[পর্ব-১৯ ]
অরুন্ধতীকে স্কুলে দিয়ে ফিরছিল তিতলি। সকালের হাওয়াটা মিষ্টি লাগছিল খুব। অরুন্ধতীর ক্লাস শুরু হয় সাতটা থেকে। তাকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে স্কুলগেটের মধ্যে ঢুকতে হয়। মাঝে মাঝে দেরি হয়ে যায় অবশ্য। তবু তিতলি চেষ্টা করে ঠিক সময়ে তাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে। এই বয়সটাতে সময়জ্ঞান তৈরি না হলে পরে সমস্যায় পড়তে হবে মেয়েটাকে। শিশু পরিবারের কঠোর নিয়মের মধ্যে বড় হয়েছে সে নিজে। আর কিছু না শিখলেও সময়ের মূল্য দেওয়াটা শিখেছে। শিখেছে নিজের কাজ নিজে করতে। স্বনির্ভরতার শিক্ষাটা সেখান থেকেই পাওয়া তার। জীবনে কোনো শিক্ষাই বৃথা যায় না। কিছুই অর্থহীন নয় জগতে। আবার সবই হয়তো অর্থহীন, তেমন করে ভাবলে। সরকারি শিশু পরিবারগুলো চলে নির্দিষ্ট বাঁধা ছকে। নিয়মমাফিক। অন্তত তাদের সময়ে চলতো। সব নিয়ম করা থাকত, রুটিন বাঁধা। ছোট ছোট দলে ভাগ করা থাকতো কাজ। এক এক সপ্তাহে একেক দলের ওপর একেক দায়িত্ব নির্ধারিত থাকতো। এক সপ্তাহে যে দল রান্না করতো, অন্য সপ্তাহে সে দল হয় বাসন মাজতো কিংবা পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালন করতো। নতুবা অন্য কোনো কাজ। প্রতিদিনের কাজ ভাগ করা থাকতো এভাবেই। দলপ্রধানের নির্দেশ মেনে চলতে হতো প্রতি পদে। অমান্য করলে শাস্তি ছিল অনিবার্য। ভোর ছয়টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হতো। নামাজ শেষে লেগে পড়তে হতো যার যার কাজে। কাজতো আসলে ছিল তাদেরই। নিজের কাজ নিজেকেই করতে হতো তাদের। রান্নাটাও। সবাই মিলে করত বলে খারাপ লাগতো না তেমন। তবু তারা যে অনাথ, সরকারি আশ্রয়ে বড় হচ্ছে, নির্মম সে সত্যটা প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিতো, তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা লোকগুলো। এমনকি, শিক্ষকরাও। পড়ার সময়টায় পান থেকে চুন খসলেও তাদের শুনতে হতো নানান কটুক্তি।
সরকার আসলে উলুবনে মুক্তো ছড়াচ্ছে, রাস্তার ছেলে-মেয়েদের পেছনে খামোখাই নষ্ট করছে কাড়ি কাড়ি টাকা, এমন কথা হামেশাই শুনতে হতো তাদের। কতজন এসব শুনতে শুনতে অতিষ্ট হয়ে পালিয়েও যেত। ধরে-বেঁধে আত্মীয়-স্বজনেরা আবার হয়তো ফেরত দিয়ে যেতো কাউকে কাউকে। কেউ কেউ ফিরত না আর। তরুণের মতো। সেই তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা ছিল তিতলির, প্রমাণ করবে সে, উলুবনে মুক্তো ছড়ায় নি সরকার, অন্তত তার ক্ষেত্রে। প্রমাণ খানিকটা হয়তো করতে পেরেছেও সে। সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তা সে এখন, বিসিএস ক্যাডার। সমাজের বেশ কিছু অনাথ আশ্রমে স্বেচ্ছানুদান দেয় সে গোপনে, প্রতিমাসে। সে চায় তার মতো আরও হাজার তিতলি আর তরুণ এ সমাজের মুখে মোক্ষম চপেটাঘাত কষে উঠে আসুক নিজের যোগ্যতায়। প্রতিষ্ঠিত হোক আপন অধিকারে।
