॥পর্ব-৩॥
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পর থেকে এই ফতোয়াবাজির সূচনা হয়। ১৯২২ সালে (১৩২৯ সনের কার্তিক সংখ্যা) ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকায় মুন্সী মোহম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমদ নামক একজন ইসলামি লেখক নজরুল সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’। তিনি ফতোয়া দেন যে, নজরুলকে আর মুসলমান বলে স্বীকার করা যায় না। ভারতবর্ষে যদি ইসলামি শাসন থাকতো, তাহলে এই ‘নমরুদ’ ও ‘ফেরাউন’-এর গলা কেটে হত্যা করা হতো বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। ১৯২৫ সালে (১৩৩২ সনের ভাদ্র সংখ্যা) ‘মোসলেম দর্শন’ পত্রিকা নজরুলকে নিয়ে ‘ইসলাম-বৈরী মুসলমান কবি’ শিরোনাম দিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। ১৯২৮ সালে (১৩৩৪ সনের মাঘ সংখ্যা) ‘ইসলাম-দর্শন’ পত্রিকায় জনৈক শেখ হবিবর রহমান ‘কাজির কেরদানী’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে নজরুলকে আক্রমণ করেন। ১৯২৮ সালের ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত নজির আহমেদ চৌধুরী নামক একজন লেখক নজরুল সম্পর্কে লেখেন, ‘যে কবিতাগুলির মধ্যে দিয়া তাঁহার কবি প্রতিভা স্ফূরণ লাভ করিয়াছে বলিয়া বলা হয় সেখানে তাঁহার প্রধান কৃতিত্ব হইতেছে খোদাকে অস্বীকার করিয়া, অমান্য করিয়া, অপমান করিয়া।’ অগ্নিবীণা কাব্য সম্পর্কে এই লেখক লেখেন, ‘খোদা তাআলার প্রতি অতি জঘন্য ভাষায় বিদ্রোহ ঘোষণা করাই তাঁহার এই পুস্তকের বিশেষত্ব। কবি সেখানে নিজের বিদ্রোহ রূপের পরিচয় দিতে দিতে মোছলেম বাঙ্গলার সম্মুখে যে আদর্শ উপস্থিত করিয়াছেন কোন আজাজীলই আজ পর্যন্ত ততটা করিতে সাহসী হয় নাই। … এছলামের প্রতি এক রতি মাসা পরিমাণ শ্রদ্ধা ভক্তি বিদ্যমান থাকিতে কোন মুসলমানই তাঁহাকে আপন বলিয়া গ্রহণ করা তো দূরে থাকুক অন্তর হইতে ধিক্কার না দিয়া পারে না। এছলামের চোখে এ অপরাধ অমার্জনীয়। সুতরাং বর্তমান যুগে তিনি যে এছলামের প্রধান শত্রু, তাহাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।’ ইসলাম দর্শন পত্রিকার সম্পাদক মু. আবদুল হাকিমও (মৃ. ১৯৫৭) নজরুলের বিরুদ্ধে বেজায় ক্ষেপেছিলেন। তিনি তার পত্রিকায় ‘বিদ্রোহ দমন’ নামে একটি কবিতা লিখে নজরুলকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন; এছাড়া একজন মুসলমান কবি হিসেবে নজরুলের কেমনভাবে সাহিত্য রচনা করা উচিত তারও সবক দেন। এছাড়া বিদ্রোহী কবিতার আরেকটি পাল্টা কবিতা লিখেছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪); একটি লেখায় নজরুলকে তিনি কেয়ামতের ময়দানের চরম শাস্তির কথা মনে করিয়ে দেন। নজরুলের বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধিতার অভিযোগ এনে যেসব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, এ তার কয়েকটি নজির মাত্র। মো. আজিজুর রহমান, বিএসসি নামক একজন লেখক নজরুলকে ব্লাসফেমির দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। এমনকি মাওলানা আকরাম খাঁ, যিনি বর্তমান কালেও অনেকের কাছে একজন ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত, তিনিও ধারাবাহিকভাবে ইসলাম বিরোধিতার কারণ দেখিয়ে নজরুল ইসলামের তীব্র সমালোচনা করে গেছেন। সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৫৭-১৯৫৬) তো নজরুলকে মানসিক ভারসাম্যহীন এবং ইসলাম ধর্মকে বিপদাপন্ন করার দায়ে অভিযুক্ত করে ফেলেন। এভাবে বিশের দশকের অধিকাংশ সময় গোঁড়া মুসলমানরা এমনকি প্রতিষ্ঠিত মুসলিম কিছু লেখক নজরুলকে ইসলামবিরোধী বলে ধারাবাহিকভাবে গালিগালাজ করে গেছেন।
