॥পর্ব-এক॥
চিত্রকল্প মূলত কবিতার অলঙ্কার-উপকরণ। তবে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের লেখা গান অনেক ক্ষেত্রেই একইসঙ্গে উৎকৃষ্ট কবিতা বলেও এসবের মাঝে চিত্রকল্প, কল্পচিত্র, উপমা, ব্যঞ্জনা, অনুপ্রাস, ছন্দ প্রভৃতি অলঙ্কার ব্যবহৃত হয়েছে। গানের অবয়বজনিত সীমাবদ্ধতা ও ছন্দজনিত বাধ্যবাকতার মধ্য থেকেও রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলসঙ্গীতের বাণীতে এসব অলঙ্কারের শিল্পসফল ব্যবহার আমাদের চমৎকৃত করে। নজরুলসঙ্গীতের বাণীর বৈভব সৃষ্টিতে প্রচুর অভিনব চিত্রকল্প সফল ভূমিকা পালন করেছে। নজরুলসঙ্গীতের কাব্যগুণ পর্যালোচনা আমাদের কেন্দ্রীয় বিষয় বলে নজরুলসঙ্গীতের বাণীর মধ্যে মধ্যে সৃষ্ট চিত্রকল্প-বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। চিত্রকল্প নিয়ে কারও কারও মনে ভ্রান্ত ধারণা লক্ষ করা যায়, তারা মনে করেন, এটি চিত্র বলে স্থিরতা বা জড়তাকে ব্যঞ্জিত করে। বিষয়টি মোটেও তা নয়। নানা ধরনের চিত্রকল্প হয়। স্রোতের চিত্রকল্প, পাখির আকাশে ওড়ার চিত্রকল্প, পথিকের চলার চিত্রকল্প, ভাবনার চিত্রকল্প—এভাবে ভাবলেই বোঝা যায়, চিত্রকল্পের ধরন নির্ভর করে অলঙ্কারটির বিষয়ের শ্রেণীর ওপর। এটি খাতায় আঁকা ছবির মতো নিশ্চল নিরাবেগ কোনোকিছু নয়।
কাজী নজরুল ইসলাম এক স্বতন্ত্র ধরনের কবি-গীতিকার; যার সঙ্গে তাঁর পূর্ব-পরকালের কোনো কবি-গীতিকারের তুলনা করার অবকাশ নেই। তিনি একইসঙ্গে রোমান্টিক ও আধুনিক কবি-গীতিকার। তাঁর পা দুটো মাটিতে কিন্তু হাতদুটো সম্প্রসারিত হয়ে ছুঁতে চায় আকাশ। তিনি প্রচণ্ড বাস্তববাদী দৃষ্টির অধিকারী আবার একইসঙ্গে দুরন্ত স্বপ্নচারী। বিদ্রোহী, বিপ্লবী, আবার গভীর-নিবিড় প্রেমিক। যে নজরুল যুদ্ধক্ষেত্রের অকুতোভয় সৈনিক, সেই কবিই ফুলবাগানের সৃজনশীল মালি। তাঁর সব সৃষ্টিকর্মে এই অদ্ভুত দ্বৈতসত্তার প্রভাব ফলে উঠেছে অনন্যতায়। এই অনন্যতার ছায়া পড়েছে তাঁর কবিতা-গানের বাণীর উপমায়, উৎপ্রেক্ষায়, চিত্রকল্পে ও কল্পচিত্রে। প্রখ্যাত কাব্যবিশারদ আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর ‘চিত্রকল্পের সম্রাট’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘কাজী নজরুল ইসলামই—আরো অনেক কিছুর মতো, বাংলা কবিতার প্রথম সম্পূর্ণাঙ্গ চিত্রকল্পী কবি—চিত্রকল্পের প্রথম সম্রাট। অন্যেরা নজরুলের দ্রোহ প্রধান বা ইসলামী কবিতায় যখন উল্লসিত, তখন তাঁরই সমবয়সী একজন কবি নজরুলের এই নিহিত চারিত্রের পথ ধরে নিজেকে করে তুললেন অমোঘ—বাংলা কবিতার চিত্রকল্প-সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট—জীবনানন্দ দাশ।’ (চিত্রকল্পের সম্রাট: আবদুল মান্নান)।