সকালটায় বেশ ফাঁকা থাকে রাস্তা-ঘাট। হাঁটতে ভাল লাগে তিতলির। সপ্তাহখানেক হলো অফিসে যাচ্ছে না সে। ছুটি নিয়েছে ক দিনের। কক্সবাজার থেকে ফেরার বেশ কিছুদিন পর থেকে শরীরটা তেমন ভাল যাচ্ছে না। দূর্বল লাগছে খুব। গাইনি ডাক্তার বলেছে কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে। গর্ভথারণের প্রাথমিক অবস্থায় একটু সাবধান থাকা ভাল। অরুকে বাদলই স্কুলে আনা-নেওয়া করছে আজকাল। তিতলি পারতপক্ষে বাসায় থাকছে। আজ আর বাসায় ব’সে থাকতে ভাল লাগছিল না মোটেই। একরকম জোর করেই বের হয়েছে। অরুন্ধতীকে স্কুলগেটে ঢুকিয়ে দিয়ে সকালের এই নির্জনে পথ হাঁটতে বেশ লাগছে তার। অদ্ভুত এক ভাললাগা ছড়িয়ে পড়ছে মনে।
‘আমার রাত পোহালো, শারদ প্রাতে… আমার…’ আপন মনে গুনগুন করে তিতলি। সকালটা খুব ভালো লাগে, জীবনটাও। রাস্তার দু পাশের সবুজ গাছপালা দেখতে দেখতে পথ হাঁটে সে। একটা বাড়ির প্রাচীর ঘেঁষা শিউলি গাছ থেকে ফুটপাতে ঝরে পড়েছে অনেক শিউলি। জায়গাটা কেমন সাদা আর জাফরানি রঙে রাঙা হয়ে আছে। মুগ্ধ হয়ে দেখে। এগিয়ে গিয়ে কুড়িয়ে নেয় দু হাতে। আঁচলে তুলে নিয়ে আবার পথ হাঁটে। মুঠোভর্তি শিউলি নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নেয়। ভারি মিষ্টি লাগে সুবাসটা।
টুং করে একটা মেসেজ আসতেই দেখল বাদল। ছোট্ট একটা শব্দ। সরি। তিতলি লিখেছে। মেজাজ খারাপ করে মোবাইলটা পকেটে ঢুকাল বাদল। শালা!
সেন্টমার্টিনে যে হোটেলটাতে ছিল তারা, সেটা ছিল সমুদ্রের খুব কাছে। আবহাওয়া উত্তাল ছিল খুব। কেমন চাপা একটা আতঙ্ক ছিল সবার মধ্যে। শোঁ শোঁ হাওয়া বইছিল, সমুদ্রের উন্মত্ত গর্জন ভেসে আসছিল কানে। যেন কোনো ভীষণ যন্ত্রণায় সে ফুঁপিয়ে উঠছিল থেকে থেকেই। প্রবল ক্ষোভে আছড়ে পড়ছিল তটে। সৈকতে কিছুক্ষণ ছিল তারা। ঝাপটা হাওয়া এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল শরীর। তারপর সৈকত থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সবাইকে। ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল যার যার ঠিকানায়। হোটেলের বারান্দায় বসে তিতলি সমুদ্রের গর্জন শুনছিল চুপচাপ। গা ছমছম করছিল তার। অরুন্ধতীর জন্য কেমন দমবন্ধ একটা আতঙ্কও বাসা বেঁধেছিল মনে। কিন্তু, তিতলি অবাক হয়ে লক্ষ করেছিল, মনের মধ্যে তবু কেমন যেন অন্যরকম একটা রোমাঞ্চ জেগেছিল। কেমন গা শিউরানো একটা আনন্দ! অদ্ভুত লাগছিল। এমন আগে কখনো হয়নি। এমন বর্ণনাতীত অনুভূতির সাথে পরিচয় হয়নি তার কখনোই, যা একই সঙ্গে ভয় জাগায় আবার রোমাঞ্চও! তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে অরুকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল তিতলি। তারপর সারা শরীরে, মনে, ভয় আর রোমাঞ্চের ককটেলে এক অনুভূতি নিয়ে অনড় বসেছিল হোটেলের বারান্দায়। চোখ সাগরে, সৈকতে। ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটা তখনও ভিজিয়ে দিচ্ছিল শরীর। সমুদ্রের ভারী বালু বয়ে আনা নোনাজল চোখে-মুখে ঢুকে যাচ্ছিল ছুরির ফলার মতো। বিঁধে যাচ্ছিল শরীরে। তবু বসেছিল তিতলি। বসে থাকতেই ভালো লাগছিল তার। উঠে গিয়ে ঘরের বদ্ধ দরজার আড়াল নিতে একটুও ইচ্ছে করেনি তখন। ঘর মানেই শেকল। শেকল মানেই বন্দিত্ব। তারচে এই ভালো। এই বাইরের খোলা হাওয়া, নোনাজল। এই কান্নার সুখ। বাহির মানেই খোলা হাওয়া। বাহির মানেই মুক্তি। মুক্তি মানেই শেকল ভাঙার