(পর্ব-১১)
লামাহাট্টা এবং ত্রিবেণী
২০১২ সালের কথা। মার্চ মাস। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লামাহাটা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দুপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। হঠাৎ থামলেন। রাস্তার পাশের কিছু ছবি নিলেন। বিশেষ করে পর্বতের গায়ে লেপ্টে থাকা গ্রাম বা ছোট ছোট ঘরবাড়ি তাকে আকৃষ্ট করেছিল।
মমতা দেখলেন, পাহাড়ি গ্রাম। উঁচু পাহাড় থেকে ক্রমশ ঢালু হয়ে আসা সবুজে ছাওয়া মনোরম ভূমি। রাস্তার পাশে বিশাল ধুপি আর পাইন বন। আশপাশে পাহাড়ের চূড়া। চমৎকার নদী। পরে রাজ্য সরকার এবং স্থানীয়দের সহায়তায় অসাধারণ একটা ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনে পরিণত হয়েছে লামাহাটা। চায়ের বাগান, পাইন বন আর র্টুরিস্ট ল’জ দিয়ে অপরূপ সাজে সেজেছে জায়গাটি। বৌদ্ধ সন্যাসীদের থেকে লামা আর হাট থেকে হাট্টা মিলে এরকম নামকরণ। জায়গাটির নাম লামাহাটা বা লামাহাট্টা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যকে ঠিক রেখেই এখানে সাজানো হয়েছে সবকিছু।
সত্যি! দার্জিলিংয়ের পাশের এই জায়গাটি, লামাহাটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। শুধু মমতা কেন, ভ্রমণপিপাসু কোনো মানুষেরই ক্ষমতা নেই এমন সৌন্দর্য্যকে এড়িয়ে যাওয়ার। স্থানীয় গাইড পার্থ বাসনেত জানালেন, এটি দার্জিলিং থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। নেটে অবশ্য পাওয়া গেলো ২৩ কিলো। ওই একই কথা। দার্জিলিং থেকে এটি পুবে বলা চলে। তবে উত্তরঘেঁষা।
টাইগার হিলের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। আর তাই ঘুম রেল স্টেশন, বাতাসিয়া লুপ, ঘুম মনেস্ট্রি; সবই পথে পড়লো। মনে পড়ছিল টাইগার হিলের পাশের ডাক বাংলো পয়েন্টের কথা। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে না পেয়ে পাহাড়ের ওপরে ছবি তুলেছিলাম আমরা। যেহেতু টাইগার হিলে গিয়েছি, তাই টাইগার সংশ্লিষ্ট একটা স্মৃতিচিহ্ন রাখা দরকার। সেলফি স্টিকে মোবাইল সেট করে দাঁড়ালাম। বাঘের মতো আক্রমণাত্বক পোঁজ নিয়ে রেডি। সবাই দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। পরে দেখলাম ছবিটা ‘অসাম’ হয়েছে। ‘ওয়াও’ হয়েছে।
ও, আরেকটা কথা ভুলে যাচ্ছিলাম। দার্জিলিং শহর ছেড়ে যাচ্ছিলাম। শহর থেকে কিছুটা দক্ষিণে এসে পুব দিকে মোড় নিলো গাড়ি। লামাহাট্টা পৌঁছানোর আগে রাস্তার বাম পাশে দেখলাম ঝাউবন। মেঘগুলো আটকে যাচ্ছিল পাহাড়ের গায়ে। ঝাউবনের ফাঁক গলে ছবি নিচ্ছিলাম গাড়ি থেকেই। নুরুল আফসার চৌধুরী বলছিলেন, বৃষ্টি না থাকলে এখানে ‘ইয়া’ (ছবি) তোলা কেউ ঠেকাতে পারতো না। সত্যিই তাই! মাঝে-মাঝে বৃষ্টির তোড়ে রাস্তা দেখা যাচ্ছিল না। দিনের বেলা, অথচ অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছিল চরাচর। দুই-একটা পাহাড় পেরোতেই দেখছিলাম বৃষ্টি কমছিল। গাছপালা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল। দু’পাশে বাড়িঘর নেই। নেই কোনো ইট-কাঠের স্থাপনা। কেবলই নানা গাছ-গাছালির শোভা। চা-বাগান। ঘাসে ছাওয়া সবুজ চত্বর। গাছপালার জলপাই রঙা মুকুট মাথায় আকাশছোঁয়া চূড়া।
বৃষ্টি ছাড়ছিলই না। লামাহাট্টা এসে গেলাম। ঘণ্টাখানেক লাগলো। লামাহাট্টার উচ্চতা ৫ হাজার ৭০০ ফুট। প্রায় দার্জিলিংয়ের সমান উচ্চতায়। দার্জিলিং এবং কালিম্পংকে সংযুক্ত করেছে এই এলাকাটি।
