॥পর্ব-এক: জন্ম ও শৈশব ॥
১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর। নুরুন নাহার বেগম ফজরের নামাজ পড়ে আসমাকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। সকালের সূর্য আলো ছড়ানোর আগেই কয়েক পাতিল ধান সিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। উঠোন ভর্তি সে ধান ছড়ানো। একটু একটু করে বেলা বাড়তে থাকে, বেলা বাড়তেই নুরুন নাহার মাসুদের শরীর খারাপ হতে থাকে। ব্যথা শুরু হয় পেটে। অবস্থা বুঝতে পেরে একমাত্র সম্বল মাখনের মা’কে খবর দেওয়া হয়। মাখনের মা ধাত্রী হিসেবে খুবই নাম করা। আসমার জন্মের সময় ও মাখনের মায়ের দায়িত্বে ছিল সব। মাখনের মার হাতে নুরুন্নাহার মাসুদ ও মশিউর রহমান মাসুদের ঘরে দ্বিতীয় সন্তান তারেক মাসুদের জন হলো।
বড় বোন আসমার দুই বছরের ছোট ছিলেন তারেক মাসুদ। সংস্কৃতিমনা ও উদার ধর্মীয় আবহে ঘেরা ছিল তাদের পরিবার। মশিউর রহমান মাসুদ অর্থাৎ তারেকের বাবা কলকাতার প্রখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করা শিক্ষিত ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। তরুণ বয়সে খুব সুন্দর গান করতেন তিনি, যুক্ত ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে। যেদিন তারেক মাসুদ এলেন এ পৃথিবীতে, তার দাদি যিনি কোনোদিন কারও আঁতুড়ঘরে যাননি, সবাইকে অবাক করে দিয়ে আঁতুড় ঘর (যে ঘরে বাচ্চা জন্ম নেয়) ঢুকলেন। নাতির মুখ দেখে বললেন, আমার নাতি এ বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। সারা দুনিয়ার মানুষ আমার নাতির জন্য ধন্যি ধন্যি করবে, দেখে নিও তোমরা। দাদির কথা যে এভাবেই ফলে যাবে, সেদিন তা কেউ অনুমানও করতে পারনি।
ছোটবেলা থেকেই তারেক দেখতে খুব ফর্সা ছিলেন, স্বাস্থ্য খুব বেশি ভালো ছিল না তার। ছিপছিপে গড়ন, পাতলা শরীর। দেখতে অনেকটা আমেরিকানদের মতো ছিলেন তিনি।
তারেকের বাবা নুরুন নাহার মাসুদকে খুব ছোটবেলায় বিয়ে করে আনেন। ননদের মেয়ে রুবি ছিলেন তার সমবয়সী। গল্প করার, কথা বলার জন্য রুবি ছিল তার একমাত্র বন্ধু। নতুন পরিবেশে থাকতে আর কোনো কষ্ট হয় না তার বন্ধু রুবির জন্য। যদিও তখন বাড়ির অন্য সবার সঙ্গে মেলামেশার মতো আবহাওয়া বজায় ছিল।
তারেক মাসুদের জন্মের কিছুদিন পরই তার নানি মারা যান। বাড়িতে শোকের ছায়া মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তারেকের বাবা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যান। কাউকে কিছু না বলে তিনি কোথায় যে চলে যান, তা কেউ জানতে পারে না। কান্নাকাটি, খোঁজাখুজি করেও মেলে না কোনো খবর। মুষড়ে পড়েন নুরুন নাহার মাসুদ। ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে তিনি দিশেহারা। অল্প বয়সে এ আঘাতের সঙ্গে সখ্য হতে না হতেই আরেক আঘাত এসে বিঁধে তার বুকে। কয়েকমাস পর হঠাৎ করেই ফিরে আসেন তারেকের বাবা। সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ হয়ে। যে মানুষটাকে এতদিন ধরে চিনে আসছে সবাই, সে মানুষটার আর যেন কিছুই অবশিষ্ট নেই এই নতুন মানুষটার মধ্যে।
আলখেল্লা পরা, লম্বা দাঁড়ি, মাথায় টুপি পরা মশিউর রহমান মাসুদ বদলাতে থাকলেন পরিবারের সব পুরনো নিয়ম কানুন। পরিবারের ভেতরের মানুষগুলোর আবেগ, অনুভূতি, অভিমতের ওপরে করতে থাকলেন আধিপত্য। বুঝিয়ে দিলেন তার কথাই শেষ কথা।
তারেকের মা ছোট বয়সে বউ হয়ে এসে সবার সঙ্গে গল্প করে, আনন্দে সময় কাটাতো বলে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি তার। কিন্তু আজ এই আবহে তার স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটে সবচেয়ে বেশি। নুরনাহার বেগমকে নিয়ে যাওয়া হয় সম্পূর্ণ পর্দার ওপাশের জীবনে।
চারপাশের বন্যার পানি থই-থই করছে। আসমা তখন কথা বলে, দৌড়ে বেড়ায় ঘরময়। পানির কারণে আমাশয় হয় আসমার। কিন্তু কোনো সঠিক চিকিৎসা করা হয়নি আসমার। তারেকের বাবার অ্যালোপ্যাথির ওপর কোনো ভরসা ছিল না। খাওয়াতে শুরু করলেন হোমিওপ্যাথিক ওষুধ। তাতে ধীরে ধীরে আসমার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। অবস্থা খারাপ দেখে মানুষের পরামর্শে খাবার বন্ধ করে দেওয়া হলো আসমার। তারেকের বাবার সামনে কথা বলার সাহস ছিল না কারও। ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত সবাই। তিনি খাবার বন্ধ করেছেন আর কেই বা আসমাকে খাবার দেওয়ার সাহস পায়! মেয়ের জন্য ভেতরে ভেতরে গুমরে মরে যাচ্ছিলেন নুরুন নাহার বেগম, কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস তার ছিল না। স্বামীর মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার কথা কল্পনায় আনতেও ভয় পেতেন তিনি।
চলবে…