গান। সমুদ্রের প্রবল গর্জন, ফোঁপানির সুর, শেকল ভাঙার গান হয়ে, মুক্তির উন্মাতাল তান হয়ে আছড়ে পড়ছিল তিতলির কানে, প্রাণে। নির্বাক মূর্তির মতো সে বসেছিল একা। একসময় বাদল এলো। ডেকে নিল তাকে ঘরের মধ্যে। শেকলের আলিঙ্গনে। প্রবল গর্জনে সাগর যখন উন্মাতাল আছড়ে পড়ছে তটে, ভাসিয়ে নিচ্ছে সব পঙ্কিলতা, বাদল তখন আছড়ে পড়ল তিতলিতে। চোখ বন্ধ করে তিতলিও গ্রহণ করল তখন। বাদলকে নয়, দীপনকে। বাদল জানল, সে। তিতলি জানল, দীপন। দীপন জানল না কিছুই। বিশ্বসংসারও।
পথ হাঁটতে হাঁটতে দীপনকে মনে পড়ল তিতলির। শিউলি দীপনের খুব পছন্দের ফুল। দীপন শিউলি ভালবাসে। বলেছিল একদিন। কথাটা মনে পড়তেই আনমনে দাঁড়িয়ে পড়ল তিতলি। কী একটা ভাবল ঠোঁট কামড়ে। তারপর আঁচল থেকে ফুলগুলো ছড়িয়ে দিল আবার পথে। কান্না চাপল কষ্টে। না। দীপনকে ভাববে না সে। একদম না। তাকে যে কষ্ট দেয়, তাকে যে ভাবে না, তার কথা সে-ই বা ভাবতে যাবে কেন! কেন তার পছন্দের ফুল আঁচলে জড়িয়ে পথ হাঁটতে যাবে সে বোকার মতো! কক্ষনও নয়! –ভেবে হাঁটার গতি বাড়াল তিতলি। শিউলি যে শুধু দীপন নয়, তার নিজেরও অনেক পছন্দের ফুল সে কথা আর মনেই পড়ল না একবারও। দ্রুত হেঁটে বাসায় ফিরল তিতলি। থমথমে মুখ। রাগে লাল।
বাদল অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল। তিতলির ফেরা দেখে ফিরে তাকাল একবার। আড়চোখে মুখের দিকে নজর করল। তারপর বলল, কী হয়েছে?
কিছু হয় নি। কী হবে! –রুক্ষ উত্তর দিল তিতলি। থেমে গেল বাদল। তিতলি এমনই। কীসে যে রাগ করে সে, আনন্দ যে কীসে তার, বোঝা মুস্কিল। বাদল বহু আগে ছেড়ে দিয়েছে সে চেষ্টা। প্রত্যুত্তর না দিয়ে নিজের কাজে মন দিল অতঃপর। তৈরি হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসল গিয়ে। নাস্তা দিয়েছে ঝুমা। নীরবে খেতে শুরু করল। তিতলিও বসল এসে। চুপচাপ। রেগে আছে বোঝা যায়। বাদল চুপ। তিতলির জবাবের অপেক্ষায়।
আজ কি ফিরতে দেরী হবে তোমার?
বলতে পারছি না। কেন?
বলতে পারটা কী তুমি? সন্ধ্যায় এক জায়গায় যাওয়ার ছিল আমার।
কোথায়?
কী করবে শুনে? আসতে তো পারবে না বলছ!
ঝগড়া করছ কেন? পারব না কখন বললাম? বলেছি এখনও জানি না পারব কি-না। চেষ্টা করতে পারি।
আমি ঝগড়া করছি? চেষ্টা করতে হবে না তোমাকে, নিজের কাজ কর।
কোথায় যাবে সেটা তো বলবে? অদ্ভুত তো!
জাহান্নামে যাব। -বলে দুপদাপ পা ফেলে নিজের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করল তিতলি। বাদল ভ্রু কুঁচকে নাশতা চিবুতে থাকল আপন মনে।
গাড়িতে বসে মনটা কেমন খচখচ করছিল বাদলের। রাস্তায় জ্যাম। কখন অফিসে পৌঁছতে পারবে কে জানে! তারপর সকাল সকাল তিতলির এমন আচরণ! তিতলিটা মাঝে মাঝে এমন অদ্ভুত আচরণ কেন যে করে! অসহ্য লাগে তখন। কিন্তু ঝগড়া করা তার স্বভাব নয়। নীরব থাকে অধিকাংশ সময়। তিতলির তাতেও রাগ। চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে পারলে। পরে আবার নিজেই অনুতপ্ত হয়। চুপ হয়ে যায় নিজেই। টুং করে একটা মেসেজ আসতেই দেখল বাদল। ছোট্ট একটা শব্দ। সরি। তিতলি লিখেছে। মেজাজ খারাপ করে মোবাইলটা পকেটে ঢুকাল বাদল। শালা! –বিড়বিড় করল নিজেই।
চলবে…