[পর্ব-৮]
রতনের দিনগুলো বেশ কাটছে আজকাল। মাথার মধ্যে ঝিঁঝিটা ঘুমিয়ে, রক্তে কোনো মৃত্যুবীজের অস্তিত্ব নেই আর। নিস্তরঙ্গ, নিরুদ্বেগ কাটছে সময়টা। রুমকীকে স্কুল থেকে আনা, বিকেলটা রুমকীর সঙ্গে খুনসুটিতে কাটানো, সন্ধ্যায় দীপন অফিস থেকে ফিরলে একসঙ্গে চা খাওয়া, তুলির সঙ্গে হালকা দুয়েকটা কথা, তারপর নিজের ঘরে পছন্দের কোনো বই নিয়ে পাতা উল্টানো। তাকে বেশি রাত জাগতে দেয় না দীপন। সে রাত জাগতে পারেও না আদতে। ওষুধ তো নিয়মিত চলে তার। ওষুধের প্রভাবে দশটা বাজতে না বাজতেই গভীর রাত নেমে আসে তার চোখে। নামে গভীর ঘুম। ছাত্রবয়সে ভীষণ পড়ুয়া ছিল রতন, ছিল তুখোড় ছাত্র। স্কুলে তার নাম ছিল সবার মুখে মুখে, কলেজেও অনেকের ঈর্ষার পাত্র ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরও তাকে পেছনে ফেলতে বেগ পেতে হতো সহপাঠীদের। সবাই সমীহ করতো তাকে, ভালো ছাত্র হিসেবে, ভদ্র ছেলে হিসেবে সে ছিল সবার প্রিয়। মেয়েরাও কামনা করতো। বুঝতো রতন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল দূরে স্থির। পড়াশোনা শেষে ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে তাকে, মা আর দীপনকে আর কষ্ট করতে দেবে না সে, পণ ছিল।
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৫॥ শিল্পী নাজনীন
সে তুলনায় দীপন ছিল বখাটে, ফাঁকিবাজ। পড়াশোনায় মোটেই মন ছিল না তার। সারাদিন টো টো ঘুরতো। রাতে বই নিয়ে মন চাইলে বসতো, নইলে না। মা’র হাতে পিটুনি খেত বেদম। তবে তার মাথা ছিল পরিষ্কার। অল্প পড়াতেই আয়ত্ত করতে পারতো যেকোনো বিষয়। রতনকে নিয়ে মা’র স্বপ্ন ছিল অনেক, বিশ্বাস ছিল অগাধ। মা’র স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, সব পূরণের দায়িত্ব রতনের, এমনটা ধরেই নিয়েছিল দীপন। সে তাই ছিল নির্ভার, মুক্ত। এই একটা ব্যাপারে বাবার সঙ্গে পুরোপুরি মিল ছিল তার। তার বাবা সংসারের সব ভার স্ত্রী খুশবুর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন সব সময়। তার একমাত্র কাজ ছিল সকালে নাস্তা সেরে পরিপাটি হয়ে দুপুরের খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে নিয়ে অফিসে যাওয়া, বিকেলে সময় মতো অফিস থেকে ফিরে ঘরের দাওয়ায় খালি গায়ে বসে সকালের বাসি পত্রিকা পড়া নইলে কোনো একটা বই হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগে পাতা উল্টানো। সন্ধ্যায় বোকা বোকা মুখ করে রান্না ঘরে ঢুকতেন বাবা, মা’র অনতিদূরে টুল পেতে বসে খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, কী রান্না করছ, রতনের মা?
মা ঘোমটা আরেকটু টেনে দিয়ে, লাজুক হেসে বাবার প্রশ্নের উত্তর দিতেন। মাকে কখনো বাবার কোনো ব্যাপারেই তেমন অভিযোগ করতে দেখেনি তারা, দেখেনি সংসারের কোনো ব্যাপারেই তেমন উচ্চবাচ্য করতে। হয়তো তেমন প্রয়োজনও ছিল না তার। কারণ তাদের বাবা, আজগর আলী, কারও সাতেপাঁচেই ছিলেন না কোনোদিন। নেহাৎ গোবেচারা ধরনের ভালো মানুষ ছিলেন তিনি, কারও উপকার করতে অসমর্থ হলে ক্ষমা চেয়ে নিতেন কিন্তু কারও অপকারে কখনো ছিলেন না তিনি। বাবার এ গুণটা রতন পেয়েছিল পুরোপুরি।
—কী করছিস ভাইয়া?
দরজায় দীপনের হাসিমাখা মুখ উঁকি দিতেই চমকে ওঠে রতন। কেমন একটু কুঁকড়ে যায়। কেন যে আজকাল দীপনকে দেখলে অমন অস্বস্তি হয় তার! ভেতরে ভেতরে শামুকের মতো গুটিয়ে যায় সে, কুঁকড়ে ওঠে। হাতের বইটা একপাশে সরিয়ে রেখে ম্লান হাসে রতন। বলে, দীপন! আয়!
—কী করছিস? পড়ছিস? কী বই ওটা?
