পর্ব-১২ ॥ ত্রিবেণী কী?
সাধারণত মেয়েদের মাথার চুল লম্বা হয়। ওই লম্বা চুলে তারা বেণী করেন। ওরকম তিনটি বেণীর সমাহার হচ্ছে ত্রিবেণী। এটি ত্রিবেণীর একটি সাদামাটা অর্থ। আবার সাহিত্যিকরা বেণী দিয়ে বাঁধা খোঁপাকেও ত্রিবেণী বলেন। যে যাই বলুক, শব্দটা অনেক কাব্যিক। মস্তিষ্কে শব্দটি প্রবেশ করা মাত্র একটি কাব্যিক অনুভূতি নাড়া দেয়। লামাহাট্টা বা কালিম্পংয়ের এই ত্রিবেণীও তাই।
তিন নদীর মোহনাকেও ত্রিমোহিনী বা ত্রিমোহনা। এই ত্রিমোহনাকেও ত্রিবেণী নামে আখ্যায়িত করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে তিন রাস্তার মোড়কেও ত্রিবেনী বলা যায়, কিছু জায়গার এরকম নামকরণও রয়েছে বাংলাদেশসহ প্রাচীণ ভারতর্ষে। কেউ কেউ এই জায়গাটিকে ত্রিবেণীসঙ্গম বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন।
হিন্দু পূরাণ মতে, ত্রিবেণী হচ্ছে পবিত্র তিন নদীর সঙ্গমস্থল বা মিলনস্থল। ওই নদীর পূণ্য ধারায় তারা স্থান করে পবিত্র হন। নদী তিনটি হচ্ছে গঙ্গা (পদ্মা), যমুনা এবং স্বরস্বতী। ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে ওই তিন নদীর মিলনস্থলটি একটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। হিন্দু তীর্থযাত্রীরা ওখানে গিয়ে পূণ্যস্নান করেন। তির্থযাত্রীদের ধারণা, তিন নধীর ওই পবিত্র ধারায় স্নান করলে পাপমুক্তি ঘটে।
এলাহাবাদের ওই ত্রিবেণীতে প্রতি ১২ বছর পর একবার কুম্ভু মেলা হয়। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির দেহভস্ম ওই ত্রিবেণীর জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, মৃত ব্যক্তির পাপমুক্তির আশায়; ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর তার শবদেহ পোড়ানো ছাই করা হয় তাই।
ফল্গুধারা নামে একটি শব্দ আছে বাংলায়। কেউ কী জানেন এর অর্থ কী? দেখেছেন কখনো সেটা কেমন? মাটির স্তরের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধারাকে বলা হয় ফল্গুধারা। এই উমহাদেশে সেটি খুব একটা দেখা যায় না। দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডে গিয়ে সেটা দেখেছিলাম। ক্লিপস অব মহের দেখতে যাচ্ছিলাম। পথে একটা প্যালেস এর ধারে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। মাটির নিচে জলধারার শব্দ হচ্ছিলো। দুই সঙ্গী প্যালেসের দিকে চলে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বিষয়টা বোঝার জন্য। দেখলাম কোথাও কোনো জলধারা নেই। খাল বা ছড়াও নেই। নেই ড্রেন বা অন্যকিছু। পশ্চিম দিকটায় কিছুটা উঁচু ভূমি। পূবে ছিলো উপত্যকার মতো জলাভূমি। সেখানে মাটির নিচ দিয়ে জলধারা গড়িয়ে পড়ছিলো। প্রকৃতির খেয়াল দেখে কিছুক্ষণ অবাক দাঁড়িয়ে ছিলাম।
ফল্গুধারার প্রসঙ্গে যাওয়ার কারণ আছে। কেউ কেউ বলেন, এলাহাবাদের ওই স্বরস্বতী নদী অন্তঃসলীলা। বলা হয়, যমুনা নদীর জলধারার নিচ দিয়ে বা মাটির নিচ দিয়ে ওই ধারা বহমান। অনেকটা ফল্গুধারার মতোই। হয়তো দুই ধারা ওখানে একাকার হয়ে গেছে। যদিও প্রকৃত অর্থে ফল্গুধারা হচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া নদীর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধারা।
বেনারসির মতো উজ্জ্বল লালচে বালু সাজানো রয়েছে মিলনস্থলে। যেন কোনো কিশোরী বধূর বাসর শয্যা। আহা ত্রিবেণী! এত সুধা তোমার রূপে!