নজরুলের হাতে বাংলা কবিতা ও গান পেয়েছে নতুন নতুন চিত্রকল্প। এসব চিত্রকল্প সংখ্যায় অগণিত এবং বৈশিষ্ট্যে অভিনব । শুধু চিত্রকল্প দেখেই অনুমান করা যায়, এসব কবিতা বা গান নজরুলের রচনা। তবে কবিতার চেয়েও নজরুলের গানে চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে অধিকতর দ্যুতিময় ও ব্যঞ্জনাগর্ভ। তাঁর গানে ব্যবহৃত চিত্রকল্পগুলো হীরকখণ্ডের মতো মূল্যবান ও প্রভাময়। নজরুলের গানে ব্যবহৃত চিত্রকল্প বিষয়ে কাব্যসমালোচক শাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছেন: ‘শুধু এই নয় বাংলা গানে তিনি কেবল পারস্যের বুলবুল, শরাব, সাকী, গোলাব, নার্গিস আর দিলরুবা নিয়ে এলেন। বাংলার আকাশ, মেঘ, তার ষড় ঋতু, তার শ্যাম বনানী, নদী, দিঘি, তার ময়ূর, পিক ও পাপিয়া, তার চাঁদ, তার নক্ষত্র, তার বনফুল, তার ঘাস, ঘাসের শিশির, কমল, কুমুদ; এবং তার উজ্জ্বল শরীরে এদের ব্যবহার করলেন রত্নালঙ্কারের মত। এক শঙ্কর ভূষণে অলঙ্কৃত হয়ে উঠল তাঁর গীতবাণী। তাঁর গান শুধু অক্ষর দিয়ে সাজানো ভাষা নয়, অকম্প্র রেখায় অঙ্কিত ছবি। বাংলা ভাষায় বর্ণোচ্ছল এতো ছবি এঁকে ইতোপূর্বে আর কেউ গান লেখেন নি। তাঁর গানের জগতে ঢুকলে মনে হয় আমরা যেন বিশাল এক আর্ট গ্যালারিতে প্রবেশ করেছি। অজ¯্র উজ্জ্বল ছবিতে যার দেয়াল আকীর্ণ। সে ছবি শুধু আবার ক্ষয়িষ্ণু পেন্সিল স্কেচ, জলরঙা ছবি নয়—তা যেন ভাস্কর, স্থপতি ও চিত্রকরের সম্মিলিত সাধনায় আঁকা অক্ষয় প্রস্তরের দেয়ালচিত্র। যেন তা কালক্রমে মুছে আতঙ্কে সজাগ রেখে আঁকা হয়েছে।
একটির পর একটি নজরুলের গানের বই পড়ুন, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টান, পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি দেখুন—দেখবেন কেবল স্তবকে নয়—পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে, পঙ্ক্তির পর্বে পর্বে, কখনো শব্দেশব্দে শুধু ছবি আর ছবি। ’( নজরুল-সংগীতের বৈশিষ্ট্য: শাহাবুদ্দীন আহমদ)
চিত্রকল্পের সংজ্ঞা দিয়ে গিয়ে এজরা পাউন্ড বলেছেন, An ‘Image’ is that which presents an intellectual and emotional complex in an instant of time.
