দুটোর ফ্লাইট ডিলে। এসে পৌঁছালো তিনটায়। তারপর এয়ার পোর্ট চেক ইন আউট-এর ঝামেলা। ট্যাক্স সব শেষ করে বের হতে ঈষাণের আরও এক ঘণ্টা। আর এদিকে ঈশানের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চন্দ্রের বিরক্তি চরম পর্যায়। হঠাৎ শা করে পাশ থেকে একটা গাড়ি এসে থামে চন্দ্রের কাছে। আর দারুণ দেখতে একজন সুপুরুষ তার ডোর খুলে ধরে,
চন্দ্র্ উঠে এসো।
চন্দ্র অবাক হওয়ার সময় পায় না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো গাড়িতে ওঠে।
আমি তোমার ছবি দেখেছি। রূপকথা তোমার সব কথা আমাকে বলেছে। তোমার প্ল্যাকার্ড দেখেই আমি তোমার কাছে চলে এলাম।
আমার আবার কী কথা?
না মানে, তোমার নিশ্চয়ই মনে নানা ভাবনা উঁকি দিচ্ছে যে, তোমাকে চিনলাম কী করে এই সব।
ঈশান দেখতে ভালো, ম্যানলি। কিন্তু সভ্যতা ভদ্রতার ধারে কাছে নেই। কোনো পরিচিত হওয়ার বালাই নেই। কেমন আছেন-টাছেন না। সরাসরি কথাবার্তা শুরু করে দিল যেন কত কালের চেনা। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই যেন চন্দ্রর মনের কথা শুনে ফেলেছে এমনভাবে হাত বাড়িয়ে দিল ঈশান,
এনিওয়ে নাইস টু মিট ইয়্যু।
হাতটা স্মার্টলি স্পর্শ করে চন্দ্র, ভদ্রতাটুকু তার মজ্জাগত। মায়ের কাছ থেকে শেখা।
আমি ঈশান। ইঞ্জিনিয়ার। নেভাদা কোস্ট ইউনিভার্সিটিতে আছি। নিত্যনতুন যন্ত্রাংশ আর অসাধারণ গতি সম্পন্ন সব ভিহাইক্যাল তৈরির গবেষণায় লেগে আছি।
এতক্ষণে বুঝতে পারে চন্দ্রকথা দিদির সঙ্গে ঈশানের যোগটা কোথায়।
রূপ ম্যাম বাড়ি আছেন তো?
ম্যাম, রূপকথা?
হ্যাঁ। তিনি তো আমার শিক্ষক। আমেরিকায় যখন তিনি প্যাট্রিসিয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রথম দিকে যোগ দিয়েছিলেন, তখন আমি তার ছাত্র ছিলাম। তিনি পড়াতেন থিওরি অব রিলেটিভিটি। ম্যামের দারুণ একটা পরিকল্পনা একদিন জানতে পাই।
কী পরিকল্পনা বলুন তো।
তিনি একটা টাইমমেশিন বানাতে চান।
হুম
যে টাইমমেশিন ছুটবে আলোর গতির চেয়েও ১০/২০গুণ বেশি গতিতে। পেছনে। কিংবা সামনে।
তাই
হ্যাঁ, যার ওপর চড়ে ভবিষ্যৎ কিংবা অতীতের নির্দিষ্ট দিন তারিখ কিংবা বছর উল্লেখ করে বাটন অন করলেই পৌঁছানো যাবে যেখানে তুমি ঠিক যেতে চেয়েছ, সেই সময়টিতে।
তাহলে তো মানুষের সবই আগে-আগে জানা হয়ে যাবে। মানে আমার ধারণা, মানুষ বেশি বেশি যেতে চাইবে ভবিষ্যতে।
উহু। ভুল বললে। মানুষ যেতে চাইবে সবসময় অতীতে। মানুষের অতীত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বর্তমান থেকে অনেক সুন্দর। আর মানুষ কেবল সুন্দরই খোঁজে। অতীতের অনেক কিছুই আমরা ভুলে যাই, মনে রাখি না। বিশেষ মুহূর্তে মনে হয় ইস যদি সেই দিনটায় আবার যাওয়া যেত? কিন্তু ভবিষ্যৎ তো বর্তমানই নির্মাণ করছে প্রতিনিয়ত। যেমন এখন আমি আর ম্যাম ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছি একটা কার্যকরি টাইমমেশিন বানানোর।
তাই। আপনি কি মনে করেন সত্যিই টাইমমেশিন বানানো সম্ভব হবে কোনোদিন। কোনোদিন কি সম্ভব হবে টাইমমেশিনে ভ্রমণ করে অতীত বর্তমান ভ্রমণ করা?
ঈশান বেশ কিছুক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করে। তারপর বলে,
হুম। হবে। একদিন কবি যা কল্পনা করে বাস্তবে বহু বহু বছর কাল যুগ পর বিজ্ঞানী তা সত্যি প্রমাণ করে। দেখই না কবি একদিন বলেছিলেন না, ‘আকাশ ফুঁড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরে। শুনবো আমি ইঙ্গিত কোন মঙ্গল হতে আসছে উড়ে’। তখন কেউ ভেবেছিল মানুষ চাঁদে যাবে, বসতি করবে সেখানে? কিংবা মঙ্গলে কোনোদিন যাওয়া সম্ভব হবে? কিন্তু গেছে তো?
