[পর্ব-৪]
তারেকের বাবা বেশিরভাগ সময়ে ৪ মাসের চিল্লায় চলে যেতেন। সবসময়ই যাওয়ার আগে তিনি একজন হুজুর ঠিক করে দিয়ে যেতেন।সব হুজুরই খুব রাগী আর কড়া মেজাজের ছিলেন।
একদিন ভোরে তারেকের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলে ফজরের নামাজ পড়তে পারেন না তিনি। হুজুর অনেক জোরে জোরে ডাকতে শুরু করেন তারেককে। তারেক ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে যান, লাফ দিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। হুজুর লাঠি নিয়ে মারতে গেলে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। হুজুরের সামনে আসার অনুমতি ছিল না তারেকের মায়ের। তিনি ঘরের ভেতর থেকে পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, ‘আমার ছেলেকে মারবেন না। ওকে ছেড়ে দিন।’ হুজুরের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে তারেক দৌড়ে মায়ের পেছনে লুকিয়ে থাকেন, মাকে জাপটে ধরে।
তারেক মাসুদের বাবার খুব ইচ্ছে তিনি তার ছেলেকে ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। তাকে নিয়ে বাবা স্বপ্ন দেখতেন। তিনি আশা করতেন, ছেলে একজন বড় আলেম হবেন। যখন তারেকের বয়স ৭ বছর, তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেন তার বাবা। প্রথমে ভাঙ্গার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয় তারেককে।পরবর্তী সময়ে তাকে ঢাকার কাকরাইল, লালবাগ ও যশোরের বাহেরদিয়া মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। সবমিলিয়ে তাকে পাঁচ-ছয়টি মাদ্রাসায় পড়তে হয়েছে। মাদ্রাসার ধরা-বাঁধা জীবন তারেকের ভালো লাগতো না একদমই। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সুযোগ ছিল না, বন্দি মনে হতো নিজেকে সবসময়। যখনই মাদ্রাসা থেকে আসতেন বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মেতে থাকতেন তিনি। হাসিখুশি থাকতেন খুব। মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় হলেই আনন্দ মিলিয়ে যেতো তার মুখ থেকে, কালো মেঘে ছেয়ে যেতো সুন্দর মুখখানা। প্রচণ্ড মন খারাপ হতো তার কিন্তু মুখে কিছুই বলতেন না তিনি। কখনো অভিযোগ করেননি মাদ্রাসার জীবন নিয়ে।
যে আর্থিক টানাপড়েনের কারণে মূলত এ দেশের ছেলেমেয়েকে মাদ্রাসায় পাঠানো হয়, তারেক মাসুদের পরিবারের সে অবস্থা ছিল না। কিন্তু তার বাবার ধর্মীয় গোঁড়ামির খেসারত দিতে হয়েছে তাকে।
তারেকের বাবা তারেককে কাকরাইল মাদ্রাসায় রেখে ৩ চিল্লায় যান দেশের বাইরে।! চিল্লা থেকে ফিরে এসে তিনি সরাসরি মাদ্রাসায় যান ছেলেকে দেখতে। তিনি মাদ্রাসায় তারেক মাসুদকে পান না কোনো বারই। তারেকের বাবা চিল্লায় যেতে না যেতেই তারেকের চাচা ও চাচাতো ভাইবোনেরা মাদ্রাসায় গিয়ে তারেককে নিয়ে আসতেন বাসায়। এতে তারেকের বাবা খুব রেগে যেতেন। তিনি তারেককে চাচা ও চাচাতো ভাইবোন থোকে দূরে রাখার জন্য ঢাকা থেকে অনেক দূরের কোনো এক মাদ্রাসায় পড়তে পাঠান।
সেসব মাদ্রাসার যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব খারাপ ছিল। মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে হতো। মাদ্রাসাগুলোর আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে না ছিল কোনো বাজার না কোনো চায়ের দোকান। মাদ্রাসাগুলো ছিল জঙ্গলে ঘেরা।
