এখন একজন মারাত্মক খারাপ মানুষ হয়ে উঠলাম। বাড়ি থেকে তাকে আবার ইতালি পাঠিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। তাই আমাদের পেছনে নারী, আমাদের পেছনে তখন স্রোতস্বী মানুষ। আমরা দুজন স্বপ্ন, আমরা পথিক, আমরা তখন চলমান-বহমান খরস্রোতা নদী। যদিও তখন মাস দুযেক ধরে প্রকৃতিতে চলছে তুমুল খরা। আগস্ট মাস। কলাভবনের ঘাসের মাঠের প্রকরণ রুক্ষ্ণ। আম্রকাননে গাছের পাতা খসে পড়ে। যেখানে-সেখানে যখন-তখন জ্বলে উঠতে পারে তীব্র দাবানল—ঠিক এমনই একদিন। সেদিন বাইক নিয়ে আসেনি। কলাভবন পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে রেজিস্ট্রার্ড বিল্ডিংয়ের দিকে আলতো হাঁটছি দুজন। ক্ষরায় পোড়া রুক্ষ্ণ মাঠে গাছের পাতায় হঠাৎ সেদিন কালো মেঘের ছটা। শুরু হলো রিমঝিম বৃষ্টি। বৃষ্টির হালকা তোড়ে দৌড়ে কলাভবনের মলচত্বরের প্রাচীন সুবিশাল বট গাছটার নিচে আশ্রয় নেই আমরা। এক মুহূর্তে জনশূন্য চারপাশ। অন্ধকার কালো সন্ধ্যার মতো সেদিনের আঁধার। সে আঁধারে বটের গাঢ় গভীর পাতার নিচে আমরা ঘন হয়ে আসি। দুজন তৃষিত ক্ষুব্ধ মানুষ আবার নতুন করে নিজেদের বিন্যস্ত করি। সেই প্রথম জড়িয়ে ধরা একে অন্যের। বুকের গভীর নিঃশ্বাস শুনতে পাওয়া দু’জনের। ঠোঁটে ঠোঁট। রক্তে আগুন। বৃষ্টির দারুন তোড়। বৃদ্ধ বটগাছ আর আমাদের ধারণ করতে পারছিল না। ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে অনেকটা ভিজে গেছিলাম আমরা। ভিজছিল গায়ের কাপড়। গাছের ডালে কাক। পায়ের নিচে সবুজ ঘাস। ভিজে উঠেছিল মন-প্রেম-শরীর—সতৃষ্ণ আবেগের উন্মার্গ কামনা। বৃষ্টি-প্রাবল্য বেঁধে দিলো আমাদের আদিম প্রেমের বস্তুগত সীমানা। কোনোমতে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লাম দু’জনে। তারপর আধো প্রেম আধো জয় আধো অপরাজয়ের মধ্যেই বৃষ্টির প্রগাঢ় আস্ফালন। সেদিন গাছের ডালে বসেছিল দু’টো পাখি। সত্যি অনেকদিন পর দূর দেশ থেকে পাখি দুটো উড়ে এসে বসলো আমার কানে। আমার কপালে তার পছন্দের জয়ললিতা টিপ। তারপর বৃষ্টির কাছে পরাজয় মেনে আমি ফেলে দিলাম রিকশার হুড। বৃষ্টিকে স্বাগত জানিয়ে মুখর ভিজে ভিজে আমরা দু’জন চলতি হাওয়ারপন্থি।
চলবে…
নারী: আ হান্ড্রেড ফেসেস অব ওম্যান-৩৪॥ শাপলা সপর্যিতা