সংকোচে হাতের বইটা দীপনের দিকে বাড়িয়ে দেয় রতন। দীপন পাশে এসে বসে। বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। বলে, বাহ্! ফুকোর দর্শন পড়ছিস! ভালো, খুব ভালো। তুই কত কিছু জানিস ভাইয়া! আমি শালা মূর্খই থাকলাম আজীবন!
দীপনের শেষের কথাটায় কেমন একটু বিষণ্নতা টের পায় রতন। রতনের জন্য দীপনের মনেও অনেক কষ্ট জমে আছে, জানে রতন। ভাইকে নিয়ে তারও অনেক স্বপ্ন ছিল, ছিল প্রত্যাশা। পারেনি। কিছুই করতে পারেনি রতন। মাথার মধ্যে ঝিঁঝির বাসা তার। করতে দেয় না কিছুই।
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৪॥ শিল্পী নাজনীন
রতন দীপনের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো একটু হাসে। তারপর খুব নিচুস্বরে, প্রায় শোনা যায় না এমন কণ্ঠে বলে, বেশি জানা ভালো নয় রে দীপন। বেশি জানার কষ্ট অনেক।
দীপন ভাইয়ের হাতে হাত রাখে। গভীর আশ্বাসের সুরে বলে, তুইতো ভালো হয়ে গেছিস ভাইয়া। সুস্থ হয়ে গেছিস একদম। সব ঠিক হয়ে যাবে এবার, দেখিস।
তারপর, যেন হঠাৎ মনে পড়ে, তেমন ভঙ্গিতে বলে, ওহ্! ভাইয়া, তোকে তো বলা হয়নি, এবার ব্যাংকক থেকে অনেকগুলো বই এনেছি তোর জন্য। কাল দেব তোকে, পড়িস আস্তে ধীরে।
একটু কেশে, গলাটা একটু পরিষ্কার করে সংকোচ কাটিয়ে আবার বলে, ভাইয়া, এসব বই তো সব তোর পড়া, এখন আবার পড়ে কী হবে! এতসব কঠিন কঠিন কথা! তুই এসব বেশি পড়িস না আর।
রতন দীপনের চোখের দিকে একটু তাকায়, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর দেয়ালের দিকে চোখ রেখে বলে, আমি তো আসলে এসব পড়ি না দীপন। পড়তে পারি না। মাথায় যন্ত্রণা হয়। এমনিই পাতা উল্টাই। অনেক দিনের অভ্যাস তো, ছাড়তে পারি না।
দীপন একটু থমকায়। রতন যে পড়তে পারে না, তার যে মাথাব্যথা করে এ তথ্য তার অজানা। সে কি তবে ভাইয়ের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছে না আজকাল? নিজের অজান্তেই কি অবহেলা করছে সে রতনের চিকিৎসায়? তখনই মনে পড়ে, অনেকদিন রতনের চেক আপ করান হয় না, আগের ব্যবস্থাপত্রেই গৎবাঁধা ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে তাকে। পড়লে মাথাব্যথা, তার মানে নিশ্চয়ই চোখে সমস্যা হয়েছে রতনের। কালই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে ডাক্তারের সঙ্গে। মনে মনে ঠিক করে নেয় সে।
—তোর ছোটবেলার কথা মনে আছে ভাইয়া? আমাদের সেই গ্রামের বাড়িটার কথা? বাড়ির পাশের সেই বড় খেলার মাঠটার কথা?
—গ্রামের বাড়ি? কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে কী একটা চিন্তা করে রতন, ভাব দেখে বোঝা যায়, মনে করতে চেষ্টা করছে, প্রাণপণ চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না, স্মৃতি প্রতারণা করছে তাকে। তারপর একটু একটু করে হাসি ফোটে মুখে। উচ্ছসিত দেখায়। বড় বড় চোখে রতনের দিকে পরিপূর্ণ তাকিয়ে, উজ্জ্বল মুখে বলে, ও! আমাদের সেই গ্রামের বাড়ির কথা বলছিস? মনে আছে তো! খুব মনে আছে! আর সেই বড় মাঠ! কী বড় একটা বটগাছ ছিল সে গাছটায়! সারাদিন সে গাছের ঝুরি ধরে বাঁদরের মতো ঝুলতিস তুই!
ফিক করে হেসে ওঠে রতন। খুশি হয়ে ওঠে খুব। ভাইয়া তাহলে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠছে এবার! মনে করতে পারছে ছোটবেলাটাও!
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৩॥ শিল্পী নাজনীন
আমাকে একবার নিয়ে যাস তো দীপন গ্রামে। কতদিন যাইনি! বটগাছটা খুব দেখতে ইচ্ছে করে। হ্যাঁ রে, মা কেমন আছে? মাকে অনেকদিন দেখিনি। মাকে কেন এখানে এনে রাখিস না তোরা? গ্রামে একা থাকতে মার কত কষ্ট হয় বলতো!
দীপনের মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়। হাসি নিভে যায় মুখের। দুঃখিত, ব্যথিত মুখে রতনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। বটগাছটা সেই ছোটবেলায়ই কাটা পড়েছিল। আর মা গত হয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। কিচ্ছু মনে নেই রতনের!
