[পর্ব-১৬]
তখন তারা অনেক ভেবে একটি পথ বের করলেন। আর সেই পথটি হলো, তারা ধারা বর্ণনা ব্যবহার না করে মনোলগ অর্থাৎ একটি চরিত্রের আত্মকথন ব্যবহার করবেন। তারেক আলী যে চরিত্র, সে যেন ডায়েরির মতো করে বলছে। এভাবেই তারেক মাসুদ ধারা বর্ণনা লিখলেন।
‘মুক্তির গান’ কোনো প্রামাণ্যচিত্র নয়, এমনকি কোনো কাহিনীচিত্রও নয়। তারেক মাসুদ এই দুইয়ের সংমিশ্রণে ছবিটি তৈরি করেন, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ন্যারেটিভ ডকুমেন্টারি। লিয়ার লেভিনের শ্যুটিং করা ২০ ঘণ্টার ফুটেজের মধ্যে ১৫ ঘণ্টাই ছিল শরণার্থী শিবিরের। সেখান থেকেই শিল্পী দলের ফুটেজ ব্যবহার করেছেন তারেক মাসুদ। আর যুদ্ধ-বিগ্রহের ফুটেজ ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন দেশ থেকে কিনে। যার মধ্যে রয়েছে ভারত থেকে ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’, ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ’সহ বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্রের ফুটেজ। ব্রিটিশ টেলিভিশনের আইটিএনসহ বেশ কয়েকটি চ্যানেলের ফুটেজও ব্যবহার করেছেন। এসব থেকে সমন্বয় ও শ্যুটিং করে সম্পাদনার টেবিলে ‘মুক্তির গান’ নির্মাণ করেছেন। লিয়ার লেভিন ‘জয় বাংলা’ নামে যে ছবিটি বানিয়েছিলেন, একই ফুটেজ থেকে তারেক মাসুদ একদম বিপরীত কিছু নির্মাণ করলেন। মুক্তির গান কাঠামোর দিক থেকে জয় বাংলার চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ় এবং ভাবের দিক থেকে বেশ একটু শিক্ষামূলক। তারেক মাসুদ বলতেন, ‘তারটা খারাপ আর আমারটা ভালো, এটা বলবো না। তিনি বানিয়েছিলেন মার্কিন দর্শকদের জন্য। তার ছবিতে গান বাদ দিয়েছিলেন। আর আমারটায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মূল্যবোধকে পুনর্জাগরিত করার চেষ্টা করেছি।’
তারেক মাসুদ প্রথমে চিন্তা করেছিলেন,ছবিটি শুরু করবে রিফিউজি ক্যাম্পের ফুটেজ দিয়ে।এর নেপথ্যে অ্যালেন গিনসবার্গের ‘যশোর রোড’ গানটি ব্যবহার করবেন। তারেক মাসুদ যখন তার কবিতাটি অনুবাদ করে সুর দিলেন, তখন তার ভালো লাগেনি। এভাবে শুরু না করার একটা কারণ হলো, এটি ভালো না লাগা। অন্য কারণটি হলো হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের অরিজিনাল নেগেটিভ পেয়ে যাওয়া। তখন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ তাদের ভাবনার পরিবর্তন করে সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা ছবি শুরু করবেন ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়ে। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের ফুটেজ দেখতেই প্রতি আধা ঘণ্টায় ৫০০ পাউন্ড খরচ হয়ে যেতো। ক্যাথরিন মাসুদ অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে কাজটি করতেন। তারা দুই সপ্তাহ এভাবে ফুটেজ দেখে ছবিটির জন্য চূড়ান্ত ফুটেজ নির্বাচন করেন। যে ফুটেজ কিনতে হয়েছে প্রতি সেকেন্ডে ২৪ ডলার দাম দিয়ে। এসব ফুটেজ সংগ্রহ করে ছবিটি সম্পন্ন করতে তাদের সময় লেগেছে সাড়ে চার বছর। ছবি নির্মাণের অধিকাংশ সময় লেগেছে তাদের ফুটেজ সংগ্রহে। শেষ পর্যন্ত এসব ফুটেজের পরিমাণ দাঁড়ায় পুরো ছবির প্রায় ৩০ ভাগ। এছাড়া, তারেক মাসুদ লিয়ার লেভিনের তোলা মেজর গিয়াসের সঙ্গে গানের দলের কথোপকথন দৃশ্যটি রেখে দেন, যেন যুদ্ধের গল্প বলার ভঙ্গিটা আরও আন্তরিক, আরও নিবিড় হয়।
ভুট্টোর সনদ ছিঁড়ে ফেলার ফুটেজ তারা ইউনাইটের নেশন থেকে কৌশলে বের করে এনেছেন, যা এক ধরনের চুরি করাই বলা যায়। অর্থাৎ দেখার জন্য নিয়ে এসে ডুপ্লিকেট কপি করে ফেরত দিয়েছেন তারা। তারেক মাসুদ এটা করেছেন। কারণ তারা জানতে পেরেছিলেন, ওদের ফুটেজ বিক্রির কোনো অনুমতি নেই। তখন তারেক মাসুদ ভেবে দেখলেন, তিনি যদি ফুটেজের জন্য দরখাস্ত দেন, তাহলে পাবেন না। আর তারেক মাসুদ এটা বুঝেছিলেন যে এই ফুটেজ ছাড়া ছবি অনেকাংশে পূর্ণতা পাবে না। এজন্য তিনি এটা করেছিলেন। তারেক মাসুদ এই ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ‘এরকম অনেক নাটকীয় ইতিহাস আছে এ ছবির পেছনে।’
তারেক মাসুদ লিয়ার লেভিনের ফুটেজে পেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পোট্রেট। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ওরা মেশিনগান,বন্দুক পাশে নিয়ে বসে আছে। তাদের কী বিষণ্ড চেহারা! কাউকে কাউকে দেখে মনে হচ্ছে স্বপ্নে বিভোর। দেশের কথা ভাবছে অথবা স্বাধীন দেশের চিত্রটি কল্পনা করছে। এমন ছবিতে তারেক মাসুদ পোট্রেট ব্যবহার করতে পারবেন না। তখন তারেক মাসুদ এবং তার সহযোগীরা ভাবলেন, একটা রেডিওর শট ব্যবহার করবেন, যা দিয়ে বোঝাবেন যে রেডিওতে ওরা যুদ্ধের সংবাদ অথবা কিছু একটা শুনছে। তখন তারেক মাসুদ বাংলাদেশের ক্যামেরাম্যান বেবি ইসলামকে ফ্যাক্স করে জানালেন যে, একচালা টিনের ঘরে একটা রেডিও রেখে তিনটি শট শ্যুট করে দেন । রেডিওতে কী দেওয়া যায়, ভাবতে থাকলেন তারেক মাসুদ। ওই সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘সংবাদ পরিক্রমা’। তখন তারেক মাসুদ ছুটতে শুরু করলেন আকাশবাণীর কাছে। তারেক মাসুদ দেবদুলালের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন কলকাতায়। তিনি তারেক মাসুদকে বললেন, ‘আমি তো অবসর নিয়েছি। আমি খোঁজ করে তোমাকে জানাবো। তুমি দুদিন পর ফোন করো।’ তারেক মাসুদ দুদিন পর ফোন করলেন। তিনি জানালেন, আকাশবাণী ১০ বছর পর্যন্ত রেকর্ড রাখে। এরপর জায়গা না হলে ফেলে দেয়। তারেক মাসুদ এসব কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়লেন। তখন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আবার নিজ থেকে বললেন, ‘এটা লিখতেন প্রণবেশ সেন। তিনি তো হাতে লিখতেন। নিজের সংগ্রহে দুই-একটা স্ক্রিপ্ট হয়তো রাখতে পারেন। ওটা যদি উদ্ধার হয় তাহলে আমি পড়ে দেবো নতুন করে।’ তখন তারেক মাসুদ তার সহকর্মী জুনায়েদ হালিমকে প্রণবেশ সেনের কাছে পাঠালেন। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, প্রণবেশ সেনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। কারণ, তার লেখা ‘সংবাদ পরিক্রমা’ পড়ে দেবদুলাল পেলেন পদ্মশ্রী, আর তিনি কোনো স্বীকৃতি পাননি। আবার বঙ্গবন্ধু ও দেবদুলালকে সম্মানিত করেছিলেন। অথচ প্রণবেশ কিছুই পাননি। এ কারণে দেবদুলালের প্রতি তার অভিমান। তারেক মাসুদের সহকর্মী যখন প্রণবেশ সেনের কাছে গেলেন, তখন তিনি শুনে তো অবাক। এ খবর এতদিন পর! তিনি জানান আট বছর আগে বাসা বদলানোর সময় আটটি স্ক্রিপ্ট খুঁজে পান। তিনি সেখান থেকে কয়েকটি স্ক্রিপ্ট আগ্রহ সহকারে পাঠিয়ে দেন। স্ক্রিপ্টটি সংগ্রহ করে দেবদুলালকে দিয়ে পড়িয়ে সেই অংশ রেডিওর সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের পোট্রেট।
এ ছবির ‘দেশেরও লাগিয়ে পরদেশি হইনু’ গানটি আসলে ছিল কীর্তন। সেটাকে প্রাসঙ্গিক করতে ‘দ্যাশেরও লাগিয়া পরদেশি হইনু’ লিখে রেকর্ড করেন তারেক মাসুদ। লিয়ার লেভিন এই গানটির সুন্দর শ্যুটিং করেছেন, যেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। শিল্পীরা ট্রাকের ওপর গান করছেন আর তালি দিচ্ছেন। ভিজ্যুয়ালটি অসাধারন। কিন্তু কীর্তনটি নিয়ে কি করা যায়,ওটা তো বিষয়ের সঙ্গে যায় না। এজন্য প্রাসঙ্গিক কথা লিখে তারেক মাসুদ ওই সুরে ব্যবহার উপযোগী করেছেন। যে গানটি দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন স্বাধীনতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। আসলে শিল্পীরা তো ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ফেরেননি, ফিরেছেন ফেব্রুয়ারিতে। তারেক মাসুদ দেখিয়েছেন ১৬ ডিসেম্বরে সাধারণ মানুষ ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে। আর মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা তা দেখে ট্রাকের ওপর হাসছে। আসলে ওটা ছিল কল্যাণী ক্যাম্পে রিফিউজি বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের হাসাহাসি করার দৃশ্য। তারেক মাসুদ এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলেন, ‘বাস্তবের চেয়ে সত্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো দৃশ্যটি বাস্তবে ঘটেনি। বাস্তবে ওরা শিশুদের সঙ্গে হাসহাসি করেছে। এটা বাস্তবে না ঘটলেও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে এটি ঐতিহাসিক সত্য। আমি বাঁধাধরা নিয়মে না থেকে সৃজনশীল স্বাধীনতা নিয়ে এমন অনেক কিছু করেছি ছবিটিতে।’
চলবে…
তারেক মাসুদ: ছবির ফেরিঅলা-পর্ব: ১৫॥ শারমিন রহমান