॥পর্ব-এক॥
নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) যে পরিবারে জন্ম, সে পরিবারের একটি সাধারণ ছবি আঁকলে তা নিয়ে সত্যিই দারুণ বিস্ময় জাগে। তার বাবার নাম ছিল কাজি ফকির আহমেদ। আমরা সাধারণত যে ধরনের আর্থিক অবস্থার মানুষকে ফকির বলে উল্লেখ করি, নজরুলের বাবা ছিলেন প্রায় সেই ধরনেরই একজন দরিদ্র মানুষ; তার ওপর তিনি কোনো লেখাপড়াও জানতেন না। দুটি বিয়ে করেছিলেন, সন্তান হয়েছিল নয়টি। নজরুলের মা ছিলেন তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, নাম জাহেদা খাতুন। নজরুলের জন্মের আগে এই মায়ের চারটি সন্তান মারা যায়। নজরুল ছিলেন তার মায়ের ষষ্ঠ সন্তান। তার নাম যে দুখু মিয়া রাখা হয়েছিল, তা ছিল পুরোপুরি যথার্থ। এই নামকরণ সম্পর্কে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের একটি মন্তব্য দারুণ আকর্ষণীয়। তার মতে, ‘এ মানুষটির জীবনে আর যা কিছুরই অভাব হোক দুঃখের অভাব কোনোদিন হয়নি।’ দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বহুসন্তান, শিশুমৃত্যু, নিরক্ষরতা—যে পরিবারের সঙ্গে এত পশ্চাৎপদ বৈশিষ্ট্য যুক্ত থাকে, সেখানে যে একজন মহৎ কবি জন্মাবেন এবং উত্তরকালে তিনি একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় কবির স্বীকৃতি পাবেন, অস্বাভাবিক কল্পনাপ্রবণ না হলে কারও পক্ষে সে রকম ভাবা সম্ভব নয়।
নজরুলের জন্মস্থান চুরুলিয়া গ্রামটি হিন্দু এবং মুসলিম ঐতিহ্যের দুটি ঐতিহাসিক নিদর্শনের জন্য পরিচিত ছিল। এর একটি হলো রাজা নরোত্তম সিংহের দুর্গ, নজরুলের বাড়ির পূর্ব দিকে এটি অবস্থিত ছিল। ১৯১৭ সালে নজরুল ভগ্নস্তূপ নামে যে কবিতা লেখেন, সেখানে এই স্থাপনার প্রভাব পাওয়া যায়। নজরুলের বাড়ির দক্ষিণ দিকে ছিল পীরপুকুর নামে একটি বিরাট পুকুর। একজন মুসলিম সাধক এই পুকুরটি খনন করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। তবে এই সাধকের নাম পরিচয় বা কোন সময় তিনি এই পুকুর খনন করেছিলেন, তা জানা যায় না। পুকুরের পূর্ব পাড়ে ওই সাধকের একটি মাজার ছিল, পশ্চিম পাড়ে ছিল একটি মসজিদ। নজরুলের পিতামহ থেকে বংশানুক্রমে এই মাজার এবং মসজিদের দেখাশুনার ভার ছিল এই পরিবারের ওপর। এই দেখাশোনার কাজটির জন্য পরিবারটিকে ওই মাজারের খাদেম বলা হতো। ১৯০৮ সালে নজরুলের বাবা মারা যাওয়ার পর দশ বছর বয়সের নজরুল ওই মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন বলে তার অধিকাংশ জীবনীতে দেখা যায়। নজরুলের লেখাপড়া হয়েছিল গ্রাম্য মক্তবে। এই মক্তবে তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষা শিখেছিলেন। পাশাপাশি কিছু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন বলে নজরুলের জীবনী লেখকরা উল্লেখ করেন। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে সংশয় যায় না। বর্ধমানের একটি অজ পাড়াগাঁয়ে হাতুড়ে শিক্ষকের কাছে একটি দশ বছরের শিশুর পক্ষে একসঙ্গে এই তিনটি ভাষা শেখা কতটুকু সম্ভব, সেটি যুক্তিযুক্তভাবে ভাবা দরকার। এমনকি নজরুলের সেসব ভাষা শিক্ষকদেরও এই ভাষাগুলো কতটুকু এবং কোন মাত্রায় জানা সম্ভব ছিল, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নও করা যেতে পারে। তার ওপর নজরুলের বাড়িতে বই পড়িয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। ফলে বড়জোর ওইসব ভাষার গুটিকতক শব্দ একপ্রকার না বুঝে মুখস্ত করা ছাড়া নজরুলের বিশেষ কোনো ভাষাগত জ্ঞান অর্জিত হয়েছিল বলে মনে হয় না। যাই হোক, লেখাপড়া যেমনই হোক না কেন, মক্তবের পাঠ শেষ করার পরপরই তিনি ওই মক্তবে একজন মোল্লার চাকরি পেয়েছিলেন। তখন তার বয়স সবে দশ পেরিয়েছে। দশ বছর বয়সের একটি শিশু মক্তবে ইসলামি জ্ঞান শিক্ষা দিচ্ছে, এবং তা ওই গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মুসলমানরা মেনে নিচ্ছে—ঘটনার মধ্যে কিছু অতিরঞ্জন ঘটেছে কি না, সন্দেহ হয়। এখানে একটা সম্ভাবনা প্রবল। সম্ভাবনাটি হলো, গ্রামের মক্তবটির লেখাপড়া ছিল নেহায়েতই দায়সারা গোছের। ফলে খাদেম পরিবারের একজন কোনো রকমে ঠেকা দিয়ে মক্তবটি চালিয়ে নিচ্ছে, এটুকুতেই হয়তো গ্রামবাসী তুষ্ট ছিল।
চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীর জ্ঞান নিয়ে ওই সময় অনেকেই গ্রাম্য পাঠশালা কিংবা মক্তবে শিক্ষকতা করতেন। নজরুলের ক্ষেত্রেও সে রকম ঘটে থাকবে। আর ধর্মীয় জ্ঞানের ব্যাপারে বর্তমান সময়ের মতো এত সচেতনতা ও বাছবিচার তখনকার অভিভাবকদের ছিল না; ফলে গ্রামবাসীরা যে তাকে মক্তব্যের শিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন, তা তেমন অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। যাই হোক, এই সময়ে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি আরেকটি কাজ পেয়েছিলেন। সেটি হলো মসজিদে আজান দেওয়া। তবে তার এই মোল্লাগিরি ছিল নিতান্তই অল্প সময়ের এবং আক্ষরিক অর্থেই অল্প বয়সের ব্যাপার। পরিণত বয়সে তার মধ্যে এই জাতীয় কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায় না। বরং একপ্রকার উল্টোপথে যাত্রা এবং উল্টোরথে আরোহণকেই তিনি তার ভবিতব্য বলে বেছে নিয়েছিলেন।
জীবৎকালে বা আরও খোলসা করে বললে ১৯২২-২৩ সালে থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী একদশকে তিনি প্রায় হঠাৎ করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিলেন। প্রত্যেক যুগেই এ রকম দুই-একজন প্রতিভাবানের দেখা মেলে যারা বছর দশেক তীব্র আলোড়ন তুলে তারপর একপ্রকার হারিয়ে যান। পরবর্তী যুগে এসব হঠাৎ উত্তেজনা সৃষ্টিকারীদের অনেকের নামও লোকে মনে করতে পারে না। নজরুল এক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রমই ছিলেন না, ছিলেন একবারে অনন্য। অথচ এই লোকটির সাহিত্যচর্চার মেয়াদ ছিল সাকুল্যে মাত্র বিশ বছর। ১৯৪২ সালের পরে তিনি সাহিত্যচর্চা তো দূরের ব্যাপার, মুখের কথাটি পর্যন্ত বলতে পারতেন না। শারীরিকভাবে এরপর তিনি ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে বাকরুদ্ধ-বুদ্ধিরুদ্ধ হয়ে গোটা পাকিস্তান আমলের চব্বিশ বছর, বাংলাদেশ আমলের পাঁচ বছর তিনি বেঁচে থাকলেন নির্বাক হয়ে। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান সৃষ্টি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, মহাত্মা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষের হত্যাকাণ্ড—রাজনীতি ও সংস্কৃতি জগতের এসব বিরাট পালাবদল চোখের সামনে ঘটতে দেখেও তিনি হয়তো এর কিছুই বুঝতে পারেননি। তিনি নিজে যে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মান পেয়েছেন, মস্তিষ্কের অক্ষমতার কারণে তাও বুঝতে পেরেছিলেন কি না, সন্দেহ হয়। জীবনের সবচেয়ে পরিণত ও ফলবান সময়টিতেই তিনি চিন্তা ও ভাষা প্রকাশের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্ত যে অল্প সময় তিনি লিখতে ও বলতে পেরেছিলেন, তা তুমুল নিন্দা ও প্রশংসা কুড়োয়। তার যুগপৎ এই নাম ও বদনামের একটি উপলক্ষ ছিল ধর্ম। তিনি কতবড় মাপের প্রতিভাবান, একসময় সেই আলোচনার চেয়ে প্রধান হয়ে উঠেছিল তিনি আর পাঁচজনের মতো ধর্মকর্ম করেন কি না। এই বিতর্ক এমনই স্থূল এবং রুচিহীন হয়ে পড়েছিল যে, নজরুল নিজেই এর একটা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। তার ‘কৈফিয়ত’ কবিতাটি লেখা হয়েছিল আসলে একরকম ব্যক্তিগত কৈফিয়ত দেওয়ার জন্যই। এই কবিতায় তিনি বলেছিলেন যে, ধর্মান্ধ মুসলমানরা তাকে কাফের বলে ফতোয়া দেয়। কিন্তু এই কারণে ধর্মান্ধ হিন্দুদের কাছ থেকে তিনি বাহবা পান না। বরং তাদের বিবেচনায় তিনি একটা ‘পাতি নেড়ে’!
সম্প্রতি ধর্মকর্ম নিয়ে এমন একটা পুরানো হাওয়া আবার বইতে শুরু করেছে। যে কেউই এখন যাকেতাকে চট করে প্রশ্ন করে বসছে যে সে ধর্মকর্ম করে কি না? যদি কোনোভাবে প্রশ্নকারীর মনে হয় যে, অমুক ঠিকঠাক মতো ধর্ম পালন করেন না—তা তিনি যতো বড়ো প্রতিভাবান বা মেধাবী মানুষ হন না কেন—তাহলে রাস্তায় মিছিল করে তাঁর ফাঁসি পর্যন্ত চাওয়া যাচ্ছে। অস্বস্তিকর এই ধর্মান্ধ হট্টগোলে নজরুলের জীবনাচারণে ধর্ম কিভাবে অনুসৃত হতো, তা নিয়ে একদফা আলোচনা করা যেতে পারে। এই আলোচনায় নজরুলকে বেছে নেওয়ার অবশ্য একটি কারণ রয়েছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ধর্মান্ধ বা জেহাদি কিংবা মুক্তমনা মানুষ এরা অনেকেই নজরুলের নানা পংক্তি তাদের ভাবাদর্শের অনুকূলে কোট করছেন। ফলে নজরুলের ধর্ম পালন যে ঠিক কেমন ছিল এবং তিনি যে ঠিক কোন অধ্যাত্ম চেতনার লোক ছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তা বোঝা মুস্কিল হয়ে পড়েছে। নজরুলের ধর্ম জীবন নিয়ে তাই একদফা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
