[পর্ব-২১]
মেয়েটা সত্যিই বোকা। কেন যে এমন পাগলামি করে দীপনের জন্য! বুকভর্তি দীর্ঘশ্বাসটা সাবধানে ছেড়ে দেয় দীপন। শ্বাস নেয় প্রাণভরে। বোকা মেয়েটা ফোন ধরছে অনেকদিন। সেই যে, সেই কবে দীপন মিটিংয়ে থাকা অবস্থায় ফোন দিলো তিতলি, উল্টাপাল্টা বকল কতগুলো, সে-ও শুনিয়ে দিল যাচ্ছেতাই, ব্লক করে দিলো তিতলির নাম্বার, তারপর থেকে আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই মেয়েটির। গাল ফুলিয়ে আছে তো আছেই। ফোন দিলেই ব্যস্ত বলছে! কেটে দিচ্ছে ফোন। অভিমান! কেন যে এত অভিমান তার, একা দীপনের ওপরই! কেন যে এত অধিকারবোধ! অদ্ভুত! অস্থির লাগে দীপনের। বোকা মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে সেই থেকে। সে নিজেও কি পাচ্ছে না! তার মনের মধ্যেও কেমন একটা কাঁটা খচখচ করে কি বিঁধছে না প্রতিনিয়ত! আজব ব্যাপার! ভালোবাসা ব্যাপারটাই এমন। আজব। প্রতিদান চায়। আটকে দেয় অধিকারের ঘেরাটোপে। নইলে তিতলি ফোন না ধরলে তার মধ্যেই বা কেন এমন তীব্র অপমানবোধ তৈরি হয়! মেজাজ খারাপ লাগে কেন এমন! কেমনতর একটা কষ্টও টের পায় ভেতরে ভেতরে, চাপা উদ্বেগ! এই বুড়ো বয়সে এসে এ আবার কোন ভিমরতি হলো তার!
ভেবে নিজের মনেই হাসে দীপন। চল্লিশটাকে কি ঠিক বুড়ো বলা যায়, না-কি উচিত? হাসে দীপন শব্দ করে। মাথা নাড়ে। দূর বাবা। নিজেকে বুড়ো ভাবতে সে অন্তত রাজি নয় একদম। এখনো রাতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যাচ্ছে সে আর রতন। মা খুশবু বেগম হিড়হিড় করে কান টেনে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন তাকে স্নান করাতে, কিংবা ঘুড়ি বানিয়ে দেওয়ার আব্দার নিয়ে সে ঘুরঘুর করছে রতনের পিছু পিছু।
আবার ফোন দেয় সে তিতলিকে। দিতেই থাকে। রোখ চেপে যায়। কতক্ষণ সে কেটে দিতে পারে দেখা যাক!
অবশেষে হার মানে তিতলি। ফোন ধরে। নির্জিব, শুকনো কণ্ঠে বলে, হ্যালো!
হ্যাঁ, কী খবর তোমার? কেমন আছ?
ভালো আছি। কে বলছেন প্লিজ? –কাটকাট জবাব তিতলির। কণ্ঠে উষ্মা, ঝাঁঝ।
চিনতে পারছ না, না? দীর্ঘদিনের বিরহে অমন হয়! অচেনা লাগে সব!
শাট আপ! জাস্ট শাট আপ! বিরহ মানে? কীসের বিরহ? কে আপনি?
আরও পড়ুন: রাত্রির রোমান্স ॥ মনোজ বসু
দ্বিধায় পড়ে দীপন। সত্যিই চিনতে পারছে না না-কি! অদ্ভুত তো! থতমত খেয়ে বলে, ভুলে গেছ! আমি দীপন বলছিলাম!
হ্যাঁ, তো? আমি তো তেমন কেউ নই, যাকে এতবার ফোন দিয়ে নিজের পরিচয় জানাতে হবে! আপনিও তেমন কেউ নন, যার কণ্ঠ শুনেই আমাকে চিনে ফেলতে হবে, তাহলে? কেন ফোন করছেন এতবার?
হো হো হেসে ওঠে দীপন। অভিমান! তিতলির কণ্ঠ কাঁপে। রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে। কাণ্ডজ্ঞান ভুলে চিৎকার করে ওঠে সে, হাসবি না হারামি! একদম হাসবি না! কেন ফোন করেছিস আমাকে? কে কথা বলতে চেয়েছে তোর সাথে!
সারা শরীর থরথর কাঁপে তার। রাগে। মাথার ভেতরটা দপদপ করে ভীষণ। আর তখনই অবাক হয়ে সে লক্ষ করে তলপেটের এককোণে তিরতির একটা কাঁপন! তার মস্তিষ্কের তরঙ্গ পৌঁছে গেছে সেখানে থাকা সত্ত্বাটাতেও! মায়ের অনুভূতিতে তীব্রভাবে সাড়া দিচ্ছে সে-ও! জীবন সত্যিই রহস্যে ঘেরা! অপার বিস্ময় লেগে থাকে তার প্রতিটি পরতে!