চিত্রকল্পের মধ্যে বুদ্ধি, আবেগ ও সময়ের ত্রিমুখী মিথস্ক্রিয়া বর্তমান। চিত্রকল্প শুধু ছবি নয়, এ হচ্ছে ছবির জীবন্ত সত্তায় উন্নীত হওয়া। বিষয় নানা ধরনের বলে চিত্রকল্পও নানা রকমের হয়। নজরুলসঙ্গীত সংরক্ত আবেগের সৃষ্টি। সেজন্য নজরুলসঙ্গীতের বাণীর মধ্যে ব্যবহৃত চিত্রকল্পগুলো জীবন্ত ও গতিশীলতার ব্যঞ্জনায় ভরপুর। এসব চিত্রকল্পময় বাণী পাঠকালে অথবা শোনার সময় আমাদের অনুভূতি নাড়া দেয়, আবেগে দোলা লাগে, প্রাণে সাড়া জাগে। এসব চোখ দিয়ে দেখার জিনিস নয়, সংবেদনশীলতা দিয়ে অনুভবের বিষয়। নজরুলের গানের চিত্রকল্পের আলোচনায় এমনটাই দেখতে পাবো।
কাজী নজরুল ইসলামের গানে প্রথমেই চোখে পড়ে প্রাকৃতিক চিত্রকল্প। প্রকৃতিকে উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি এমন সব চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন, যা বাংলা কবিতা-গান-কথাসাহিত্যে আগে ছিল না (?)। ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ ’—এ ধরনের চিত্রকল্প তিনিই প্রবর্তন করেছেন। কয়েকটি শব্দের তুলিতে অঙ্কিত এই ছোট একটি চিত্রকল্পে বিশাল প্রকৃতির ছবি ফুঠে উঠেছে অনিঃশেষ সৌন্দর্যের রঙ মেখে। তার বড় কথা হচ্ছে—প্রকৃতি এখানে জীবন্ত সত্তায় উন্নীত হয়েছে। বিশাল পাহাড় তার জননী-জনক আকাশের কোলে হেলান দিয়ে নিদ্রারত এই কল্পনাটি প্রকৃতিকে সপ্রাণ চলনক্ষম সত্তায় উন্নীত করেছে। এই একটি চরণে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে, তা একাধারে সুন্দর ও সাবলাইম। তেমনিভাবে ‘চন্দ্র ঘুমায় গগন-তলে সাদা মেঘের আঁচল পেতে’ আরেকটি চমৎকার চিত্রকল্প, যা প্রকৃতিকে সজীব সত্তায় উন্নীত করেছে এবং তার পারিবারিক অবস্থানের ভঙ্গিটিকে সৌন্দর্যের চূড়ায় উপনীত করেছে। অনুরূপভাবেই একটি সম্পূর্ণরূপে অভিনব চিত্রকল্প হচ্ছে, ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশীতে / ছুটে তরঙ্গ বাসনাভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে।’ চাঁদনীরাতে পুকুরের স্বচ্ছ জলে প্রতিবিম্বিত চাঁদের ছবি এবং মৃদুবায়ে সৃষ্ট তরঙ্গ-উদ্ভূত জলভাঙ্গা ছবির সিরিজে চাঁদের ছবির সঙ্গে চাঁদের ছবির অঙ্গাঙ্গি-ছবিকে কবি পারসোনিফিকেশনের মাধ্যমে একটি রোমান্টিক জীবন্ত ও চলন্ত রূপ দান করেছেন। বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে একটি প্রাণহীন ছবি জীবন্ত রোমান্টিক প্রেমদৃশ্য হয়ে উঠেছে। চাঁদ বা চাঁদমুখ নিয়ে কাব্যকথা মোটেও নতুন নয়, কিন্তু চাঁদ নিয়ে এমন চিত্রকল্প একান্তই অভিনব, অনুপম ও অনিন্দ্যসুন্দর। ‘বকুল চাঁপার বনে কে মোর চাঁদের স্বপন জাগালে / অনুরাগের সোনার রঙে হৃদয়-গগন রাঙালে ।’ চিত্রকল্পটি অনুরাগ-রাঙা হৃদয়ের স্বপ্নীল মুগ্ধতাকে জোছনা-ধোয়া সৌন্দর্যের প্রলেপে মুড়িয়ে উপস্থাপন করেছে যা বারবার দেখেও পুরোনো হয় না, ক্লান্তি জমে না চোখে। ‘অনুরাগের সোনার রঙ’কল্পচিত্রটি পুরো চিত্রকল্পটিকে অভিনব ও অনিঃশেষ নান্দনিক মহিমা দান করেছে। ‘কথা কও, কও কথা, থাকিও না চুপ করে/ মৌন গগনে হের কথার বৃষ্টি ঝরে’—এই চিত্রকল্পটি শুধু অভিনবই নয়, অতুলনীয়ভাবে সুন্দরও বটে। কথার বৃষ্টি কি হয় আসলে? হতে পারে তা কথার গুণেই। মৌনতা যদি আকাশ হয়, তবে কথারা হবে বৃষ্টিধারা। আকাশ তো কথা বলে না। তাই সে মৌন বা মহামৌন। আর বৃষ্টি মানে শব্দ এব মৌনতাভাঙ্গা শব্দ। বৃষ্টি মানে শান্তি । বৃষ্টি মানে স্বস্তি। বৃষ্টি মানে প্রাণজুড়ানো পরশ।
