[পর্ব: ১০]
মুক্তিযুদ্ধ ও তারেক মাসুদ
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের এক আলোকিত অধ্যায়। তারেক মাসুদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তার কোনো দোদুল্যমানতা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন গণমানুষের কাছে। তার এই প্রচেষ্টা প্রস্ফুটিত হয় ‘মাটির ময়না’, ‘মুক্তির কথা’ ও ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রে।
তারেক মাসুদ সবসময় বলতেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে। এ ঋণ শুধু একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে নয়, সাধারণ মানুষ হিসেবেও।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের কারণেই তিনি মাদ্রাসার জীবন ছেড়ে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারেক মাসুদ যে মাদ্রাসায় পড়তেন, সেখানে ভূগোল, ইতিহাস পড়ানো হতো। কিন্তু বাংলা, ইংরেজি কোনোটির দেখা পাননি তিনি। ওই সময় তার পরীক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু।
মুক্তিযুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই তারেক মাসুদের জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বারবার বলেছেন, যদি মুক্তিযুদ্ধ না হতো তাহলে তিনি কোনো মাদ্রাসার ঈমাম হতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে জীবন পরিবর্তনের মাধ্যম মনে করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তারেক মাসুদের বয়স ছিল ১৫-১৬ বছর। তার মতে, মধ্যবিত্ত ছেলেদের তখন এ বয়সে যুদ্ধে যাওয়ার সময় হয়নি। কিন্তু সাধারণ কৃষক পরিবারের ১২-১৩ বছরের অনেক ছেলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হওয়ার কারণে তারেক ওই বয়সে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি বলে খুব আপসোস করতেন। তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং হৃদয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন এ দেশের মানুষের যন্ত্রণা আর ত্যাগের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মামা বাড়ি ফুলসুতি গ্রামে এসে থাকেন। তার কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চারপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করা। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দিতেন তিনি। কখনো কখনো কাজ করেছেন গুপ্তচর হিসেবেও।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে তারেক মাসুদ শিখে গেলেন ক্যাচিং, এলএমজি বের করা,পরিষ্কার করার কৌশল। এতসব কাজ শিখে যাওয়ার ফলে তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেলো, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অপারেশনে যাওয়ার আবদার করলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তারেককে সিভিল অপারেশনে নিয়ে যেতে রাজি হলেন। সিভিল অপারেশন যে, ‘আর্মি অপারেশন’ তারেক সেটা জানতেন না। একদিন হঠাৎ করেই এলো সেই দিন, মুক্তিযোদ্ধারা তারেক মাসুদকে নিয়ে গেলেন সিভিল অপারেশনে। রাজাকারের বাড়ি ঘেরাও করা হলো। তারেক মাসুদকে রান্না ঘরের দায়িত্ব দেওয়া হলো, যেন রাজাকারের বউ কোনো ঝামেলা করতে না পারে। কিন্তু মহিলা এমন চিৎকার করতে শুরু করলো, তারেক মাসুদ ভয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে এলেন।
যুদ্ধের সময়ের একটা ভয়ঙ্কর স্মৃতি তারেক মাসুদকে তাড়া করে বেড়াতো সবসময়। যার কারণে তার কোনো ছবিতে ভায়োলেন্সের কোনো দৃশ্য তিনি রাখতেন না। একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তিনি খুব ভালো করেই জানতেন ভায়োলেন্স সম্পূর্ণ বানোয়াট। তবু তিনি সহ্য করতে পারতেন না। কিশোর মনে যুদ্ধের সেই ভয়াবহ স্মৃতিটা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল তারেক মাসুদের মনে। তা তিনি পরবর্তী সময়ে কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
তারেক মাসুদ সেদিনও সিভিল অপারেশনে যাওয়ার সুযোগ পান। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের আক্রমণ করলে একজন রাজাকার কুমার নদীর ধার দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারেক দেখতে পান মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের উদ্দেশে গুলি ছোড়ে। গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে যায় রাজাকারটি। নদীর নীল পানি তারেকের চোখের সামনে সহসাই লাল হয়ে ওঠে। রাজাকারের শরীর পানিতে ডোবে আর ওঠে। এমন করতে করতে একসময় রাজাকারের শরীরটা পানিতে ভেসে ওঠে। এই দৃশ্যটা তারেক মাসুদকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাড়া করে বেড়িয়েছে। কিশোর বয়সে সেই ভায়োলেন্সের দৃশ্যটি মনের মধ্যে বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করে দেয়।
তারেক মাসুদের মনে আরও একটা বিষয় বেশ প্রভাব ফেলে। তার এক মামা, দুলু মামার ভাই। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করতেন। তিনি তার ওই মামার সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া করেন এবং খালি গায়ে নানা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
ওই সময় নগরকান্দা থানায় পুরো পাঞ্জাবিরা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ৭/৯ দিন ধরে থানা অবরোধ করে রাখেন। গ্রামের মানুষ কোনো সাহায্য করতেন না। রাজাকারেরা যেন কোনো সাহায্য করতে না পারে তাই রাস্তা ঘাট ও থানার চারপাশ ব্লক করে রেখেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যে গোলাগুলি ছিল তা দিয়ে জয় সম্ভব ছিল না। এছাড়া থানার ওপর দিয়ে বোম্বিং বিমান উড়ছিল পাঞ্জাবিদের সাহস জোগানোর জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা বুদ্ধি আর কৌশল খাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল স্বপ্ন পূরণের দিকে। এমন একটা পরিস্থিতিতে তারেক মাসুদ নিজেকে আড়াল করা এবং পজিশন নেওয়ার জন্য একটা গর্তে লাফ দেন, তার ধারণা ছিল ওখানে কেউ থাকবে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখতে পান সেখানেও একজন বন্দুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তারেক মাসুদ তাকে চিনতে পারেন এবং অবাক হন। বন্দুকধারী লোকটা তার এলাকার, বয়স ৪০, নাম গ্যাদা এবং পেশায় একজন চোর। তারেক মাসুদদের বাড়িতেও বহুবার চুরি করেছে এই গ্যাদা অথচ আজ দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত।
তারেক মাসুদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন তার দিকে। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মাথা নুইয়ে আসছিল তার। মুক্তিযুদ্ধের পর গ্যাদা আর কোনোদিন চুরি করেনি। তারেক মাসুদ বারবার একটা কথা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ শুধু তার একার নয় বদলে দিয়েছে, তার মত আরও অনেক মানুষের জীবন। তারেক মাসুদের নানা ধর্মপ্রাণ। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন। মাগরিবের নামাজ পড়েই তিনি রেডিও নিয়ে বড় আমগাছতলায় বসতেন। গ্রামের অনেক মানুষ স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতে জড়ো হতো সেই আম গাছের নিচে। তারেক মাসুদ বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধের ঘটনা শুনতেন আগ্রহ ভরে। আমার সোনার বাংলা শুনে শিহরিত হতেন। তারেক মাসুদের জীবনে মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সত্যিকার অর্থে তারেক মাসুদ ও মুক্তিযুদ্ধ অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত।
চলছে…
তারেক মাসুদ: ছবির ফেরিঅলা-পর্ব: ৯॥ শারমিন রহমান