দীপন হাসে। শান্ত হতে বলে তিতলিকে। কথা ব’লে যায় অনর্গল। শান্ত হয় তিতলি। চুপচাপ শোনে দীপনের বকরবকর। ভালোলাগায় ভেসে যায় শরীর, মন। প্রশান্তি আসে মনে। অভিমানে জলে ভ’রে আসে চোখ। আহ্! দীপনের এই কণ্ঠস্বরটুকু শোনার জন্য কী অধীর অপেক্ষা তার! কী অস্থির প্রতীক্ষায় কাটে তার প্রতিটি প্রহর! তবু উপেক্ষার তীব্র আগুনে তাকে পুড়িয়ে দেয় দীপন, অপমানের অসহ্য উত্তাপে ছাই করে দেয় তার মন।
কিপ্টুস! তুই একটা কিপ্টুস! –ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে তিতলি।
কিপ্টুস কেন? –কণ্ঠে স্নেহ ঢেলে বলে দীপন। তিতলিকে কখনও কখনও মনে হয় ছোট্ট রুমকী, কখনও মা, কখনও আবার প্রেমিকা! স্ত্রী! তা-ও মাঝে মাঝে মনে হয় বৈ-কি!
ভালোবাসিস না, তাই কিপ্টুস! কষ্ট দিস, তাই কিপ্টুস!
বাসি তো সোনা! অনেক ভালোবাসি!
তাহলে কেন এত কষ্ট দাও? কেন এমন করে এড়িয়ে যাও আমাকে?
তুমি এমন অবুঝ কেন? আমার সীমাবদ্ধতাগুলো কেন বুঝতে চেষ্টা কর না? আমার একটা সংসার আছে, অনেক দায়িত্ব সেখানে, চাকরি করি একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে, গাধার খাটুনি খাটতে হয়। মেজাজ সব সময় ঠিক রাখতে পারি না। তার মধ্যে তুমি ভুল বুঝে এমন উল্টাপাল্টা বকতে শুরু কর যে মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে যায় তখন।
বাজে বকবে না। তোমাকে কবে বলেছি যে দায়িত্বে অবহেলা করে আমাকে সময় দাও তুমি? বরং অবসর সময়ে একটু কথা ব’ল, সেটুকুই চেয়েছি। তাতেও তোমার আপত্তি। ইচ্ছেমতো অপমান কর আমাকে, যা ইচ্ছে তাই বলে যাও! কেন দীপন? কী করেছি আমি? মানুষ মনে হয় না আমাকে? অপমানবোধ কি থাকতে নেই আমার?
আচ্ছা বাবা, সরি। আর করব না। কান্না থামাও এখন। এই বোকা মেয়ে, কান্না থামাও বলছি! আদর! চুমু!
কে চেয়েছে তোমার আদর? কে চেয়েছে তোমার চুমু? চাই না এসব! মিথ্যুক! সরি বলছ, না? কষ্ট দেবে না আর, না? মিথ্যুক! প্রতিবারই এমন বল, তারপর আবার কষ্ট দাও! আস্ত একটা শয়তান তুমি!
তিতলিকে থামানো দায়। এতদিনের জমা থাকা রাগ, ক্ষোভ, অভিমান একে একে উজাড় করতে থাকে সে। ভালোবাসাও। চুপচাপ শোনে দীপন। হু, হ্যাঁ করে। বুকের ভেতরটা হালকা লাগে খুব। ভেতরে চেপে থাকা পাথরটা কখন সরে গেছে, টের পায় নি। শান্তি শান্তি লাগে। তিতলির সাথে কথা বললে এমন হয়। কেমন শান্তির একটা আঁচড় লেগে থাকে বুকের ভেতর। মুক্ত একটা হাওয়া ছুঁয়ে যায় মন। মানবমন এত রহস্যময়, এত বিচিত্র তার গতিপ্রকৃতি, ভেবে বিস্মিত হয় দীপন।
শান্ত হয় তিতলিও। রুমকী, তুলি, রতন সবার খবরা-খবর নেয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায় সবার কথা। সম্পর্কটা অদ্ভুত লাগে এখানেই। দীপনের পরিবার, এমনকি তুলিকে নিয়েও গভীর উদ্বেগ তিতলির, ভালোবাসাও। আবার নিজেই সে স্বীকার করে তুলিকে সে ঈর্ষা করে!
ঈর্ষা! কেন? –প্রশ্ন করে দীপন।
বা রে! ও যে আমার ভালোবাসায় ভাগ বসাচ্ছে নিয়মিত!
না-কি ওর ভালোবাসায় তুমি?
ইশ! মোটেই না! ও-ই ভাগ বসাচ্ছে আমার ভালোবাসায়। তুমি আমার! শুধু আমার! ওর কাছে তোমাকে গচ্ছিত রেখেছি, আমানত স্বরূপ! সময় হলে ঠিক সুদে-আসলে বুঝে নেব, মনে রেখ!
সময় কবে হবে?