দু হাতে দু কাপ চা নিয়ে রুমে ঢোকে তুলি। দীপনের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু থমকায়। আড়ষ্টভাবে রতনের দিকে একটা কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ভাইয়া, আপনার চা।
হাত বাড়িয়ে চা নেয় রতন। তুলিকে বলে, তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নাও তুলি! আমরা মাকে আনতে গ্রামে যাব শিগগিরই।
দীপনের মুখের দিকে তাকিয়ে তুলি বুঝে যায় তার মূর্তি ব’নে যাওয়ার কারণ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ার টেনে ব’সে পড়ে। এত কষ্ট কেন থাকে মানুষের জীবনে ভেবে পায় না সে।
কাল তো শুক্রবার, অফিস ছুটি। ভাইয়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব ভাবছি।
—বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলে দীপন। রুমকী তখনো ড্রইংরুমে। স্কুল ছুটি থাকলে সে একটু রাত করে ঘুমুতে যায়। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে ঠিকঠাক করতে করতে কিছু একটা ভাবছিল তুলি। দীপনের কথা শুনল। চুপ থাকল কিছুক্ষণ। তারপর শান্তকণ্ঠে বলল, কখন যাবে? সিরিয়াল দিয়েছ?
—বিকেলের দিকে যাব। সকালে সিরিয়াল দিতে হবে। ডাক্তার নাজমুলের নাম্বারটা আছে না তোমার কাছে? দেখতে হবে। কিন্তু ভাইয়াকে তো ডা. অনল সেন দেখে।
ভাইয়াকে চোখের ডা. দেখাতে হবে। চোখে সম্ভবত কোনো সমস্যা হয়েছে ভাইয়ার। পড়তে পারে না, বলছিল আজ।আচ্ছা। ডা. সেনের কাছেও তো নেওয়া হয় না অনেকদিন। উনাকেও দেখিয়ে আনো একদিন। এখন কিছুটা ভালো আছে যেহেতু।
—হ্যাঁ, নিতে হবে শিগগিরই। তোমার অফিসের ঝামেলা মিটলো? কী সব অডিট ফটিড চলছিল তোমাদের!
মিটেছে। এমনভাবে বলছ যেন আমাদের অফিসের কাজ নেহাতই ছেলেখেলা কোনো ব্যাপার!
—যাঃ বাবা! সে আবার কখন বললাম?
—তোমাকে কি আর চিনি না? কী বলতে চাও বুঝি না ভাব?
হাহাহা! তুমি সত্যিই জিনিয়াস একটা! এই না হলে আমার বউ! কী অত সাজুগুজু করছ সেই কখন থেকে! এসো তো, একটু আদর করে দেই! এত বুঝদার বউ আমার!
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-২॥ শিল্পী নাজনীন
কটমট করে দীপনের দিকে তাকায় তুলি। ভস্ম করতে চেষ্টা করে চোখে। তারপর হেসে ফেলে ফিক করে। দীপনটা বরাবরের ফাজিল। তার সঙ্গে কোনোদিন পেরে ওঠে না সে। দীপনের চোখেমুখে দুষ্টুমি। তুলি উঠে পড়ে। বিছানায়, দীপনের পাশে শুতে শুতে বলে, ইয়ার্কি ছাড়া থাকতে পারো না, না?
তুলিকে কাছে টানতে টানতে দীপন বলে, ইয়ার্কি আবার কী? তোমার মতো বুঝদার বউ তো সত্যিই দুর্লভ!
—সবসময় তোমার এই তামাশা ভালো লাগে না। তোমার পরবর্তী ট্যুরের খবর কী? কোথায় যাবে এবার?
—এবার সম্ভবত ইউরোপের কোনো দেশে যেতে হবে!
—তাই নাকি! একেবারে ইউরোপ!
—কেন কেন? তুমি কি মনে করো ইউরোপ, আমেরিকায় শুধু তোমাদের অফিসের লোকজনই যায়?
—সে আবার কখন বললাম?
—তুমি যদি বুঝদার বউ তবে আমিও তোমার এলেমদার বর, ভুলে গেলে চলবে?
—আবার!–শাসনের ভঙ্গিতে ধমকে ওঠে তুলি, চোখ পাকায়। দীপন সে সবের তোয়াক্কা করে না। সে তুলির শরীরে ব্যস্ত।
—কতদিন থাকবে? সাড়া দিতে দিতে প্রশ্ন করে তুলি।
—অনেকদিন। প্রায় বছরখানেক।
—মানে কী! আঁতকে ওঠে তুলি।
তুলিকে শক্ত করে জড়িয়ে নিতে নিতে দীপন নিচুস্বরে বলে, দূর পাগলি! দিন-পনেরো থাকব হয়তো। এখন কথা বলে না।
নৈঃশব্দে ডুবে যায় তুলি-দীপন। ছন্দময় নীরবতা।
চলবে…
ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৭॥ শিল্পী নাজনীন