শিশুদের মন বলে কিছু থাকে, তাদেরও ইচ্ছা, চাওয়া, পছন্দ বা অপছন্দের কিছু থাকতে পারে, তা বোঝার মতো মানসিকতা ছিল না তারেকের বাবার। তিনি চেয়েছিলেন তার সন্তান তারেক বড় নামকরা আলেম হবেন। তাই তিনি তার স্বপ্ন পূরণ করতে সমস্ত কৌশল অবলম্বন করেন।
তারেকের বাবা তারেকের কাছ থেকে তার ভালোবাসা আর সংস্কৃতিমনা বন্ধু-বান্ধবকে আড়াল করতে চেয়েছেন বারবার। তা যে তারেকের কোমল মনে কতটা ব্যথা জমিয়েছে বাবা হয়ে তা তিনি বোঝেননি, বোঝেননিতারেকের চোখের ভাষাও। ব্যথাতুর মন নিয়ে স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করেছেন। মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলেননি। পাখির মতন উড়ে বেড়াতে যার ভালো লাগতো,তাকে বন্দি করা হলো খাঁচায়। খাঁচার পাখির মতোই ছটফট করতে থাকেন তারেক, বোঝেনি কেউ সে যন্ত্রণা। পরবর্তী সময়ে আমারা তার মুখেই বন্দিজীবনের যন্ত্রণার কথা জানতে পাই। তিনি মাদ্রাসার জানালার শিক ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকতেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতেন, ‘বাইরের শিশুরা কত স্বাধীন, তাদের জীবনটা কত আনন্দে ভরা!’
ঢাকার কাকরাইল ও মালিবাগ মাদ্রাসায় পড়া অবস্থায় তার চাচা তাকে প্রতি সপ্তাহে বাসায় নিয়ে যেতেন। তাই সপ্তাহের শেষে মাদ্রাসার গেটেই অধীর আগ্রহে চাচার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতেন তারেক মাসুদ। একবার তারেকের চাচা তাকে আনতে যেতে পারেননি কোনো এক কারণে। তারেক অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চাচাকে দেখতে না পেয়ে একা একাই বের হয়ে যান চাচার বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি তো বাসা চেনেন না। কী করে যাবেন চাচার বাসায়। পথে মাদ্রাসার একজন হুজুরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার। হুজুর তারেকের ব্যাকুলতা দেখে নিজেই সঙ্গে করে চাচার বাসায় পৌঁছে দিতে যান তাকে। চাচার বাসার সামনে যেতেই গেট দেখে চিনতে পারেন তারেক মাসুদ। তিনি হুজুরের কথা একদম-ই ভুলে যান, হুজুরের কাছে বিদায় না নিয়েই এক দৌড়ে ঢুকে পড়েন বাড়ির ভেতরে। হুজুর কী করবেন বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফিরে আসেন মাদ্রাসায়।
আসলে এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি তিনি মাদ্রাসা থেকে বের হতে কতটা অস্থির থাকতেন। জীবনের প্রথম মাদ্রাসা দর্শনে তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম ভর্তি হওয়া ভাঙ্গার মাদ্রাসা সংলগ্ন একটি বিরাট দিঘি ছিল। যেটি আমরা ব্যবহার করতাম। আমি যখন প্রথম মাদ্রাসায় গেলাম সেদিন রাত সাড়ে তিনটার দিকে আমাকে তুলে সেই বিরাট দিঘির ঘাটে নিয়ে যাওয়া হলো। কুয়াশার মধ্যে সামান্য আলো—আঁধারিতে দেখা যাচ্ছিল সবাই মেসওয়াক করছে। আমাকেও মেসওয়াক করানো হলো। আসলে একটি শিশুর অভিজ্ঞতা একরকম ইন্দ্রজালিক অভিজ্ঞতা।
তারেক মাসুদ ছোটবেলা থেকেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব-ই তাকে মাদ্রাসার সব ছেলের থেকে আলাদা করে রেখেছিল। মাদ্রাসায় পড়া অবস্থাতেই তিনি নিজের স্টোভে চা করে খেতেন। রবিবার বাদে সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতে তারেক কে একজন মহিলা দুধ দিয়ে যেতেন। তারেকের মা দুধের ব্যবস্থা করেছিলেন।
চলবে…