কথা তো একতরফা বেশিক্ষণ বলা যায় না। অথচ কথা বলা ও শোনা ছাড়া শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। প্রিয়জনের মুখের কথার মতো মিষ্টি, শান্তিদায়ক, স্বস্তিদায়ক আর কিছুই নেই। অতএব কথা কও। বুক ভরা আকুলতা প্রকাশিত হতে চায় কথায়। অর্থাৎ প্রিয়জনের আকুলতাভরা মৌনতা মানেই না-ঝরা বৃষ্টিধারা। ‘মৌন গগনে হের কথার বৃষ্টি ঝরে।’—এই কয়েকটি কথার মাধ্যমে সৃষ্ট চিত্রকল্পে নজরুল অনেক বড় কথা, বড় ভাব, বড় অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কল্পনার ছবি এঁকেছেন বাস্তবের রঙতুলি সহযোগে। গানের গ্যালারি সজ্জিত হয়ে উঠেছে বাস্তবের রঙমাখা কল্পনার চিত্রকল্পে। ‘তোমার বিনা-তারের গীতিবাজে আমার বীণা-তারে ’—সূচক গানটির একটি চিত্রকল্প এমন: ‘পালিয়ে বেড়ায় উদাস হাওয়া গোপন কথার ফুল ফুটিয়ে গো / আমি তারে মালা করে লুকিয়ে রাখি বক্ষে নিয়ে গো ।’ কী অপূর্বসুন্দর চিত্রকল্প ! বাতাসের কাজ ফুল ফোটানোয় সহায়তা করা। কিন্তু এখানে কথার ফুল। উদাস হাওয়া ফুল ফোটাচ্ছে আর কবি সেই ফুল চয়ন করে তা দিয়ে মালা গেঁথে লুকিয়ে রাখছেন বুকের ভেতরে। হাওয়া ছাড়া শব্দ হয় না। হাওয়ার কম্পন ছাড়া শব্দ সৃষ্টি হয় না। হাওয়ার মাধ্যম ছাড়া শব্দ পরিবাহিত হয় না। আর কথা মানেই শব্দ। উচ্চারিত সুরেলা শব্দরাজি অর্থাৎ গান প্রেরকযন্ত্র বা ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে তা বেতার বা ট্রানজিস্টারের মাধ্যমে শ্রোতার মুগ্ধশ্রবণে পৌঁছে অনুরক্ত হৃদয়ে ঠাঁই করে নেওয়ার বিষয়টি একটি বিজ্ঞানছোঁয়া চিত্রকল্পের মাধ্যমে চিত্রায়িত করেছেন নজরুল। এই চিত্রকল্প একইসঙ্গে অভিনব ও শিল্পসফলতায় অতুলনীয়ভাবে উপভোগ্য। সুখ-দুঃখ বিরহ-মিলন অভিমান-আকুলতা ভুল-শুদ্ধতার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা পার্থিব নারীর শাব্দিক ছবি আঁকতে গিয়ে নজরুল সৃষ্টি করেছেন এমন এক চিত্রকল্প যা পূর্ব-দৃষ্টান্তহীন এবং সাফল্যে তুলনারহিত: ‘নয়নভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল / ফুল নেবো না অশ্রু নেবো ভেবে হই আকুল।’ প্রেমের কবি নজরুল নশ্বর প্রেমের অবিনশ্বর ছবি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যখন বলেন, ‘মনে পড়ে আজ সে কোন্ জনমে বিদায়-সন্ধ্যাবেলা / আমি দাঁড়িয়ে রহিনু এপারে, তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা।’ তখন হাজার বিরহ, মৃত্যু, শতাব্দী-সহস্রাব্দ অতিক্রম করে বেঁচে থাকা মানবীয় প্রেমের মহাচিত্রকল্প রচিত হয়ে যায় সুরের রেখায় শব্দের তুলিতে ভাষার আকাশে। অথবা যখন বলেন, ‘মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম নদীর চরে / যুগল রূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে ’, তখন প্রেমের মৃত্যুঞ্জয়ী জীবন্ত প্রতিমার অধিষ্ঠান ঘটে ভাবনা-দর্শনের সোনার সিংহাসনে। এটি এমনই একটি চিত্রকল্প যার মাঝে বাধা পড়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী মহাজীবন ও কালজয়ী মহাকাল এবং সর্বজয়ী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে প্রেম।