সে তো নিত্য গবেষণা আর তার সাফল্য। অথচ টাইমমেশিন? এ এক সময় পরিবর্তনের বিষয়। যে সময় হারিয়ে গেছে। তাকে পাওয়া। তাহলে তো আর হারিয়ে যাওয়া সময় বলে কিছু থাকে না।
সময় পরিবর্তন নয় চন্দ্র বলো সময় পরিভ্রমণ। তাছাড়া সময় কি আসলে হারিয়ে যায়? সময় হারিয়ে যায় না। ঠিকই স্থির রয়ে যায়। আমরা মানুষ। মরণশীল। জরা মৃত্যুকে এড়াতে পারি না। মানুষ আমরা, ক্ষয়ে যাই মরে যাই। সময় ঠায় সব স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে এক জায়গায়। তুমি কি ভেবে দেখেছ? ইথারের মাধ্যমে দূর দেশের ছবি বা কণ্ঠ অন্য কোনো দূর দেশে বসে পর্দায় দেখতে পাই শুনতে পাই। সেই ইথারে তো তাহলে নিশ্চয়ই শত শত বছর আগেরও অনেক কিছুই ভেসে আছে। বলা তো যায় না এমনও হতে পারে ১৬০০/১৭০০ বছর আগের কোনো মানুষের ছবি বা কথাও হয়তো কোনো একদিন ইথার থেকে পেয়ে যেতেও পারি আমরা। ইথার তরঙ্গের প্রতিটি ফ্রাকশন যেদিন আমরা টাচ করতে পারব, সেদিন এটাও সম্ভব হতে পারে। মনে রেখো বিজ্ঞানের অসম্ভব বলে কিছু নেই।
কী বলছেন আপনি এসব?
হুম। প্রশ্ন করে দেখবে তোমার দিদিকে। ম্যাম তো এ নিয়েই গবেষণা করছেন। আমরা টাইমমেশিনে দূরত্বের মাপে ভ্রমণ করতে পারব না। ভ্রমণ করতে হবে সময়ের পরিমাপে। তাই একে মাইল কিংবা আলোকবর্ষ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। আর এ হবে দারুণ এক ভ্রমণের পরিকল্পনা।
চন্দ্রর খানিকটা রাগ হয়। তার শুরু থেকেই ধারণা দিদি এমন একটা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যা কোনোদিন সফল হওয়ার নয়। সময় বয়ে যাচ্ছে। দিদির বয়স প্রায় ২৯/৩০ হতে চলল। বিয়ে শাদির নাম নেই। ঘর সংসারের চিন্তা নেই। দিনরাত পড়ে আছে এক গবেষণা নিয়ে। ঈশান আসার কথা শুনে একদিকে চন্দ্র খুশিই হয়েছিল। ভাবছিল দিদির কোনো পছন্দের বা ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু এত আরও এক কাঠি এগিয়ে। চন্দ্রর একটাই ভয়। এই গবেষণা যেদিন অসফল প্রমাণিত হবে, সেদিন দিদিকে কী করে সামলাবে। দিদি নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পড়বে। সে রাগত স্বরে ঈশানকে বলে,
পরিকল্পনা নয়। বলুন অসম্ভব পরিকল্পনা।
তুমি তো দেখছি দারুণ নিরাশাবাদী মেয়ে! স্বপ্ন না দেখতে পারলে কী করে স্বপ্ন সফলের প্রত্যাশা করা যায় বলতে পারো?
আপনি আমাকে বলুন অলীক স্বপ্ন দেখে কী লাভ?
স্বপ্ন কখনো অলীক হতে পারে না। মনে রেখো। রাতে ঘুমিয়ে আমরা যে স্বপ্ন দেখি, তা ফ্রয়েডের ভাষায় আমাদের মনের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা বহিঃপ্রকাশ। বাস্তবে যা আমরা খুব করে চাই কিন্তু বিপরীত পরিস্থিতির কারণে সেটা করতে পারি না, তখন স্বপ্নে তার প্রকাশ ঘটে। আসল কথা অবদমিত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ হলো স্বপ্ন। কিন্তু বাস্তব স্বপ্ন যা তোমাকে জাগিয়ে রাখে, দিনের পর দিন ঘুমুতে দেয় না, তার প্রতি নিষ্ঠা থাকলে সেই নিষ্ঠা আর একাগ্রতাই তোমাকে সফলতার দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবে ঈশান। তারপর বলে,
আচ্ছা চন্দ্র, তুমি কি ভাবতে পারো আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়?
কী বলছেন এসব? আপনি তো দেখি দিদিরই মতোই।
তুমি বলো। আত্মা অবিনশ্বরতো?
বলো?
হ্যাঁ অবিনশ্বর।
পৃথিবীর সব ধর্মেই কিন্তু বলা আছে আত্মা অবিনশ্বর। শরীর পুড়িয়ে ফেললে ছাই হবে। কিংবা কবর দিলে মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু আত্মা? তার কী হবে? শরীর ছেড়ে বের হয়ে আসার পর স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল। কোথাও না কোথাও তো আছে তারা। বাতাসেও থাকতে পারে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগও সম্ভব হতে পারে। যারা এক সময় দেহ নিয়ে পৃথিবীতে ছিল। তাহলে নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব।
এও কি সম্ভব?
আমি তোমাকে আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেব। তখন তুমি বুঝবে অসম্ভব কথাটার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। রূপকথার রাজকন্যার মতো পৃথিবীখ্যাত এমন একজন সাইন্টিস্টের বোনের কাছে এমন কথা আমি আসলে সত্যি আশা করিনি।
চলবে…
টাইমমেশিন: পর্ব-৫ ॥ শাপলা সপর্যিতা
টাইমমেশিন: পর্ব-৪ ॥ শাপলা সপর্যিতা
টাইমমেশিন: পর্ব-৩ ॥ শাপলা সপর্যিতা
টাইমমেশিন: পর্ব-২ ॥ শাপলা সপর্যিতা
টাইমমেশিন: পর্ব-১ ॥ শাপলা সপর্যিতা