নেভাদা কোস্ট ইউনিভার্সিটির স্পেশাল অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ। দেশ বিদেশের সব সাংবাদিক হাজির। ঈশান খুব ব্যস্ত। গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করেছে তার পুরো দল। মধ্যরাত শেষ হওয়ার কিছু পরেই গরম চুল্লি থেকে সম্পূর্ণ আকার নিয়ে নেমে এসেছে টাইমমেশিন। আগেও বহুবার বহু পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী এই প্রচেষ্টা করে গেছেন। সাফল্যের সঙ্গে টাইমমেশিন তৈরিও করা গেছেন। কিন্তু তাতে ভ্রমণ সম্ভব হয়নি। এবার অবশ্য যে দুজন ব্যক্তি পৃথিবীতে আলোড়ন জাগানো এই আবিষ্কারটির জন্য নিয়োজিত আছেন, তারা দুজনই খুব ইয়ং। একজন হলেন ইঞ্জিনিয়ার ঈশান আব্দুল্লাহ আর একজন বিজ্ঞানী রূপকথা রাজকন্যা। আর সবচেয়ে বেশি ভরসার জায়গা হলেন বিজ্ঞানী আকবর খান। তিনি রয়েছেন পুরো কাজটির পেছনে বিশ্ববাসী ইতোমধ্যে তা জেনে গেছে। এখানে রয়েছেন আরও অনেক নামকরা ডাকসাইটে বিজ্ঞানী আর জাঁদরেল সাংবাদিক। পর্দা ঘিরে মঞ্চে রাখা আছে টাইমমেশিনটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে গেল পর্দা। গ্যালারিতে বসে থাকা শত শত সাংবাদিকের ক্যামেরা ঝলকে উঠল মুহূর্তের মধ্যে। শুধু ক্লিক আর ক্লিক। সরাসরি সেটা দেখানো হচ্ছে ডিসকোভারি চ্যানেলেও। ওদিকে বাংলাদেশেও রূপকথা রাজকন্যা চন্দ্রকথা শেহজাদী ঝুমুর চৌধুরীর চোখ টিভির পর্দায়। দারুন কৌতূহল। দমবন্ধ করা উত্তেজনা। চন্দ্রর উত্তেজনা আরও বেশি। কারণ তার বিশ্বাসটা জন্মেছে মোটে ক’দিন আগে। রূপকথারও দারুণ এক অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে। কারণ ঈশান তো তার পর্যায়টা নামিয়ে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর দৃষ্টিটা এর পরই এসে স্থির হবে বিজ্ঞানী রূপকথা আর বিজ্ঞানী আকবর খানের ওপর। এখন যে মুগ্ধতায় দেখা হচ্ছে টাইমমেশিনের বাহ্যিক রূপ। যদি ভ্রমণ করতে তারা ব্যর্থ হয়, তবে এটি জাস্ট আয়রনের একটা জঞ্জাল হিসেবে পরিগণিত হবে আর বিশ্ববাসী তাদের দিকে তাকিয়ে হাসবে। ঝুমুরও চশমার গ্লাসটা একবার মুছে আবার চোখে দেয়। বোঝা যায় টেনশনে আছে মাও। রূপকথা মায়ের হাতটা জোড়ে চেপে ধরে,
মা।
মেয়ের মনের অবস্থা মা বুঝতে পারে। চন্দ্রও মায়ের হাতটা ধরে। দুই মেয়ের চারটি হাত মুঠোয় ধরে ঝুমুর একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন প্রার্থনা করে। বোধ করি মেয়ের সারাজীবনের ইচ্ছে প্রত্যাশা আর পরিশ্রম যেন বাস্তব হয় এই প্রার্থনাই সে করছে সৃষ্টিকর্তার কাছে।
চিন্তা করো না। সব হবে। ঠিকঠাক মতোই হবে।
এর মধ্যেই সাংবাদিকদের জেরা পর্ব শুরু হয়ে যায়,
আচ্ছা মি. ঈশান আপনি তো শুরু হতেই ‘প্রজেক্ট টাইমমেশিন-১৯৭৪ টু ২০৩৬’ এর সঙ্গে যুক্ত?
জ্বি।
আমাদের একটু বলুন তৈরি টাইমমেশিনটি আসলে কী প্রযুক্তি অনুসরণ করেছে?
এটি আসলে খুব একটা বিশেষ প্রযুক্তি নির্ভর নয়। কারণ আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে টাইমমেশিনটির বডি তৈরি করেছি, তা খুব বেশি পার্থক্যের তাপমাত্রায় ভ্রমণে যাবে না।
কিন্তু যখন আমরা চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে ভ্রমণে যাচ্ছি তখন তো…
সাংবাদিকে মুখের কথা টেনে নিয়ে ঈশান বলে,
দেখুন। মহাশূন্য ভ্রমণে তাপমাত্রা, অভিকর্ষ বল মহাকর্ষ বল ভর ওজন আর অক্সিজেন এর কম বেশি, আলোকবর্ষ মানে দূরত্ব অর্থাৎ লেঙ্গথ্ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এ তো মহাকাশ ভ্রমণ নয়। পৃথিবীর ভেতরেই থাকছি আমরা।
এই ভ্রমণটা তাহলে কেমন আর এই ভ্রমণটা কি আদৌ সম্ভব?