জন্মান্তর আছে কি নেই তা প্রমাণসাপেক্ষ নয়, তা শুধু কল্পনা বা বিশ্বাসের ব্যাপার। কিন্তু দুটি লাইন কবিতা হিসেবে পাঠের সঙ্গে সঙ্গে কিংবা গানের চরণ হিসেবে শোনামাত্রই আমাদের মানসনেত্রে প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে জন্ম-জন্মান্তর পরিক্রমণ করে টিকে থাকা/ফিরে আসা প্রেমিক-প্রেমিকার নানাবিধ যুগল ছবি এবং তা আমাদের বিশ্বাসের বাছবিচারহীন তাৎক্ষণিক সম্মতি আদায় করে নেয়। আর পুরো গানটির স্থায়ী-অন্তরা-সঞ্চারীতে সমাবিষ্ট একাধিক চিত্রকল্প কল্পনা, ভাবনা বিশ্বাসকে নিয়ে যায় কাল থেকে কালে, জনম থেকে জনমে, জীবনের এক উঠোন থেকে আরেক উঠোনে। ‘ ওগো প্রিয় তব গান! আকাশ-গাঙের জোয়ারে উজান বাহিয়া যায়।’এই চিত্রকল্পটিও অসাধারণ, অনন্য ও অপূর্বসুন্দর। আকাশ, গাঙ, জোয়ার, উজান, বেয়ে যাওয়া এসবই দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয় এবয় আমাদের সুপরিচিত। তেমনি গানও আমাদের নিত্যদিনের চেনাজানা উপভোগের বিষয়। প্রিয়জনও খুব চেনাজানা মানুষ। তার মানে—চিত্রকল্পটির প্রতিটি শব্দচিত্র বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। কিন্তু পুরো চিত্রকল্পটি একটি মধুর কল্পনা, একটি সুমষ্টি ভাবনা, একটি গভীর আকুলতাকে ধারণ ও উপস্থাপন করেছে। এসবের কোনোটিই দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়, স্পর্শযোগ্য নয়। এগুলো সবই অরূপ বা বিমূর্ত বিষয়। এভাবেই নজরুল বিমূর্ত বিষয়কে মূর্ত অনুষঙ্গ সহযোগে রূপের পরিসীমায় এনে প্রতিমূর্ত করে তুলেছেন। কল্পনা আর বাস্তব বাঁধা পড়েছে অভিন্ন বাঁধনে অভিন্ন ভূগোলে। আর সবকিছু মিলিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে কালজয়ী সোনালি শিল্পসৌধ। নজরুলের একটি সুবিখ্যাত গান ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি চোখের চাওয়ায় ’। এ গানেও একাধিক সুন্দর চিত্রকল্পের সাবেশ ঘটেছে। সেসবের মধ্যে অতুলনীয় সুন্দর একটি চরণ, একটি চিত্রকল্প , ‘চমকে ওঠে মোর গগন ঐ হরিণ-চোখের চাওয়ায় ’— যা দেখে চমকিত হয়ে ওঠে পাঠকশ্রোতার হৃদয়-মন-মেধা-অভিজ্ঞতা। যার মায়াবি-সুন্দর চোখের চাওয়ায় আনন্দে বিস্মিত-চমকিত হয়ে ওঠে সর্বদর্শী আকাশ, তার স্পর্শে পাষাণের ঘুম ভেঙে যাবে, তার বুক চিরে বইবে সুরের ঝরনাধারা, সেটাই স্বাভাবিক । কিন্তু কোনো মানুষের সম্মোহন শক্তিকে এভাবে চিত্রায়িত করা অতুলনীয় কাব্যশক্তি-কল্পনাশক্তির পরিচয়বাহী যার অধিকারী ছিলেন নজরুল। নজরুলের ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’’ শীর্ষক গানটির প্রতিটি অন্তরা বা অনুচ্ছেদ একেকটি অভূতপূর্বসুন্দর চিত্রকল্প, যা নন্দনতত্ত্বের বিচারে এককথায় ভয়ঙ্করসুন্দর বা সাবলাইম। কিন্তু তার ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর / ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়’— এই প্রথম দুটি চরণে সৃষ্ট চিত্রকল্প অভিনবত্বে, ব্যঞ্জনায়, আনন্দের আবহ সৃষ্টিতে, গতির প্রচণ্ডতা বোঝাতে, ঝড়ের ভয়াবহতা উপস্থাপনে, সুর-তালের ঝঙ্কার সৃষ্টিতে, ধ্বংসের পাশাপাশি সৃষ্টির বারতা প্রকাশে এবং সর্বোপরি পাঠকশ্রোতার মনে-মেধায়-বিশ্বাসে-রুচিতে-অভিজ্ঞতায় গভীর-নিবিড়-প্রবল আবেদন সৃষ্টিপূর্বক জায়গা করে নিতে