এক.
আকাশে চাঁদ গলে গলে পড়ছে যেন জোছনায়। ঢাকা শহরে দৈত্যের মতো বিশাল বিশাল অট্টালিকার ফাঁক গলে একচিলতে আলো এসে পড়ে রূপকথার গায়ে মুখে শরীরে। বিছানার ওপর উপুড় হয়ে বই পড়ছে সে। ৮ বছরের মেয়েটাকে ঝুমুরের মনে হয় যেন এক ডানাভাঙা পরী। নিজের মেয়ে। কালো রঙে দুর্গার মতো অপরূপ। বড় বড় চোখ, টিকালো নাক আর রেশমি ঝলমলে চুলের কন্যাটি তার বড় আদরের। চিরকালের একলা জীবনে এ তার পরম পাওয়া। বিধাতার এক অদ্ভুত ভালোবাসা তার প্রতি। কিছুক্ষণ আগেই মায়ের কাছে এসেছিল কতগুলো কল্প কাহিনির বই নিয়ে
মা মা দেখো। এই বইগুলো আমি পড়ি?
পড়ো
বই পড়তে কোনো নিষেধ নেই। সব পড়ো। ঝুমুর মেয়েকে সবসময়ই বলে
সব পড়ো। দেখো জানো। যেকোনো ধরনের বই পড়ার অভ্যেস করো।
আচ্ছা মা সত্যি সত্যি কি মানুষ চাঁদে গেছে?
তোমার কী মনে হয়?
গেছে।
হুম গেছেই তো।
মা মা জানো, চাঁদে প্রথম কাকে পাঠানো হয়েছিল?
মেয়েটা কথা বলার আগে পিছে কতবার যে ‘মা’-‘মা’ করে ডাকে। খুব ভালো লাগে ঝুমুরের। কথাগুলো প্রলম্বিত করে সে। মেয়ের আগ্রহ বাড়াতে আর কতটুকু সে জেনেছে, তা বোঝার জন্য না জানার ভান করে।
কাকে?
একটা বানর আর একটা কুকুরকে
কেন রে? মানুষ বাদ দিয়ে বানর আর কুকুর কেন?
নিজের মেয়ের আইকিউ পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হয় ঝুমুরের।
কারণ চাঁদে গেলে কেউ বাঁচবে কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্য একটা কুকুর কিংবা বানরই ঠিক।
কেন, কেন, বানর কেন? কুকুর কেন?
মা, তুমি খুব বোকা। একটা মানুষ যদি চাঁদে যেতে গিয়ে মরে যায়। বুঝো না কিছুই তুমি।
কেন মানুষ চাঁদে গিয়ে মরে যাবে কেন? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। বুঝিয়ে বলতো একটু।
মা যখন কেউ যায়নি এমন একটা অজানা জায়গা। সেখানে প্রাণী বাঁচতে পারবে কি না, উপযুক্ত পরিবেশ আছে কি না—সেটা বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করেছে কিন্তু প্রমাণ তো করতে পারেনি। দেখা গেল মানুষটি চাঁদে গিয়ে কোনো একটা কারণে মারা গেল। তখন? তাই আগে প্রাণী হিসেবে কুকুর বা বানর পাঠিয়ে দেখা হয় যে সেখানে ওরা বাঁচবে কি না।তারপর মানুষ পাঠায়।
ঝুমুর আবার প্রশ্ন করে তো কী হয়েছে বানর আর কুকুর কি মরতে পারে না?
আহা।বানর আর কুকুর কি মানুষের মতো অত মূল্যবান? একটা কুকুর বা বানর মরলে তেমন ক্ষতি হয় না মানুষ মরলে যেমন হয়।
চোখ বড় বড় করে মা রূপকথার কথাগুলো একটু বোঝার চেষ্টা করে।
তাইতো তাইতো। মানুষের মতো অত মূল্যবান কুকুর আর বানর কি করে হবে!
হঠাৎ খুব আহ্লাদিত আর লজ্জিত হয়ে গা ঘেঁষে মুখটা মায়ের ঘাড়ে ঘষতে ঘষতে বলতে থাকে—
জানো মা, আমার না সাইনটিস্ট হতে ইচ্ছে করে।
একে বলে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া
ওমা বলিস কিরে? তুই সাইনটিস্ট হবি? তা ঠিক আছে। হোস। এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে তাতে? কিন্তু সাইটিস্ট হতে ইচ্ছেটা কেন হলো শুনি?
কেন বলতো?