জানা গেলো, এখানে লোকবসিত খুব কম। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা বলে কথা। স্থানীয় লোকদের সবাই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এখানে কী কৃষি হয়, সেটাই বুঝলাম না। তবে হ্যাঁ, চা-বাগান করাও তো কৃষি কাজের মধ্যে। পাহাড় থেকে ফলমূল সংগ্রহ কিংবা পাহাড়ের গায়ে ক্ষুদ্র পরিসের কিছু চাষও কৃষির মধ্যেই পড়ে।
নেপালের খুব প্রভাব স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে। কথা বলেন নেপালি ভাষায়। তাদের পদবিও নেপালিদের মতো। বাস করেন শেরপা, ইয়ালমস, তামাং, ভূটিয়া ও দুপাস সম্প্রদায়ের লোক। সম্ভবত ভারতের বিখ্যাত ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া এই এলাকা থেকেই উঠে এসেছিলেন। তবে শেরপা সম্প্রদায় কেন বিখ্যাত জানেন? পর্বত আরোহণে দক্ষ এঁরা। যারা মাউন্ট এভারেস্ট বা উঁচু পর্বতারোহণ করতে চান, তাদের অবশ্যই শেরপাদের সাহায্য নিতে হয়।
এখানে পাইন গাছের পাশাপাশি ধুপি দেখা যায় খুব। পাইন তো অনেকেই চেনেন। বিশাল লম্বাকৃতির বৃক্ষ। ডালপালা ছড়ায় না। শুধু ওপরের দিকে ওঠে। কিন্তু ধুপি গাছ কী? এটি দূর থেকে অনেকটা ঝাউ গাছের মতো মনে হয়। তবে ঝাউ নয়। দূর থেকে কাঁটা জাতীয় গাছ মনে হলেও কাটা নেই এর গায়ে। পাতা ও বা ছোট ডাল দেখলে মনে হয় খুব ধারালো। আসলে তা-ও নয়। কাছ থেকে দেখলে মনে হতে পারে পাটের সুতোয় বোনা শতরঞ্জি। সুতোয় বোনা হাতের কাজও মনে হতে পারে। কেটে ছেঁটে রাখলে লম্বাটে হয়। আবার ঝোপের মতো হয়, হয় গোলাকারও। ধুপির ফলও হয়। দেখতে অনেকটা হরিতকির মতো। কাচা ফল সবুজ। পাকলে কালো।
অল্প সময়ের মধ্যে লামাহাটা বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। আগে এর নাম খুব একটু শোনা যায়নি। জায়গাটি লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছে এখানকার ইকো ট্যুরিজম এর জন্য। পরিবেশগত ভারসাম্য ঠিক রেখে; জীব এবং জৈববৈচিত্র্য অটুট রেখে এখানে ট্যুরিজম স্পট ডেভেলপ করা হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা মাথায় রেখেই সব করা হচ্ছে। আধুনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে গুরুত্ব পেয়েছে পরিবেশ। এখানে রাজ্য সরকার ও গ্রামবাসীদের অংশীদারিত্বে কিছু রোড সাইড গার্ডেন এবং রিসোর্ট পরিচালিত হয়।
এখানকার একটা বিষয় লক্ষণীয়। রাস্তার পাশে রঙিন কাপড়ের অসংখ্য নিশান। এটা নেপালে দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখেছিলাম ভুটানে। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এটা করেন। ভুটানে শুনেছিলাম কেউ মারা গেলে বাঁশের ডগায় (সাধারণত ১০১টি বাঁশ) রঙিন কাপড় বেঁধে দেয়। বাতাসে চিকন লম্বা কাপড় উড়তে থাকে। আবার ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্যও এটা করা হয়ে থাকে। তবে এখানে কৃপা লাভই মূল উদ্দেশ্য। কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও ছিল। বলা হয়ে থাকে, এইসব রঙিন কাপড়ের (স্থানীয় ভাষায় প্রার্থনা ঝালর) মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস মানুষের মনকে শুদ্ধ করে, সুন্দর এবং পবিত্র ভাবের উদ্রেক করে। মন্দির, সেতু বা বিভিন্ন স্থাপনার পাশেও এই ধরনের প্রার্থনা পতাকা দেখা যায়।