এতটাই সফল যে, তা পাঠকশ্রোতার শোনামাত্রই সেই আবেদনের সঙ্গে শতভাগ একাত্ম হয়ে ওঠে। লাইনগুলো পড়ার বা শোনামাত্রই কালবোশেখী ঝড়ের ভয়ঙ্কর সুন্দর চেহারা তার ধ্বংসের তাণ্ডব, প্রবল বৃষ্টির ধারাপাতসহ নতুন সাফল্যগর্ভ সম্ভাবনার পতাকার ছবি হয়ে ভেসে ওঠে মানসনেত্রে। এভাবেই চিত্রকল্পসমৃদ্ধ কথাগুলো প্রবাদের মতো মুখস্থ উচ্চারণের স্থায়ী মর্যাদা লাভ করেছে। এমন চিত্রকল্পের সঙ্গে বাঙালি পাঠকশ্রোতার পূর্বপরিচয় ছিল না (!)।
বিশেষত নজরুলের গজলগানগুলোর প্রতিটাই আলাদা আলাদা অভিনব চিত্রকল্পের গ্যালারি। ‘এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বলো কে / টলমল জল-মোতির মালা দুলিছে ঝালর-পলকে ’, ‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী / খুলে দাও রঙ-মহলার তিমির দুয়ার ডাকিলে যদি ’, ‘আমার কোন্ কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন্ সোনার গাঁয় / আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায় ’, ‘করুণ কেন অরুণ আঁখি দাও গো সাকি দাও শরাব ’, ‘খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে ’, ‘ চাঁদের পিয়ালাতে আজি জোছনা-শিরাজী ঝরে ’, ‘সাহারাতে ফুটলো রে রঙীন গুলে লালা’, ‘পলাশ ফুলের মউ পিয়ে ঐ বউ কথা কও উঠলো ডেকে’, ‘ ঐ জলকে চলে লো কার ঝিয়ারী / রূপ চাপে না তার নীল শাড়ী’, ‘বাদলা কালো কান্তা আমার রিমঝিমিয়ে ’, প্রভৃতি চরণ এবং চিত্রকল্প বাংলা কবিতাগানের রাজত্বে এককভাবেই নজরুলের আমদনি। প্রত্যেকটি চরণে এক একটি মনোহর দৃশ্য বাস্তবতা ও কল্পনার সমন্বিত রঙতুলিতে ফুটে উঠেছে যা একইসাথে অভিনব এবং চিত্তাকর্ষক ।
অনুরূভাবেই তাঁর অনেক গানের চিত্রকল্পযুক্ত চরণ প্রবাদের মতো মুখস্থ বাণীতে উন্নীত হয়েছে। যেমন ‘আজো মধুর বাঁশরী বাজে/ গোধুলি লগনে বুকের মাঝে’, ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরি একা ’, ‘করুণ কেন অরুণ আঁখি দাও গো সাকি দাও শারাব ’, ‘ বাজলো কি রে ভোরের সানাই নিদ-মহলার আঁধার-পুরে’, ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি ’, ‘আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয় আমার কথার ফুল আমার গানের মালা গো/ কুড়িয়ে তুমি নিও ’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল’, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিস না আজি দোল’, ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো’, ‘শূন্য আজি গুলবাগিচা যায় কেঁদে দখিন হাওয়া’, ‘শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে / বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে’, ‘ ঐ জলকে চলে লো কার ঝিয়ারী / রূপ চাপে না তার নীল শাড়ি’, ‘ একেলা গৌরী জলকে চলে গঙ্গাতীর’, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘূর্ণিবায় / জল তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে সে যায় ’, ‘চমকে চমকে ধীর ভীরু পায় / পল্লী বালিকা বনপথে যায়, একেলা বনপথে যায় ’, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই ’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার ’— প্রভৃতি চরণ মানুষের মুখস্থ এবং এসব চরণের প্রতিটিই এক একটি সুন্দর চিত্রকল্প বা চিত্রকল্পপ্রায়।
চলবে…