আমি তোমার ছোটবেলা দেখতে যাব।
সাইন্টিস্ট হলেই কী করে আমার ছোটবেলা দেখবি? ও দিন তো পুরানো হয়ে গেছে। শেষ। একে বলে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া।
এবার ঝুমুরের সত্যিই অবাক হওয়ার পালা। আসলেই মাথায় ঢোকে না তার। কোথা থেকে জল কোথায় গড়াচ্ছে। ছিল চাঁদ মানুষ কুকুর আর বানরের গল্প। চাঁদে যাওয়ার গল্প।
ঠিক আগেরই মতো লজ্জিত হয়ে রূপকথা বলে,
মা, আমি একটা টাইম মেশিন বানাবো বড় হয়ে। তাই সাইন্টিস্ট হতে চাই। আর সেটায় চড়ে আমি তোমার ছোটবেলায় চলে যাব। শিউলি ফুলের ওই গাছটা দেখব। বড়শির টোপ গিলে ধরা খেয়ে বড় মামাকে যে মাছটা ছিপসহ ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল সেই ঘটনাটা দেখব। মা তোমাদের বাসার ঝুলানো বারান্দা থেকে লালমাই পাহাড়টা দেখতে কেমন লাগে, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। আর ওই যে বাদুড়। পেয়ারা খেয়ে সকাল বেলা ইলেকট্রিসিটির তারে শক খেয়ে মরে যায়, সেই বাদুড়গুলোকে দেখার আমার বড় শখ মা।
রূপকথার ছোট বোন চন্দ্রকথা পাশে বসে কতগুলো ব্লক নিয়ে একটা ঘর বানাতে খুব চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তার বয়স পাঁচ। কেউ ভাবেনি সে মা আর বড় বোনের কথাগুলো এত মনোযোগ দিয়ে শুনছে। হঠাৎ দৌঁড়ে এসে রূপকথার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, দিদি ও দিদি আমাকেও নিয়ে যাবা?
খুব গুরুগম্ভীর একটা ভাব এনে রূপকথা বলে, তুমি ভয় পাবে নাতো?
না না একদম ভয় পাব না।
শক্ত হয়ে বসে থাকতে পারবে তো টাইম মেশিনে?
পারব দিদি
ওটা কিন্তু অনেক জোরে যাবে মনে রেখো। আলোর গতির চেয়েও দ্রুত।
চন্দ্রকথা অত কিছু বোঝে কি বোঝে না, শুধু বলে ওঠে,
দিদি ওটাতে তোমার আমার দু’জনের জায়গা হবে তো?
মুখে চোখে সাইন্টিস্ট ভাব এনে রূপকথা বলে, হুম একটু বড় করে বানাতে হবে তবে।
নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগতে থাকে তার
তারপর একটানা দু’জনে প্ল্যান করতে থাকে কী করে টাইমমেশিন বানানোর যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। রূপকথা চন্দ্রকথাকে তার সব প্রজ্ঞা ঢেলে দিতে থাকে সাইন্টিস্ট হতে হলে অনেক পড়াশোনা জানতে হবে। অংকে পটু হতে হবে। ইংলিশ খুব রপ্ত করতে হবে। কারণ বড় বড় বিজ্ঞানের বইগুলো সবই ইংরেজিতে। আর অনেক অনেক সময় ধরে পড়ার অভ্যেস করতে হবে। ছোটবোনকে একটু বকাও দেয় সে, তুমি তো সন্ধ্যা হতেই ঘুমিয়ে পড়তে চাও। এমন করলে হবে না। ভোরে উঠলেও অনেক রাত জেগে জেগে পড়ার অভ্যাস করতে হবে।
কেন দিদি?
একটু মুরুব্বিয়ানা ফলায় রূপকথা। মা প্রায়ই ওদের বলে যেসব কথা, সেগুলোই বলতে বলতে ছোট বোনকে ঝাড়ি দেয় সে, আরে দিন কি আর চব্বিশ ঘণ্টার জায়গায় ছাব্বিশ ঘণ্টায় হবে, হ্যাঁ? তাহলে পড়ার সময় বাড়বে ক করে? ঘুমানোর সময় কমিয়ে বেশি সময় জেগে পড়ার সময় বাড়াতে হবে।
আমি না ঘুমিয়ে পারব না। আমিতো টাইমমেশিন বানাব না। সাইন্টিস্ট হব না।শুধু তোমার সাথে যাব মা’র ছোটবেলায়।
তা বললে হবে না।আমি এত কষ্ট করে টাইমমেশিন বানাব আর তুমি কষ্ট ছাড়াই আরাম করে চলে যেতে চাও? যেতে হলেও কিছু না কিছু জানতে হবে। হঠাৎ কোনো বিপদে পড়লে উদ্ধার পাওয়ার জন্য।
কী বিপদ দিদি? উদ্ধার কী?
ওদের কথার মোড় ঘুরে যায়। বিপদ আর উদ্ধার সম্পর্কে রূপকথা চন্দ্রকথাকে জ্ঞান দিতে শুরু করলে ঝুমুর সরে আসে তাদের কথার মাঝ থেকে।
ঝুমুর অবাক হয়ে ভাবতে থাকে কি অদ্ভুতভাবে মেয়েটার মাথায় ঢুকে গেছে প্রকৃতির রূপ। তার শোভা। আহা নেশাতুর। তাকে ছোঁয়ার এমনই প্রবল আকাঙ্ক্ষা তার মেয়ের। কি দারুণ সেতু তৈরি করেছে মনে মনে। টাইমমেশিন।খুব কষ্ট হতে থাকে ঝুমুরের বুকের ভেতর। ঢাকা শহরের এই অট্টালিকার ভীড়ে সে পারেনি তার মেয়েকে দিতে একটা সবুজ ঘাসের মাঠ। সকালে ঘুম ভেঙেই চোখের সামনে মেলে ধরতে পারেনি একটা নীল আকাশ আর মুঠো মুঠো সোনা রোদ। যা তার বাবা মা তাকে দিয়েছিল। নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগতে থাকে তার।
চলবে…