আধুনিক লামাহাটাকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে আরেকটি বিষয়কে সামনে রেখে। একে বলা হচ্ছে রোমান্টিক স্থান। শান্ত পরিবেশের সঙ্গে পাহাড়-নদী দর্শনের সুখ অনাবিল। আর তাই মধুচন্দ্রিমা বা হানিমুনের জন্য এই জায়গাটি বেশ নাম কুঁড়িয়েছে। শৈল পাহাড়, শিলাখণ্ডের ধারঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী, ট্রেকিং, ধুপি বন; সবই কেড়ে নেবে মন! একটি তথ্য দিয়ে রাখি। শিলিগুড়ি থেকে লামাহাট্টার দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার। জিপে গেলে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা। আর দার্জিলিং থেকে? আগেই তো বলেছি, ঘণ্টাখানেক।
যাই হোক, এবার বলছি আরেকটি রোমান্টিক জায়গার কথা। অন্তত আমার কাছে এটিই এ অঞ্চলের সবচেয়ে রোমান্টিক স্পট মনে হচ্ছিল। কারণ সেখানে একটি ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। যার নাম লাভারস মিট ভিউ পয়েন্ট। মূল গেইটের মধ্যে কথাটি লেখা। ধারণাটি চমৎকার! প্রেমিক- প্রেমিকারা সেখানে নিজেরা দেখা করবেন এবং ওই ভিউ পয়েন্ট উপভোগ করবেন।
জায়গাটির নাম অবশ্যই রোমান্টিক-ত্রিবেনী। সহজ বাংলায় বলা চলে তিন বেণীর সমাহার। এখানে নদীকে বিনুনীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। লামাহাটা থেকে এটি মাত্র ৪ কিলোমিটার পুব দিকে।
ত্রিবেণী জায়গাটি পড়েছে কালিম্পংয়ের মধ্যে। পশ্চিম থেকে এটিকে কালিম্পংয়ের প্রবেশদ্বার বলা চলে। একদিকে সিকিম থেকে এসেছে তিস্তা। অন্যদিক থেকে গভীর বন পেরিয়ে স্বচ্ছ জল নিয়ে এসেছে রাংগিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচের কাবরু পর্বতের একটি গেইসার বা উষ্ণ প্রস্রবন থেকে রাংগিতের উৎপত্তি। এরা ত্রিবেণীতে মিলিত হয়ে ভাটিতে বয়ে গেছে তিস্তা নামে। সবুজে মোড়া রহস্যময় ঘন বন। তার ফাঁক গলে সুউচ্চ পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা যুগল স্রোতস্বীনি এখানে করেছে আলিঙ্গন। তারপর জলপরীর মতো বয়ে গেছে হাজারো মাঠ পেরিয়ে।
ওপর থেকে পাখির চোখ করে দেখতে হয় ত্রিবেণীর সৌন্দর্য। ভিউ পয়েন্ট পাশের একটি পাহাড়ের ওপর। খাড়া ঢালুতে কংক্রিটের গাঁথুনি। রেলিং করা। কিছু অংশে ছাউনি আছে। বাকিটা উন্মুক্ত। সেখান থেকে সবচেয়ে সুন্দর দেখা যাচ্ছিল মিলনস্থলটি। সবমিলিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক অসামান্য জায়গা এই ত্রিবেণী। সেদিন জলটা ঘোলা ছিল। বৃষ্টির পানি লালচে মাটি চুইয়ে পড়েছিল নদীতে। তাই জলটা ছিল ঘোলাটে, পিংক।
আমাদের গাড়ি যখন ত্রিবেণীতে থামে, তুমুল বৃষ্টি তখনো। বৃষ্টিতে ভিজেই এক দৌড়ে চলে গেলাম ভিউ পয়েন্টে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। আমার আগেই মিলটন ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল। সে যখন গিয়েছিল, তখন ত্রিবেণীটা মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল। যেই আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই চারদিক থেকে মেঘ এসে পুরো ভিউটাকে ঢেকে দিলো। কী আর করা। ওর মধ্যেই ছবি তুললাম। বৃষ্টি বাড়লে সবাই ছাউনির নিচে চলে গেলো। ফিরোজ আলম তখন বললেন, দাঁড়ান আপনার প্যানোরমিক ছবি তোলে দেই।
এখানে চা-পানের জন্য সবাই বসে। কিন্তু সকাল থেকেই বিরামহীন বৃষ্টি থাকায় দোকানদারের চুলোয় আগুন জ্বলেনি। চা বসায়নি। আলো কম ছিল। ওর মধ্যেই গ্রুপ সেলফি হলো।
ত্রিবেণী নামটা দারুন। এর অর্থ কী জানেন? তিন বেণীর সমাহার। নদীর তিনটি ধারাকে এখানে ত্রিবেণী বলা হয়েছে।
চলবে…
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-১০॥ উদয় হাকিম