পত্র-পত্রিকার এসব সমালোচনার বাইরে গোড়া মোল্লা-মৌলভিদের দ্বারা নজরুল অনেকবার দৃষ্টিকটূ আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে সিলেটে মুসলিম ছাত্রদের একটি প্রাদেশিক সম্মেলনে এ রকম একটি ঘটনা ঘটে। সম্মেলনের এক পর্যায়ে নজরুল ইসলাম গান শুরু করতে যাবেন, এমন সময় দর্শক সারিতে বসে থাকা একজন মৌলভি তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, ইসলামে গান গাওয়া জায়েজ কি না। উত্তরে নজরুল বলেন, ‘বসন্তে কোকিল গাছের ডালে বসে আপনার মনে গান গায়। সে কারও তোয়াক্কা করে না। কাক এসে তাকে তাড়া করলে সে উড়ে যায়। আমিও আমার মনের আনন্দেই গান করবো, যদি আপনারা কাকের মতো আমায় তাড়া করেন, তা হলে চলে যাবো।’ মৌলভির এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন এবং কবির এই অভিনব উত্তরে সভায় তখন কিছুটা শোরগোল লেগে গেছে। সেই শোরগোল ছাপিয়ে হঠাৎ আরেকজন মৌলভি চেঁচিয়ে প্রশ্ন করেন যে, ‘নজরুল নামাজ পড়ে কি না।’ এই প্রশ্ন আমাদের লালসালু উপন্যাসের কাঠমোল্লা মজিদের এই জাতীয় একটি প্রশ্নের কথা মনে করিয়ে দেয়। যাই হোক, নজরুল দৃঢ়ভাবে বলেন যে, নামাজ পড়া না পড়া তার ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং এটা অন্য কারও দেখার বিষয় নয়। সভায় তখন তার পাশে বসে ছিলেন এ কে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২)। বলাবাহুল্য, সেদিন এবং তার পরের দিন নজরুল এই সম্মেলনে অনেকগুলো গান গেয়ে শোনান।
কুচবিহারের একটি মিলাদ মাহফিলে নজরুল এরও চেয়ে গুরুতর একটি আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন। বিখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ (১৯০১-৫৯) ছিলেন এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। মাহফিলে নজরুলকে বক্তব্য দিতে আহ্বান জানানো হয়। তিনি বলেন যে, তিনি কথার মাধ্যমে তার মনের ভাব ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারবেন না, তার ভাব প্রকাশের যথার্থ মাধ্যম হলো গান। অনুমান করি, মিলাদের মতো একটি অনুষ্ঠানে তার এই গান গাওয়ার আগ্রহ উপস্থিত মোল্লা-মৌলভিদের পছন্দ হয়নি। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে আসর-এর নামাজের সময় আসে। যথারীতি সকলেই সমবেতভাবে এই নামাজে অংশ নেন। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু নজরুল; তিনি এই নামাজে অংশগ্রহণ করেননি। অনেকেই এই ব্যাপারটা খেয়াল করেন এবং এই কারণে তার ওপর রাগ জমতে থাকে। নামাজ শেষে আবার আলোচনা শুরু হলে এই রাগ উন্মাদনার রূপ নেয়। এ সময় নজরুল বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তার বক্তব্যে তিনি বলেন যে, এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তার ধর্ম নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই; তার ধর্ম হলো তারুণ্য। ব্রিটিশ শাসনের ওই সময়ে সবার কী করা উচিত সে ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন যে, এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় ধর্ম হলো দেশের জন্য কাজ করা। একটি পরাধীন দেশে তিনি কিভাবে নামাজ পড়বেন এই প্রশ্ন তুলে তিনি তার নামাজ না পড়ার একটি ব্যাখ্যা দিতেও শুরু করেন। এর ফল হলো ভয়ঙ্কর। মাহফিলে উপস্থিত সমবেত ‘ধার্মিকরা’ প্রথমে নজরুলকে গালি দেওয়া শুরু করে; এরপর তারা নজরুলের দিকে তেড়ে আসে ঠেঙিয়ে শায়েস্তা করার জন্য। এই ধর্মরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য কতিপয় তরুণ দ্রুত নজরুলকে ঘিরে ধরে তাকে অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে অন্যত্র নিয়ে যান। বস্তুত গোঁড়া মুসলমানরা বিরামহীনভাবে নজরুলের বিরোধিতা করে গেলেও প্রগতিশীল এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ মুসলমান সমাজ নজরুলকে সবসময় সমর্থন দিয়ে গেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারণের ক্ষেত্রে নজরুল কখনোই তেমন সক্রিয় ছিলেন না। নামাজ-রোজসহ ধর্মের অন্যান্য অনুষঙ্গও তিনি তেমন অনুসরণ করতেন না। ফলে অতোবড়ো লেখক হওয়া সত্ত্বেও তাকে বারবার ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল। ঐ একই সময়ে অর্থাৎ ত্রিশের দশকের আধুনিক কবিদের কয়েকজন ঘোষিত নাস্তিক ছিলেন, জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও তারা হিন্দু ধর্মের কোনো আচার তেমন পালন করতেন না। তবু এঁরা কেউই ধর্মীয় কারণে গোঁড়া হিন্দুদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হননি। নজরুলের জন্য এ ছিল এক যাত্রায় ভিন্ন ফলের মতো। তথাপি ব্যক্তিগত জীবনযাপনে নজরুল এমন কিছু নজির স্থাপন করেছেন, ত্রিশের দশকের ‘মহৎ আধুনিকেরাও’ যা দেখাতে পারেননি। এর একটি উদাহরণ হলো প্রমীলা সেনগুপ্তের (১৯০৮-৬২) সঙ্গে তার বিবাহ। হিন্দু-মুসলিম বিবাহ ওই যুগে সামাজিকভাবে মোটেই সহজ ছিল না। এই ধরনের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দু পাত্র বা পাত্রীকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে হতো। প্রমীলার ক্ষেত্রেও সে প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু নজরুল দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করেছিলেন। বস্তুত তার এই দৃঢ় অবস্থানের কারণে আজীবন প্রমীলা সেনগুপ্ত স্বধর্মে থাকতে পেরেছিলেন।
উল্লেখ্য, নজরুল কেন প্রমীলা সেনগুপ্তকে মুসলমান বানালেন না, তা নিয়েও তখনকার কয়েকটি পত্রিকায় বেশ সমালোচনা হয়েছিল।
আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও আরেকটি উদাহরণ এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। সেটি হলো নজরুলের সন্তানদের নামকরণ। নজরুল যথাক্রমে তার প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ (১৯২৪-২৪) ও অরিন্দম খালেদ (১৯২৬-১৯৩০)। এই দুটি সন্তান অবশ্য শিশু বয়সেই মারা যায়। পরবর্তী সময়ে তার যে দুটি সন্তান বেঁচে ছিল, তাদের একজনের নাম কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম (১৯২৯-৭৪) এবং অপরজন কাজী সব্যসাচী ইসলাম (১৯৩১-৭৯)। নজরুলের সন্তানদের নাম তিনি নিজেই রাখতেন এবং যেসব পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি ছেলেদের নাম ঠিক করতেন, তা থেকে কোন ধরনের ব্যক্তিদের প্রতি নজরুলের অনুরাগ ছিল তা বোঝা যায়। যেমন, প্রথম ছেলের নামের কৃষ্ণ হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান অবতার, আর মোহাম্মদ ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক। দ্বিতীয় ছেলের নামের অরিন্দম শব্দের অর্থ শত্রুদমনকারী। রামায়ণে রাবণপুত্র মেঘনাদকে অরিন্দম বলা হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তও (১৮২৪-১৮৭৩) মেঘনাদবধ মহাকাব্যে ‘অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ’ (মেঘনাদের আরেকটি নাম ইন্দ্রজিৎ) শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। আর খালেদ হলো ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত বীর খালেদ বিন ওয়ালিদ; খলিফা আবু বকরের সেনাপতি হিসেবে তিনি কিংবদন্তি বীরের মর্যাদা পেয়েছেন। একইভাবে অনিরুদ্ধ হলো শ্রীকৃষ্ণের পৌত্রের নাম এবং সব্যসাচী হলো মহাভারতের অর্জুন। কাজী অনিরুদ্ধর ডাক নাম ছিল লেনিন এবং সব্যসাচীর সান ইয়াৎ-সেন/সানি। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (১৮৭০-১৯২৪) রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লবের প্রাণপুরুষ এবং সান ইয়াৎ-সেন (১৮৬৬-১৯২৫) ছিলেন চীনা জিংহাই বিপ্লবের (১৯১১) প্রধান নেতা, যিনি তখন চীনের জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃত। লক্ষ করলে দেখা যাবে, নজরুল তার সন্তানদের নামের মধ্যে সচেতনভাবে হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্য এবং তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিপ্লবীদের নামের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন।
