[পর্ব:৬]
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭৩ সালে প্রাইভেটে ম্যাট্টিক পরীক্ষা দিয়ে তারেক প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন। তারপর ঢাকায় এসে ভর্তি হলেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। এ সময় তিনি চাচাতো ভাই শহীদুর রহমান শহীদের বাসায় থাকতেন। এখানেও তাকে একরকম প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে তারপর আবার শহুরে পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেগ পেয়েছে তাকে। ছয় মাস পড়ার পর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ছেড়ে ভর্তি হলেন ঢাকা নটরডেম কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে। তিনি ইতিহাসের ছাত্র হলেও সারাদিন পড়ে থাকতেন চারুকলা ইনস্টিটিউটে। চলত শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাফেরা, আড্ডা আর অগোছালো স্বপ্ন দেখা—তাও চলচ্চিত্র নিয়ে।
ছবির ফেরিওয়ালা
১৯৮২ সাল। তারেক মাসুদ ফিল্ম নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য ভারতের পুনায় আবেদন করেন। তার স্কলারশিপও হয়ে গিয়েছিল। ওই বছর মার্চের ২৪ তারিখ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। এসেই ভারতবিরোধী মনোভাব বোঝানোর জন্য ভারতের সব স্কলারশিপ বাতিল করে দিলেন। এর মধ্যে তারেকের স্কলারশিপটাও চলে গেলো। নাট্যকার সাঈদ আহমেদ ছিলেন এরশাদের কালচারাল উপদেষ্টা। তিনি তারেককে খুব স্নেহ করতেন। তাকে দিয়েই তারেক স্কলারশিপ রিভাইভ করান। আবার গিয়ে ডিরেক্টর কৃষ্ণমূর্তির কাছ থেকে নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট আনেন তিনি। কিন্তু এই ছোটাছুটিতে অনেক দেরি হয়ে যায়। সেখানে সেশনও শুরু হয়ে গেলো। ফলে তারেকের আর যাওয়া হলো না। এবার রাগে-দুঃখে আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। পারিবারিকভাবেই তিনি অর্থ জোগাড় শুরু করেন।
তারেক তখন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেছেন। এসএম সুলতান তখন বাংলার যুবকদের কাছে কিংবদন্তি। এস এম সুলতানকে নিয়ে আহমদ ছফার একটি লেখা তারেক মাসুদ, সাজেদুল আউয়াল, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুসহ কয়েকজনকে সুলতানের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে। তারেক মাসুদসহ যারা চলচ্চিত্রের বিকল্প ধারা নিয়ে ভাবছিলেন, তাদের মনে হয়েছিল সুলতানের ওপর ছবি করাটা খুব জরুরি। তখন আনোয়ার হোসেন ছিলেন তারেকদের ক্যামেরার শিক্ষক। তিনি সবসময় উৎসাহ দিতেন ছবি বানানোর জন্য। তারেক মাসুদ একদিন আনোয়ার হোসেনের জিগাতলার বাসায় গিয়ে যখন বললেন, তিনি পড়াশুনা করার জন্য বিদেশ চলে যাবেন, তখন আনোয়ার হোসেন তারেকের সামনে ওইদিনের ইত্তেফাক পত্রিকা খুলে দিয়ে পড়তে বললেন। সেখানে ব্যাক পেজে বড় বড় করে লেখা ছিল এসএম সুলতান হাসপাতালে, মারাত্মকভাবে অসুস্থ।
আনোয়ার হোসেন তারেক মাসুদকে বললেন, ‘তুমি যদি এখন বাইরে পড়তে চলে যাও, ফিরে এসে দেখবে শিল্পী নেই। তোমার মনের মধ্যে কিন্তু বিরাট আফসোস থেকে যাবে।’
জবাবে তারেক মাসুদ জানান, তার যাওয়ার যাবতীয় কাজ হয়ে গেছে। তিনি চলে যাবেন। এরপর আনোয়ার হোসেনের বাড়ি থেকে বের হয়ে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে ৬ নম্বর গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও গাড়ি আসছিল না। গাড়ি আসছিল না দেখে তারেক ভাবতে শুরু করলেন। এ সময় তার মাথায় উল্টো বুদ্ধি এলো। তিনি ভাবলেন বিদেশ যাবেন না এবং বিদেশ যাওয়ার টাকা দিয়েই তিনি এসএম সুলতানের ওপর সিনেমা বানাতে শুরু করবেন।
আমেরিকায় ফিল্ম বিষয়ে পড়াশুনা করার জন্য যে অর্থ তিনি জোগাড় করেছিলেন, সেটা দিয়েই শুরু করলেন সুলতানের ওপর ছবি বানানো। তিনি ভাবলেন, সুলতানকে নিয়ে ছবিটা বানালে একদিকে যেমন এত বড় মানুষের ডকুমেন্টেশন হবে, তেমনি ফিল্ম বানাতে গিয়ে ফিল্ম বানানোর লার্নিংটাও হবে, স্বশিক্ষিত হতে পারবেন। তার বারবারই মনে হচ্ছিল শিল্পী সুলতানের জীবনের প্রামাণ্যচিত্র তৈরি খুব জরুরি।
চলবে…