আগেই বলা হয়েছে নজরুলের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল একরকম মোল্লাগিরি দিয়ে। অল্প বয়সে পিতা হারানোয় তাঁকে অকালে এই আয়ের পথে নামতে হয়েছিল। দশ-এগারো বছরের নজরুল মাথায় একটা মুসলমানি টুপি পরে সামনে বসে থাকা কতিপয় গ্রাম্য ছাত্রকে আরবি, ফারসি ও উর্দু পড়াচ্ছেন; আর তার ছাত্ররা শরীরে দোল দিয়ে দিয়ে তা মুখস্থ করছে—নজরুলের সারা জীবনের বিদ্রোহী বা প্রেমিক বা সৈনিক কোনো ধরনের ইমেজের সঙ্গে এই দৃশ্য মেলানো যায় না। কিন্তু অবস্থার ফেরে পড়ে তাকে তাই করতে হয়েছিল। অনুমান করা যায়, এ সময় তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। কারণ, এমন একটি পেশায় তিনি ছিলেন, নিয়মিত নামাজ না পড়লে চাকরিটাই চলে যেতে পারতো। কিন্তু এই হুজুরগিরি সম্ভবত নজরুলের নিজেরও পছন্দ ছিল না। মাত্র বছর খানেক পরেই তিনি এই কাজ ছেড়ে দেন; বলা চলে আজীবনের জন্য ছেড়ে দেন। এরপর যেখানে তিনি যোগ দেন, সেটা মোটেই ইসলামিক জায়গা ছিল না। বরং গোড়া কোনো মুসলমান জায়গাটিকে রীতিমতো কাফেরি জায়গা বলে ফতোয়া দিতে পারেন। সেটি হলো ‘লেটোর দল’। লেটোর দল হলো গ্রাম্যভাবে গড়ে ওঠা যাত্রা গানের দলের মতো একপ্রকার পালা গানের দল। এরা বিভিন্ন পর্ব উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে মজুরির বিনিময়ে বিভিন্ন পালা অভিনয় করে দেখাতো। নাচ, গান, অভিনয়, বাদ্যযন্ত্র বাজানো এসব নানা রকম মনোহারি বিনোদন উপকরণ দিয়ে সাজানো এই লেটোর গান ছিল তৎকালীন বর্ধমান এলাকার অন্যতম গ্রামীণ বিনোদন। লেটোর আসর গ্রাম্য লোকশিল্পীদের একরকম কেরামতি দেখানোর জায়গাও ছিল।
নজরুল প্রতিভার প্রথম কেরামতিও এই লেটোর দলেই শুরু হয়। এখানে তার মূল ভূমিকা ছিল গান গাওয়া ও নাচা। তবে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি নিজেই একজন জাঁদরেল পালাকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সাধারণত লেটো গানের বিষয় ছিল হিন্দু পুরাণের নানা কাহিনী। নজরুলও মোটামুটি এইসব পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে পালা লিখতে শুরু করেছিলেন। যেসব পালা তিনি লিখেছিলেন তার মধ্যে ‘মেঘনাদ বধ’, ‘দাতাকর্ণ’, ‘শকুনীবধ’, ‘রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ’ নামক চারটি পালা অন্যতম। এসব পৌরাণিক পালার পাশাপাশি আকবর বাদশা ও চাষার সঙ নামে দুটি পালাও তিনি লেখেন। এই সময় নজরুল ইসলামের ধর্মীয় জীবন যাপনের কোনো প্রমাণ মেলে না। পরিবার থেকেও তিনি অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে একরকম বাউণ্ডুলে ধরনের স্বাধীন জীবন বেছে নিয়েছিলেন। এরপর কিশোর বয়সেই অন্তত তিনটি পেশায় তিনি জড়ান, যার একটিও মর্যাদার দিক দিয়ে উঁচু দরের নয়। প্রথমটি হলো রুটির দোকানের সহকারীর চাকরি, দ্বিতীয়টি রেলওয়ের গার্ডের ভৃত্য এবং তৃতীয়টি এক দারোগার বাড়ির কাজের লোকের চাকরি।
চলবে…