বস্তুত এই হিন্দু-মুসলিমের মিলনই তিনি আজীবন চেয়েছেন। এজন্য নিজে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের জন্য অনেক কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন গীতিকার হিসেবে একই হাতে তিনি ইসলামি গজল যেমন লিখেছেন, তেমনি শ্যামা সংগীত ও শ্রীকৃষ্ণের ভজনও লিখেছেন। আর আগের আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, শুধু হিন্দু ও মুসলমানের ঐতিহ্য এবং উপাসনা সম্পর্কিত কবিতা ও গান লিখেই তিনি দায়িত্ব শেষ করে বসে থাকেননি; বরং নিজেই একাধারে দুই ধর্মের উপাসনা পদ্ধতি চর্চা করেছেন। এই ধরনের উপাসনা চর্চা ভারতবর্ষের আর কোনো পুরোধা লেখকের মধ্যে দেখা যায়নি। আমরা জানি, হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় ক্ষেত্রে অনেক অবতার বা পয়গম্বর রয়েছে; কিন্তু নজরুল ছিলেন যেনো এই দুই সম্প্রদায়ের এক নতুন ধাঁচের কবি-পয়গম্বর—যিনি বাণী দিয়েই মাত্র ক্ষান্ত হননি, নিজে জীবনে তা করে দেখিয়েছেন। এই কবি-পয়গম্বরের ধর্মটিও ছিল তার মতো অনন্য। কোনো বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নামে একে চিহ্নিত করা চলে না। গোলাম মুরশিদ নজরুলের এই ধর্মীয় বিশ্বাসের অভিনব একটি নাম দিয়েছেন: ‘দ্বীন-এ-নজরুল’। বস্তুত ব্যক্তিজীবনে নজরুল যে ধরনের প্রথাবিরোধী ধর্মচর্চায় অভ্যস্ত ছিলেন, পৃথিবীর কোনো ভাষার কোনো প্রধান লেখকের মধ্যে তা দেখা যায় না।
নজরুল রাজনীতি সচেতন ছিলেন, কিন্তু ধর্মের রাজনীতিকরণ এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যযুগীয় উন্মাদনায় সামিল হননি। তার রাজনৈতিক চেতনার পুরোটাই জুড়ে ছিল মৌলবাদ বিরোধিতা; অসাম্প্রদায়িক সেকুলার ও সাম্যবাদী রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর ছিল আজীবন পক্ষপাত। এজন্য তুরস্কের রক্ষণশীল সমাজ ভেঙে যখন মোস্তফা কামাল পাশা (১৮৮১-১৯৩৮) আধুনিক সেক্যুলার তুরস্কের স্বপ্ন দেখেন, তখন নজরুল তাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হন। ধর্মকে নজরুল করে তুলেছিলেন একান্তই ব্যক্তিগত অনুভব ও চর্চার ব্যাপার। তিনি যেমন একহাতে হিন্দুয়ানি ও মুসলমানি গান সফলভাবে লিখতে পেরেছিলেন, ধারণা করা যায়, বাংলায় তখন যদি খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ ধর্মীয় ধারা শক্তিশালী থাকতো, নজরুল হয়তো ওইসব ধর্মেরও উৎকৃষ্ট ভক্তিগীতি রচনা করতেন। কারণ মানবতা, প্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য প্রভৃতি ছিল তার মূল চেতনা।
একুশ শতকের এই অগ্রসর পৃথিবীতে বাস করেও আমরা কি চেতনার দিক দিয়ে নজরুলের সমকক্ষ হতে পেরেছি? নাকি নিজেদের সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক ধর্মবোধ নজরুলের ওপর আরোপ করে তাকে ‘নিজেদের লোক’ ভেবে অশ্লীল আনন্দ পাচ্ছি?
তথ্যসূত্র
১। গোলাম মুরশিদ—‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য: নজরুল মানস সন্ধানে’। অন্ত. মো. মাহবুবর রহমান (সম্পা.)। প্রীতিকুমার মিত্র স্মারকগ্রন্থ। রাজশাহী, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, ২০০৯।
২। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (সম্পা.)। সমকালে নজরুল ইসলাম, ১৯২০-১৯৫০। ঢাকা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ১৯৮৩।
৩। রফিকুল ইসলাম। ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃষ্টি’। দ্বিতীয় সং.। কলকাতা: কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, ১৯৯৭।
৪। রাজনারায়ণ বোস। আত্মস্মৃতি। ৪র্থ সং.। কলকাতা: ওরিয়েন্ট বুক কোং, ১৯৬১।
৫। Priti K Mitra. The Dissent of Nayrul Islam : Poetry and History. Nwe Delhi: Oxford University Press, 2007.শেষ