ও হ্যাঁ, ভারতে পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতেও একটি জায়গা আছে, যার নাম ত্রিবেণী নগর। ওখানেও গঙ্গা, যমুনা আর স্বরস্বতী নদী মিলিত হয়েছে। সেখানে অবশ্য তিন নদীই দৃশ্যমান। তবে গঙ্গা আর যমুনা বড় নদী। স্বরস্বতীর ধারা আগে বড় থাকলেও সরু খালের মতো বয়ে গেছে, ক্ষীণ ধারা।
মানবদেহকেও ত্রিবেণী হিসেবে দেখা হয়। শরীরের ভেতরের যে নাড়ি, শিরা, ধমনী, দেহতাত্ত্বিক ভাবার্থে এসবই ত্রিবেণী। তবে নির্দিষ্ট করে ত্রিবেণী বলা হয় স্নায়ুতন্ত্র, শিরা এবং ধমনীকে। ওই ত্রিবেণী সঙ্গমে অবগাহন করতে পারলে মনের অন্ধকার দূর হয়। আলোকিত হয় অন্তরাত্মা।
অবশ্য হিন্দু পুরাণে ত্রিবেণী তথা ওই তিন নদীকে আরও একভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে ত্রিবেণীর গঙ্গাকে বলা হয়েছে ঈড়া বা ভগবতী নামে। ভগবতী হচ্ছে যে ভগ বহন করে। ভগ শব্দের অর্থ ঐশ্বর্য, ঐশীগুণ বা ঈশ্বরত্ব। পিঙ্গলা হলো যমুনা নদী। আর সুষুণ্মা হলো সরস্বতী নদী। ঈড়াকে বলা হচ্ছে ধমনী, যার মধ্যে শুদ্ধ রক্ত প্রবাহিত হয়। পিঙ্গলা হলো শিরা। যার মধ্যে দিয়ে দূষিত রক্ত প্রবাহিত হয় এবং পরে তা শুদ্ধিকরণ হয়। সুষুণ্মা হলো স্নায়ুতন্ত্র। যা মানুষের মস্তিষ্কে অনভূতির সৃষ্টি করে। যা জ্ঞান হিসেবে যা সঞ্চিত থাকে, প্রজ্ঞা হিসেবে প্রবাহিত হয়। যাকে তুলনা করা হয়ে থাকে সরস্বতী নদীর সঙ্গে।
ত্রিবেণী ঘাট বলতে কেউ কেউ যোনিকে বুঝিয়ে থাকেন। যেখানে অবগাহন করলে অমৃতের তৃপ্তি মেলে। যদিও এর পক্ষে জোরালো কোনো যুক্তি নেই। তবে নানা ব্যাখ্যার মধ্যে যোনি বা জরায়ুমুখের সঙ্গে ত্রিবেণীর সাদৃশ্য খোঁজা হয়। এর পেছনে যুক্তি হলো নারীর যোনি থেকে লাল (রজ), সাদা (সুধা) ও কালো (এখানে কালোকে মধু হিসেবে মনে করা হয়েছে) এই তিন ধারা প্রবাহিত হয়।
তবে, ত্রিবেণীর যত অর্থই থাক, এগুলো আসলে বাঙালী সংস্কৃতিতে এসেছে প্রচলিত বা পৌরাণিক পরিভাষা হিসেবে। নদীর ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লাল, সাধা এবং কালো এই তিন ধারাকে ত্রিবেণী হিসেবে মেনে নেওয়া হয়।
ত্রিবেণীর এসব ব্যাখ্যা শুনে মাথা নষ্ট! ব্যাখ্যা যাই বলুক, আমার কাছে শব্দটা কাব্যিক, অর্থবহ। আর কালিম্পংয়ের এই ত্রিবেণী সত্যিই সুন্দর। বৃষ্টিনস্নাত সবুজ সতেজ বনের ভেতর থেকে লাজ রাঙ্গা নববধূর মতো বেরিয়ে এসেছে তিস্তা-রাঙগিত। বেনারসির মতো উজ্জ্বল লালচে বালু সাজানো রয়েছে মিলনস্থলে। যেন কোনো কিশোরী বধূর বাসর শয্যা। আহা ত্রিবেণী! এত সুধা তোমার রূপে!
চলবে…
আরও পড়ুন: দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-১১॥ উদয় হাকিম