দেখুন, আমরা যদি বিশ্বাসই না করি যে এটা সম্ভব, তবে আর এতদূর কি করে এলাম। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সম্ভব।
তারপর ঈশান পরিবেশটা হালকা করে
শুনুন ব্শ্বিসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
সাংবাদিক তবু নাছোড়বান্দা,
না মানে এ তো খেলা নয়। শত শত কোটি কোটি টাকার বিষয়টাও জড়িয়ে রয়েছে।
দেখুন এত কমার্শিয়ালি কোন আবিষ্কার সম্ভব নয়। মনে রাখবেন যেকোনো আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যর্থতা। এটাকে আসলে ব্যর্থতা বলাই ঠিক নয়। এই ব্যর্থতাগুলো আসলে ইনভেস্টমেন্ট। পরবর্তী সময়ে সফল হওয়ার।
গ্যালারিতে নীরবতা নেমে আসে। ঈশানের কথার উত্তর দিতে পারে না কেউ। একজন নীরবতা ভাঙে,
আচ্ছা রূপকথা রাজকন্যে নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে আছেন?
হ্যাঁ, তিনি সার্বক্ষণিক নেটে আছেন আমাদের সাথে। তিনি না থাকলে কী চলে?
আমরা কি তার সাথে যোগাযোগ করতে পারি?
অবশ্যই।
গ্যালারি থেকে সরাসরি ইন্টারনেটে যোগাযোগ হয়। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে রূপকথা রাজকন্যের মুখ। নিজের গবেষণারুমটি থেকে যেখানে বসে মনিটরে রূপকথা মা আর চন্দ্রকথাসহ অনুষ্ঠানটি দেখছিল। রূপকথা হ্যালো বলতেই ছুটে আসতে থাকে প্রশ্ন,
আচ্ছা ম্যাম। আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশে বসে এমন একটা আবিষ্কারকে সফলতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব?
কেন নয় সেটা আপনি আগে আমাকে বলুন?
সাংবাদিক ইতস্তত করে,
না মানে, মানে। তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশে বসে এই ভাবনা আসলে কি হাস্যকর নয়?
আমি তো বলব এ আপনার রুচি। আপনি হাসতে চাইলে হাসবেন। তবে তৃতীয় বিশ্ব বলে আপনি এই মুহূর্তে আমার দেশকে যে শ্রেণীতে ফেলে দিলেন আশা করি খুব দ্রুতই আপনার ভুল ভাঙবে।
তাৎক্ষণিক আর একজন সাংবাদিক,
এ কি আদৌ সম্ভব ম্যাম?
দেখুন। আমরা অনেক দেশের সাহায্য নিয়েছি ঠিক। ভাগ্যের কারণে আর নিজেদের কিছু ভুলে আমরা আজ অনেক পিছিয়ে আছি ঠিক। কিন্তু যে বিধাতা আমাকে ২৫০০০ কম্পিউটারের সমান স্মৃতিশক্তি ধারণক্ষম একটি কার্যকরী ব্রেইন দিয়েছেন তাকে নিশ্চয়ই আপনি অস্বীকার কিংবা হাস্যকর করে তুলতে পারেন না। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই একজন মানুষ একটি দেশ আর সারাবিশ্ব এগিয়ে যায়। তাই আমাদের অর্থনৈতিক বাধাটাকে অনেক দেশ কোনো বাধাই মনে করেননি। তারা আমাকে যথাযথ সাহায্য করেছেন।আমার দেশও যতটুকু সম্ভব আমাকে হ্যাল্প করে যাচ্ছে।
আর একজন সাংবাদিক আবার প্রশ্ন ছুড়ে দেন,
এই অলিক ভ্রমণটিকে আপনি বাস্তবের সাথে কিভাবে সংযুক্ত করবেন। ধরুন আপনি যখন, আজ, ২০৩৬ সাল এ অবস্থান করছেন আর তা থেকে ২০০৭ এ চলে যেতে চান তখন?
তাৎক্ষণিক উত্তর রূপকথার,
সেটাইতো দেখার জন্য সারাবিশ্ব অপেক্ষা করছে। আপনিও একটু অপেক্ষায় থাকুননা। হুম?
গ্যালারি থেকে ঈশান প্রথম হাততালি দিয়ে ওঠে। সাথে সাথে আরও আরও যত সুধীজন। টানটান উত্তেজনাপূর্ণ একটা প্রেস কনফারেন্স শেষ হয়। ঈশান চন্দ্রকথা মা আর স্যার সবাই দারুণ খুশি রূপকথার শেষ উত্তরটি যথার্থ প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে। কিন্তু চন্দ্রকথা খেয়াল করে রূপকথা অত উৎফুল্ল নয়। তার কপালে চিন্তার সুস্পষ্ট রেখা দেখা যায়। ভীষণ ব্যস্ত আর ব্যাকুলভাবে সে ফোনে স্যারের নম্বর ডায়াল করে,
স্যার, দেখেছেন পুরো সেশনটি…
আরো আরও কী কী সব কথা হয় গুরুশিষ্যের মধ্যে। চন্দ্র আর মা এর মধ্যে থাকে না। ল্যাবরেটরি ছেড়ে যায় তারা। রূপকথা বিশেষ কোনো আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্যারের সাথে।
চলবে…