এ জন্মে মনে হয় হবে না আর, পরজন্মে ঠিক বুঝে নেব, দেখ! কিন্তু তুমি শুধু আমার, এটা মনে রেখ!
তুমি এমন পাগল কেন? –হাসতে হাসতে বলে দীপন।
তোমার জন্য! –বলে নিজেও হাসে তিতলি। চোখ মুছে নেয় গোপনে। ওপাশে দীপন বোঝে না। সে কথা বলে যায়।
তোমাকে একটা কথা বলা হয় নি। -মৃদুকণ্ঠে বলে তিতলি।
কী? –কৌতূহলি কণ্ঠ দীপনের।
আমি মা হতে যাচ্ছি!
বাহ। ভালো তো! অভিনন্দন! –হড়বড় ব’লে ওঠে দীপন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখে ঈর্ষার আগুনে জ্বলে যাচ্ছে তার বুক! তীব্র অসূয়া পুড়িয়ে দিচ্ছে মন! এ কী অনাসৃষ্টি! কেন হচ্ছে এমন? ভেবে পায় না নিজেই। প্রকৃতি নারীকে তৃতীয় নয়ন দিয়েছে, বেচারা দীপন জানে না সে কথা। তার কণ্ঠের ওঠা-নামা, তার স্বরে লেগে থাকা কাঁপনের তারতম্যে তিতলি বুঝে নেয় তার ঈর্ষা, ধরে ফেলে তার অসূয়া। তীব্র এক সুখে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার! বাসে, দীপন ভালোবাসে তাকে! এরচে বেশি কিছুতো আর চায় নি সে দীপনের কাছে!
খুশি হয়েছ, না? –আলতো প্রশ্ন করে তিতলি।
হ্যাঁ, অবশ্যই! –কণ্ঠে অতিরিক্ত জোর ঢেলে বলে দীপন। সে জানে না, অনেক দূরে, ফোনের অন্যপান্তে থাকা এক নারীর চোখে দারুণ স্পষ্ট, স্বচ্ছ হয়ে ভেসে উঠছে তার প্রতিবিম্ব। তিতলি হাসে। মৃদু কণ্ঠে বলে, দীপন, একটা কথা বলি?
আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন। পরে কথা বলি, কেমন?
আরেকটু! প্লিজ!
আচ্ছা, বল।
আমি সারাক্ষণ তোমাকে ভাবি দীপন। আমি খুব করে চাই আমার মেয়েটা যেন তোমার মতো হয়।
থমকায় দীপন। চমকায়। তারপর অবাক গলায় বলে, আমার মতো হয় মানে?
মানে দেখতে যেন তোমার মতো হয়, তোমার মতো করে যেন সে ভাবতে শেখে!
কী পাগলের মতো বলছ! আমার মতো ভাবতে শেখে মানে কী? আমি কেমন করে ভাবি?
আরও পড়ুন
মাঝে-মাঝে জীবনদর্শনও বদলে যায় ॥ চাণক্য বাড়ৈ
অন্যরকম। আমার দেখা মানুষগুলোর মধ্যে তুমি অন্যরকম দীপন, আলাদা। তোমার ভাবনাগুলো আমাকে নাড়া দেয় ভীষণ। আমি চাই আমার মেয়েটা তোমার মতো হোক!
হো হো হাসে দীপন। বলে, কিন্তু তোমার মেয়ে আমার মতো দেখতে কী করে হবে! আর আমি তো দেখতে ভালোও নই তেমন! কালো, কুৎসিত! আর মেয়ে হবে তা-ই বা বুঝলে কী করে?
বাজে বকবে না। আমি জানি, মেয়েই হবে। তাছাড়া মেয়েটা তো তোমারই! তোমার মতো দেখতে হবে না কেন?
মাথা ঘুরে যায় দীপনের। কী বলে তিতলি! এমনকি তিতলির সাথে তার তো এখনো সরাসরি চোখের দেখাটাও হয়নি!
তোমার শরীর ঠিক আছে তো? গাঁজা কি খুব সস্তা যাচ্ছে আজকাল?
বাজে বকছ কেন দীপন? আমি জানি, ও তোমার মেয়ে! হ্যাঁ, আমার মেয়ের বায়োলজিকাল বাবা বাদল, কোনো সন্দেহই নেই তাতে। কিন্তু আমি জানি, ও তোমার। -তিতলির আশ্চর্য দৃঢ়, শান্ত কণ্ঠ দীপনের শরীরে কেমন একটা কাঁপন এনে দেয়। কেমন শিরশিরে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে যায় শরীরজুড়ে। সুখের চোরাস্রোত ভাসিয়ে নেয় তাকে। বুকের ভেতরটা অদ্ভুত এক বোধে টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। হঠাৎ খুব ইচ্ছে করে তিতলিকে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিতে। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার শান্ত, কোমল মুখ। তীব্র বিস্ময়ের ঘোর কেমন আচ্ছন্ন, বিবশ করে দিতে থাকে শরীর, মন।
চলবে…